#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_30
ঝিল পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে। বিস্ময়ে অবাক সবাই। কেউ আগাতে সাহস পাচ্ছে না। ঝিল অভিনব যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে এসে দাঁড়ালো । চারপাশে উদভ্রান্তের মতো চোখ বুলাতে লাগলো। কোথাও অভিনব কে দেখতে পাচ্ছে না। বুকের ভেতর চিন চিন ব্যাথা অনুভব হলো। অভিনব কে হারিয়ে ফেলার নীল ব্যাথা ওকে স্তব্ধ করে দিলো।
আলগোছে মাটিতে পরে গেল। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা।
ঝিল হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। অভিনব বলে চিৎকার করে উঠলো। পাগলামির শীর্ষে চলে গেছে। নিজের চুল গুলো নিজেই খামচে ধরে রাখলো। পাগলের মতোই দেখাচ্ছে ওকে।
_ ঝিল, ঝিল
মৃদু শব্দে ঝিল কেঁপে উঠলো। চোখ মুখ মুছে নিয়ে আশে পাশে চোখ বুলালো। অভিনবর কন্ঠস্বর ছিলো ঐ টা ? ঝিল এতোটাই জ্ঞান হীন যে অভিনবর নাম ধরে ডাকতে ও ভুলে গেল। শুধু পাগলের মতো আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলো।
মাথার নিউরন গুলো বোধহয় কানে পৌছাচ্ছে না। বাঘের হালকা গর্জনে ও ঝিলের কর্নপাত হলো না।
হঠাৎ এক শক্ত পোক্ত হাত ওকে টেনে জঙ্গলে নিয়ে নিলো। ঝিলের চোখ দুটো ছলছল করছে। অস্ফুটন স্বরে বলল
_ অভিনব আপ
ঝিলের ঠোঁটের কাছে আঙুল দিয়ে অভিনব বলল
_ হুসসস।
ঝিল দমে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অভিনবর দিকে। কি শান্তি এই মুখ টাতে। একটু আগে যে ব্যথায় জর্জরিত ছিলো। সে ব্যাথা টা নিমেষেই উধাও। অভিনব লক্ষ্য করলো কিছু দূরে বাঘ টা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিকার হারিয়ে ফেলায় ক্রুদ্ধ সে। অভিনব পায়ের কাছে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে একটু দূরে মাটির চাকা দেখতে পেল। একটু ঝুঁকে ঝিলের কানে ফিস ফিস করে বলল
_ এখানেই দাঁড়ান ,আমি আসছি ।
_ অভিনব
_ আসছি আমি।
অভিনব চলে গেল। নিঃশব্দে মাটির চাকা টা উঠিয়ে ঝিলের দিকে ফিরে আসলো। ঝিলের মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে হাসলো। ঝিল অশ্রু ভেজা নয়নে তাকিয়ে আছে। চোখের পাপড়ি গুলো নোনা জলে ডুবে আছে। তবু ও মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে । ঠিক যেন সদ্য পানি থেকে উঠা পদ্মফুল। যার মুখে বিন্দু বিন্দু পানি কনা লেগে আছে।
অভিনব চোখ ফিরিয়ে নিলো । কিন্তু ঝিলের কোনো পরিবর্তন নেই। তার চোখ অভিনব তে আটকে গেছে। অভিনব চোখ ঘুরিয়ে আশে পাশে তাকালো। সুযোগ বুঝেই বেশ জোরে মাটির চাকা টা ফেলে দিলো। মাটির চাকা টা উল্টো দিকের ঝোপঝাড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দ তুললো। সঙ্গে সঙ্গে বাঘ টা সে দিকে হুমড়ি খেয়ে পরলো। ভয়ঙ্কর গর্জনে পরিবেশ ভারী হয়ে গেল।
অভিনব ঝিলের মাথা টা বুকে চেপে ধরে নিচু হয়ে বসলো। চোখ দুটো এদিক ওদিক ঘুরে চলেছে।
মিনিট পাঁচেক পর অভিনব স্বস্তির দম ফেললো। অভিনবর ভারী নিশ্বাসের শব্দ ঝিলের কানে এসে লাগলো। তাতেই ঝিলের ধ্যান ফিরলো। ঝিল উঠে দাঁড়ালো। অভিনব ঝিলের দিকে ঘুরে তাকাতেই ঝিলের দু চোখ দেখে থমকে গেল। মেয়েটার চোখ দুটো থেকে অনড়গল নোনা জলের ফোয়ারা চলছে। অভিনবর বুক টা ভারী হয়ে গেল। চাঁপা কষ্টে অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগলো। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারলে ভালো লাগতো। ঝিল কাঁপা হাত টা অভিনবর বুকে রাখলো। সারা শরীরে হাত বুলাতে লাগলো। মানুষ টা সত্যি ই কি তাঁর সামনে দাড়িয়ে আছে? নাকি সব ভ্রম।
হঠাৎ করেই ঝিল দূরে সরে গেল। মাথা চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। অভিনব বিস্ময়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ঝিলের দিকে এগিয়ে আসতেই ঝিল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা হাতে ঝিলের মাথায় হাত বুলিয়ে অভিনব বলল
_ আমি ঠিক আছি ঝিল। আপনি কেন পাগলামো করছেন বলুন তো ? তখন যদি আপনার কিছু হয়ে যেত। সেটা কি খুব ভালো হতো ?
_ আমি আমি আমি অভিনব আমি
_ হ্যাঁ আপনি ?
_ জানি না আমি । কিচ্ছু জানি না। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করে থাকবো ?
বলুন কেন চলে আসলেন এখানে ? একটি বার আমার কথা মনে আসলো না ?
ঝিল কথা গুলো চিৎকার করে বলে কাঁদতে লাগলো।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ঝিল কে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো অভিনব । ঝিল নাক টেনে কাঁদছে ।
_ ঝিল এভাবে কাঁদে না। পঁচা মেয়েরা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে। দেখি দেখি তো
অভিনব ধীর হাতে ঝিলের মাথা উঁচু করলো। ঝিল নাক টেনে তাকালো। আবার কেঁদে উঠলো। দু হাতে অভিনব কে জড়িয়ে ধরলো। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল
_ আমি আপনাকে ছাড়বো না আর। একদম দূরে যাবেন না আমার থেকে।
_ যদি কেউ নিয়ে যায় ?
_ দিবো না আমি কাউকে। আমার
ঝিল থেমে গেল । অভিনব ভ্রু নাচিয়ে বলল
_ আপনার কি ?
_ কিছু না।
ঝিল পেছন ঘুরতেই অভিনব টেনে কাছে নিয়ে আসলো। একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল
_ মাহেরা কিন্তু নিয়ে যাবে তখন কি হবে ?
_ আমি কি করে জানবো ? আর তাতে আমার ই বা কি?
_ আপনার কিচ্ছু যায় আসে না ?
_ উহুহ
অভিনব বাঁকা হাসলো। ঝিল কে এক হাতে জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার প্রায়। অভিনব ঝিল কে নিয়ে ঝোপ থেকে বেড়িয়ে পরলো। প্যান্ট এর পকেট থেকে লাইটার বের করলো। লাইটার টা সুইচ সিস্টেম খানিকটা টচ এর মতোই ।
মৃদু আলো তে ঝিলের দিকে তাকালো। লেপ্টে থাকা চুল গুলো কানের কাছে গুঁজে দিতে দিতে বলল
_ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে ঝিল । এই যে চোখের কোনে লেপ্টে থাকা শুকনো নোনা জল । উজ্জল মুখ টায় চিন্তার ছাঁপ । লেপ্টে থাকা কাজলের ছোঁয়া । সব মিলিয়ে কেমন বউ বউ লাগছে।
ঝিলের চিত্ত কেঁপে উঠলো। অভিনবর জ্যাকেট খামচে ধরলো। অভিনব নিঃশব্দে হেসে বলল
_ তাঁতে আমার কি ? আমি তো মাহেরার ই হয়ে যাবো।
অভিনবর কথাতে ঝিল ভ্রু কুঁচকে নিলো। কনুই দিয়ে পেটে গুঁতো মেরে বলল
_ আগে আমাকে তালাক দিন তারপর মাহেরার গলায় ঝুলে পরবেন কেমন ?
_ ঝিল
_ কি ?
_ আপনার তালাক চাই ?
ঝিল তখনি উত্তর দিতে পারলো না।বেশ কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। কিন্তু উত্তর মিললো না। অভিনব ঝিল কে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই মাহেরার কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
বিরক্তি তে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। সাথে সাথে আরো অনেকের ডাক শোনা গেল। অভিনব তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল
_ তাড়াতাড়ি চলুন। সবাই আমাদের খুঁজে চলেছে।
ঝিল মাথা ঝাঁকালো । অভিনব এক হাতে ঝিলের হাত চেপে ধরে আগাতে লাগলো।
*
মৃদু লাইটের আলোর আভাস পেয়েই সবাই ছূটে গেল সে দিকে। অভিনব ঝিলের হাত ধরে হেঁটে আসছে। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। অভিনব লম্বা করে হাসতেই সবাই এসে এটা ওটা প্রশ্ন করতে লাগলো। অভিনব উত্তর দিলো না। সবার এতো এতো প্রশ্নে ঝিলের ভ্রু বেঁকে গেছে। অভিনব ব্যাথাতুর কন্ঠে শান্ত দৃষ্টি রেখেই বলল
_ জঙ্গল থেকে বের হয়ে বলি ?
সবাই আর কথা বাড়ালো না। হাঁটা লাগালো । পাঁপড়ি এসে ঝিল কে জড়িয়ে ধরলো। হাত বুলিয়ে বলল সে ঠিক আছে কি না ? প্রতি উত্তরে ঝিল শুধুই মুচকি হাসলো। সবাই সাড়ি বদ্ধ হয়ে হাঁটছে । ঝিল পাঁপড়ির সাথেই হেঁটে যাচ্ছে।
_ আর ইউ ওকে অভিনব ? তুমি জানো আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম ?
_ আম ওকে মাহেরা ।
_ কোথাও ব্যাথা পেয়েছো দেখি তো।
অভিনব হাত উঁচু করে বাঁধা দিলো । কৃতঙ্গতার চোখে বলল
_ আমি ঠিক আছি মাহেরা।
মাহেরা তবু ও শুনলো না । অভিনবর হাত ধরে দেখতে লাগলো। অভিনব বিষয় টা হজম করতে পারছে না। মাহেরার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বলল
_ তুমি সামনে গিয়ে হাঁটো। আম ফাইন নাও ।
মাহেরা মাথা ঝাঁকিয়ে অভিনবর থেকে দূরে স্বরে গেল।
*
কটকা থেকে সবাই বোর্ট এ উঠে বসলো। একে একে সবাই অভিনব কে প্রশ্ন ছুঁড়লো। অভিনব লম্বা করে দম নিয়ে সেই সময়ের ঘটনা বর্ননা করতে লাগলো।
অভিনব বাঘের আক্রমণের অপ্রস্তুত থাকলে ও নিজেকে সামলে নিয়েছিল। বাঘ টা খাবলে পরার আগেই খানিকটা টা ছিটকে দূরে সরে গেল। বাঘ টা গড়ান গাছের সাথে হালকা বারি খায় আর একটু নড়চড় করে উঠে। অভিনব সেই সময় টা তেই নিজেকে সামলে নেয়। তবে পকেট থেকে লাইটার দিয়ে একটু আগুন জ্বালিয়ে ছিলো তবে বনের ভেতরে আগুন জ্বালালে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশংকা থাকে । তাই অভিনব সেটা ও সরিয়ে নিলো। বাঘ টা আবার ঝাঁপিয়ে পরলো। অভিনবর কান ঘেঁষে একদম। তবে অভিনব দ্রুত লুকিয়ে পরেছিলো। তাই বাঘ টা উম্মাদের মতো বিহেভ করতে থাকে। কারন সে তার স্বীকার হারিয়েছে। তারপর পর ই ঝিল চলে আসে।
অভিনব এক দমে কথা গুলো বললো।অমীত ছেলে দুটো কে বেঘোরে বকতে লাগলো । কারন শুধু মাত্র তাদের জন্য ই অভিনবর এতো বড় বিপদ হয়েছিলো। অভিনব সবাই কে থামতে বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিলো।
ঝিল অভিনবর এক বাহু ধরে বসে আছে। যেন ছেড়ে দিলেই অভিনব কোথাও পালিয়ে যাবে । ঠোঁট খানা প্রশস্ত করে হাসলো। ঝিলের চোখ বন্ধ করা , বোধহয় কোনো কিছু নিয়ে বিশাল গবেষণা চালাচ্ছে ।
অভিনব ধীর হাতে ঝিল কে জড়িয়ে ধরলো। মৃদু আলো তে তা স্পষ্ট দেখতে পেল মাহেরা। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। অভিনব ঝিল কে জড়িয়ে আছে ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। হঠাৎ করেই মাহেরা চলন্ত বোর্ট থেকে পানি তে পরে গেল।
অভিনব সে দিকে হা হয়ে তাকালো । সবাই চিৎকার করে উঠলো। মাহেরা হাত পা নাড়ছে বাঁচার জন্য। অভিনব দেরি করলো না আর পানি তে ঝাঁপ দিয়ে পরলো। কারন সে একদম কর্নারে ছিলো।
মিনিট পাঁচেক পর মাহেরা কে এক হাতে জড়িয়ে বোর্ট এর কাছে ফিরলো অভিনব । সবাই টেনে মাহেরা কে উঠালো।
শাকীলের সাহায্য নিয়ে বোর্ট এ উঠে বসলো অভিনব।
মাহেরার জ্ঞান প্রায় যায় যায় অবস্থা । সবাই মাহেরা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।
শুধু মাত্র একজন ই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আর সে হলো ঝিল।
মাহেরার বিষয় টা তাকে ভাবাচ্ছে। মাহেরা কি ইচ্ছে করেই পরে গিয়েছিলো। ঝিল আর ভাবতে পারছে না। অসহ্য লাগছে তাঁর । অভিনবর মানসিকতায় বিরক্ত সে।
অতিরিক্ত মনুষ্যত্ব ঝিল কে ক্রুদ্ধ করে দিয়েছে।
ঝিল এক পলক তাকালো। অভিনব মাহেরার হাতে মালিক করে যাচ্ছে। ঝিল আর তাকাতে পারলো না।
চাঁপা কান্নায় ভেঙে পরলো। এতো কেন কষ্ট হচ্ছে তাঁর?
জীবন বড্ড নাটকীয়। এক মুহূর্তের জন্য ঝিলের মনে হয়েছিল অভিনব শুধু তাঁর। কিন্তু এখন সব কিছুই মানবিকতা মনে হচ্ছে।
মিনিট দশেক পর মাহেরার পূর্ন জ্ঞান ফিরলো। মাহের বোন কে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কারন এখন বেশি কিছু ভাবলে মাথায় চাপ পরবে। আর তাঁতে মানসিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
অভিনব ফোঁস করে দম ফেলল । সম্পূর্ন ভিজে একাকার সে।
_ মাহের ব্যাগে এক্সট্রা কাপড় থাকলে মাহেরার শরীরে জড়িয়ে দাও।
ঠান্ডা বাড়ছে , পরে অসুস্থ হয়ে পরবে।
মাহের সম্মতি জানালো। অভিনবর প্রতি কৃতঙ্গতার দৃষ্টি রাখলো । অভিনব শুধু হাসলো ।
মিনিট খানেক পর ঝিলের পাশে এসে বসলো। স্বস্তির দম ফেলে ঝিলের দিকে তাকালো অভিনব । কিন্তু ঝিলের দৃষ্টি অন্যদিকে। অভিনব ভেবেছিলো ঝিল এখন তাঁকে ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর নানা পাগলামো করবে ।
কিন্তু কিছুই করলো না। অভিনব খানিক টা কষ্ট পেল।
চলবে