#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৫
___________ো

৯.
বিশাল বড়োবাড়ি নামক বাড়িটা কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে লাগছে আঞ্জুমানের কাছে। এত বড়ো বাড়ি অথচ থাকার মতো নাকি কোনো মানুষই এপর্যন্ত তার চোখে ঠেকল না! এটা আদৌ কোনে বাড়ি কি না সন্দেহ হচ্ছে তার। পুরোনো যুগের জমিদারের বাড়ির মতো মনে হচ্ছে, একদম সুনশান-নিস্তব্ধ। এই বুঝি সময়-অসময়ে তাঁদের আত্মারা এসে ভর করবে আঞ্জুমানের ওপর। তখন আবার চিৎকার করেও কাছে পাবে না বদ লোকটাকে। লোকটা সেই যে তখন আঞ্জুমান এনে একপ্রকার রুমে রেখে গেল, তারপর মাঝ দিয়ে শুধু একবার শাড়ি এনে হাতে ধরিয়ে মুখ ফুটে দুটো শব্দ উচ্চারণ করল,

‘শাড়িটা পাল্টে নে।’

ব্যস! তারপর থেকেই উধাও। তখন যা কাঁপছিল না সে একদম মৃগী রোগীর মতো। তবে সেটা ঠান্ডায় নাকি ভয়ে বলা মুশকিল। ভয়ের দিকের জোড়’ই বেশি হবে হয়তো। সে বর্তমানে এখন নিজেকে রাজপ্রাসাদের কারাগারে বন্দিনীর মতো মনে করছে। জানালায় তাকিয়ে বৃষ্টির প্রকোপ পরখ করে দেখে নিলো। বৃষ্টির কোনো থামাথামি নেই, ভাবল; এই বৃষ্টি কাল পর্যন্তও থামে নাকি সন্দেহ আছে, তাহলে বাড়ি যাবে কীভাবে? ভাই-ও তো মনে হয় নিতে আসতে পারবে না এরমধ্যে। ভাবনার অন্তরাতে এসে বিঘ্ন ঘটায় কাজের লোক করিম মিয়া।

‘ছোটো সাহেব আপনারে ডাকে।’

রিমা শিক্ষিত মেয়ে বিধায় মাঝেমধ্যে এখানে আসা-যাওয়ায় করিম মিয়ার সাথেও কথাবার্তা হয়। সেই সুবাদে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলার করিম মিয়াকে শাসিয়ে রিম তাকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার জন্য আদেশ দেয়। নাহলে চাকরি যাবে। সেই ভয়ে করিম মিয়াও যথেষ্ট চেষ্টা করে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করতে, সেখানে অবশ্য আলী’ই তাকে সাহায্য করেছে। এদিকে আলীকে পাছে সবাই বড়োলোক বউয়ের গোলাম বলে। সেদিকে আলীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তার ধারণা সে বউয়ের নয়, টাকার গোলাম। আসলে পৃথিবীটা’ই টাকার গোলাম সেখানে বসবাসরত মানুষ তো আর সেটার বিপক্ষে যাবে না। পারতপক্ষে তারা আরো বেশি মুখিয়ে থাকে অর্থকড়ি মুঠোভরতি করতে। এ-যেন যজ্ঞের ধন। আজকাল রাস্তাঘাটের ভিক্ষুক’দেরও পাঁচ-দশ টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায় না। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে, কখন থালায় বড়ো লোক’দের পকেট খসিয়ে শ’পাঁচেকের নোট পড়বে। যাইহোক ছোটো সাহেব বলতে কাকে সম্মোধন করে গেল করিম মিয়া আঞ্জুমানের সেটা বোধগম্য হলো না। যেই ডাকুক আপাতত নিচে যাওয়া উচিত সাহেব বলেছে যেহেতু তাহলে বাড়ির একজন কর্তা গোছের লোক তো হবেই। সেই ভাবনা থেকেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো আঞ্জুমান। ডুপ্লেক্সের বাড়িটাতে নিচের গেট বরাবর বড়ো হলরুম, কাজের লোকদের থাকার জন্য দুয়েকটা রুম ছাড়া নিচে আর কোনো রুম নেই। বাড়ির লোকদের থাকার আর মেহমান’দের থাকার রুম সব ওপরেই। সেখানের’ই এক গেস্টরুমে আঞ্জুমানকে নিয়ে গিয়েছিল আলী। হলরুমের মাঝে সোফাসেট আর রান্নাঘর ডানদিকে সেখানে অবস্থান ডাইনিং টেবিলের। বামদিক দিয়ে এসেছে ওপর তলার সিঁড়ি। নিচে নেমে আঞ্জুমান ডানদিকে তাকালে রান্নাঘরের সামনের ডাইনিং-এ পায় আলীকে। আলী তার আসার আভাস পায়নি। তা দেখে দুরুদুরু কাঁপন্ত বুক নিয়ে আলতো পায়ে এগিয়ে যায় আঞ্জুমান সেদিকে। তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের সজাগ মানুষ আলী আঞ্জুমানের এগিয়ে আসার আভাস পায়। যার ফলে মুখ উঁচিয়ে তার দিকে দৃষ্টি ফেরায় যা কি না এতক্ষণ খাবারের দিকে ছিল। এদিকে করিম মিয়া রান্নাঘর থেকে সকল খাবার ডাইনিং-এ সাজিয়ে রাখা শেষ করে আলীর উদ্দেশ্যে বলল,

‘সাহেব, যাই?’

চোখের ইশারায় সায় দিলে করিম মিয়া কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কিছু পল থম মেরে দাঁড়িয়ে চলে যায় গেট দিয়ে। তার চলে যাওয়ার পর নিস্তব্ধতার ঝংকার নেমে আসে চারিপাশে। যেন একটা সুঁই পড়লেও বাজ পড়ার শব্দ তুলবে। কিন্তু নাহ, সুচের চেয়েও ধারালো ও শানিত গলায় আলী নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে বলল,

‘বস এখানে।’

সম্মুখে আলীর বরাবর বসার চেয়ার ইশারা করে আঞ্জুমানকে বসতে বলল। আঞ্জুমান তাও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেটা দেখে মেজাজ চওড়া হয়ে গেল আলীর। চাপা ধমকে বলল,

‘বসতে বলছি না। কথা কানে যায় না?’

যদি-ও ধমকটা হালকা পাতলা ছিল তবে সেটা নিস্পন্দতার ছন্দের তাল ছিঁড়ে গমগমে শোনাল। এমনিই আতঙ্কে জর্জরিত ছিল আঞ্জুমান এখন আলীর তীক্ষ্ণ ফলার উচ্চ শব্দে দেহে কাঁপন তুলল যেন। ভয়ে কাঁপতে থাকা আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়ে আলী নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা, শান্ত করার চেষ্টায় নামল সফলও হলো। শান্ত, কোমল স্বর নিয়ে আঞ্জুমানকে শোধাল,

‘বসছিস না কেন? ভয় কীসের? বাঘ-ভাল্লুকের আস্তানায় তো রেখে আসিনি তোকে। শুধু খাওয়ার জন্যই তো বসতে বলছি।’

শেষের কৌতুকপূর্ণ কথায় আঁড়চোখে তাকাল অবনত থাকা আঞ্জুমান। ভেবে দেখল, আপাতত বসেই পড়ি এত সুন্দর সুন্দর খাবার সম্মুখে রাখা। না খেলে আবার সৃষ্টিকর্তা নারাজ হবেন। আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনার মাঝেই আলগোছে চেয়ার টেনে বসে পড়ল আঞ্জুমান। তাকে বসতে দেখে আলতো হাসল আলী। সম্মুখে এগিয়ে দিলো খাবারের প্লেট। অতঃপর আঞ্জুমানকে কোনো প্রকার অস্বস্তিতে না ফেলে নিজের খাওয়ার দিকে মনযোগ দিলো। আলীকে চুপচাপ, নিরব হয়ে নিবিষ্ট মনে খাবার খেতে দেখে আঞ্জুমানের মনে সাহসের কিছুটা সঞ্চার হলো৷ সে হাত রাখল প্লেটে অতঃপর খাবার শুরু করল। খাবার মাঝে একসময় নিশ্চুপ অবস্থার পরিবর্তন হলো আলীর কথায়,

‘মরতে গিয়েছিলি কেন?’

তিন শব্দের কথায় কী ছিল কে জানে কিন্তু আঞ্জুমান কয়েক পল খাওয়া থামিয়ে বলে উঠল,

‘বাড়িত যাইতাম।’

এতক্ষণ যাবৎ আঞ্জুমানের বিমূঢ়তা কেটে বলা এই মাত্র দু’শব্দ আলীর কর্ণকুহরে মিষ্টি, সুমধুর শোনাল। আঞ্জুমানের নত হওয়া মুখশশীর পানে চেয়ে রইল সময় খানেক ধরে অতঃপর আঞ্জুমানের কথার বিরোধিতা করে বলল,

‘এখন তো রাত, তাও আবার উত্তাল হাওয়ার বেগে বৃষ্টি চলছে। যাওয়া সম্ভব না। আপাতত খেয়ে নে, পরে শক্তি পাবি সামাল দেওয়ার।’

রহস্যময় কথার পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্জুমান কেবল ‘খেয়ে নে’ কথাটাই মনে ধরে খাওয়া শুরু করল। বোকা, মাথামোটা মেয়েটার মাথায় শেষোক্ত কথার অর্থ ধরল না।

১০.
সকালের উজ্জীবিত সূর্যের তাপ সহনশীলতার মতো। তবে মানুষ কথার তাপের প্রখরতা বৃদ্ধিতে কুণ্ঠিতবোধ করে না। ঝাঁঝ মেশানো কটুক্তি করা যেন তাদের জন্মগত অধিকার, যা ইতিপূর্বে দেশ স্বাধীন করে স্বাধীন নাগরিকের অধিকারের চেয়েও বড়ো মনে হয়। এসবকিছু সেসব মূর্খ জনগণের কাছে গণ্য। যেমন এখন আলীর বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামীণ মানুষজন। খবরটা তাদের কানে পৌঁছানো মাত্রই শুরু হয় ছোটো থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ’দের হট্টগোল। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমে বিভোর থাকা আলীর কর্ণকুহর সেসব হট্টগোলের চ্যাঁচানো শুনেও নিবৃত্ত মনে বিনাশিত অবয়ব ঘুমে বিভোর হওয়ার প্রস্তুতি নেই।

‘লাজ-লইজ্জা বইলাও একখান কথা আছে নাকি।’

‘বলি হারি বাপু। চেয়ারম্যানের না হয় চরিত্রে দোষ আছে তা তো আমরা জানি’ই। তাই বইলা মাইয়াডারও কি মতিভ্রম হইল যে নিজেও….ছি ছি! আমার বলতেও লজ্জা লাগতাছে।’

গ্রামের লোকজন মুখ উঁচিয়ে থুতু ছিটাচ্ছে আর কথাগুলো বলছে।

‘মাইন-ইজ্জতের রইল না আরকিছু। এত বড়ো বাড়ি খালি দেইখা সেই সুযোগে জোয়ান দু’খান মাইয়া-পোলা কীসব নষ্টামি শুরু করছে, আমাদের গ্রাম পুরা নষ্ট কইরা ফালাইব। যাও কেউ গিয়া চেয়ারম্যান রে ডাক দিয়া লইয়াহো।’

মুরুব্বি গোছের একজন লোক কথাগুলো বলে আলীকে ডাকার জন্য লোক পাঠায়। এসবের মাঝে আঞ্জুমানের করুণ অবস্থা দেখার মতো। মানুষের মৃত্যু হলে যেমন দেখায়, একদম রক্তশূণ্য, স্থির, শান্ত। তেমনই দেখাচ্ছে তাকে। মনে হয় দেহ আছে শুধু আত্মা ছেড়ে দিয়েছে। সে অনুভূতি শূন্য, নিথর ফ্লোরে পড়ে থাকা লাশের মতো। গ্রামবাসী বিচার বসিয়েছে আলীর বাড়ির সামনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকা আঙিনায়। গ্রামের মাস্টার, সাথে মসজিদের ইমাম আরো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের আবির্ভাবও রয়েছে।

‘শুনো আলী মিয়া, তোমার ঘরে এই মাইয়ারে পাওয়া গেছে। বাড়িতে কেউ আছিল না। তুমি আর মাইয়া দু’জনই জোয়ান পোলাপাইন। তাও আবার রাইতে থাকছে মাইয়াটায়। সেইখানে তৃতীয় ব্যক্তি শয়তানের প্ররোচনায় যা কিছু হওয়ার তো হইয়া গেছে, ঠিক না?’

গ্রামেরই মুরুব্বি বিচারে বসে উপরোক্ত কথাগুলো বললেন। সাথে সাথে ছোটো-বড়ো সকলেই ‘ঠিক, ঠিক’ করে আওয়াজ দিয়ে ওঠে। সকলেই নিজ নিজ তৈরি মতামত ব্যক্ত করল অথচ আঞ্জুমানের অভিমত তো দূরে থাক মেয়েটাকে দেখার জন্যও কেউ নেই। না তার পরিবার আর না এই সমাজের লোক। পরিবারের কথা বলতে গেলে, ‘নিজের জান নিজে বাঁচা’ ধরনের অবস্থা। আঞ্জুমানের এই বিধ্বস্ত ঘটনা নানা বাড়ি কর্ণগোচর হয়ে দাদা বাড়িও পৌঁছে যায়। তা সত্ত্বেও কেউ আঞ্জুমানকে বাঁচার তাগিদ দিতে এগিয়ে আসে না। উলটো নিজেদের সম্মান বাঁচানো মূখ্য হিসেবে গণ্য করে বলে,

‘যা ইচ্ছা করো গা। অপয়া মাইয়া যত নষ্টামির মইদ্দে থাকে। ও’র সাথে আমাগোর কোনো সম্পর্ক নাই। এ-মুখো যে আর না হয় কইয়া দিও।’

আরো নানা ধরনের কটুক্তি করে আঞ্জুমানের নামে যা গ্রামবাসীকে আরো বিষিয়ে তোলে। সেসব শুনেই আঞ্জুমানকে সকলে শাস্তি হিসেবে মাথার চুল কামিয়ে, মুখে কালি মেখে সারা গ্রাম ঘুরানোর প্রস্তাব রাখে। অথচ বিত্তশালী, ক্ষমতাবান আলীর শাস্তি কোথায়? এখানেও নারীর শাস্তি মূখ্য! কারণ কী? তারা অসহায়, নিপীড়িত, দূর্বল এবং তাদের জন্মই পুরুষদের পদতলে পিষ্ট হওয়ার জন্য হয়েছে বলে? কেন, কেন তারা কি আর সকলের মতো মানুষ নয়? তাদের দেহের গঠন, পুরুষদের বিপরীত লিঙ্গ হওয়াই সম্ভবত নারী জীবনের শাস্তি ও অভিশাপ স্বরূপ!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here