‘ধূম্রজাল’
সূচনা পর্ব
লিখনে : তাবিনা মাহনূর
________
‘গত রোববার বিকেল থেকে ডক্টর শামসুজ্জামান তোহা নিখোঁজ ছিলেন। পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে তার পরিবার জানালে তদন্ত কমিটির সাহায্যে আজ ভোরবেলা তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওসি গালিব আখতার জানান, দুদিন যাবৎ তারা ডক্টর তোহার রিসার্চ সেন্টার এবং তার কর্মস্থলগুলোতে খোঁজ করে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে আজ ভোরবেলা তোহা রিসার্চ সেন্টারে ডক্টর তোহার নিজস্ব কেবিনের গোপন কক্ষে তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে…’
সকাল সকাল তাজা খবর শুনতে সাখাওয়াত খুব ভালোবাসেন। তাই এক হাতে খবরের কাগজ, অন্য হাতে করলার শরবত এবং সম্মুখে টেলিভিশন না চললে তার পুরো দিন মন্দ কাটে। ডায়াবেটিসের কারণে হাতে চায়ের কাপ থাকে না। স্ত্রী হানজালা এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকেন। প্রানপ্রিয় স্বামীর শারীরিক উন্নতিতে তার সচেতনতা প্রধান ভূমিকায় থাকে। এই মুহূর্তে স্বামীকে টিভির দিকে তাকিয়ে একমনে বসে থাকতে দেখে তিনি তার পাশে বসে বললেন, ‘আহা, জুসটা খেয়ে তারপর টিভি দেখো। টিভি কোথাও চলে যাচ্ছে না।’
সাখাওয়াত বেশ উত্তেজিত, ‘তুমি দেখছো না কি হয়েছে? ডক্টর শামসুজ্জামান তোহা, চেনো উনাকে?’
হানজালার কণ্ঠে অনাগ্রহ প্রকাশ পেল। এ ধরণের কঠিন খবরে তিনি কোনো আকর্ষণ খুঁজে পান না। তার খবরের বিষয়বস্তু বেশিরভাগ চলচ্চিত্র জগত এবং ফ্যাশন দুনিয়ার পরিবর্তিত রূপ সম্পর্কে। তিনি বললেন, ‘আমি এসব খবর তেমন রাখি না। তবে তোহা নামটা খবরের কাগজে অনেকবার দেখেছি।’
সাখাওয়াত বিস্তারিত বোঝালেন, ‘তোহা স্যার, কাঁচা-পাকা চুল আর হাস্যোজ্জ্বল মুখ। উনি কিন্তু সাধারণ কোনো মানুষ নন। উনি একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। ক্যানসার কোষ নির্মূলে যেই ট্রায়াল ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা আবিষ্কারে উনি ছিলেন বড় মাপের একজন গবেষক। এছাড়াও উনার একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে, মাংকিপক্সের প্রতিরোধী টিকা। আমাদের ঔষধ কোম্পানির বিশাল লাভের পেছনে উনার একটা অবদান নিশ্চয়ই আছে।’
কথোপকথনের মাঝে গুলবাহার এসে উপস্থিত। সাখাওয়াত আর হানজালার বড় কন্যা গুলবাহার পেশায় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। তবে তার চাকরিটা একটু ভিন্ন। সে অপরাধ জগতের বড় বড় অপরাধীদের সাইকোলজি যাচাই করে এবং মাঝে মাঝে কিছু ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকে। অর্থাৎ, অপরাধ মনোবিজ্ঞান নিয়ে তার কাজকর্ম। সেই সূত্রে অনেক সময়ই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এই যেমন আজও একজন মাদকাসক্ত কিশোর অপরাধীর সাথে তাকে ব্যস্ত সময় কাটাতে হবে।
ডক্টর শামসুজ্জামান তোহার মৃত্যুতে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে সে তারই প্রিয় ছাত্র এবং তোহা সেন্টারের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী। সেই ছাত্র ডক্টর তোহার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সরিয়েছে যার কারণে তার বিরুদ্ধে শুধু খু-নের অভিযোগ নয়, তথ্য গোপনের অভিযোগও আনা হয়েছে। গুলবাহার মায়ের কাছে এসে নাস্তা চাইতে গিয়ে টিভিতে চোখ পড়লে তার নজর আটকে গেল টিভির পর্দায়। মৃদু স্বরে সে বলে উঠলো, ‘এই ছেলে? উনি তোহা স্যারের খু-নি?’
সাখাওয়াত মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চিনিস নাকি?’
গুলবাহার কেবলই বলতে যাবে, ‘হ্যাঁ দেখেছি তো’। কিন্তু ছেলেটার নাম শোনার পর তার মুখ থেকে কোনো কথা উচ্চারিত হলো না। সে কিছুটা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দ্রুত ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। সাখাওয়াত আবার বললেন, ‘কিরে বাহার? চিনিস নাকি ছেলেটাকে?’
‘মনে হয়’, বলে হন্তদন্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেল বাহার। হানজালা ডাইনিং রুমে যেতে যেতে বললেন, ‘মেয়েটা সারাক্ষণ দৌড়ের ওপর থাকে। কাজ আর কাজ! একটা সংসার করলে নাহয় একঘেয়েমি ভাবটা কমে যেতো। কত করে বলছি ছেলেটার বাবা মাকে নিয়ে বাসায় আসতে বলিস…’
হানজালার প্রতিদিনের রেডিও চালু রাখার পাশাপাশি তিনি খাবারের আয়োজনও করে ফেললেন। টেবিলে খাবার রেখে গুলবাহারের অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর বাহার এলো শাড়ি পরে। হানজালা বুঝলেন মেয়েটা একবারে তৈরি হয়েছে। খেয়েদেয়েই বিদায় নিয়ে চলে যাবে অফিসে। কিন্তু আজ এতো দ্রুত যাওয়ার কারণ বুঝলেন না তিনি। মনের কথা প্রকাশ করলে বাহার উত্তর দিলো, ‘কাজ আছে মা। আবির ফোন করে বললো তাড়াতাড়ি যেতে।’
– ছেলেটাকে একবার বাড়িতে নিয়ে আয়। পরিচয় করিয়ে দে।
– কেন মা?
– কেন মানে? তুই না সেদিন বললি আবির তোর প্রতি আগ্রহী?
গুলবাহারের নির্বিকার উত্তর, ‘মা, এটা এমনিই একটা আকর্ষণ। আবির আমার ক্লাসমেট ছিল, এখন সহকর্মী। আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি, কাজ করছি, এভাবে চলতে চলতে একটা আকর্ষণবোধ তৈরি হতেই পারে। ইট’স ন্যাচারাল।’
– ইট’স ন্যাচারাল, কত সহজে বলে দিলি রে গুলবাহার?
পেছন থেকে বাহারের একমাত্র ফুপি সালমা এ কথা বলে ওঠায় সে একটু বিব্রত বোধ করলো। ফুপি সালমা নিঃসন্তান মানুষ। ফুফার মৃত্যুর পর থেকে সাখাওয়াত নিজের সম্মানিত বোনকে নিজের কাছেই রেখেছেন। সালমার মানসিকতা কিছুটা পুরোনো দিনের মানুষদের মতো। মেয়েদের রাত করে বাড়ি ফেরা, ছেলে বন্ধু থাকা কিংবা ছেলেদের মতো চালচলন তিনি পছন্দ করেন না। সালমার মাঝে ধর্মীয় আবেগ প্রবল। এজন্য বাহারের কাজকর্ম তিনি সমর্থন করেন না।
বাহার তার ফুপিকে সম্মান করে চলার চেষ্টা করে। এ ধরণের কথার কোনো জবাব না দিয়ে সে এড়িয়ে চলে। বরাবরের মতো, এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে বাহার মুচকি হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে সে বললো, ‘আসছি মা, আসছি ফুপি।’
সালমার অনধিকার চর্চা হানজালা একদম পছন্দ করেন না। মৃদু কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘সবসময় সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করতে আসে।’ তারপর তিনি উচ্চস্বরে ডাকলেন, ‘নাজ! এই গুলনাজ! কলেজে যাবি না?’
ছোট কন্যা গুলনাজ কলেজের পোশাক পরে হাজির। মুখ ভার করে সে বলছে, ‘কি একটা নাম রেখেছো! বান্ধবীরা খালি চাপাবাজ বলে ডাকে।’
হেসে ফেললেন হানজালা। তিনি কিছু বলার আগেই সালমা বললেন, ‘শোন মা, তোর বান্ধবীদের বলবি নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করা খুব পাপের কাজ। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম…’
হানজালা রান্নাঘরে চলে গেলেন। তার এসব শুনতে ভালো লাগে না। তার ধারণা, এই বুড়ি সবজায়গায় ধর্মীয় কথাবার্তা বলে পরিবেশ গম্ভীর করে তোলে। এখন মা মেয়ের মাঝে খুনসুটি চলতো যেটা সালমা নষ্ট করে দিলেন গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাবার্তা বলে।
_________
– বাহার! তুমি যদি জানতে শাড়িতে কতটা আবেদনময়ী লাগে তোমাকে, তাহলে হয়তো নিজেকে আড়াল করে রাখতে।
কথাগুলো আবির সরাসরি গুলবাহারকে বলার সাহস পায় না। কিন্তু মনের মাঝে লুকোনো ইচ্ছেটা সে কিছুতেই দমাতে পারে না। এর ফলে সে বাহারের খুব ভালো বন্ধু রূপে থাকতে চেয়েছে। যেন অন্তত কাছ থেকে দেখে চোখের আরাম হয়। কিন্তু মনের জ্বালা তো মেটে না। তাই বিভিন্ন উপায়ে বাহারকে সে তার ভালো লাগার কথা বলেছে। অবশ্য বাহার থাকলে তার আর কোনো মেয়েকে দরকার হবে না বলেই সে মনে করে। কেননা বাহারের মাঝে আছে টক, ঝাল, মিষ্টি, নোনতা, সব ধরণের স্বাদ।
দুই আঙ্গুল দিয়ে শব্দ করে আবিরের ধ্যান ভাঙলো বাহার। আবির মুচকি হেসে বললো, ‘পেঁয়াজ রঙা শাড়ি, বাহ!’
বাহার তার কথা গুরুত্ব না দিয়ে বলে উঠলো, ‘কাজের কথায় এসো আবির। আমাকে আসামির সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবে?’
– এখন তোমাকে প্রয়োজন নেই আপাতত। কেননা, আসামিকে রিমান্ডে নেয়া হবে। সে মুখ না খুললে অন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপর যদি সাইকোলজিক্যাল যাচাই-বাছাই প্রয়োজন হয় তাহলে তোমাকে ডাকা হবে।
– আমি এসব জানি আবির। আমি এমনিই দেখা করতে চাইছি। সেই সুযোগটা হবে কিনা সেটা বলো। তুমিই না বললে তাড়াতাড়ি এলে দেখা করিয়ে দিতে পারবে?
ফিসফিসিয়ে আবির বললো, ‘তুমি তাড়াতাড়ি এলে আমি বেশিক্ষণ তোমাকে দেখতে পারি।’
কিন্তু তার কথা এড়িয়ে বিরক্ত হয়ে বাহার বললো, ‘আবির? তুমি পারবে কিনা বলো নাহলে আমি আমার কাজে যাবো।’
– এক মিনিট দাঁড়াও। আমি স্যারের সাথে কথা বলে আসি।
সিআইডি আবির গেল ওসি গালিবের সাথে কথা বলতে। বেশ কিছু সময় পর আবির এসে বললো, ‘এসো বাহার। দোতলায় জেনারেল সেলে রাখা হয়েছে আসামিকে।’
আবিরের পিছু পিছু হেঁটে দোতলায় গেল বাহার। তাকে এই কাজটা সেরে সিএস বিভাগে যেতে হবে। সিএস হলো ক্রিমিনাল সাইকোলজি। ওখানেই বাহারের অফিস।
যেই কারাগারে তোহার খু-নিকে রাখা হয়েছে সেটার বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যায় না অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরেট ধাতু দিয়ে দরজাটা তৈরি করা হয়েছে। একটা ছোট জানালা আছে যেটা খুললে ভেতরে আসামির অবস্থান জানা যায়। কিন্তু বাহারের জন্য পুরো দরজাটা খুলে দেয়া হলো। এবং বাহার আবারো বিস্মিত হলো ভেতরে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে। সে বিস্ময় চেপে ভেতরে ঢুকে বললো, ‘আপনি! আমাকে চিনেছেন?’
মানুষটা এক ঝলক মুখ তুলে তাকিয়ে বাহারকে দেখে আবারো মুখ নামিয়ে নিলো। বাহার বলে উঠলো, ‘প্রিয়..’
– আমি প্রিয়ংশু নই।
চমকে উঠলো বাহার। আবির ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বাহার জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার নাম কী?’
চুপ করে আছে মানুষটা। বাহার আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘নাম কী আপনার?’
এবার উত্তর দিলো সামনে বসে থাকা যুবক, ‘নাম না জেনে আসেননি নিশ্চয়ই?’
হঠাৎ রাগ চড়ে গেল বাহারের, ‘অপরাধী হয়েও এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন আপনি সিআইডি আমি আসামি!’
আবির ধমকে উঠলো, ‘বল, তোর নাম বল বেয়াদব!’
যুবক আর কথা বাড়ালো না। সামনে তার সাথে ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে চলেছে সে জানে। তাই এখনই মার খেয়ে নিজেকে দুর্বল বানানোর ইচ্ছে নেই তার। সে বলে উঠলো, ‘আমি মুসলিম।’
এবার হতাশ হলো বাহার। আবিরের হাত উঠে গিয়েছে। তবে সে মারের ভঙ্গি করলেও মারেনি। উচ্চস্বরে বলে উঠলো সে, ‘মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব বেয়াদব, কি জিজ্ঞেস করছে সেটা বল!’
– আমি রিভার্টেড মুসলিম।
বাহার বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। সে তাহলে ভুল দেখেনি। সে প্রশ্ন করলো, ‘প্রিয়ংশু, আপনি কি…’
যুবক মাথা তুলে দৃঢ় চিবুকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি প্রিয়ংশু নই। আমি উম্মাতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমি সাদি হাসরাত।’
____________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)