#নিজেকে_ভালোবাসি

#পর্ব- ২

কেবিনে বসে অর্ক আর রুহী একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। রুহী মূলত অর্ককে এসিস্ট করে। অর্কর কনসেপ্টে হালকা পরিবর্তন করতে চাচ্ছে রুহী। কিন্তু অর্ক তা চাচ্ছে না। এ নিয়ে তাদের মত বিরোধ চলে। অর্ক কনফিউজড হয়ে না পারতে সবার সামনে কনসেপ্টটা তুলে ধরে। ডিসিশন দিতে বলে সবাইকে। সাদমান বলে আমার কাছে তো রুহীরটাই ঠিক মনে হচ্ছে। মাহিরা বলে আমার কাছেও রুহীরটাই ঠিক মনে হচ্ছে। আর কেউ কিছু বলতে যাবে ওমনি অর্ক দুষ্ট হাসি দিয়ে বলে কোনো ডিসিশন দেয়ার আগে সবাই মাথায় রেখো আমি কিন্তু এবার ঈদ বোনাস আটকে দিবো।
সাদমান বলে, এটা কেমন কথা! তুই তো দুর্নীতি করছিস।
অর্ক বলে, আমার অফিস আমি যা ইচ্ছে করতে পারি।
মাহিরা বলে, আমি তোকে জবাই করে ফেলবো।
এমপ্লয়ি মৌ ঝটপট বলে স্যার আপনার কনসেপ্টই ঠিক। আমি বোনাস হারাতে চাই না, বলে হাসতে থাকে।
রাফি বলে, আমিও আপনার দলে স্যার।

রুহী বলে, ঠিক আছে অর্ক স্যারের কনসেপ্টই ঠিক থাক। তবে আজ সকালে দেখেছি আম্মু মাংস ভিজিয়েছে। কাল নাকি অফিসে কাচ্চি রান্না করে পাঠাবে। আম্মুকে না করে দিবো। খামাখা কষ্ট……

ওমনি রাফি লাফ দিয়ে বলে না না, বোনাস বাদ, বোনাস বাদ। আন্টির হাতের কাচ্চিবিরিয়ানি মিস করা যাবে না।
মৌ বলে, স্যার বোনাস না হয় এবার না- ই নিলাম। কাচ্চি আমার চাই।
সাদমান বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলে, দেখছিস তোর টাকা কাচ্চির কাছে হেরে গেল। পৃথিবীতে টাকা দিয়েই সব কেনা যায় না বন্ধু! সবাই একসাথে হাসতে থাকে।

অর্ক হেসে বলে, ঠিক আছে। মিস রুহীর কনসেপ্ট গ্রানটেড। কাচ্চি আমিও হাতছাড়া করতে চাই না।

রুহীর মা প্রায়ই এটা সেটা রান্না করে অফিসে দিয়ে পাঠান। আর সবাই তাতে হামলে পড়ে। এজন্য রুহী এক্সট্রা খাতির পায় সবার কাছে।

পরদিন সকালে অফিস এসে অর্ক দেখে ডেস্কে একটা সিভি রাখা। ছেলেটা বেশ কোয়ালিফাইড। সাথে যে ফটো আছে তাতে গাড়ির হ্যান্ডল ধরে হিরো মার্কা পোজ দিয়ে বসে আছে। যেন কেনডিডেট নয় পাত্র দেখা হচ্ছে। কিন্তু নতুন কাউকে তো নিয়োগ করার কথা না তবে এটা এখানে কেন?
অর্কর হিসেব মেলে না।

সাদমান ঢুকে বলে, দেখেছিস? কেমন লাগলো ছেলেটাকে?
–ভালো কিন্তু আমাদের তো এখন নতুন কাউকে দরকার নাই, তাইনা?
–আরে এটা অফিসের জন্য না তো। রুহীর জন্য?
–রুহীর জন্য মানে?
–মেয়েটা কতদিন এভাবে একা জীবন কাটাবে। কত আর বয়স। অফিসের বড় ভাই হিসাবে আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। ছেলের ফ্যামিলী, ছেলে সব ভাল। রুহী রাজি থাকলে আমি আন্টির সাথে আলাপ করবো। শুধু রুহী ডিসিশন দিলেই আর কোনো সমস্যা নেই।

অর্ক এমন আকস্মিক পরিস্থিতিতে কি করবে ভেবে পায় না। বিড়বিড় করে বলল, রুহী ডিসিশন দিলে মানে … কথা শেষ হবার আগেই মাহিরা আর নওশীন রুমে ঢুকে। মাহিরা একটা ফাইল টেবিলে রেখে বলে ফাইনাল হয়ে গেছে। পার..ফেক্ট হয়েছে। রুহী খুব সুন্দর ডিসিশন দিয়েছে। মেয়েটা একটা জিনিয়াস!

অর্ক খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। কোনো দিন ওকে কেউ জোরে কথা বলতে দেখেনি। আজ কি হলো, অর্ক ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
– রুহীর ডিসিশন হলেই কি ফাইনাল নাকি? ওর কী এমন ধারনা আছে। ও কি আমাদের চেয়ে বেশি এক্সপেরিয়েন্সড? ওর ডিশিসন তো ভুলও হতে পারে। এটুকু একটা মেয়ে তার ছয় বছরের দুটো বাচ্চা আছে। কোনো একটা ভুল ডিসিশনের জন্যই তো ওর এ অবস্থা। আর তোরা ওর ডিসিশনকে এত প্রাধান্য…… বলতেই অর্ক থেমে যায়। পিছনে রুহী দাঁড়ানো।
রুহী মুহুর্তে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

মাহিরা বলে, অর্ক এটা তুই কী করলি? তোর মাথা কী নষ্ট হয়ে গেছে? কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে গেলি!
নওশীন বলল, আমি বরং রুহীর কাছে যাই।

সাদমান বলল, না, রুহীকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দে। তোরা বাইরে যা। অর্কর সাথে আমার একা কিছু কথা আছে।

অর্ক মুখ অন্ধকার করে চেয়ারে বসে আছে। সাদমান কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই অর্ক বলে উঠে, আমি রুহীকে ভালবাসি সাদমান। আমি.. আমি খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছি। আমি এগুলো কেন বললাম!
–খারাপ তো অবশ্যই করেছিস। এখন কিভাবে সামলাবি? আসলে ভালোবাসায় থাকলে মানুষ এমন হিংসে আচরণ করে। কিন্তু তুই এভাবে রিয়েক্ট করবি জানলে আমি এই প্ল্যান কখনই করতাম না।

–প্ল্যান ?

–হুম প্ল্যান। তোর মনের কথা জানার জন্যই আমি নিজ হাতে এ বায়োডাটা বানিয়েছি। আর ফটোর এ ছেলেটা আমার বোনের মামাতো দেবর। ঐ বেটা কবে বিয়েশাদি করে বাচ্চা নিয়ে সুখে দিন যাপন করছে। তুই তো চাপা স্বভাবের। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতি না তাই এ লাইন ধরেছিলাম। স্বীকার তো করলি ঠিকই কিন্তু সব গুবলেট করে ফেললি।
একবার রুহীর কাছে যা তুই।

–না আমি একলা ওকে কিছু বলব না। যা বলার সবার সামনেই বলব। আমি খারাপ করেছি আমিই ঠিক করবো।

রুহী ওর ডেস্কে বসে আছে। ওয়াসরুমে অনেকক্ষণ কান্না করেছে বলে চোখ ফুলে আছে। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অফিসে একটা থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
অর্ক এসে রুহীর সামনে দাঁড়ায়। সবার দৃষ্টি অর্কর দিকে।
–মিস রুহী, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আজ যা বলেছি তার জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আপনি অনেক মেধাবী ও স্ট্রং একটা মেয়ে। আপনি আপনার জীবনকে একা হাতে যেভাবে সামনে নিয়ে যাচ্ছেন তা অন্যান্য মেয়েদের জন্য একটা উদাহরন। আপনার মেধা কিংবা চলার পথকে জাজ করার কোন অধিকার বা যোগ্যতা আমার নেই। আমি কোন ভনিতায় যাবো না। শুধু বলবো আমি ভুল বলেছি। সবার সামনে আপনার কাছে তাই ক্ষমা চাচ্ছি। ভুল করে ক্ষমা চাওয়ায় কোনো লজ্জা নেই। শুধু একটি অনুরোধ করবো আমার উপর রাগ করে এই পরিবারটিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করবেন না প্লিজ। এ পরিবারের প্রতিটা সদস্যই অনেক মূল্যবান।

রুহী ঠোট কামড়ে চুপচাপ সব শুনছিল। বলল, আপনি ক্ষমা চাইবেন না প্লিজ। পরিবারে এমন ছোটখাটো ব্যাপার হতেই পারে। আমি কিছু মনে করিনি।
অর্কর বুক থেকে যেন পাথর সরে যায়। মাথা নিচু করে ধন্যবাদ বলে কেবিনে ফিরে যায়।

সাদমান রুহীর মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে যায়। মাহিরা দূর থেকে চিয়ার আপ হওয়ার ইশারা দেয়। রুহী হেসে দেয়। এতো সুন্দর একটা পরিবার রেখে সে কোথায় যাবে!

সাদমান জিজ্ঞেস করে, এখন কি করবি? রুহিকে তোর ভালবাসার কথা কবে জানাবি?
–রুহিকে জানানোর আগে মার সাথে আলাপ করবো। তুই তো জানিস আমি মাকে সব বলি। আর আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মাকে না জানালে কিভাবে হবে। মা অমত করবে না জানি। তবুও ছেলে হিসাবে এটা আমার দায়িত্ব। ভাবছি রুহী যদি আমাকে মানা করে দেয়?

–দেখ অর্ক, তুই আমার বন্ধু বলে বলছি না তোর মত ভালো ছেলেকে রুহী না করলে জীবনের মস্ত বড় ভুল করবে। আর এভাবে একা একা জীবন চলবে নাকি মেয়েটার!
তুই রুহীকে একবার তোর ভালবাসার কথা বল পরে না হয় আমরাও বোঝাবো। আমরা যে ওর ভাল চাই এ বিষয়ে নিশ্চয়ই ওর মনে কোনো সন্দেহ নেই।
এক কাজ করি তোর মত ওকেও একটা বায়োডাটা পাঠিয়ে দেই। দেখি কি রিয়েকশন হয়। তারপর না হয় সিচুয়েশন বুঝে তুই ওকে বললি।
ওয়াও!হোয়াট এ জিনিয়াস আই এম! নিজের কাঁধে নিজেই চাপড় দেয় সাদমান।

সকালে অর্কর মা আসে অফিসে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে। দুদিন পর আমেরিকার উদ্দেশ্য ফ্লাইট উনার। বড় মেয়ে থাকে ওখানে। সবার পাশাপাশি তিনি রুহীকেও অনেক আদর ও দোয়া দিয়ে গেলেন। আসলে তিনি রুহীর উদ্দেশ্যেই এসেছিলেন। গত রাতে রুহীর প্রতি অর্কর ভালোলাগার বিষয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে অর্কর সাথে। রুহী এখনও কিছু জানেনা বলে তিনিও কিছু বলেন নি । শুধু দোয়া দিয়ে গেলেন।

সাদমান এসে রুহীুর কাছে মৃদু সরে বলল, আন্টি আমাকে একটা গুরু দায়িত্ব দিয়ে গেছে। তিনি অর্কর জন্য একটা মেয়ে দেখেছে। আজ মেয়েটার সাথে অর্কর দেখা করার কথা। অর্ক যেন কোনো ভাবেই পালাতে না পারে সেদিকে আমাকে খেয়াল রাখতে বলেছে। আজ তোর আর অর্কর যে মিটিং আছে ধানমন্ডিতে ওখানেই ওই মেয়ের সাথে দেখা হওয়ার কথা। আমি তোকে এ গুরু দায়িত্বটা সঁপে দিলাম। তুই সাথে সাথে থাকবি, ঠিক আছে।
রুহী চুপ হয়ে শুনে সাদমানের কথা। ওর বুক ধকধক করতে থাকে।
অর্ক স্যার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে!
নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুহী। এটাই তো হাওয়ার কথা। কেন সে বোকার মত মনের গভীরে স্বপ্ন দেখছিল! যেখানে সে নিজেও বিয়ে ভালবাসা কোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত নয়। রুহী কখনোও তার জীবনে অর্ককে আসতে দিবে না। তবে কেন অর্ক অন্য কাউকে বিয়ে করবে ভেবে মন খারাপ করছে?

মন অস্থির হয়ে উঠে রুহীর। কিন্তু বাস্তবতা তো মেনে নিতেই হবে।

চলবে।।

ঝিনুক চৌধুরী।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here