#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_49
দু পরিবারের মাঝে সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে মাস দুয়েক। নেই কোনো আড়ষ্ঠতা আর না আছে কোনো দ্বন্ধ। দুই এলাকার মানুষ যেন ধরে প্রান ফিরে পেয়েছে। খুনা খুনি না হলে ও রক্তারক্তি হয়েছে বহু বার। ভয়ে থাকতে হতো সবাই কে। মির্জা পরিবার আর শিকদার পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গেট টুগেদারের মাধ্যমে বিয়ের বিষয় টা ঘোষনা দিবে। তবে অভিনব বাঁধা দিয়ে বলেছে সে আর ঝিল প্রাকৃতিক সান্নিধ্যে পেতে চায়। যেহেতু সময় টা বর্ষাকাল আর গত বছরে হাওর যাওয়ার সুযোগ ছিলো না তাই তাঁরা সেখানে যাবে।
কেউ অবশ্য দ্বিমত করে নি। তবে কথা দিতে হয়েছে বিদেশ ভ্রমনের পূর্বে বিশাল গেট টুগেটার এটেন্ট করতে হবে তাঁদের । স্বাদরে গ্রহন করেছে অভিনব। ঝিল ও সম্মতি প্রকাশ করেছে।
ব্যাগ প্যাক গোছাচ্ছে অভিনব। এতোক্ষনের মৌনতা ভেঙে ঝিল পাশে এসে বললো
_ হাওর তো পরে ও যেতে পারতাম !
_ উহহুহ পরে যাওয়া যেতো না !
_ কেন ?
_ ভুলে গেলে বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওর এর আসল সৌন্দর্যের দেখা মিলে ?
_ সবাই কে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
ব্যাগ গুছিয়ে কাবাডে রেখে অভিনব নাছোড়বান্দা সুরে বলল
_ সেটা বললে তো হবে না। সংসারী হয়ে গেছো সেটা ভালো তবে ভ্রমন ছাড়া তো যাবে না। প্রকৃতির সান্নিধ্য না পেয়ে পাঁচ কেজি ওজন বাড়িয়ে 53 তে চলে এসেছো। কোলে নিতে অসুবিধা হয় মিসেস।
_ খোঁটা দিচ্ছো ?
_ উহহুহ খোঁটা কেন দিবো ? বউ কে খোঁটা দেওয়ার সাধ্য আমার আছে ?
মুখ বাঁকিয়ে নেয় ঝিল। সত্যি পনেরো মাসে পাঁচ কেজি ওজন বেড়ে গেছে। এটা মোটে ও ভালো কথা নয়। আচ্ছা সত্যি কি অভিনবর কষ্ট হয় ?
মুখে কাঠিন্য এনে বলল
_ আমাকে কখনো কোলে নিবে না আর !
_ কেন?
_ আমি যাকে তাকে কষ্ট দিতে চাই না !
_ ওকে !
অভিনবর নিদারুন উত্তরে খেপে গেল ঝিল। মাথার ট্রাওয়াল টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। অভিনব আড়চোখে দেখে হাসলো। ঘর থেকে বের হবে তাঁর আগেই অভিনব পথ আটকে বলল
_ কোথায় যাও ?
_ কোথাও না !
_ রাগ করেছো ?
_ নাহহ যাঁর তাঁর সাথে ঝিল রাগ করে না !
কালো কুচকুচে আঁধারে পূর্ণিমার দেখা মিলেছে। কাঁচের ভেতর দিয়ে রাতের পরিবেশ টাকে নির্মূল লাগছে। ঝিলের মোচরামোচরি উপেক্ষা করে কোলে তুলে নিলো অভিনব।
প্রচন্ড অবাকের সাথে অভিমান হলো মেয়েটার। অভিনব তাঁর ঝকঝকে হাসি দিয়ে বলল
_ প্রেম নাকি আঁধার ম্লান ?
_ কোনটাই নাহহ !
_ ওকে তোমার ইচ্ছে ।
অভিনব বেডের দিকে যেতেই খচখচ করতে লাগলো ঝিল। একটু আগে শপিং মল থেকে এসেছে প্রচন্ড ক্লান্ত সে। অভিনবর তাঁতে ধ্যান নেই। বাঁকা হেসে বলল
_ চয়েজ করার সুযোগ দিয়েছিলাম মিসেস। আপনি তা অবঙ্গা করেছেন এখন আমার চয়েজেই সন্তুষ্ট থাকুন।
_ নো অভিনব দেখো
ঝিল কে বলার সুযোগ দেয় না সে। আঁধার কে লজ্জায় ফেলতে বাধ্য করে। তাই তো পূর্ণিমার চাঁদ টা ও নুইয়ে যায় আকাশের বুকে। ভালোবাসার গহীনে ঝিল ওহ নুইয়ে যায় অভিনবর বুকে।
প্রকৃতির সাথে মানুষের বড্ড মিল।
.
সকাল সকাল দারুন এক খবরে লাফিয়ে উঠে ঝিল। ফোনের ওপাশ থেকে লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে মৌনতা। অতি লজ্জায় কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বেডের উপর হাঁটু গেড়ে বসে ঝিল। প্রচন্ড খুশি তে চোখ উজ্বল হয়ে গেছে। ততক্ষণে অভিনবর ঘুম ভেঙে গেছে। ঝিল এক পলক তাকিয়ে ফোনে মনোযোগ দেয়। আগ্রহীর স্বরে বলে
_ তারপর কি হলো ? ভাইয়া তোকে প্রপোজ করার পর তুই কি করলি ?
_ কি করবো এক্সসেপ্ট করে নিলাম।
_ বাহহ এতো কিছু হয়ে গেল আর আমি কিছু ই জানতে পারলাম না ?
_ কাল রাতে রোহন তোকে অনেক বার কল করেছে তুই ফোন তুলিছ নি।
দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটে ঝিল। লজ্জায় পরে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে
_ পাপা দের জানিয়েছিস তোদের কথা ?
_ আজ সকালে রোহন জানিয়েছে। আমি ও বাসায় জানিয়েছি। পজিটিভ উওর মিলেছে।
খুশি তে চিৎকার করে উঠে ঝিল। অভিনবর ভ্রু কুঁচকে যায়। ঝিল এতোটাই অন্যমনস্ক যে অভিনবর কোলে শুইয়ে পরে। একটু পর পর হাসছে সাথে অভিনবর গাঁয়ে চড় থাপ্পড়। ঝিলের কান্ডে অবাক হয় অভিনব। কথা শেষ হতেই থতমত খেয়ে যায় ঝিল।
নিজেকে ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। অভিনব এক ভ্রু নাচিয়ে হাসে , ঝিল সে হাসির মানে বুঝতে পেরে ছুট লাগায়।
*
ব্রেকফাস্টের টেবিলে মাথা নিচু করে খাচ্ছে ঝিল। অভিনবর জ্বালায় শান্তি মিলছে না। হাত দিয়ে না হয় পা দিয়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। এক সময় প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠে যায় সে। অভিনব মুচকি হেসে বলে
_ আমরা আজ রাতেই রওনা হবো। রোহন আর মৌনতা ওহ আমাদের সাথে যাচ্ছে। ঝিল কে কেউ জানিয়ে নাহ।
_ কয় দিনের জন্য যাচ্ছো তোমরা ?
_তিন রাত লাগবে পাপা।
_ আচ্ছা তাহলে আমরা সবাই ওহ তো ট্যুর দিতে পারি কি বলেন বড় ভাই ?
ইববান একটু রুটি মুখে পুরে নেন। ইচ্ছে যে তাঁর ও করছে। আহা কতদিন প্রকৃতির সাথে মিতালি গড়া হয় না।
লিটন আর মুজাহীদের দিকে তাকাতেই দুজন হাসি মুখে সম্মতি জানায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে হুলস্থর লেগে যায়। সবাই বেশ খুশি হয়। অভিনবর ইচ্ছে হলো পরিবারের সাথে যাওয়ার তবে এখন তা সম্ভব নয়। পরে যাওয়া হবে বলে নিজ মন কে সান্ত্বনা দিলো।
সবাই জায়গা সিলেক্টড করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অভিনব ল্যাপটপ হাতে খোঁজ লাগিয়ে বলল
_ তোমাদের জন্য কক্সবাজার বুকিং করলে কেমন হয় ?
সবাই সম্মতি জানায়। অভিনব কক্সবাজারের সমস্ত টিকিট কনফার্ম করে নেয়। ইববান মির্জা বাড়ি তে ও খবর পাঠান। তাঁরা ও সম্মতি জানান।
.
গালে হাত দিয়ে বসে আছে ঝিল। একটু আগে রোহনের সাথে কথা হয়েছে। রোহন জানিয়েছে ফ্যামিলি ট্যুর হচ্ছে। সবার সাথে যাওয়ার লোভ টা তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে। মাত্র ই রুমে এসেছে অভিনব। ঝিলের ভাব ভঙ্গি বুঝতে না পেরে বলল
_ কি হয়েছে ?
_ কিছু না !
_তুমি কি ডাইনিং এর বিষয় টা নিয়ে রাগ করেছো ?
_ উহহুহ।
_ তাহলে ? সমস্যা কি ?
ঝিল উত্তর দেয় না। অভিনব ব্যস্ত হয়ে পরে। ঝিলের পাশে বসতেই ঝিল ব্যগ্র কন্ঠে বলে
_ আমি যাবো না !
_ কেন ?
_ সবাই ফ্যামিলি ট্যুর এ যাচ্ছে । আমরা ও যাই সবার সাথে ?
_ ফ্যামিলির সাথে অন্য বার যাবো এবার একটু আলাদা ঘুরি ? শাকীল , মাহের আর অমিত কে কথা দিয়েছি আমি। ওরা ও তো যাবে আমাদের সাথে।
সচকিত হয় ঝিল । একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে
_ মাহেরা আপু যাবে না তো ?
_ আরে নাহহ।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অভিনবর বুকে মুখ গুঁজে দেয়। পর পর কয়েক টা নিশ্বাস ফেলে বলে
_ আমাকে নিয়ে সাঁতার কাটতে পারবে ?
_ অবশ্যই পারবো । মানছি 48 থেকে 53 কেজি তে চলে এসেছো বাট অভিনবর ক্ষমতা এতো টা ও ঠুনকো নয়।
মুখ বাঁকিয়ে নেয় ঝিল। হাতের সাথে অভিনবর শার্টের বোতাম গুলোর বন্ধুত্ব করে নেয়। পর পর বোতাম গুলো নিয়ে খেলছে সে। অভিনব কিছু বলে না । নির্লিপ্ত চাহনি তে ঝিলের খেলা দেখতে থাকে।
.
বাড়ির সবাই কে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় ঝিল। দীর্ঘ এক বছরের ও বেশি সময় এই বাসাতেই বসবাস। অনেক আপন হয়ে গেছে মানুষ গুলো। রাগ অভিমান সব কিছু ছাপিয়ে গড়েছে ভালোবাসা । প্রতি টা ইট ও যেন মনে গেঁথে গেছে। অভিনব সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে গাড়ি চলতে থাকে। সুনাম গঞ্জের হাওর দেখার জন্য মন কেমন করছে । অথচ ঝিলের মুড অফ। অভিনব এক পলক তাকিয়ে সামনের দিকে চোখ রেখে বলল
_ মন খারাপ কেন করছো ? হাওর সম্পর্কে কি কি বলেছিলাম মনে আছে ?
ঝিল মাথা ঝাঁকায়। অভিনব গাড়ির ব্রেক কষতেই ঝিল চমকে তাকায়। ব্যাক থেকে ক্যামেরা বের করে ঝিলের হাতে দিয়ে বললো
_দেখো ছবি গুলো কতো টা প্রাণোচ্ছল। মন খারাপের অবকাশ পাবে না।
ঝিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভরা পরিবার পেয়ে সব কেমন গুলিয়ে গেছে। একটু হাসি ফুটিয়ে হাওরের তীক্ষ্ম ছবি তে দৃষ্টি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এই অপরূপ সৌন্দর্য উপেক্ষা করার শক্তি ওর নেই। অভিনব হাসে , ভ্রমন প্রেমিরা এমনি হয় প্রকৃতি পাগল।
গাড়ি এসে থামে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড এ। গাড়ি পার্ক করে দিয়ে টিকিট কনফার্ম করে নেয় অভিনব। ঝিল একদম সেটে দাঁড়িয়ে আছে। যেন অভিনবর ভেতর ঢুকে যাবে। ওর এমন আচারনে কিছু মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখছে তাঁতে ওর কিছুই যায় আসে না। বাস ছাড়বে এগারোটায়। এখনো আধ ঘন্টা সময় আছে তাই দুটো চা নিয়ে নেয় অভিনব। ঝিল খাবে না বলে নাকোচ করে। অভিনব একটু হেসে বলে
_ আমি চা এনে দিলাম আর তুমি খাবে না ? এই যে এটা তে আমি স্পর্শ করে আছি , তা ও খাবে না ?
_ নাহ খাবো না।
_ সত্যি খাবে না ?
কথাটা এতো টাই আবেগ মাখা যে ঝিল নুইয়ে যায়। ফোঁস মেরে চায়ের কাপ টা নিয়ে নেয়। একটা বেঞ্চে উঠে বসে ফু দিয়ে চা খেতে থাকে। প্রচন্ড হাসি পেলে ও হাসে না অভিনব।
দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটার আর কিছু ক্যান্ডি নিয়ে আসে।
এগোরাটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে সবাই বাসে উঠে বসে। অভিনব আর ঝিল মাঝামাঝি বরাবর সিট পেয়েছে। অবশ্য এতে কোনো সমস্যা নেই আর না আছে আগের বারের মতো আড়ষ্ঠতা। শিষ বাজিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। জানালা গলিয়ে মৃদু অন্ধকার ঝিলের তুলতুলে গাল কে ছুঁইয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো যেন ঝিলের সৌন্দর্য শতগুন বাড়িয়ে ছে । ওষ্ঠাধরের মাঝে ফাঁক রেখে নির্লিপ্ত চেয়ে আছে অভিনব। মোহে মোহিত সে , হঠাৎ করে তাঁর উষ্ণ হাতের আঙুলি ছুঁইয়ে দেয় ঝিলের গালে। কেঁপে উঠে ঝিল , সাথে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নেয়।
ঝিলের ভয়ার্ত চাহনি লক্ষ্য করে তাকায় অভিনব। বিষয় টা বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে ফেলে। ঝিলের কাঁধে মাথা রেখে নিম্মস্বরে বলে
_ রাত বাড়লে লাইট কিন্তু অফ হয়ে যাবে তখন নিজেকে গুটিয়ে নিলে খবর আছে।
_ হুমকি দিচ্ছো ?
_ আলবাত দিচ্ছি। বউ হলো ভালোবাসার মাধ্যম। যখন তখন ভালোবাসবো তাঁতে তোমার কি ?
এক গাল হাঁসে ঝিল। অভিনবর বাহু তে চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে। ঘুমানোর জন্য লাইট অফ করে দেওয়া হয়। ঝিল লজ্জায় নুইয়ে যায়। অভিনব একটু হেসে ঝিল কে বুকে জড়িয়ে নেয়। কিছু প্রেম ময় অনুভূতি নিয়ে কেঁটে যায় অনেক টা সময়। দু জনের কেউ ই ঘুমাতে পারে না। অভিনবর শার্ট খামচে ধরে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ঝিল। অদ্ভুত শিহরন জাগছে, অভিনব একটু নড়েচড়ে উঠে। ঝিল ভ্রু কুটি করে শুধায়
_ কি হয়েছে ?
_ ঘুম তো আসছেই না , তাই ভাবলাম কফি খাওয়া যাক ?
অবিশ্বাসের চোখে তাকাতেই অদ্ভুত হাসে অভিনব। ব্যাক প্যাক থেকে ইলেক্ট্রনিক ফ্লাক্স বের করে পানি গরম করে নেয়। তাঁতে কফি পাউডার মিক্স করে সামান্য পরিমান বাদামি চিনি দিয়ে নেয়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঝিল। অভিনব পাক্কা ট্রাভেলার্স । একটা ছোট ব্যাক প্যাকে এতো কিছু রাখে যা ধারনার বাইরে। হঠাৎ করেই ডোরেমনের ম্যাজিক্যাল পকেটের কথা মনে পরে গেল। যার মাঝে পুরো পৃথিবী কে লুকিয়ে রাখা। উচ্চশব্দে হেসে উঠে। অভিনবর শক্ত পোক্ত হাত ঝিলের ঠোঁট আটকে দেয়।
নিজের আচারনে অভিনব নিজে ও কেঁপে উঠে। ঘোর লাগা চোখে একটু করে এগিয়ে যায়। ঝিলের কম্পমান শরীর কে কাছে টেনে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
চলবে