#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৫)
নিহিতা তখন গোসল করেছে মাত্র। ভেজা চুল থেকে তোয়ালে খুলে হিজাবটা হাতে নিয়েছিল ওযু করবে বলে। মায়ের গলা পেয়ে সেভাবেই বাইরে ছুটল। বারান্দা ধরে সোজা হেঁটে গেলে লেবু গাছটা পড়ে। নিহিতা বারান্দা পেরোতে পারল না। তার আগেই চোখ দুটো আটকে গেল গেইটের দিকে।
শূভ্র রঙের পাঞ্জাবিখানায় মসৃণ মুখটা বড্ড কোমল, স্নিগ্ধ ও মসৃণ দেখাচ্ছে। দেহ কাঠামো থেকে যেন পবিত্র আলোর স্ফুরণ ঘটছে! ঠোঁটের মুচকি হাসিটা নিহিতার হৃদয়ে ছুরির ফলার মতো বিঁধতেই ধপাস শব্দ হলো! বারান্দা থেকে গড়িয়ে লেবু গাছের তলাতে গিয়ে থামল নিহিতার দেহখানি। ভয়ে, আতঙ্কে, টাল সামলাতে লেবুর একটি ঢাল চেপে ধরেছিল ডান হাতে। কাঁটা ফুটতেই আর্তনাদ করে উঠল!
ব্যথিত কণ্ঠস্বর সর্ব প্রথম পৌঁছাল মনের কানে। মাহদীর কোলে থেকেই চিৎকার করল,
” খালামনি! ”
তারপর তরতর করে নেমে আসল মাটিতে। বাবাকে ফেলে উঠোনের মধ্যখানে ছুটছে। মাহদী ছেলেকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসে। ছেলের কাছে দাঁড়াতে নিহিতার গোঙানি শব্দ পায়। ঘাড় ফিরে তাকাতে কিঞ্চিৎ ভয় পায়। নিহিতার কাছে পৌঁছায় ঝড়ের গতিতে! উঠানোর জন্য হাতে ধরতে গিয়েও থেমে যায়। বলল,
” কীভাবে পড়লে? সাবধানে উঠো! ”
নিহিতা মাটিতে হাতের ভর রেখে উঠতে গিয়ে ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে। চোখ ছেড়ে পানি গড়িয়ে পড়তে বলল,
” পারছি না! ”
ততক্ষণে মন নানিকে ডেকে এনেছে। তিনি মেয়ের হিজাব ঠিক করে দিয়ে চুল ঢাকলেন। পাজামা টেনে গোড়ালি ঢেকে বললেন,
” পড়লি কিভাবে? ”
নিহিতা উত্তর দিল না। হাতে বিঁধে থাকা কাঁটার দিকে তাকিয়ে থেকে ফুঁপিয়ে উঠল। মাহদী ব্যাপারটা খেয়াল করে হাতের কাঁটা টেনে তুলল দ্রুত। তাড়া দিয়ে বলল,
” ও একা উঠতে পারবে না। আপনি সাহায্য করুন। কাঁটাস্থানে ওষুধ দিতে হবে। ”
কথাটা বলতে বলতে গেটের দিকে তাকাল। এরশাদ রহমান নামাজ শেষে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলছিলেন। মাহদীরাও সাথে ছিল। মন পানি খেতে চাওয়াই শ্বশুরকে রেখে চলে আসতে হয়েছে। এখনও আসছেন না দেখে চিন্তায় পড়ে গেল সে।
আসমা রহমান সর্ব শক্তিতে মেয়েকে তুলতে সফল হলেন। মায়ের হাতের জোরে নিহিতা সোজা হয়ে দাঁড়ালেও হাঁটতে পারল না। একপা সামনে এগুতে পড়ে যাচ্ছিল মাহদী চট করে ধরে ফেলে। নিহিতা অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” মনে হয় পা-টা ভেঙে গেছে! ”
কথাটা মায়ের উদ্দেশ্যে বললেও উত্তর দিল মাহদী,
” আরে না! উপর থেকে পড়েছ তো তাই মচকে গেছে একটু। ”
মাহদীর কথায় খুব একটা আস্থা পেল না নিহিতা। মাহদী নিজেও অনাস্থায় ভুগছে। না দেখে কিভাবে বুঝল মচকে গেছে? সে কি ডাক্তার? মাহদী নিজের বলে ফেলা উক্তিতে লজ্জা পেল। মাঝখান থেকে আসমা রহমান বললেন,
” এখন ঘরে নিব কিভাবে? ”
আসমা রহমানকে ছুটে বাইরে বের হতে দেখে রিন্টুর মা পিছু নিয়েছিল। দূরে থেকে বলল,
” কোলোত নেন। খালাম্মা আপাক কোলোত নেন। ”
আসমা রহমান রেগে গেলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন,
” ও কি বাচ্চা? আমি কিভাবে কোলে নেব? না বুঝে কথা বলতে আসবি না। ”
রিন্টুর মাকে শাসিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর অসহায় স্বরে বললেন,
” তোর বাবাও বাসায় নেই। কখন আসবেন কে জানে! এভাবে আর কতক্ষণ থাকবি? ”
রিন্টুর মা আবারও কথা বললেন,
” খালুক লাগবে ক্যান? হামারে দুলাভাই আছে না? উনাক নিবা কন। ”
আসমা রহমান অগ্নি চোখে তাকালেন। কিছু বলতে পারলেন না। মন বাবার পাঞ্জাবি টেনে বলল,
” ও বাবা, খালামনিকে কোলে নেও। ব্যথা পাচ্ছে তো! ”
আসমা রহমান নাতির দিকে তাকালেন, মাহদীও। তারপর শাশুড়ি ও মেয়ে জামাইয়ের চোখাচোখি হলো। মাহদী ম্লান হাসল। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” কোলে নিতে হবে কেন? একপা মচকেছে তো কী হয়েছে? অন্য পা আছে না? ওটা দিয়ে যেতে পারবে। ”
নিহিতার ডানহাতটা নিজের কাঁধে রেখে বলল,
” ছোটবেলায় কুতকুত খেলনি? ”
নিহিতা উত্তর দেওয়ার পূর্বে বলল,
” না খেলে থাকলে আজ খেলবে। এসো আমি সাহায্য করছি। ”
নিহিতা কুতকুত খেলার চেষ্টা করল না। মাহদীর উপর সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। আসমা রহমান ও রিন্টুর মায়ের সহযোগিতায় খাটে শুয়ে পড়ল। মাহদী রুম থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। পড়ার টেবিলের সামনে একটি ফটোফ্রেমের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সামনে এগিয়ে যায়। একটা বাচ্চাকে আরেকটা বাচ্চা চুল বেঁধে দিচ্ছে। চিরুনি হাতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” এটা নায়রা? ”
আসমা রহমান মেয়ের থেকে চোখ সরিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালেন মাহদীর দিকে। ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। ”
” আপনাদের বাসায় ছবির ফ্রেম? অবাক লাগছে খুব! ”
” কেন? ”
” নায়রা আমাকে কখনও ছবি তুলতে দিত না। বাবা নাকি পছন্দ করেন না! ”
” হ্যাঁ। উনি এসব পছন্দ করেন না। ছবি তোলা ভালো নয়। খুব প্রয়োজন হলে তবেই তুলেন। ”
” তাহলে এটি? ”
আসমা রহমান মাহদীর দিকে ঘুরে বসল। বললেন,
” এটা ওর মামা তুলেছিল। বিদেশি মোবাইলের প্রথম ছবি। নিহিতার বাবা জানতেন না। পরে বাঁধিয়ে নিহিতাকে উপহার দিল তখন আর সরাতে পারেননি। কেউ ধরলেই কাঁদত খুব! ”
মাহদী ছোট্ট নায়রার মুখটায় হাতের তালুর নরম স্পর্শ রাখল। চোখ বন্ধ করতে দেখতে পেল নায়রা নিহিতার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ছবিটা আগের জায়গায় রেখে দিল। মাহদী নিহিতার রুম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসল। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
” মা, ঐ ছবিটা আমাকে দেওয়া যায় না? ”
আসমা রহমান চমকে তাকালেন। পর মুহূর্তে মেঘে ঢেকে গেল মুখখানা। সেভাবে নিহিতার দিকে তাকালেন। নিহিতা শোয়া অবস্থায় ছবিটার দিকে তাকাল। পর মুহূর্তে মাহদীর দিকে। লম্বা নিশ্বাস টেনে বলল,
” দিয়ে দেও, আম্মু। ”
” তোর কষ্ট হবে না? ”
” না। উনি আমার থেকেও বেশি যত্নে রাখবেন। ”
আসমা রহমান ছবিটা মাহদীর হাতে দিতে সে বুকে চেপে ধরল। কৃতজ্ঞ হাসি দিয়ে চলে গেল। নিহিতা তার চলে যাওয়ার পানে চেয়ে স্বগোতক্তি করল, ‘ ওখানটাই তো আমিও আছি। তার বুকের ওমটা কি আমাকেও ছুঁয়ে দিল? ‘
ভাবতেই নিহিতা ভেতরে ভেতরে উষ্ণ অনুভূতি টের পেল।
” তোমরা এখন যাও, আম্মু। আমার নামাজ বাকি আছে। ”
আসমা রহমান রিন্টুর মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে মনের দিকে তাকাল নিহিতা। বলল,
” ছোট আব্বু, তুমি একটু নানির কাছে যাও? আমার নামাজ শেষ হলে ডাকব। ”
” তোমার ব্যথা ভালো হয়ে গেছে, খালামনি? ”
” না। ”
” তাহলে নামাজ পড়বে কিভাবে? ”
নিহিতা মৃদু হাসল। বলল,
” বসে বসে। ”
” বসেও নামাজ পড়া যায়? ”
মনের কণ্ঠ থেকে বিস্ময় গলে পড়ল যেন! চোখেমুখে নিদারুন কৌতূহল।
” হ্যাঁ, যায়। কেউ দাঁড়াতে না পারলে সে বসে নামাজ পড়তে পারে। বসতে না পারলে শুয়েও পড়তে পারবে। আল্লাহ আমাদের সেই সুযোগ দিয়েছেন। ”
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ। ”
এর মধ্যে রিন্টুর মা ওযু করার পানি দিয়ে গেল। নিহিতা আদুরে স্বরে বলল,
” ছোট আব্বু, এবার নানির কাছে যাও। ”
” কিন্তু আমার যে বসে বসে নামাজ পড়া দেখতে ইচ্ছে করছে, খালামনি। একটু থাকি? ”
মনের অনুরোধে নিহিতা হেসে ফেলল। বুকে জড়িয়ে বলল,
” আচ্ছা। থাক। কিন্তু আর কখনও এমন অনুরোধ করবে না। ঠিক আছে? ”
মন দারুন খুশিতে রাজি হয়ে গেল।
________________
বিকেলে চায়ের বদলে কফি দেখে অবাক হলো মাহদী। কফির কাপের নিচে একটা কাগজ চাপা দেওয়া। তার শুরুতে ইংলিশে লেখা ‘ Thank you ‘ তারপর নিচে বাংলায় লেখা, ‘ আপনি যে চা খান এটা মাকে বলেননি কেন? আপুটাও কী মন ভোলা! আপনাকে নিয়ে এত গল্প করেছে অথচ এই ছোট্ট অভ্যাসের কথা বলেনি। আপুর হয়ে আমি দুঃখিত। এখন থেকে আর চা খেতে হবে না। ‘
মাহদী কাগজটা মুচড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মন বারান্দায় চেয়ার পেতে মোয়া খাচ্ছে। ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,
” তুমি খালামনিকে বলেছ আমি কফি খাই? ”
মন খানিকটা ছিটকে উঠল। পরক্ষণে ভেবে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” খালামনি জানতে চেয়েছে তাই। ”
” কী জানতে চেয়েছিল? ”
” সব তো মনে নেই, বাবা। ”
মাহদী শক্ত চাপে কাগজখানা চেপে ধরে বড় বাড়িটার দিকে তাকাল। চুপচাপ রুমে ফিরে এসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
” নানিকে বলে এসো, আমি তার হাতে চা-ই খাব। কফি যেন আর না বানায়। ”
” কফি তো নানি বানায়নি। ”
” তাহলে? ”
” খালামনি বানিয়েছে। ”
মাহদী কফিতে দ্বিতীয় চুমুক দিতে গিয়েও দিল না। ছেলের হাতে দিয়ে বলল,
” এটা তুমি খাও। শেষ হলে খালামনিকে বলে আসবে, আমি শুধু তোমার আম্মুর হাতের কফি খাই। ”
_____________
পরের দিন সকালে মনকে ঘুমে রেখে শ্বশুরের সাথে বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিল মাহদী। ফিরে আসতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পুরো রুম ঝকঝকে, তকতকে। সব কিছু বেশ পরিপাটিভাবে গুছানো। সাজাতে গিয়ে এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় সরানো হয়েছে। মেঝেটা ভিজে। বোধ হয় মাত্রই ধুয়েমুছে দিয়েছে কেউ। একটা অন্য রকম ঘ্রাণও পাচ্ছে। একটু খোঁজ করতেই উৎস মিলল। বিছানার কাছের ছোট টেবিলটার উপর স্তুপকারে বেলি ফুল রাখা। তা দিয়ে খেলছে মন। পাপড়ি দিয়ে বিছানা মাখামাখি! মাহদী জানতে চাইল,
” ফুল কোথায় পেলি? ”
মাহদী টেবিলটি দেখিয়ে বলল,
” এখানে। ”
মাহদী বুঝল মন জানে না। তার ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ রেখে গেছে হয়তো। মাহদী আর মাথা ঘামাল না। ঘামে ভেজা শার্ট পালটাতে গিয়ে দেখে তার জামাকাপড় নেই কোথাও। মনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,
” খালামনি নিয়ে গেছে। ”
” কেন? ”
” ধুয়ে দিবে তাই। তুমি নাকি ধোও না। গন্ধ করছিল! ”
মাহদী আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” আমি কাপড় ধুই না! আমার কাপড়ে গন্ধ! ”
চলবে
[কেউ বকবে না। পরের পর্বগুলো বড় করে দিব ইনশাআল্লাহ ]