#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২২)
নিহিতাকে রিকশায় উঠিয়ে মাহদীও পাশে বসল। তাকে স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ না দিয়েই মাহদী বলল,
” সেদিন তোমাকে গল্প শোনানোর সময় তন্বীর কথা বলেছিলাম মনে আছে? ”
নিহিতা চোখ উল্টে তাকাল মাহদীর মুখটায়। শীতল চোখ জোড়ায় দৃষ্টি স্থির রাখতে পারল না। সরিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। আপনার বন্ধু ছিল। আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল দেখে চড় মেরেছিলেন। ”
মাহদী বাঁকা হাসল। পর মুহূর্তে রাশভারী গলায় বলল,
” ভেবেছিলাম তোমার জন্য অতটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু আমি ভুল। তোমাকে পুরোটা বলা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আজ আমায় তোমার পাশে রিকশায় বসতে হতো না। ”
নিহিতার দৃষ্টি ফিরে এল মাহদীর মুখে। চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি, নিশ্বাসে আফসোসের ভারি ধাক্কা! নিহিতার কষ্ট হলো। মন খারাপের চাহনি ফেলে বলল,
” তন্বী আরও কিছু করেছিল? ”
মাহদী বোধ হয় নিহিতার প্রশ্নটা শুনল না কিংবা উপেক্ষা করে বলল,
” ঝামেলাটুকু সেখানেই শেষ হতে পারত, হলো না। আমার আর তন্বীর পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল। বাবা রেগে গেলেন খুব। আম্মুকে কথা শুনাতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা শেষ হচ্ছিল না। সময়ের সাথে সাথে বড় হচ্ছিল। এদিকে আমি ছিলাম ভীষণ আম্মু ভক্ত। বাবার এই রাগারাগিটা মেনে নিতে পারছিলাম না। বার বার মনে হচ্ছিল, আমার কোনো দোষ নেই। তন্বীর বলা পুরো বক্তব্যটাই যে মিথ্যে বাবাকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। একরাতে এটা নিয়ে বাবার সাথে আমার বেশ তর্ক চলছিল। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বেয়াদবের আখ্যা দিয়ে শরীরে আঘাত করতে লাগলেন। আমি বাঁধা দেইনি, প্রতিবাদ করিনি, চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। আমি চুপচাপ সহ্য করলেও আম্মু পারছিল না। তিনি ছুটে এলেন আমাকে বাঁচাতে। বাবা বার বার বলছিলেন সরে যেতে। আম্মু শুনছিল না। যতটা পারছিল আমাকে আড়াল করে নিচ্ছিল। বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে আম্মুর গালে একটা চড় মেরে বসলেন। মুহূর্তে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ি। আম্মুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে না পড়তে বাবার নাক সই ঘুষি মেরে বসি। ”
এতটুকু বলে মাহদী থামল। নিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার এক আঘাতে বাবাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছিল। আমি একবারের জন্যও হাসপাতালে যাইনি, বাড়িতেও না। আম্মু প্রায় কল করে কান্নাকাটি করতেন, তবুও আমাকে বাড়িতে নিতে পারেনি। তার কয়েক বছর পর আম্মু আর আব্বুকে একসাথে দেখেছিলাম তোমাদের বাড়িতে। আমি শুধু আম্মুকে ফোন করে বলেছিলাম বিয়ে করব। ব্যস! তারা ছেলের বউকে নিতে ছুটে এলেন। যদিও সেদিন বউমাকে নিতে পারেনি। তোমার বাবা বিয়েতে অমত করেছিল। এসব তো তুমি জানোই। যেটা জানো না সেটা বলি। নায়রাকে নিয়ে কিন্তু আমি বাবার বাড়িতে উঠিনি। আমার বাড়িতে উঠেছিলাম। আম্মু আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল অনেক। যখন দেখল কাজ হচ্ছে না তখন নায়রাকে বলতে শুরু করল। সে তো একটুতেই গলে গেল! শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার বায়না ধরা শুরু করল। তার যাতে মন খারাপ না হয় সেজন্য বলেছিলাম, আমি যাব না। তুমি ঘুরে এসো। নায়রা রাজি হলো। আমার আম্মু এসে তাকে নিয়ে গেল। সেখান থেকে ঘুরে এসেই সে শ্বশুরের সাফাই গায়তে শুরু করল। সুযোগ পেলেই আমাকে বলত, আমি ভুল করেছি। ক্ষমা চেয়ে সম্পর্ক ঠিক করা উচিত। তার কথায় আমার মন নরম হওয়ার বদলে আরও পাষাণ হয়ে গেল। কড়া করে বলে দিলাম, ঐ বাড়িতে যাওয়া নিষেধ। তার কণ্ঠে যেন আর কখনও বাবার কথা না শুনি। নায়রা আমার আদেশটা খুব হালকাভাবে নিল। জানত, আমার কাছে অনুমতি চাইলে পাবে না৷ তাই ঐ বাড়ি যাচ্ছে এমন একটা মেসেজ দিয়ে চলে যেত।
আমি কেন জানি নায়রাকে বকতে পারতাম না, রাগ দেখাতে পারতাম না। এদিকে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্বশুরের যত্ন-আত্তি করাটাও আমার সহ্য হচ্ছিল না। তবুও রাগটা চেপে যাচ্ছিলাম। নায়রার প্রেগন্যান্সির বয়স যখন সাতে পড়ল তখন খুব সুন্দর করে বলেছিলাম, ‘ তুমি শুধু শুধু এসব করছ। আমি কখনই তার কাছে ক্ষমা চাইব না, ঐ বাড়িতেও যাব না। এ অবস্থায় তোমাকে একা ছাড়তে পারব না। তাই আমার ফোনে কোনো মেসেজ দিয়ে লুকিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না। না মানে না। ‘ নায়রা আমার কথাকে পাত্তায় দিচ্ছিল না তাই শাসিয়ে বলেছিলাম ঐ বাড়িতে গেলে আমার বাসায় ঢুকতে দেব না। আমার এই শাসানির প্রভাব থাকল কয়েক দিন পর্যন্ত। একদিন হঠাৎ ফোনে মেসেজ আসে বাবা নাকি খুব অসুস্থ দেখতে যাচ্ছে। আসার সময় যেন তাকে নিয়ে আসি। আমার এত রাগ হলো যে নায়রাকে আনতে গেলাম না। সে আমার অপেক্ষা করতে করতে বাসায় আসল মাঝরাতে। রাগে তখন আমার শরীর কাঁপছে। কিছু একটা না করে ফেলি সে ভয়ে তাকে রুমে রেখে বাইরে চলে এলাম। ভেবেছিলাম রাতটা বাইরে কাটিয়ে তাকে শিক্ষা দেব।
কয়েক মিনিট পরেই নায়রার কল আসে আমার ফোনে। আমি রিসিভ করার বদলে ফোন বন্ধ করে পকেটে রেখে দেই। নিজের জেদ ধরে রাখতে বাকি রাতটুকু রাস্তায় কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম ভোরবেলা। কলিংবেল চাপলে দরজা খোলার বদলে ভেতর থেকে অনবরত দরজায় বাড়ি দেওয়ার শব্দে লক্ষ্য করলাম সিটকানি বাইরে থেকে লাগানো। রাগের মাথায় হয়তো আমিই লাগিয়েছিলাম। সিটকানি খুলে দরজা মেলতে দেখি মালিকা খালা একটা বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখের অবস্থা ভয়ংকর! আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলল, ‘ ম্যাডাম রে জলদি হাসপাতালে লইয়া যান। ‘ আমি ছুটে ভেতরে ঢুকতেই ভয়ে জমে গেলাম। নায়রা হাত-পা ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। মেঝেতে রক্তর মাখামাখি। ”
মাহদী থেমে প্রলম্বিত নিশ্বাস টানল। নিহিতা আতঙ্কিত চোখ দুটোতে চেয়ে বলল,
” সবাই জানে মনকে জন্ম দেওয়ার সময় নায়রা হাসপাতালে মারা গিয়েছে। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। মনকে জন্ম দেওয়ার সময় নায়রা মারা গিয়েছে সত্যি কিন্তু হাসপাতালে নয়, আমার বাসায়। আমি রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম বলেই তার প্রসব বেদনার সময় সামনে ছিলাম না। রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে বাইরে থেকে সিকটানি লাগিয়েছিলাম বলেই মালিকা খালা পাশে থেকেও তাকে হাসপাতালে নিতে পারেনি। নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক ভেবে ফোন বন্ধ করে ছিলাম বলেই তার শেষ নিশ্বাসটুকুর শব্দও পাইনি। ”
মাহদীর গলা ধরে এলো। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিজেকে সামলাতে অনেকটা সময় নিয়ে বলল,
” তুমি প্রথম দিন যখন নায়রার সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলে সেদিন আমি ভয় পেয়েছিলাম। সে ভয়েই তোমাদের বাড়ি ছাড়তে চেয়েছিলাম। অথচ আজ দেখ, নিঃসংকোচে সব সত্য বললাম। কেন জানো? কারণ তুমি তোমার পথ ভুলে গেছ। তোমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই সম্পূর্ণ সত্য বলা। এই সত্য থেকে আমার সম্পর্কে দুটো ধারণা পাবে। এক. আমার এক ভালোবাসা ব্যথা পেলে আমি অন্য ভালোবাসাকে ব্যথা দিতে দ্বিধাবোধ করি না। দুই. আমার রাগের কাছে ভালোবাসা হেরে যায়।
নিহিতা, আমি জানি মনকে তুমি ধাক্কা দিয়ে ফেলেছ। তবুও চুপ করেছিলাম। কারণ, নায়রাকে হারানোর পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি আর কখনও রাগ করব না। রাগে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিব না। হাসপাতাল থেকে এখানে চলে আসার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নিইনি। অনেক ভেবেচিন্তে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমি দূরে চলে আসলে তুমি নিজের ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু তুমি তো একের পর এক ভুল করেই চলেছ! ”
মাহদীর মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি রেখে বলল,
” আমি চাইলেই তোমার বাবা-মায়ের কাছে নালিশ করতে পারি, করছি না। কারণ, আমার জন্যই তারা এক মেয়ের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আমার জন্যই আরেক মেয়ের কাছ থেকে আঘাত পান সেটা আমি চাই না। যদিও এবার সমস্যাটা তুমি সৃষ্টি করছ আমি নই তবুও জামাই-শ্বশুরের সম্পর্ক নষ্ট হবেই। কিছু শাস্তি অন্যায় না করেও পায়। তুমি কি আমাকে সে শাস্তি দিতে চাচ্ছ? ”
এই এতক্ষণ পর নিহিতার চোখের পলক পড়ল। কিছু একটা বলার জন্য ঠোঁট কেঁপে উঠতে মাহদী বলল,
” আমার প্রতিজ্ঞা যদি ভেঙে যায় ভুলে যাব তুমি নায়রার বোন। ”
মাহদীর শাসানির মধ্যে রিকশা থেমে গেল। কাঠ স্বরে বলল,
” নামো। ”
নিহিতা হালকা কেঁপে উঠল। চারপাশে চোখ পড়তে বিস্ময় ধরা পড়ল অক্ষিকোটরে। বিড়বিড় করল, ‘ আমরা এখনও বাড়ির সামনেই? ‘
মাহদী আবার ধমকে উঠল,
” নামতে বলেছি। ”
নিহিতা নামল। গেটের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি ভয় পেয়েছি তাহলে ভুল। ”
মাহদী কপাল কুঁচকে নিলে নিহিতা মৃদু হেসে বলল,
” আপনাকে ভালোবেসে আমি মরতেও রাজি। ”
__________
নিহিতার পেছন পেছন আসমা রহমানও রুমের ভেতর ঢুকলেন। দরজা লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় গিয়েছিলি? ”
নিহিতা ভয়ে আমতা আমতা শুরু করলে আসমা রহমান নিকটে এসে দাঁড়ান। নিহিতাকে নামাজ ছেড়ে উঠে যেতে দেখে তিনি সালাম ফিরিয়ে বাইরে এসেছিলেন। বসার রুমে কাউকে না পেয়ে মূল দরজার দিকে এগিয়ে যান। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রাখতেই দেখেন মাহদী নিহিতাকে টেনে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। তারপর থেকে বসার রুমে বসে মেয়ে আসার অপেক্ষা করছিলেন।
নিহিতা ভেবেছিল মিথ্যে বলবে। পর মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে বলল,
” আমি মাহদীকে ভালোবাসি, আম্মু। ”
আসমা রহমান মেয়ের গালে সশব্দে চড় মেরে বললেন,
” মাহদী নয় ভাইয়া। ফের যদি এই নামটা উচ্চারণ করতে শুনেছি তাহলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব। আমরা তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি? ”
আসমা রহমান একটু চুপ থেকে বললেন,
” আমার অনেক দিন থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল, পাত্তা দিইনি। নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছিলাম এই বলে যে, আমার মেয়ে অমন হতেই পারে না। কিন্তু এখন? ছি! ”
আসমা রহমান নাক-মুখ কুঁচকে নিলেন।
________
মাহদী বাসায় ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিল এরশাদ রহমানের সাথে কথা বলবে। নিহিতাকে সামলানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে উদ্দেশ্যেই শ্বশুরকে খুঁজতে তার রুমে যায়। তিনি ফোনে কথা বলতে বলতে মাহদীকে ইশারায় বসতে বলেন। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই বুঝতে পারে ফোনের ওপাশে আহাদ কথা বলছে। তাদের ফোনালাপ দীর্ঘ হয়। কথা শেষ করে মাহদীর নিকট বসেই এরশাদ রহমান বললেন,
” অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি চেয়ে রেখ। ”
” কেন, বাবা? ”
” কেন আবার? নিহিতার বিয়ের দায়িত্ব নিতে। ”
এরশাদ রহমান একটু থেমে বললেন,
” আমার তো আর ছেলে নেই। মেয়ের জামাই আছে। এখন তুমিই আমার জামাই, তুমিই আমার ছেলে। ”
এরশাদ রহমানের স্নেহের বুলিতে মাহদী খুশি হওয়ার বদলে দুঃখ পেল। মন খারাপের কণ্ঠে বলল,
” এই দায়িত্ব আমি নিতে পারব না, বাবা। ”
” কেন? ”
মাহদী কী উত্তর দিবে খুঁজে না পেয়ে বলল,
” অফিস থেকে ছুটি দিবে না। ”
এরশাদ রহমান কিছু একটা বলতে চাইলেন তার আগেই আসমা রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
” ও যখন চাচ্ছে না তখন জোর করো না। আমরা দুজনেই সব সামলে নেব। ”
এরশাদ রহমান অপ্রসন্ন মুখ বানিয়ে বলল,
” এসব কী বলছ? নিহিতার বিয়েতে মাহদী আসবে না? ”
” আসবে না কেন? যখন ছুটি পাবে তখন আসবে। ”
স্বামীকে চুপ করিয়ে দিয়ে মাহদীর কাঁধে হাত রাখলেন আসমা রহমান। কোমল স্বরে বললেন,
” আমি জানি, তোমার আসতে অসুবিধা হবে। তবুও বলছি, তোমার সুবিধামতো এসো। তুমি আসলে নায়রার স্থানটা পূর্ণ থাকে। ”
চলবে