#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_12

পশুর নদীর উপর দিয়ে বোর্ট চলছে তার নিজ গতিতে।
নদীর স্রোত বরাবরের মতোই উথাল। তাই এখানে আসতে হলে ভালো ইঞ্জিনের বোর্ট এ আসা উচিত।
করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত।
বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে প্রায় 8 কিলোমিটার দূরে 30 হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্র টি গড়ে তোলা হয়েছে।
মংলা থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় পর্যটন কেন্দ্রে পৌছাতে এক থেকে দেড় ঘন্টা লাগে।
যেহেতু ওরা খুলনার জেলখাটা ঘাট থেকে এসেছে তাই ওদের পৌছাতে এতো বেশি সময় লাগছে।
সাধারন বড় বড় আর রাত্রি যাপনের ট্যুর গুলো জেলখানা ঘাট থেকেই ছাড়া হয়।
কিছুক্ষণের মাঝেই করমজলে এসে বোর্ট থামলো।
ট্যুর নির্দেশক কিছু নির্দেশনা দিয়ে সবাই কে নিয়ে নেমে গেলেন।
অভিনব লম্বা করে দম ফেললো। ঝিল খুব বেশি ই উৎফুল্ল হয়ে আছে।
অভিনব মুচকি হেসে ঝিল কে নিয়ে এগিয়ে গেল। ঝিল অভিনবর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
মাহেরা নামের মেয়েটি অভিনবর দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে।
ঝিল সে দিকে না তাকিয়ে পরিবেশ টা উপভোগ করতে লাগলো।
সুন্দরবন ভ্রমনের স্বাদ নিতে চাইলে করমজলে আসা বাহুল্য । প্রকৃতির সোভা বাড়াতে এখানে রয়েছে কুমির হরিন , রেসাস বানর সহ নানা প্রজাতির পশুপাখি।
এছাড়াও নির্মিত রয়েছে কাঠের ট্রেইল , টাওয়ার এবং জেলেদের মাছ ধরার কর্মযজ্ঞ হচ্ছে অতিরিক্ত প্রাপ্তি।
করমজলে বাংলাদেশের একমাত্র কুমিরে প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র অবস্থিত।

করমজলে প্রবেশের জন্য নিদিষ্ট টিকিট মূল্য রয়েছে। সাধারনত ট্যুর কোম্পানির প্যাকেজেই এই সকল টিকিট মূল্য দেওয়া থাকে ।
বাংলাদেশি ও বিদেশী পর্যটক দের জন্য অর্থাৎ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তির করমজল পর্যটন কেন্দ্রের প্রবেশ মূল্য যথাক্রমে 20 এবং 300 টাকা।
অবশ্য দশ বছরের কম বয়সী শিশুদের টিকিট মূল্য দশ টাকা।
অভিনব জন্মসূত্রে আমেরিকান আর বাংলাদেশী নাগরিকত্বর সার্টিফিকেট না থাকাতে অভিনব একজন বিদেশী পর্যটক।
অগত্যা অভিনব কে এক্সট্রা টাকা পেমেন্ট করতে হলো।

অনেকেই ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এসেছে যার জন্য ও এক্সট্রা পেমেন্ট করতে হলো।
পার ক্যামেরা প্রতি বাংলাদেশি দের 200 টাকা এবং বিদেশীদের 300 টাকা।
সকল মূল্যের সাথে 15% ভ্যাট প্রযোজ্য।

শাকীল হাসতে হাসতে বলল
_ অভিনব বাঙালি হয়ে ও তুমি হইলা না বাঙালি। তোমাকে বেশি ই পেমেন্ট দিতে হবে।

অভিনব মুচকি হেসে কপালে স্লাইট করে দেখালো।
যার অর্থ সবই কপাল। অভিনবর এমন কান্ডে ঝিল মুচকি হাসলো ।

সবাই করমজলের ইটের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো।
ঝিল কাঁধের ব্যাগ টা টেনে নিলো। অভিনব হালকা হেসে বলল
_ কোনো সমস্যা হচ্ছে ?

ঝিল মাথা ঝাঁকালো। অভিনব আশে পাশের কিছু ভিউ তুলতে লাগলো।

সামনে বেশ অনেক গুলো বানর দেখতে পেল। ঝিল ভয় পেয়ে অভিনবর হাত খামচে ধরলো।
ঝিল বরাবর ই বানর কে বেশ ভয় পায়। একবার ওর কাঁধে চরে বসেছিল । এ কথা ভাবতেই ঝিলের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। বার বার শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো।
অনেকে বানর গুলো কে খাবার খাওয়াচ্ছে। অভিনব ঝিলের এক হাত শক্ত করে ধরলো। আশ্বস্ত করে বলল
_ আরে আসুন কিছু বলবে না। সবাই কেমন খাবার খাওয়াচ্ছে। আপনি ও আসুন।

_ নাহ নাহহ আমি যাবো না। আমি শুনেছি বানর কাঁধে চরে চুল খামচে ধরে।
সমস্ত উঁকুন না খেয়ে উঠে না।

_ ঝিল কি সব বলে যাচ্ছেন । আচ্ছা আমি নিয়ে যাচ্ছি কেমন , আসুন আমার সাথে।

ঝিল নাছোড়বান্দা, অভিনব ঝিলের সাথে পেরে না উঠতে পেরে লম্বা করে শ্বাস ফেলল। আশে পাশে তাকিয়ে বলল
_ এখানে শপ কোথায় বলুন তো ?

ঝিল কাঁপা স্বরে উত্তর দিলো ঐ যে আপনার পেছন দিক টায় মুদি দোকান। অভিনব ভ্রু কুঁচকে নিলো। ঝিল প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তে তাকালো। অভিনব খানিক টা চিন্তিত হয়ে বলল
_ মুদি ইউ মিন মোদী , আমি তো জানি ওনি ভারতের প্রাইম মিনিস্টার।
ওনার নামের সাথে আবার শপ এড করা আছে ?

_ ধ্যাত সেটা বলি নি ঐ যে দোকান, ঐ টাকে ই মুদি দোকান বলে ।
এতো কিছু জানেন এটা জানেন না।

অভিনব ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগলো। মেয়েটা বেশ রেগে গেছে। ঝিল কে নিয়ে রুটি কিনে নিয়ে আসলো ।
সবার মতো অভিনব ও বানর কে খাওয়াতে লাগলো।
ঝিলের বেশ মজা লাগলো বিষয় টা। সামনে খাবার দিলেই কেমন খাবলে নিচ্ছে বানর গুলো।
অভিনবর পাশে গিয়ে ঝিল বলল
_ আমি ও খাওয়াবো।

অভিনব নিঃশব্দে হাসলো। ঝিল একটু রুটি নিতেই তিনটে বানর লাফিয়ে উঠলো।
ঝিল রুটি ফেলে চিৎকার করে উঠলো।
ঝিল কে দৌড়াতে দেখে একটা পাজি বানর ঝিলের পেছনে লেগে গেল।
ঝিল চেঁচাতে লাগলো।
_ অভিনব হেল্প প্লিজ হেল্প ।

অভিনব দ্রুত গিয়ে ঝিল কে ধরলো। একটু দূরে রুটি ফেলতেই বানর চলে গেল।

অভিনব হো হো করে হেসে উঠলো। ঝিল ছলছল চোখে তাকালো। সবাই ওর ভয় পাওয়া দেখে হাসছে। অভিনব ঝিলের চোখের পানি দেখে হাসি থামিয়ে দিলো।
পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ঝিলের চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।
ঝিল পাথরের মতো চেয়ে রইলো। অভিনব প্রশস্ত হাসলো।
_ কাঁদছেন কেন ? সবাই মজা পেয়ে হেসেছে আপনাকে বিদ্রুপ করে নয়। বানর ভয় পেতেই পারেন।
সবাই তো সব কিছু তে ব্রেভ হয় না।

_ কিন্তু অভিনব

_ কোনো কিন্ত নয় চলুন আমার সাথে। ব্রেভ গাল এতো গুলো বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছেন তাতে চোখে পানি নেই। আর আজ এই সামান্য বিষয়ে।

ঝিল লজ্জা পেল। অভিনব সেই ফাঁকে একটা ছবি ক্লিক করে নিলো।
যাহহ ঝিলের অজানা।

আরেকটু হেঁটে আসতেই সবাই দেখতে পেল একটু দূরেই বেশ অনেক গুলো হরিন রাখা আছে। যাদের চারপাশে শিক দিয়ে বাধাই করা দেয়াল।
যার কারনে পর্যটক রা হরিনের আদর করতে পারবে।
ঝিল চকচকে চোখে তাকিয়ে অবিশ্বাসের কন্ঠে বলল
_ অভিনব ঐ গুলো কি হরিন ?

_ হ্যাঁ।

ঝিল লাফিয়ে উঠলো। অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে অভিনবর হুডির হাতা খামচে ধরলো।
অভিনব এক পলক তাকিয়ে ঝিলের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। মেয়েটার হুস জ্ঞান ঠিক নেই কোথায় না আবার চলে যায় । ঝিল বকবক করেই যাচ্ছে হঠাৎ চোখ পরলো মাহেরার দিকে।
মাহের ওদের দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। ঝিল গলা ঝেরে নিলো ।
_ আপনাকে মাহেরা পছন্দ করে ?
_ আমাকে বললেন ?
_ হুহহ
_ না তেমন কিছু তো নয়। কিন্তু কেন বলুন তো?
_ না এমনি ।

অভিনব সন্দিহান চোখে তাকালো । ঝিল মুখ টা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে।
অভিনব ফ্যাল ফ্যাল করে সাইডে তাকালো। মাহেরা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অভিনবর সাথে চোখাচোখি হওয়াতে মৃদু হাসলো। অভিনব ও হাসলো। সেটা দেখে ঝিল একটু ভ্রু কুঁচকে থেকে অভিনবর থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেল।
অভিনব ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো।
হরিনের কাছে এসে সবাই নানান পোজে ছবি তুলছে।
ঝিল কে আশে পাশে খুঁজতে লাগলো। কাছে তো নেই।
কোথা থেকে মাহেরা এসে বলল
_ হে অভিনব। তোমাকে তো দেখাই যায় না।

অভিনব মুচকি হাসলো। মাহেরা জ্বিভ কেঁটে বলল
_ সরি তুমি বলে ফেললাম।

_ ইটস ওকে। তুমি করেই বলতে পারেন।

_ থ্যাংকস। তাহলে তুমি ও আমাকে তুমি করে বলো।
আমি তো তোমার থেকে বেশ ছোট।

অভিনব মুচকি হেসে সায় জানালো। মাহেরা বেশ কিছু প্রশ্ন করছে অভিনব সরল হেসে তার উত্তর দিচ্ছে।

_ অভিনব ঝিল কি তোমার গালফেন্ড?
বিকজস তোমরা তো একি কেবিনে থাকছো।

_ নো। সি ইজ মাই জাস্ট ফ্রেন্ড ।
আমাদের দেড় বছর আগে প্রথম দেখা হয়েছিল একটা ভেজালে। তারপর আবার এই ট্রিপে এসে দেখা হলো, আর দুজনেই জ্বালিয়াতির স্বীকার।
আলাদা কেবিন ছিলো না তাই একটা তেই ম্যানেজ করতে হচ্ছে।
ওনাকে একা ফেলে রাখা তো সম্ভব নয়।

মাহেরা হালকা হাসলো। বোধহয় অভিনবর উত্তরে তৃপ্ত সে। অভিনব হরিনের কিছু ফটো ক্লিক করলো।
লোহার পাত গুলোর মধ্যে দিয়ে হাত বাড়াতেই হরিন এসে দাঁড়ালো ।
অভিনব হরিন গুলো কে হাত দিয়ে আদর করতে লাগলো।
হরিন কিংবা কুমির দের খাবার দেওয়া নিষেধ । কারন এতে কেউ ভেজাল মিশিয়ে দিলে পশু গুলোর ক্ষতি হয়ে যাবে ।

মাহেরা আফরা কে ডেকে নিলো। অভিনব কে উদ্দেশ্যে করে বলল
_ আমাদের কিছু ছবি ক্লিক করে দিবে প্লিজ।

অভিনব সবিনয়ে ফটো ক্লিক করতে লাগলো। মাহেরা অভিনবর সাথে দু একটা সেলফি ও নিলো।
ঝিল অন্য দিক দিয়ে হরিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
বেশ কিছুক্ষণ কথা ও বলেছে। পশু পাখির সাথে একা একা কথা বলার মতো দারুন এক অভ্যাস রয়েছে তার।
হরিন কিছু না বুঝুক ওহ ওর মতো বকেই যাচ্ছিলো।
এক পর্যায়ে রটের ফাঁক দিয়ে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে নিলো।
অভিনবর শরীর ঘেঁষে ছবি তুলছে মাহেরা।
এই মেয়েটার এমন ঢলাঢলি পছন্দ হচ্ছে না ওর।
কেন জানি ভীষন কান্না পাচ্ছে।মাহেরার চুল গুলো ছিড়তে পারলে শান্তি পেত ওহ।

ঝিল এক পা দু পা করে অভিনবর পাশে এসে দাঁড়ালো । মাহেরা লম্বা হেসে বলল
_ হে ঝিল কোথায় ছিলে তুমি ? আমরা সবাই কতো গুলো ফটো তুললাম।

ঝিল ভদ্রতার খাতিরে হেসে বলল
_ আসলে আপু সব জায়গার আবহাওয়া আমার সহ্য হয় না তাই একটু ঐ দিকে গিয়েছিলাম।
কিন্তু তা ও শান্তি মিললো না।

মাহেরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো। অভিনব ঝিলের এমন কথা তে ওর দিকে একপলক তাকালো। মাহেরা কিছুক্ষণ ভেবে বলল
_ হোয়াট এভার । চলো সবার একটা সেলফি হয়ে যাক।

_ নাহহ নাহহহ ঠিক আছে।

আফরা এগিয়ে এসে বলল
_ এটা কেমন কথা ঝিল ? চলো সবার একটা স্মৃতি ফ্রেমে বন্দি করে নেওয়া যাক।

_ আপু

_ ঝিল একটা ছবি তুলতেই পারেন। সবাই এতো করে বলছে যখন।

ঝিল অভিনবর দিকে একপলক তাকালো। অভিনবর দৃষ্টি ক্যামেরা তে। সবাই মিলে একটা সেলফি তুলেই নিলো।
ট্রাভেল এজেন্সি থেকে একজন কর্মকর্তা সবাই কে ডেকে পাঠালেন।
সবাই এক সাথে হয়ে কয়েকটি ছবি তুলে নিলো । মাহেরা অভিনবর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো । ঝিল সরে যেতে নিলেই অভিনব হাত চেঁপে ধরলো।
ঝিলের চোখ দুটো কেমন ছলছল করছে। অভিনব কিছুক্ষণ ঝিলের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ঠিক সেই সময়েই ফটো ক্লিক হলো। সুন্দর এক ফটো ক্লিকে আত্মার সম্পর্ক বন্দি হয়ে গেল।
অথচ দুজনের কেউ ই বিয়ে টাকে মেনে নেয় নি।
ভাগ্যে কখন কি করে দিবে তা কেউ বলতে পারবে না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here