#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৪
___________

৭.
নানাবাড়িতে কেমন চুপচাপ সিঁটিয়ে থাকে আঞ্জুমান। না কারো সাথে কথা বলে আর না রুম থেকে বেশি একটা বের হয়। মামাতো ভাই-বোন’দের সাথেও ততোটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তার। কারণ নানা বাড়ির আর সকলের মতো ছোট-বড়ো মামাতো ভাই-বোনরা-ও তাকে অপয়া, অলক্ষুণে মেয়ে বলে ভাবে। যে কি না জন্মের সময় তার মা’কে খেয়ে ফেলেছে বলে তাদের ধারণা। সকলের এসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন মৌলবাদী ধর্ম আঞ্জুমানের কিশোরী মনে খুব গভীরভাবে ছাপ ফেলছে। যার কারণে আঞ্জুমান নিজের দুরন্তপনা, হাসিখুশি, উচ্ছলতা নিয়ে ঘুরে ফিরে আনন্দঘন বেলাগুলো হারিয়ে ফেলছে। নিজের মধ্যে সেসব আঁটকে রেখে কেবল সখি লিপির সাথেই খানিকটা উচ্ছাসতা পেশ করে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে, তার লেখাপড়া বন্ধের মাধ্যমে। লেখাপড়ার গুরুত্বটা বেচারির জন্য সিলগালা করে বন্ধ করে দিয়েছে। দাদা ও নানা বাড়ির মধ্যে কোনো রকম সুতোর মতো ছিঁড়ে যাওয়া শুধু একটুখানি ঝুলন্ত সম্পর্ক। সেই সুবাদেই আসা-যাওয়া আঞ্জুমানের তাও বেশিদিন থাকা যাবে না বলে আজ বিকেলে ছোটে ভাই এসে তাকে নিয়ে যাবে। সখি লিপির সাথে আবার কবে না কবে দেখা হয় জানা নেই তার। তাই একটু বাইরে বের হওয়ার চিন্তাভাবনা করছে আঞ্জুমান। যেই ভাবা সেই কাজ লিপির বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।

মন্দ ভাগ্য একেই বলে বোধহয়। লিপিকে পাওয়া গেল না। লিমন জানালো, লিপি কাজে গেছে। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। বেরিয়ে এলো লিপিদের বাড়ি থেকে। মন খারাপ নিয়ে একটু নিজের মতো করে একা সময় কাটাতে মন চাচ্ছে আঞ্জুমানের। হাঁটতে হাঁটতে সেদিনের পুকুর ঘাটে এসে সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে। কেন জানি আজ একটু কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মন কেমন কেমন অনুভূতি ধারণ করেছে, জানা নেই। হয়তো মনের কোণে জমে থাকা কষ্টরা উপচে পড়ে বেরিয়ে আসার পায়তারা করছে। আজ কেন এত চাওয়ার যোগ হলো জানা নেই কিন্তু জানা আছে কান্নাদের উগড়ে ফেলার ইচ্ছেটা। তার মন বলছে,

‘আজ যদি মা বেঁচে থাকত, তাহলে বোধহয় জীবনটা অন্যরকমই হতো। এভাবে হেলায়ফেলায় দিন কাটাতে হতো না আর না সকলের অভিশাপ শুনতে শুনতে একবুক কষ্ট বাসা বাঁধত মন কোণে।’

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শব্দ তুলে ভিজিয়ে দিচ্ছে আঞ্জুমানের ক্রদনরত মুখশশী। এ যেন বৃষ্টির আড়াল করার ইচ্ছে আঞ্জুমানের কান্নাকে আর ধুয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার বেদনাবিধুর মনকে। বিমূঢ় চিত্তে বেশ কিছুক্ষণ সময় দমকা বৃষ্টির স্রোতে নিজের গা ভাসাল সে। অতঃপর ঝপাৎ শব্দ তুলে পুকুরের পানিতে নেমে পড়ল। অনেক সময় ধরে তাকে পানির ওপর ভাসতে না দেখে এবার যেন উন্মাদনা কাজ শুরু করল আলীর মনে। বদ্ধপরিকর হয়ে আঞ্জুমানের আত্মহনন করার পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিয়ে সে-ও ঝপাৎ শব্দ তুলে পানিতে নেমে পড়ল। সাঁতরে সাঁতরে ডুবে থাকা আঞ্জুমানকে টেনে ডাঙায় তুলল। সাঁতার জানা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা আঞ্জুমানের নাকেমুখে পানির প্রবেশ বেশ একটা ছিল না উপরন্তু আলী-ও দ্রুতই উঠিয়ে এনেছে। তাই পেটে অল্প-অল্প চাপ প্রয়োগ করতেই কাশি ওঠে সল্প পরিমাণ পানি মুখ নিসৃত হয়ে হুঁশ ফিরে আঞ্জুমানের। তাকে সোজা করে বসিয়েই গালে চপেটাঘাত করে আলী। গালে হাত রেখে নিভুনিভু হতভম্ব হওয়া মুখশশীতে কালো নির্লিপ্ত স্তব্ধতা গ্রাস করে আঞ্জুমানের। সাথে কানে-মাথায় ভোঁভোঁ শব্দ করে থাপ্পড় খাওয়ার কারণ জানার পোকা কিলবিল করতে থাকে। এরমধ্যে ভেতরে ভেতরে বাঁধভাঙা কান্নারা নোনাজলের ফোয়ারা ছুটিয়ে আসতে চায় অক্ষিপট থেকে। কোনোমতে নাক ফুলিয়ে আঁটকে তাদের সংবরণ করছে আঞ্জুমান। আলী এতক্ষণ যাবৎ তার রাগ মিশ্রিত কান্নার আনুষ্ঠানিকতার তোড়জোড় উপভোগ করছিল বৃষ্টির উদ্যমতার সাথে। আঞ্জুমান বয়সের অনুকূলে থাকলেও আলীর অনুভূতিরা তখন তুঙ্গভদ্র। সে আঞ্জুমানের এমন রূপে অভিভূত, আবিষ্ট। অচৈতন্য মোহগ্রস্তের মতো পাজাকোলে তুলে নেয় আঞ্জুমানকে। হতচকিত আঞ্জুমান বৃষ্টির তোড়ে ঠিকমতো চোখ মেলেও তাকাতে পারছে না, তাহলে সে দেখতে পেত তার জীবনের ধেয়ে আসা সর্বগ্রাসী সর্বনাশ’কে।

৮.
রিমা বাবার বাড়ি এসেছে দু’দিন হলো। সেই কখন থেকে আলীর ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছে অথচ বরাবরই ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে। যদি-ও জানে বৃষ্টির কারণে হচ্ছে এমন। তবুও মন টানছে না, কোনো অশুভ সংকেত তাকে ভীত করে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে, যার অর্থবোধক তাৎপর্য সে বের করতে পারছে না। তাই সেই কখন থেকে ফোন বন্ধ জানা সত্ত্বেও কলের ওপর কল দিয়েই যাচ্ছে, এই বুঝি ফোনটা তুলে আলী। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু’ই বলে যাচ্ছে ফোনের অপাশে থাকা সুমধুর কণ্ঠী নারী। রিমাকে ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করে রুমের এ-মাথা ও-মাথা করতে দেখে এতক্ষণ যাবৎ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটো ভাবি সামিয়া। এগিয়ে এসে রিমার পিছনে দাঁড়িয়ে সে বলল,

‘কী গো ননদিনী এমন অস্থির হয়ে আছ কেন?’

ছোটো ভাবির সাথে গলায় গলায় ভাব রিমার। বাকি দুই ভাবির সাথেও ভালো সম্পর্ক, তাঁরা-ও রিমাকে যথেষ্ট আদরযত্ন করেন; তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুপূর্ণ সম্পর্ক হলে খোলামেলা যেসব আলাপ করার মতো সেসব কেবল এই ছোটো ভাবি সামিয়ার সাথেই হয়। এতে অবশ্য যথেষ্ট কারণও রয়েছে। হয়তো সামিয়া তার সমবয়সী বলে কিংবা তার স্বামী বিদেশ থাকে বলে। যাইহোক আপাতত নিজের এই অস্থিরতা বলার জন্য কাউকে পেয়ে যাওয়ায় মনটা অর্ধেক চাপমুক্ত হয়ে হালকা অনুভব হলো।

‘ভাবি দেখো না ও আমার ফোনটা ধরছে না।’

রিমার কম্পনরত গলায় কান্নার ঝোঁক শুনতে পেল সামিয়া। এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বিছানায় বসিয়ে রিমাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল,

‘তো অস্থির হচ্ছো কেন? আবার দেও।’

তবুও সেই অস্থিরচিত্তে রিমা ফের তার ভাবিকে শোধায়,

‘ফোন তো বন্ধ বলছে।’

‘দেখ মেয়ের কাণ্ড। এজন্যই তো ফোন ধরছে না আলী। সে কি জানে নাকি তার বধূয়া ফোন করতে করতে পাগলপ্রায়।’

বলেই হেসে ফেলল সামিয়া। তার হাসি দেখে রিমা কালো মুখ করে বলল,

‘মজা নিবে না তো। মনটা কেমন কেমন জানি করছে আর তুমি আছ মজা নিয়ে।’

রিমার থুতনিতে ডানহাত দুই-আঙুলে উঁচু করে ধরে রসিকতাপূর্ণ কণ্ঠে সামিয়া বলল,

‘তা কেমন কেমন লাগে শুনি? কাছে পাওয়ার আকুলতা নাকি বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়ে গরম শরীরের সাথে মিশে নরম শরীরে উষ্ণতা নেওয়া, কোনটা?’

‘যাও, জানি না।’

লজ্জায় দু-হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফেলে রিমা। তখন সামিয়া তার ঢেকে থাকা মুখ থেকে হাত দু’টো সরিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘বাব্বাহ! বিয়ের ছয় বছর হয়ে এলো। তাও এত প্রেম! তোমরা পারোও বটে।’

সামিয়ার কথায় আকস্মিকভাবে মন খারাপের পরতটা আরো ভারি হয়ে এলো। সেটা সম্ভবত সামিয়ার চোখে এড়ালো না তাই সে কথা ঘুরাতে বলল,

‘আচ্ছা, ছাড়ো সেসব। দু’দিন হলো ঘুরে এলে, তোমাকে হাতের কাছে পেলামই না। বলো তো এবার আলী ভাইয়ের আদরযত্ন কেমন খেলে?’

ইশারায় সামিয়াকে এগিয়ে আসতে বলল রিমা। অর্থাৎ কানে কানে হবে সকল কথা। সামিয়া-ও খুশি মনে হাসি মুখে এগিয়ে গেল আগ্রহী শ্রোতার ন্যায়। তখন রিমা তার ভাবির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘বাতি নিভানো বন্ধ ঘরে, অল্প খোলা জানালার ফাঁক গলে আবছা আলোতে আমার ভাই তোমায় যেভাবে আদর করে, তুমি-ও সানন্দে তা যেমন গ্রহণ করো। আমার বেলায়ও তাই মনে করো।’

রিমার কথা শুনে হাসি হাসি মুখ করে তাদের গল্প শোনার ইচ্ছেটাই মরে গেল সামিয়ার। মুখ পাংশুটে করে রেখে বলল,

‘যাও যাও, মেয়ে বজ্জাত হয়ে গেছে। আমার কথা আমার ওপরেই এপ্লাই করছ। হুহ্!’

একবার সামিয়ার বাসর ঘরের কথা জানতে চাওয়ায় সামিয়া তাকে এই কথাই বলেছিল। তাই আজ সে-ও সুযোগে সেটাই বলে দিলো সামিয়াকে। উচ্চস্বরে খিলখিল করে হেসে এগিয়ে জড়িয়ে ধরল রিমা তার ভাবিকে। কিন্তু মনে সেই অশুভ সংকেত ডাকা পাখি ডেকেই চলেছে অবধারে। না জানি কোন তছনছ করার খেলায় নেমেছে এই ঝড়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here