#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২১)
নিহিতা কথার মাঝেই নিজের গাল বাড়িয়ে বলল,
” চাইলে চড়ও মারতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। ”
মাহদী অগ্নি ঝরা দৃষ্টিতে তাকাল। দুটো তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ সংযত করছে। দৃষ্টি সরিয়ে বিদ্রুপ করে বলল,
” আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তুমি নায়রার বোন! ”
নিহিতা অপমান বোধ করল না। খুশি হয়েছে এমনভাবে তাকাল। মৃদু হেসে বলল,
” আমারও ভাবতে কষ্ট হয়, আপনি আপুর স্বামী। ”
একটু থেমে আবার বলল,
” কষ্টটা একটু বেশিই হয়। অসহ্য রকমের। আপনি কি বুঝতে পারেন? ”
মাহদী উত্তর দিল না। নিহিতার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। সে সময় মন দৌড়ে এলো কোথাও থেকে। নিহিতার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
” খালামনি, তুমি আবার আম্মু সেজেছ? ”
নিহিতা মনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। গাল টেনে মিষ্টি করে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” আমার আম্মু সাজতে ভালো লাগে। ”
মন একটু চুপ থেকে বলল,
” আমার যে খালামনি সাজে বেশি ভালো লাগে? ”
” কেন? ”
” খালামনি সাজলে বাবা খুশি হয় তাই। ”
নিহিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বাবা বলেছে? ”
” না। ”
” তাহলে জানলে কিভাবে? ”
মন সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসে বলল,
” তুমি যেদিন আম্মু সাজ সেদিন বাবার চোখ লাল হয়ে থাকে। আমি ভয়ে কাছে যাই না। একা একা ঘুমাই। ”
” তাই? ”
মন মাথা উপরনিচ নাড়ালে নিহিতা বলল,
” আর বাবা? তিনি ঘুমান না? ”
মন উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। আসমা রহমানের গলা পাওয়া গেল,
” নিহিতা, মাহদী এসেছে? ”
আসমা রহমানের হাতে বাদামী রঙের কাগজ মোড়ানো একটি প্যাকেট। নিহিতার হাতে প্যাকেটটি দিয়ে আগের প্রশ্নটি আবার করলেন,
” মাহদী এসে পড়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”
আসমা রহমান বোরকা খুলছিলেন। মেয়ের কাছ থেকে উত্তর পেয়েই গলার স্বর বদলে গেল,
” তাহলে তুই এখানে কী করছিস? ”
মায়ের প্রশ্নে নিহিতা চমকে তাকাল। চোখেমুখে ভয়! আসমা রহমান খানিকটা ধমকের সুরেই বললেন,
” রুমে যা, আমি না ডাকলে বাইরে বের হবি না। ”
নিহিতা মনকে ছেড়ে চুপচাপ পাশের রুমে ঢুকে গেল। আসমা রহমানের দৃষ্টিতে সন্দেহ। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার সচেতন মেয়েটা জামাকাপড় ছাড়াই এত দূর বেড়াতে চলে এসেছে! মেয়েদের যে প্রতি মাসের একটি বিশেষ দিন মনে রাখতে হয় সেটাও ভুলে গিয়েছে।
_________________
মন বালিশে শুয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। আসছে না দেখে উঠে পড়ে। বাবার কাছে এসে দাঁড়ালে মাহদী বলল,
” মন, দেখ তো আশেপাশে কোথাও তোর মায়ের কিছু আছে নাকি। ”
বাবার আদেশ পেয়েই মন পুরো রুমে তল্লাশি চালিয়ে একটা রাবার ব্যাণ্ড পেল। বিজয়ী কণ্ঠে বলল,
” এটা আছে। ”
মাহদী রাবার ব্যাণ্ড হাতে নিয়ে দেখল ধূলো লেগে আছে। পরনের টি-শার্টের বুকের কাছটায় ময়লা মুছে কাঠের বক্সটাতে রাখল। তালাবদ্ধ করে আলমারিতে রেখে বলল,
” ঘুমাবি চল, সকালে আমার সাথে উঠবি। ”
মন বিছানায় উঠতে উঠতে মনে করিয়ে দিল,
” আমি তো রোজ তোমার সাথেই উঠি, বাবা। ”
মাহদীর মনে পড়েছে এমন ভাব করে বলল,
” হ্যাঁ। কিন্তু অন্য সময় নিজ ইচ্ছেয় উঠিস, কাল আমার ইচ্ছেতে উঠবি। ”
মন মাথা নেড়ে বুঝাল সে উঠবে। তারপর বাবার বুকে ঘাপটি মেরে চোখ বন্ধ করে নিল।
পরের দিন সকালে মনের হাতে কিছু জিনিসপত্র দিয়ে বলল,
” আজ তোর যা যা দরকার হবে সব এখানে আছে। এগুল নানির কাছে রেখে আয়। ”
মন নানির রুমের দিকে দৌড় দিলে মাহদী নিজের রুমের দরজায় তালা দিল। চাবি নিয়ে শাশুড়ির রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে ডাকল,
” আম্মা? ”
আসমা রহমান বেরিয়ে আসলে তার হাতে চাবি দিয়ে বলল,
” ঐ রুমে আপনি ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দিবেন না। ”
______________
দুপুরে খেতে আসার পূর্বে নামাজ পড়ে নেয় মাহদী। মসজিদ থেকে বের হয়ে টুপি খোলা হয়নি। সেভাবেই বাসার কলিংবেল বাজিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল। দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকাতে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
” আব্বু! ”
ছেলের কণ্ঠে আব্বু ডাকটা যেন আতাউল করিমের হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল। এক সুখকর ব্যথা অনুভূত হতে চোখের কোণে জল জমতে শুরু করে। গড়িয়ে পড়ার আগেই মাহদীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
” বাবাদের কি মুখে বলতে হয় মাফ করে দিয়েছি? ”
মাহদী নীরব থাকলে আতাউল করিম পুনরায় বললেন,
” আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তোর পরিবর্তনটা কয়েক দিনের নাকি সারাজীবনের। সেজন্য সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ”
এবার মাহদী কথা বলল,
” কী মনে হচ্ছে? পরিবর্তনটা কয়েক দিনের নাকি সারাজীবনের? ”
আতাউল করিম মাহদীকে ছেড়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
” অনিশ্চিত উত্তরটা না-ই দিলাম। শুধু বলব, তোকে এই রূপে দেখলে বউমা খুশিতে কেঁদে ফেলত। ”
সামান্য বিরতি টেনে আবার বললেন,
” বউমার খুশির জল দেখতে পারলাম না বলে ভারি আফসোস হচ্ছে! ”
বাবার আফসোসের ফেলা ভারি নিশ্বাসটা মাহদীর বুকে ব্যথার ঝড় তুলে দিল। সেই ঝড়ে এলোমেলো হয়ে স্মৃতির ডায়রী খুলে বসল মাহদী।
তখন নায়রা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পেটের সাথে হাত, পা, মুখও অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। ইচ্ছে হলেই বসতে পারে না। খাবার-দাবারে খুব অনিহা। এমন অবস্থায়ও সে চেয়ারে বসে নিয়ম করে নামাজ পড়ে, কোরআন তেলাওয়াত করে। এমনি একদিন নামাজের পর তেলাওয়াত শেষ করে উঠে দেখে মাহদী তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে হালকা হেসে কোরআন শরীফে চুমু খেয়ে বলল,
” কী দেখছ? ”
মাহদী বসা থেকে উঠে এসে কোরআন শরীফ নিজের কাছে নিয়ে বলল,
” তোমার কষ্ট। ”
” কষ্ট? ”
” হ্যাঁ। সেজদা দেওয়ার সময় তুমি কাঁপছিলে। কোরআন পড়ার সময় ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছিলে। এত কষ্ট করা কি জরুরি? ”
নায়রা সাথে সাথে উত্তর দিল না। ধীর পায়ে খাটে বসতে চাইলে মাহদী এসে ধরল। পাশে বসে বলল,
” তোমার কষ্ট দেখলে আমার খারাপ লাগে, নায়রা। ”
নায়রা মাহদীর কাঁধে মাথা রাখে। স্বামীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কোমল স্বরে বলল,
” যার দয়ায় পৃথিবীতে নিশ্বাস নিচ্ছি তাকে ভালোবাসতে আবার কষ্ট কিসের? আমার তো আনন্দ হয় এই ভেবে যে, এখনও তার নাম জপতে পারছি! ”
নায়রার কথায় মাহদী খুশি হলো না, দুঃখও পেল না। নীরবে নায়রার তৃপ্তিভরা হাসিখানা দেখল। মুহূর্তকাল পর বলল,
” আমাকে নামাজ পড়ার জন্য জোর কর না কেন, নায়রা? এমনও তো হতে পারে, জোর করলে আমি..”
মাহদীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নায়রা উত্তর দিল,
” আমি চাই না তুমি আমাকে খুশি করতে নামাজ পড়ো। ”
মাহদী চুপ হয়ে গেলে নায়রা আবার বলল,
” আমি চাই তুমি আল্লাহকে খুশি করতে তাঁর পথে আসো। তবেই না জান্নাত উপহার পাবে। ”
নায়রার কথার গাম্ভীর্য অর্থটা মাহদী ধরতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমি যদি হঠাৎ বদলে যাই, তুমি আমাকে খুব ভালোবাসবে তাই না? ”
” না। ”
নায়রার উত্তরে মাহদী অবাক হলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” ভালোবাসবে না? ”
” অবশ্যই বাসব। এখন যেমন বাসি তেমন। ”
মাহদী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” তাহলে পালটে কী লাভ! ”
নায়রা মৃদু হাসল। মাহদীর গালে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” গুণ দেখে ভালোবাসা কম-বেশি হয় না, গুণ দেখে সম্মান আর শ্রদ্ধা কম-বেশি হয়। তুমি হঠাৎ পালটে গেলে তোমার প্রতি আমার সম্মান বাড়বে, শ্রদ্ধা বাড়বে। বাবার সামনে চোখ তুলে গর্ব নিয়ে বলতে পারব, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের প্রতিদান পেয়েছি। ”
নায়রার কথাগুলো মাহদীর ভেতরটা কাঁপিয়ে দিলেও স্বভাব পাল্টাতে পারেনি। এতে যেমন নায়রার মন খারাপ হয়েছিল তেমন মাহদীরও। একদিন মাহদী মনখারাপের সুরে বলেই ফেলল,
” আমি তোমার সম্মান বাড়াতে অক্ষম। ”
নায়রা হেসে বলেছিল,
” তোমার নামের অর্থ কী জানো? ”
” কী? ”
” সৃষ্টিকর্তা দ্বারা পথপ্রদর্শিত। তোমাকে সঠিক পথে আনার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। তুমি অধৈর্য্য হলেও আমি ধৈর্য্য হারাব না। তাঁর সময়মতো তোমাকে ঠিক পথে আনবেন। আমি তো সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি। ”
মাহদী দীর্ঘস্বাস ফেলে স্মৃতির ডায়রী বন্ধ করে আপনমনে বলল, ‘ সে সময় এসেছে, নায়রা। অথচ, তুমি নেই! ‘
__________________
নিহিতা এশারের নামাজ পড়তে বসল অস্থিরমনে। মাহদী প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটার সময় বাসায় আসলেও আজ আসেনি। ঘণ্টার কাঁটা সাতটা পার হতেই সে চিন্তায় পড়ে। চিন্তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো রাত আটটায়। এশারের আজান শুনতে শুনতে মাহদীর নাম্বারে কল করে, রিসিভ হয় না। বেশ কয়েকবার কল করার পরও যখন ধরল না তখন মেসেজ পাঠায়। উত্তর আসেনি। এদিকে মা ওযু করার জন্য তাড়া দিয়ে নিজেও ওযু করে নেয়। জায়নামাজ বিছিয়ে যখন নিয়ত বাঁধল তখন নিহিতার মনে পড়ল হয়তো মা কিছু জানে। এখন প্রশ্ন করা যাবে না দেখে নিজেও ওযু করে জায়নামাজে বসে। ঠিক করে নামাজ শেষ হলে জিজ্ঞেস করবে।
মাহদীর ভাবনায় নিহিতা খেয়ালই করল না সে নিয়ত ভুল করেছে। চার রাকাতের জায়গায় তিন রাকাত সুন্নত পড়েছে। সালাম ফেরাতে গিয়ে ঘাড়ের পাশে না তাকিয়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। জায়নামাজে মনোযোগ না রেখে কান খাড়া করে শুনছে কলিংবেল বাজছে নাকি। সুন্নত শেষে ফরযের এক রাকাতের সেজদা করতে হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। নিহিতা জায়নামাজ ফেলে শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে দিল। মাহদী নিহিতার দিকে না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকছিল। নিহিতা উদ্বিগ্নচিত্তে জিজ্ঞেস করল,
” এত দেরি করে এলেন? আমার চিন্তা হচ্ছিল। কল করেছিলাম, ধরেননি কেন? ”
নিহিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ডাইনিং পার হচ্ছিল মাহদী। কী মনে করে পাশের রুমে তাকাল। ফাঁকা জায়নামাজে দৃষ্টি পড়তে প্রশ্ন করে বসল,
” তুমি নামাজ ছেড়ে এসেছ? ”
নিহিতার চেতন ফিরল বুঝি। খোলা দরজার দিকে তাকাতে সেও জায়নামাজ দেখতে পেল। সভয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” হ্যাঁ। ”
মাহদী অকস্মাৎ নিহিতার ডান হাতের কনুই চেপে ধরল। দ্রুতকদমে বাইরে হেঁটে চললে নিহিতা জিজ্ঞেস করল,
” কী করছেন? হাত ছাড়ুন। আম্মু দেখতে পাবে। ”
মাহদী কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। মূল দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসল। খালি রিকশা ডেকে বলল,
” উঠো। ”
চলবে