#নিজেকে_ভালোবাসি
#পর্ব- ৫ ( শেষ পর্ব)
সাদমান এসে বলে, আন্টি আমরা আজ আসি। আরেকদিন না হয় আসবো।
সবাই একে একে বের হয়ে যায়। রুহির মা কাউকে বাধা দেয় না। সবার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন।
অর্ক দিশা নিশার সামনে এসে বসে।
–তোমরা অনেক অনেক বেশি দুষ্টামী করবে। এই বয়সে তোমরা দুষ্টুমি করবে নাতো আমরা করবো? মাথায় হাত বুলিয়ে সবার শেষে বের হয় অর্ক।
রান্নাঘরে রুহিকে দেখে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। কাজের ফাঁকে হঠাৎ অর্ককে দেখে চমকে তাকায় রুহী। অর্কর চোখ যেন কিছু বলতে চায়। ছাদে অর্কর চোখে যে স্বচ্ছতা যে দৃঢ়তা ছিল তা এখন যেন কেমন এলোমেলো। কি বলতে চায় অর্ক- রুহি তা পড়তে পারে না। এক দৃষ্টিতে ওরা একে ওপরকে দেখতে থাকে।
অর্ক এগিয়ে নিজের হাত রুহীর গালে রাখে। অর্কর স্পর্শে রুহী সরতে পারে না চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়। এ কেমন অনুভূতি! এভাবে যদি জীবন পার করে দেয়া যেত!
চোখ ঝাপসা হওয়ার আগেই অর্ক তড়িৎ গতিতে বের হয়ে যায়।
কিছু না বুঝে উঁকি দিয়ে রুহি দেখে ঘর একদম ফাঁকা, কেউই নেই। রুহির মা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
—-
সবাই বের হয়ে এলোমেলো হাঁটছে। সাদমান সবাইকে গাড়িতে উঠার ইশারা দেয়। সবাই একে একে উঠলেও অর্ক অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকে। সাদমান ডাকে, কই যাচ্ছিস? গাড়িতে ওঠ।
কিছু না বলে অর্ক গাড়িতে উঠে।
গাড়িতে সবাই চুপ হয়ে আছে।
মৌ কেঁদেই চলেছে।
–এমন ফুটফুটে দুটো বাচ্চার সাথে আল্লাহ কেন এমন করলো ? কেমন বাস্তবতায় এসে পড়েছে ওরা! দুষ্টুমী করতেও ভুলে গেছে এ বয়সে।
মাহিরা বলে, রুহিকে দেখ! কেমন চুপচাপ বাচ্চা দুটোর দায়িত্ব পালন করছে। আগে নাকি প্রচুর সাজতো আর এখন কেমন সাদামাটা জীবন চালাচ্ছে। এটুকু বয়সে কেমন গাম্ভীর্যের আবরণ নিয়ে চলছে। কেউ যেন রুহীর কাছে ঘেষতে না পারে কিংবা বাচ্চাদের প্রতি দায়িত্ব নিয়ে যেন কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে তাই বলেও নি ওরা রুহির না ওর বোনের বাচ্চা। এ কেমন সেক্রিফাইজ”!”
–বোন দুলাভাইকে হারিয়ে রুহি যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেছে। আল্লাহ ওদের পরিবারকে কি সিচুয়েশনে ফেলেছে, নওশিন চোখ মুছে বলে।
সাদমান বলে, যে যা বলতে চাও, যত কাঁদতে চাও সব আজ এখনই কর। আগামীকাল অফিসে এ বিষয়ে কোন কথা হবে না। আমি চাই না এতোদিন রুহি যে শক্ত হয়ে চলেছে তা আমাদের সহানুভূতিতে ভেঙে পরুক।
অর্ক উদাস মনে সামনের সিটে বসে ছিল। ওর চিন্তাগুলো সব এলোমেলো হয়ে আছে। এতোদিন ভেবেছিল রুহীর জীবনে একটা অতীত আছে, বুকে চাপা কষ্ট আছে। অর্ক এক বুক ভালবাসা দিয়ে সে কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। আনন্দে ভরিয়ে রাখবে রুহীকে আর ওর পরিবারকে। যা তাদের প্রাপ্য।
কিন্তু এখন সব ওলোট পালোট হয়ে গেল।
নিষ্পাপ বাচ্চা দুটির জন্য দায়িত্বের যে উচু দেয়াল চারপাশে গড়েছে রুহী, অর্কর ভালোবাসা কি তা পার করতে পারবে? জীবন যুদ্ধে হেরে না যাওয়া রুহিকে যে মুরতি দিয়ে অর্ক সাজিয়েছিল সে তো তার চেয়েও অনেক বেশি জ্যোতির্ময়। অর্কর কি যোগ্যতা আছে তাকে ছোঁয়ার! অর্কের ভেতরে ঝড় বইতে থাকে। রুহি যদি মানা করে দেয় তবে অর্ক কিভাবে নিজ ভালবাসাকে দাঁড় করাবে রুহির ত্যাগের সামনে?
রুহীকে হারানোর ভয়ে হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে অর্কর।
পরদিন অফিসে রুহি আসে বড় বড় বাস্কেটে ভরে গত রাতের সব খাবার নিয়ে। রাতে যেহেতু সবাই না খেয়ে ফিরেছে তাই রুহীর মা আজ সব বক্স বন্দি করে দিয়ে পাঠিয়েছে। সবাই দেখে মহা খুশি। মাহিরা তো জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বসে।
গত রাতের কথা কেউই তুলে না।
গতরাতে যা সবাই জেনেছে তা নিয়ে রুহিরও কোনো মাথাব্যাথা নেই। এ অফিসে সবার সাথে তার আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আজ হোক কাল সবাই জানতোই।
রুহির ভেতরে এখন অন্য তোলপাড় চলছে। ছাদে অর্কর কথা গুলো কানে বার বার গুঞ্জন করছে। এতদিন নিজের জীবন নিয়ে রুহীর যে কঠোর সিদ্ধান্ত ছিল, নিজের গড়া দেয়াল ছিল অর্কর কথায় তা যেন অল্প অল্প করে ভাঙ্গতে লেগেছে।
সে কি সিদ্ধান্ত নেবে!
অফিসে অর্ক নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না। কাজের ফাঁকে শুধু দরজার দিকে চোখ যায় এই বুঝি অর্ক আসবে। পরদিনও অর্ক অফিস আসে নি। অপেক্ষা করতে করতে রুহীর কান্না আসে। কাকে কি বলবে বুঝে পায় না। গলা ভারি হয়ে আসে। জীবন যেন হঠাৎ থমকে গেছে। প্রতিটা মুহূর্ত যেন এক একটা যুগ।
অবশেষে অনেক সাহস যুগিয়ে অর্ককে কল করে রুহি।
ওপাশ থেকে অর্ক হ্যালো বলতেই রুহির সকল অস্থিরতা মুহূর্তেই চলে যায়। এলোমেলো চিন্তার সকল সমাধান যেন ওই কণ্ঠের মধ্যেই আছে।
অর্ক আবার বলে, হ্যালো।
রুহি চেতন ফিরে পায়।
–অফিস আসেন না যে আপনি?
অর্ক চুপ করে থাকে। কি বলবে বুঝে পায় না।
–কাল কি আসবেন? আমি অপেক্ষায় থাকবো!! বলেই রুহী কল কেটে দেয়।
—**
অর্ক আজ সকাল সকাল অফিসে এসেছে। এভাবে অফিস না করা মানে রুহীর মনের উপর চাপ দেয়া। যেটা সে মোটেও চায় না। রুহীকে একান্ত নিজের মত করে চিন্তা করতে দেয়া উচিত।
রুহী অফিসে ঢুকলে সবাই অবাক হয়ে তাকায়। মৌ তো দুবার চোখ কোচলায়। মাহিরা তার স্বভাবসুলভ জোড়ে একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এসে রুহীকে জড়িয়ে ধরে। কি মিষ্টি লাগছে তোকে! একেবারে একটা পুতুল।
আজ মিষ্টি গোলাপী রংয়ের সাথে সবুজ পাড়ের শাড়ি পরেছে রুহী। সাথে সবুজ টিপ, সবুজ কাচের চুড়ি, কানে ঝুমকা, পিঠ অবদি লম্বা ছাড়া চুল।। আজ সে কাজল দিয়ে চোখ রাঙিয়েছে। সবাই মুগ্ধ চোখে দেখছে ।
সাদমান বলে, আমাদের রুহীকে তো একদম পরী লাগছে!
রুহী লাজুক হাসি হাসে।
সোজা অর্কর রুমে চলে যায় রুহী। সবাই মুচকী হেসে যার যার কাজে ফিরে যায়। আজ কার জন্য রুহী এতো সেজেছে তা বোঝার বাকি থাকে না কারো।
অর্ক ল্যাপটপে কাজ করছিল। দুদিনে অনেক কাজ জমে গেছে।
দরজায় টোকা দিয়ে রুহী রুমে ঢুকে। অর্ক ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে নামাতে ভুলে যায়। স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। কাকে দেখছে সে! তার ভালবাসার মানুষটা এতো সুন্দর! নিজেকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে ইচ্ছে করে, রুহী কি আজ শুধু আমার জন্য সেজেছে?
অর্ক চোখ নামিয়ে নেয়। নিজের কাজে মন দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে।
–কিছু বলবেন মিস রুহী?
রুহী ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থাকে। আস্তে আস্তে বলে, সেদিন ছাদে বলা আপনার কথাগুলো আমি অনেক বার ভেবেছি। আসলে দায়িত্ব পালনে যদি দৃঢ়তা থাকে তখন নিজেকে না হারিয়েও তা পালন করা যায়। নিজেকে ভালোবাসলে, মুল্যায়ন করলে কোনো কাজকেই আর কঠিন মনে হয় না।
আমি হুট করে হয়তো আমার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবো না। তবে আমি চেষ্টা করবো।
কিছুক্ষণ থামে রুহী।
গলার স্বর আরেকটু নামিয়ে বলে, আমি নিজেকে ভালবাসতে শিখে গেছি।
আমি…আমি নিজেকে ভালোবাসি…… সেই সাথে…… আপনাকেও।
অর্ক ল্যাপটপ নামিয়ে মাথা নিচু করে নীরবে হাসে। চোখ তুলে তাকায় রুহীর দিকে। নিজ গালে হাত রেখে অপলক তাকিয়ে থাকে।
রুহী লজ্জায় চোখ তুলতে পারে না। কাঁপা কণ্ঠে বলে, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
–কখনো তো ভালোভাবে তোমার দিকে তাকাতে পারি নি। আজ না-হয় অধিকার নিয়ে মন ভরে তোমাকে দেখি!
রুহী লজ্জায় যেন আরও কু্ঁকড়ে যায়।
অর্ক ড্রয়ার খুলে একটা বক্স বের করে রুহীর সামনে রেখে বলে খুলে দেখো।
রুহী বক্সটা খুলে দেখে একজোড়া স্বর্নের বালা।
অর্ক বলে, এটা আমার দাদীর। মাকে দিয়েছিল তার বিয়েতে। মা দিয়ে গেছে তোমার জন্য।
যদি রাজি থাকো তবে আজ না হয় দুজনে মিলে কোনো শোরুমে গিয়ে ব…ড় একটা ড্রেসিং আয়না অর্ডার দিবো !!
সমাপ্তি।।
ঝিনুক চৌধুরী।।