#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৩
___________
৫.
‘তোর খালি আছে ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা ঘুইরা বেড়ান। এছাড়া আর কোনো কাজ আছে তোর। খাওন তো খালি তোর ভাইয়ের ওপর বইয়া বইয়া খাস। চিন্তা করস কইতে আসে সব খরচ?’
নিরবে কথাগুলো শুনল আঞ্জুমান। আর কথাগুলো হাতের ফোনে বলল তারই আপন বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী। গ্রাম-অঞ্চলে কারো হাতে বেশি একটা ফোন দেখা যায় না। শুধু কিছু বিত্তবান ব্যক্তিদের’ই হাতে থাকে। সেই বিত্তবান ব্যক্তিদের মধ্যে আঞ্জুমানের নানার বাড়ির কর্তা বড়ো মামা-ও পড়ে। ধানের গদি থাকার কারণে ভালোই আয় হয়। নানার বাড়িতে আঞ্জুমানকে কেউ খুব একটা পছন্দ করে না। কারণটা হলো তাকে জন্ম দিতে গিয়ে, তাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন মারা যায়। এমনিতেই পাঁচ ভাইয়ের এক বোন আঞ্জুমানের মা। এজন্য তার মা’কে সবাই খুব আদর ও স্নেহ করে। আঞ্জুমানকে জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর মারা যাওয়াটা কেউ-ই বিশ্বাস করতে চায়নি। তাই সবাই আঞ্জুমানকে দোষারোপ করে। অলক্ষ্মী সম্মোধনটা তার ছোটোবেলা থেকে পাওয়া আর গা সওয়া। অথচ এখানে তার দোষ কোথায়? সে তো আর নিজ হাতে জন্মদাত্রীকে হত্যা করতে যায়নি। কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ এই প্রবাদগুলো এমন হাজারো কলিকে ফুলে রূপান্তরিত হতে দেয় না, যা অকালেই ঝরে পড়ে। না জানি এই আঞ্জুমান নামক কলির অদৃষ্টে কী লেখা আছে? মুঠোফোনের ওপাশ থেকে আরো নানা গাল-মন্দ, অভিসম্পাত করতে থাকে তার বড়ো ভাবি। আঞ্জুমান কিছু না বলে চোখের জল ফেলে, মুঠোফোনটা তার মামার ঘরে দিয়ে আসে।
হাঁটতে হাঁটতে লিপিদের বাড়িতে চলে আসে আঞ্জুমান। ঘরের সামনের বারান্দায় তখন লিপি চাল বাছাই করছে। আঞ্জুমানকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে এগিয়ে এসে উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে মুখের এমন অবস্থা ক্যান? কী হইছে? চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে দেখি।’
‘আচ্ছা লিপি বল তো, আমার কী দোষ? আমি কী করছি? সবাই ক্যান আমাকে অপয়া, অলক্ষ্মী বলে। আমি মইরা যাই না কেন? তাই অভিশাপ দেয়। শুন না, আমার না মাঝে মাঝে মইরা যাইতে মন চায়। মন চায় গলায় দড়ি দিয়া দিতে। তাইলে মানুষগুলো অন্তত কিছুটা শান্তি পাইব।’
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিলো আঞ্জুমান। তার কান্না দেখে লিপি দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে বসায়। যে রুমে তারা বসেছে সেটাতে তার মা ও লিমন থাকে, পাশেরটাতে লিপি ঘুমায়। লিপির মা কাজে চলে যাওয়ায় তারা এই ঘরে এসে বসে রয়েছে। ঘরে নিয়ে লিপি পানি এনে দিলো আঞ্জুমানকে। পানি পান করে কিছুটা ধাতস্থ হলো সে। এটা দেখে আস্তে ধীরে লিপি তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হইছে? তুই এমন করলি ক্যান? ঝগড়া হইছে বাড়ির কেউর সাথে?’
‘হুম, সকালে বড়ো মামার ফোনে বড়ো ভাবি ফোন দিছে।’
অতঃপর ফোনে হওয়া যাবতীয় কথাবার্তা লিপিকে জানায় সে। লিপি যদিও জানে তার পরিবার তার প্রতি করা আচরণের সম্পর্কে তবুও স্বান্তনার বাণী শোনায়। যাতে করে কিছুটা হলে হালকা অনুভব হয় আঞ্জুমানের। কিছুক্ষণ সুখ-দুঃখের আলাপ করা শেষে লিপি অনুরোধের সুরে বলল,
‘তুই বস, আমি রান্ধনটা শেষ কইরা নেই। তারপর দু’জন পুকুরপাড়ে যামু গোসল করতে।’
আঞ্জুমান তখন সবকিছু ভুলে গিয়ে চোখ মুছে লিপির রান্না-বান্নার কাজে হাত লাগিয়ে দ্রুত কাজকর্ম শেষ করে দিলো। যদি-ও লিপি না করেছিল সাহায্যের জন্য। তখন আঞ্জুমান কপট রাগ নিয়ে বলে,
‘তুই আমার সখি না? আর তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কইরা পুকুরপাড়ে যামু এল্লেগাই তো হাত চালাইতাছি তোর লগে।’
৬.
পুকুরপাড়ে সিঁড়ি তৈরি করা ঘাটলায় দু-বান্ধবী বসে আছে। চারিদিকে গাছগাছালির বেড়িবাঁধ দেওয়া। মনোরম পরিবেশে দুপুরের প্রখর রোদে পানি গরম হয়ে আছে। আম পাকার দিন এমনতর ঝাঁঝালো রোদের তেজ ঝড়-বৃষ্টির আসার আশংকা তৈরি করে। লিপি পানিতে নেমে গেল দেখে আঞ্জুমান-ও নামলো। পুরোপুরি ডুবে দেয়নি এখনো দু’জন, কিছুক্ষণ পানিতে তাদের দুষ্টুমি চলল, ছিটেছিটি চলল। কে কতদূর সাঁতরে যেতে পারে সবার আগে সেই প্রতিযোগিতাও চলল। অথচ আনন্দে আত্মহারা দু’জন খেয়াল করল না, পথধারের এই পুকুরের পাশে হেঁটে চলা মানুষজনের নজরে তারা আসতে পারে। যদি-ও ভরদুপুরে কেউ আসবে না এখান দিয়ে, কারণ সময়টা সকলের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকার। কিন্তু আলী তার স্ত্রী রিমার জন্য পছন্দের মাছ আনতে গিয়েছিল হাঁটে, তাই সদর থেকে ফেরার রাস্তাতে পুকুর হয়ে যাওয়ার সময় দুই বান্ধবী’কে পানিতে মেতে থাকতে দেখে চোখ পড়ল। তবে দৃষ্টি সীমানা কেবল আঞ্জুমানের ভিজে জবজবে শরীরের সাথে এঁটে থাকা শাড়ির অভিন্যস্ত ভাঁজে ভাঁজে। এরইমাঝে সাঁতরে সাঁতরে দু-তিন ডুব দিয়ে পানি থেকে ওঠে এলো তারা। ভিজে শাড়ি শরীরের সাথে এঁটে গায়ের প্রতিটি ভাঁজ যেখানে দৃশ্যমান, সেখানে তারা দু’জন শাড়ি চিপে পানি ঝরাতে ব্যস্ত। তখন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আলী। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের অবস্থানের জানান দিলে, চমকে তাকায় তার দিকে আঞ্জুমান ও লিপি। এদিকে আলীর নিষ্পলক চক্ষুদ্বয় ষোড়শী যৌবনা আঞ্জুমানের সকল সৌন্দর্য শুষে নিতে ব্যস্ত। তা ভীতু আঞ্জুমান টের না পেলেও স্বল্প বুদ্ধিমান লিপির তীক্ষ্ণ নজর ঠিকই খেয়াল করল আলীর লোভাতুর দৃষ্টি। তাই সে এবার চেঁচিয়ে ওঠে বলল,
‘কী হইছে আপনে কী চান এহানে?’
লিপির বজ্রাহত কণ্ঠস্বরে আলীর দৃষ্টিচ্যুত হলে মেজাজ গমগমে হয়ে যায়। আলী তখন তার বাজখাঁই গলায় লিপিকে বলল,
‘তোর সাহস তো কম বড়ো না! চেয়ারম্যানের কাছে প্রশ্ন করস তাও আবার জোর গলায়!’
গ্রামের সকলেই আলীর শিক্ষিত মূর্খ, নারী লোভী, বদ আচরণের বিষয়ে অবগত। তবে এও জানে সে বেশ ক্ষমতাধর তা কেবল বড়োলোকি শ্বশুর বাড়ির কারণে। তাই ওমন ক্ষমাধরের মুখের ওপর আর কিছু বলার সাজে না দেখে লিপির মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। আলীর উচ্চস্বরে লিপিকে দেওয়া ধমকে বলা কথায় আঞ্জুমানের মন ভারাক্রান্ত হয়। মনে মনে চেয়ারম্যান আলীকে বেশকিছু গাল-মন্দ করে। তবে মুখে বলার সাহস হয় না আলীর বলিষ্ঠ, উচ্চ দেহ দেখে। ভাবে, তার মতো কাঁধের নিচে পড়া মেয়েকে যদি ধরে তুলে এক আছাড় দেয় তাহলে তাকে আর খোঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এখান থেকে সটকে পড়ার জন্য বারবার লিপিকে খুঁচাতে থাকে। লিপি-ও তার অভিব্যক্তি ধরতে পেরে আঞ্জুমানের হাত ধরে যেই না সামনে পা বাড়াবে তখনই আবারও আলীর বাজখাঁই গলার কাছে থমকাতে হলো,
‘এত বড়ো সাহস আমাকে অপমান করার?’
অবুঝের মতো আঞ্জুমান ও লিপি নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে। অতঃপর লিপি সহাস্যে গলায় শোধায়,
‘কী কন চেয়ারম্যান কাকা, আমাদের সাহস আছেনি এত যে আপনেরে অপমান করমু?’
চূড়ান্ত অবাকের চূড়ায় পৌঁছে ধমকানো গলায় আলী বলল,
‘এই বদ মাইয়া তোর কোন জন্মের কাকা লাগি আমি। ভাই বলবি।’
কথাটা বলল আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়ে। অস্বস্তিতে গাঁট হওয়া অবস্থা এবার আঞ্জুমানের। সে এবার সাহস করে আলীকে বলল,
‘যাই লাগেন না, আমরা এখন যাই। ভিজা কাপড়ে কতক্ষণ ধইরা দাঁড়ায় আছি।’
আঞ্জুমানের মুখশ্রীতে লালিমা জড়ানো চিকন কণ্ঠে মাতাল প্রায় অবস্থা আলীর। স্নিগ্ধতা জড়ানো চেহারা এখন চোখের সামনে থেকে চলে যাবে ভাবতেই একদলা কষ্টরা গলায় পাক খাচ্ছে। লোভাতুর দৃষ্টি যে এবার ক্রমেই নিজের আকাঙ্খা পূরণ করতে চাইছে। এদিকে আলীর কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় আঞ্জুমান লিপির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। মেয়েটার সাহস দেখে যারপরনাই অবাক হলো আলী। অথচ কিছুক্ষণ আগেও আঞ্জুমানকে ভীত ও আতংকগ্রস্থ মুখ নিয়ে লিপির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সেই কি না গটগট করে হেঁটে চলে গেল আলীকে মুখের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে পাত্তা না দিয়ে। তবে এমন ঝাঁঝ মরিচের স্বাদই তো চাইছিল আলী। ঘরে বেশি মিষ্টি খেতে খেতে এবার স্বাদের পরিবর্তনটা বেশ জমবে। তবে কথা হলো স্বাদটা নিবে কীভাবে আর মিষ্টির একটা ব্যবস্থা করবেও কীভাবে? ঝাল-মিষ্টি একসাথে থাকলে আবার বিদঘুটে স্বাদে আলীর অবস্থা হবে খারাপ।
চলবে…