#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_52

নীলাদ্রি লেকের পাশে পরিত্যক্ত প্লেসে সবার আড্ডা চলছে। সকালের আবহাওয়া প্রান কে সচ্ছ অনুভূতি তে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। রোহন বেশ ভালো গিটার বাজাতে পারে। সৌখিনতার বসেই গিটার বাজানো হয় তাঁর । দু এক লাইন গাইলে ও লজ্জায় আর গাইতে পারলো না। মৌনতার সাথে মিল রেখে সবাই পিঞ্চ করে যাচ্ছে। পরিশেষে বেশ কিছুটা সময় সবুজ ঘাসে বসেই আড্ডা চললো। সকালের নাস্তা টা এখানেই করা হলো। নাস্তা তে ছিলো ফল , জেলি পাউরুটি। আশে পাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে সবাই। মৃদু হাওয়াতে উড়ছে চুল। চারপাশে পরিত্যক্ত মেশিন পরে আছে।
ট্রাভেল কর্মকর্তা জানালেন মূলত খনি তে ব্যবহার করা হতো এগুলো। এক সময় বেশ মূল্যবান ছিলো এ যন্ত্র যা এখন অতি নগণ্য।
অসাবধানতার কারনে কঙ্কর লেগে উল্টে পরে গেলো ঝিল। অভিনবর কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ সৃষ্টি হলো। চিন্তিত হয়ে ঝিলের পায়ে হাত দিয়ে শুধাল
_ তুমি ঠিক আছো ঝিল ?

চুলের কারনে ঝিলের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তারউপর মাথা নিচু , অভিনব ব্যস্ত হয়ে পরলো। ভয়ে বুক ভারী হয়েছে । হঠাৎ চমকে গেল ছেলেটা। কারন খিল খিল করে হাসছে ঝিল। ফোঁস করে দম ফেলে অভিনব। মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে ক্রুদ্ধ নয়নে তাকায়। ঝিল নুইয়ে যায়। অভিনব হাঁটু তে হাত রেখে হাসতে থাকে। এক টা সময় পর হাসতে হাসতে কচি ঘাসে শুয়ে পরে। ঝিল ভ্যবলার মতো তাকিয়ে প্রশ্ন করে
_ এটা কি হলো?

_ রিভেঞ্জ! তুমি আমাকে ভয় পাওয়াতে চেয়েছিলে তাই আমি ও একটু ভয় পাইয়ে দিলাম। যাকে বলে যে যেমন তাঁর সাথে তেমন।

ঝিলের রাগ হয়। আশে পাশে তাকিয়ে কিছু পায় না। অভিনবর মাথা টা ফাটিয়ে দিতে পারলে শান্তি হতো। হঠাৎ হাতের দিকে চোখ যায়। হাত দিয়েই কার্য সম্পূর্ন করে সে। কোনো মতে উঠে বসে অভিনব। একটু অভিনয়ের সুরে বলে
_ এতো জোড় কবে থেকে আসলো। মেয়ে দের হাত তো নরম তুলতুলে হয় তোমার হাত পাথরের মতো শক্ত কেন ?

কিছুক্ষণ পর ঝিল উল্টো পথে যায়। বিরবির করে বলে
_ কপালে বউ জুটেছে যে তাই তো ভাগ্য। এমন অসভ্য লোকের কপালে আমি যে জুটেছি তাই তো বেশি।

অভিনব ঝিলের দিকে ছুটে গেল। ঝিল কে স্পর্শ করবে তাঁর আগেই বলল
_ একদম আমাকে স্পর্শ করবে না। অন্য কাউ কে বিয়ে করে তাঁর নরম তুলতুলে হাতের ছোঁয়া গ্রহন করো।

_ বাহ বেশ ভালো আইডিয়া দিলে তো। তুমি ই একমাত্র বউ যে তাঁর সতীন কে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছো।

অভিনবর খাপছাড়া ভাবে ঝিলের কান্না পেলো। অভিনব মুখ টিপে হাসছে। ঝিল কিছুতেই অভিনবর নিছক মজা টা গ্রহন করতে পারলো না। উল্টো পথে দৌড় লাগালো। বিস্ময়ে হতবাক অভিনব এক মুহুর্ত ও দেড়ি করলো না।
ঝিলের হাত খপ করে ধরলো। ব্যাথাতুর কন্ঠে বলল
_ আম স্যরি । ভেরি স্যরি ঝিল। আমি শুধুই মজা করেছি। প্রমিস আর কখনো মজা করবো না।

ঝিল এবার কেঁদেই দিলো। কেন ছোট বিষয় টা মানতে কষ্ট হচ্ছে ওর। নিছক মজা টা ও বুকে রক্ত ক্ষরন করছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে মেয়েটার নাজেহাল অবস্থা। ঝিলের মুখে পর পর কতো গুলো চুমু খেয়ে বুকে চেপে নিলো। তাঁতে ও ঝিলের কান্না থামে না।
অভিনব শপথ করলো এ কথা আর কখনোই বলবে না। যে মেয়েটা সাধারন মজা ও মেনে নিতে পারে না যদি এমন কখনো ঘটে নির্ঘাত উল্টো কিছু করে বসবে।
ভালোবাসার নতুন সমীকরন দেখালো ঝিল।

.

নীলাদ্রি লেকে নৌকা করে ঘোরাঘুরি হলো কিছুক্ষণ। শীতল বাতাসের সাথে টলটলে পানির মিল বন্ধন যেন স্বর্গীয় সুখ। সৃষ্টি কে উপভোগ করতে পারলে পৃথিবীর বুকের সেরা অনুভূতি সেটাই হবে। প্রতি নৌকার ভাড়া 300 টাকা করে। এগারোটার দিকে সবাই বোটে ফিরে আসলো। দুপুরের নাস্তা তে দেওয়া হলো মুরগির মাংসের খিচুড়ি , মরিচ ভর্তা , আর সালাত। এমন পরিবেশের জন্য পারফেক্ট খাবার। সবাই খানিক টা জিরিয়ে নিলো। অভিনব কথা বলে জানতে পারলো সাইট সিনে যাওয়া হবে।
ঝিল বায়না ধরে বললো
_ আমরা সবাই বাইকে করে যাই ? প্লিজ এটায় বেশি মজা হবে । তুমি বাইক রাইড করবে প্লিজ।

অভিনব একটু চিন্তিত হলো। বাইকে যাওয়া যেতেই পারে তবে রাস্তার অবস্থা যে তেমন ভালো না। তবু ও মানা করলো না। ঝিলের মুখে হাসি দেখার জন্য একটু রিক্স না হয় নিলো।
ঝিল প্রচন্ড খুশি হয়ে টুপ করে অভিনবর গালে চুম খেলো।
_ বাহহ এবারের ট্যুর টা সত্যি প্রয়োজনীয় ছিলো।

_ আমি রোমান্টিক এটাই প্রমান দিলাম। হুট হাট চুম খাওয়াতে ও ভালোবাসা বাড়ে। তবে বাড়াবাড়ি করলে কমে যায়। যেমন টা তুমি করো। বলা নেই কওয়া নেই সোজা লিপস টু লিপস ছিইই।

ঝিলের কথায় অভিনবর মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে যায়। এখন সত্যি তাঁর কিস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো তবে পানি ঢেলে দিলো মাহের। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো ছেলেটা। শিমুল বাগানে যাওয়ার জন্য ই ডাকতে এসেছে মাহের। দীর্ঘশ্বাস টেনে অভিনব মিনমিনে স্বরে বলল
_ ভাই আর বোন দুটোই আমার রোমান্টিক মুহুর্তে পানি ঢেলে দেয়।

বাইক ভাঁড়া করা হলো। পার বাইক 300 করে রাখা হয়। তবে অভিনব যেহেতু নিজে বাইক ড্রাইভ করবে তাই বাইক এর কস্ট টা বেশি পরলো। বাইকে উঠে হৈ হুল্লর শুরু হলো। অভিনবর শক্ত পিঠে মাথা এলিয়ে দেয় ঝিল। চোখ দুটো বন্ধ করে রাখে। অভিনব একটু সাবধান করে বললো
_ আমাকে জড়িয়ে ধরো প্লিজ। রাস্তা টা একটু আঁকা বাঁকা ।

_ আচ্ছা।

শিমুল বাগানের কাছে বাইক পার্ক করা হলো। যদি ও এখন শিমুলের সিজন না তবু ও ঘোরার জন্য সুন্দর এক জায়গা।ঝিল একটু আফসোস করে বলল

_শীত কালে আসলে শিমুলের বাহার ও দেখা যেতো।

_ তা যেতো তবে হাওরের আসল সৌন্দর্য তো এখনি।

শিমুল বাগানের বিশাল গাছ গুলো ছাউনির মতো দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশ টা ও শীতল। বিশাল বাগান ঘুরে চোখে পরলো ঘোড়া।
অভিনব একটা ঘোড়া ভাড়া করলো। ঝিল ভয় পাচ্ছে দেখে অভিনব আশস্ত করে বলল
_ আমি জকি না হতে পারি তবে ঘোড়া কন্ট্রোল করতে পারি।

_ যদি পরে যাই আমি !

_ কিচ্ছু হবে না বোকা । আসো

এক প্রকার টেনে হেচরে ঘোড়ার পিঠে উঠায় অভিনব। ঘোড়ার নরম তুলতুলে শরীরে হাত বুলায় ঝিল। ঘোড়া টা পেছন ঘুরে তাকায় তাঁতে ভয় পেয়ে যায় ঝিল। কয়েক মিনিট ঘোড়ার পিঠে ঘোরা ফেরা করে নেমে যায়। অভিনব মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত শব্দ করতেই ঘোড়া টা ঝিলের হাত চেটে দেয়। যাঁর ফলে চেচিয়ে উঠে ঝিল। অভিনবর ভীষন হাসি পায় তবু ও হাসে না। পরে দেখা যায় ঝিল নিজেই হাসছে। অভিনব ঝিলের হাত ভালো করে ওয়াস করে শিমুল বাগান থেকে বেরিয়ে আসে।

.

বারেক টিলার উদ্দেশ্য রওনা হয় সবাই। বারেক টিলায় উঠার কারন এখান থেকে পাহাড় আর জাদুকাটা নদীর ভিউ টা বেশ ভালো দেখা যায়। তবে টিলার রাস্তা একটু উঁচু হয়ে যায়। যাঁর কারনে বাইকের স্প্রিড কমিয়ে দেয় অভিনব।
বারেক টিলার উপরে এসে বাইক পার্ক করে।
এখন জাদুকাটা নদীর পানি খুব কম। পূর্ন বর্ষা তে পানি তে টুইটুম্বর থাকে। বারেক টিলায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছু মুহূর্তু উপভোগ করে। সমীরনে গা শিরশির করে উঠে। অভিনবর গা ঘেঁষে দাঁড়ায় ঝিল।
নদীর পরে বালুর মোটা আস্তরন আর তারপর ই পাহাড়। আকাশ টা যেন খুব কাছে নেমে এসেছে।

ঝিলের তো যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না। অভিনব তাড়া দিয়ে বলল
_ দেরি হয়ে যাচ্ছে ঝিল।

_ আরেকটু প্লিজ ।

_ অনেক ক্ষন তো হলো। এবার যাই , আসো ।

মন খারাপ করে ঝিল। অভিনব দম ফেলে। ছোট ছোট বিষয়ে ঝিলের মন খারাপ হয়। আসলে মেয়েটা ছোট ছোট বিষয়ে আনন্দ খুঁজে নেয় তাই ছোট বিষয় গুলোই আঁকড়ে ধরে।

আজকের লাস্ট স্পর্ট হলো লাকমাছড়া। বেশ কিছুক্ষণ বাইক রাইড এর পর লাকমাছড়ার দেখা মিলে।

লাকমাছড়ায় এসে সবাই একটু লেমন জুস খেয়ে জিরিয়ে নেয়। শান্ত পরিবেশ টা বেশ উপভোগ করছে। অভিনব ঝিলের ক্লান্ত মুখ টা মুঠো বন্দি করে বলে
_ চলো ঝরনার পানি তে নামা যাক।

ঝিল সম্মতি জানায়। বিশাল পাহাড়ের কোন বেয়ে পানি নেমে যাচ্ছে। পাহাড়ের সাথেই ইন্ডিয়ান বর্ডার। একটা ব্রিজ দেখা যায় যেটা ইন্ডিয়ায় অন্তর্ভুক্ত। হয়তো ব্রিজের ভিউ টা আরো উপভোগ্য। কারন ব্রিজের গা ঘেঁষেই ঝর্নার পানি নেমে আসছে।

পাথরে পা রাখতেই পানি বেয়ে নেমে যায়। বেশ স্রোত রয়েছে। ঝিল বার বার উল্টে যাচ্ছিলো অভিনব টেনে ধরে। স্রোতের পানি তে ভিজে একাকার হয়ে যায়। মসৃন পানির সংস্পর্শে নতুন রূপে সজ্জিত হয় ঝিল। বাচ্চা দের মতো পানির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে নেয়। অভিনবর দৃষ্টি ঝিলের সৌন্দর্য উপভোগে ব্যস্ত।
অভিনব হঠাৎ করে অনুভব করলো, প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রিয় মানুষের থেকে বেশি নয়। অধর কোনে হাসি ফুটে উঠে। ব্যক্তিগত মানুষ টি সত্যি ই অপরূপ হয়। যে সৌন্দর্য মানুষ কে পাগল অব্দি করে ফেলে। তাই বোধহয় মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।

ঝিলের কাছে এসে দাঁড়ালো অভিনব। স্রোতে ভাসার জন্য ঝিলের এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। পাথরে গায়ে ঠেস দিয়ে বসলো।
_ চোখ বন্ধ করো ঝিল।

_ কেন?

_ করোই নাহ।

ঝিল চোখ বন্ধ করলো। অতি সাবধানতার সাথে ঝিল কে কোলে তুলে নিলো অভিনব। স্রোতের পানি তে বেশ কিছুটা পথ নেমে আসলো। ঝিল অনুভব করছে পানিতে ভেসে যাচ্ছে। চোখ খুলতে যেতেই অভিনব বলল
_ একদম না। ভয় পাবে তাহলে ।

ঝিল চোখ খুললো না। অভিনবর শরীরে মিষ্টি সুভাসের সাথে স্রোতে ভাসা উহুহ প্রেমের স্রোতে ভাসতে লাগলো। স্বর্গীয় সুখ কেমন তা জানা নেই। তবে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে সেরা অনুভূতির একটি।

.

লাকমাছড়া থেকে সবাই বোটে ফিরে আসলো। টেকের ঘাট ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে খুব। তবু ও কিছু তো করার নেই। লাঞ্চের সময় পাড় হয়ে যাচ্ছে।বোট থামানো হলো হাওরের মাঝ খানে গাছের ছায়া তে। পানি এতো টাই পরিষ্কার যে পাকা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। ঝিল নামার জন্য বায়না ধরলো। অভিনব চেয়ে ও বারন করতে পারলো না। পরিশেষে ঝিল কে নিয়ে রোডে নেমে দাঁড়ালো। স্রোতের সাথে পানি তে থেকে রোড পিচ্ছিল হয়ে গেছে। একটু আগালেই পা পিচলে যাচ্ছে। তবু ওহ ঝিল হাঁটতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর টেনে ধরলো অভিনব।
_ আর এক সেকেন্ড ওহ না। লাঞ্চ করা হয় নি , এখন লাঞ্চ করবে।

_ আর একটু।

_ সব কিছু তেই আর একটু আর একটু করো কেন বলো তো ?

_ অভিনব প্লিজজজজ !

_ কিহহ ? রোম্যান্স করবে আসো কাছে ?

হা হয়ে যায় ঝিল। দ্রুত গতিতে চলে আসে। ভ্যাগা স্বরে বলে
_ অসভ্য ।

রোহনের ধরা বোয়াল মাছ দিয়ে লাঞ্চ হবে আজ। সব থেকে বেশি এক্সাইটেড রোহন। বোয়াল মাছ মুখে তুলেই বললো
_ সেরা।

_ মাছ টা তুমি না ধরলে এতো সেরা হতো না ভাই।

অভিনবর কথাতে সবাই হেসে দিলো। রোহন সে দিকে পাত্তা দিলো না। নিজের ধরা মাছ, মানেই অন্য রকম ভালোবাসা।
লাঞ্চে ছিলো ভাত , বোয়াল মাছ , সবজি , টাকি মাছ ভর্তা আর ডাল।

খাওয়া শেষে সকলে ছাঁদে বসে পরে। কেউ বা শুয়ে পরে। পড়ন্ত বিকেল হওয়াতে রোদ নেই। তাই বেশ ভালোই ভিউ দেখাচ্ছে। বোট চলছে তাহিরপুরের উদ্দেশ্য।
তাহিরপুরে যে পথ দিয়ে আসা হয়েছিলো এখন সে পথ দিয়ে ফিরছে না। অভিনব ই বলেছিলো হাওরের মানুষের জীবনযাত্রার এক ঝলক দেখতে চায়। তাই ক্যানেলের মধ্য দিয়ে বোট চলছে।
ছাঁদে বসে অভিনবর কাঁধে মাথা রেখে হাওরের শেষ চিত্র উপভোগ করছে ঝিল।শান্তি ময় এক জার্নি ছিলো এটা। যে জার্নি তে হারানোর ভয় নেই বরং ছিলো প্রাপ্তির সমীকরন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here