‘ধূম্রজাল’
পঞ্চদশ পর্ব

তাবিনা মাহনূর

___________

শুক্রবার এলে সাদির কাছে তা ঈদের মতো আনন্দ বয়ে আনে। আজ সাদি ভোর থেকে বেশ খোশ মেজাজে আছে। তোহা সেন্টারে ছুটির দিন ছিল রবিবার, সাদি সহ আরো কিছু কর্মচারীর আবেদনে তোহা ছুটির দিন শুক্রবার করেছিলেন। তিনি না-স্তি-ক ছিলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তিনি কোনো ধর্মের ব্যাপারে ঘৃণা প্রকাশ করতেন না বা আগ্রহও দেখাতেন না। তাই শুক্রবারকে ছুটির দিন ঘোষণা করা কোনো সমস্যা মনে করেননি তিনি।

আজ রিসার্চ সেন্টার বন্ধ। সাদি আজকের দিনটা নিজেকে সময় দিবে। যেকোনো কাজ থেকে দূরে থাকবে সে। পুরো দিনের একটা কাজের তালিকা মনে মনে ভেবে সে সকালে বাজার করতে বেরিয়ে গেল। বাজারে যেতেই তার মনে হলো, সবাই তাকে এখনো অপরাধী মনে করে। সে ধনী গোত্রের মানুষ হওয়ায় টাকা দিয়ে নিজের অপরাধ ঢেকেছে, এটাই তাদের ধারণা। সাদি এমন চোরা চোখের দৃষ্টি অবহেলা করতে পারলো না। মন খারাপ হয়ে এলো তার। মানুষের দোষ সে দিবে না, মানুষকে যা দেখানো হবে তাই বিশ্বাস করা অস্বাভাবিক নয়।

খুব দ্রুত বাজার কাজ শেষে সে মুদি দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাসার পথ ধরলো। যারাই তাকে দেখছে, কেমন যেন দূরে দূরে থাকছে। ফুটপাতে হাঁটতে থাকা সাদিকে দেখে এক লোক ফুটপাত থেকেই নেমে পড়লো। সাদি শুনতে পেল ধীর কণ্ঠে কেউ বলছে, ‘টাকা থাকলে কি না সম্ভব!’

অথচ সাদির এখন টানাপোড়েন চলছে। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী জমানো টাকাগুলো বিশেষ কাজে ব্যয় হচ্ছে, বাকি যা আছে তাতে নতুন বাসায় ওঠা থেকে শুরু করে এ দেশে থাকা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে খুব কষ্ট করতে হবে। সাদি তিন রুমের বাসা নিয়েছে। দুটো বেড, আর ড্রইং ডাইনিং একসাথে। একটা বেড যেটা বাড়তি আছে সেখানে সে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। আরেকটা আরামের জন্য। এই মাসটা চলে গেলে নতুন বাসায় উঠবে সে। আর খরচ কমিয়ে দিবে। খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক চলবে কিন্তু অপ্রয়োজনীয় খরচ কম করবে সে।

স্টেরি আর রণজিৎ এতো সহজে সবকিছু মেনে নেয়ার কারণ সাদি খুব ভালো করেই জানে। মামলা প্রত্যাহার করার পর তাদেরকে কাগজ ফিরিয়ে দেয়া হবে। এরপর তারা হয়তো সাদিকে অন্য কোনো বানোয়াট মামলায় ফাঁসিয়ে দিবে আবারো, অথবা তাকে গুম করে ফেলবে। আর নয়তো মেরেই ফেলবে। তারপর তার অস্তিত্ব চাপা দিতে নানান কাহিনী গড়ে উঠবে, একদিন সবাই ভুলে যাবে। এই হলো তাদের পরিকল্পনা যা সাদি খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু তারা জানে না সাদি কি ভেবে রেখেছে।

বাসায় পৌঁছে আপন জনের অভাব অনুভব করলো সাদি। রাস্তায় মানুষ তাকে যেভাবে ব্যথিত করেছে, আপন মানুষের কাছে তা ব্যক্ত করলে ব্যথার ভার একটু হলেও কমে যেতো। এই মুহূর্তে দুজনকে মনে পড়ছে তার। প্রথম জন তার মা, রাধিকা ব্যানার্জি। মা থাকলে আহ্লাদ আর আদরে সে দুনিয়ার সকল কষ্ট ভুলে যেতে পারতো। মায়ের বকাও শান্তিময়।

আর দ্বিতীয় জন সাবিত্রী সেনগুপ্ত। সে আর ব্যানার্জি নেই। হিমাংশু সাবিত্রীকে ব্যবহার করলেও স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি। হিমাংশু বিয়ে করেছে লন্ডনে গিয়ে সেখানকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারীকে, মেয়েটার নাম হৈমন্তী। বেশ বড় বংশের মেয়ে, পড়াশোনায়ও ভালো। মেয়েটা নাকি অন্তঃসত্ত্বা। আর সাবিত্রী এখন সিঙ্গেল মাদার, সে মিডিয়ার কাছে নিজের অবস্থান এমনভাবে তুলে ধরে যেন সে অত্যন্ত কষ্টকর জীবন পেরিয়ে জয়ী রূপে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সাদি হাসে, কেউ তো জানে না সাবিত্রীর আসল রূপ কি।

এই মুহূর্তে সাবিত্রীকে মনে পড়ার বিশেষ কারণ, সাবিত্রী তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতো। বন্ধুর মতো জড়িয়ে ধরে শান্ত করতো সাদিকে। সাদি তখন রেগে থাকলে কিংবা মন খারাপ থাকলে স্ত্রীর সান্নিধ্যে যেতেই আইসক্রিমের মতো গলে যেত। এখনো এমন কাউকে তার প্রয়োজন যে তার কথা শুনবে, একটু আশ্বাস দিয়ে বলবে, ‘কেউ না থাকুক, আমি তো আছি তোমাকে ভালোবাসার জন্য।’

তবে আল্লাহকে চেনার পর থেকে এই কষ্টগুলো সাময়িক হয়ে উঠেছে। এই যেমন এখন, মা আর প্রাক্তন স্ত্রীকে ভেবে মন ভার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই যুহরের আজান শুনতে পেল সে। আর সাথে সাথে তার মন ভালো হয়ে এলো। আযানের উত্তর দিয়ে দুআ পড়ে সে গোসল করতে চলে গেল। আযান দেয় সোয়া বারোটায়। আর জুম্মার সালাত অনুষ্ঠিত হয় একটার দিকে। তাই গোসল সেরে দেরি না করে চলে গেল সে মসজিদে।

সালাত শেষে খুতবা শুনলো সে। নিমকি, খেজুর আর মিষ্টি রাখা একটা বাক্স দেয়া হলো তাকে। বয়স্ক লোকটা মৃদু হেসে তাকে বললো, ‘আজ আমার ছেলের বিয়ে হয়েছে। তাই সবাইকে এগুলো দিচ্ছি। দুআ করে দিবেন বাবা।’

এই একটা জায়গায় এলে সবাইকে আপন মনে হয় সাদির। সে ঠিক করলো, বাসায় গিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে মসজিদে চলে আসবে। মাগরিব পর্যন্ত এখানেই থাকবে।

_________

বাহারের সময় কাটতে চায় না। চাকরি ছেড়ে আজ দুদিন পার হলো ঘরে বসে। অনলাইনে ক্বুরআন তিলাওয়াত শিক্ষার একটা কোর্সে ভর্তি হয়েছে সে, সেটা শুরু হবে আরও তিন দিন পর। আরেকটা অফলাইন কোর্সে ভর্তি হয়েছে যা মূলত জাপানিজ ভাষা শিক্ষার জন্য। তার ইচ্ছে আছে সিয়ামের সাথে পরামর্শ করে জাপানে পিএইচডির জন্য যাবে। যেহেতু সিয়াম বেশিরভাগ সময় ঢাকার বাইরে থাকে তাহলে তার সমস্যা না থাকারই কথা।

কিন্তু এই কয়দিন খুব অলস সময় যাচ্ছে। ফুপির সাথে ধর্মীয় আলোচনা, ইস্তেগফার করা ছাড়া বাকি সময়টা সে বই পড়ার পেছনে কাটায়। ইদানিং তার মাঝেও লেখালেখি করার ইচ্ছে প্রবলভাবে জেগেছে। অবশ্য ফেসবুকের কল্যাণে আজকাল প্রত্যেকেই লেখক বনে যান। মানদণ্ড বিচার না করে অনুসরণকারীর ভিত্তিতে লেখকদের স্বীকৃতি মিলে যায়। বাহার চাইলেই তথাকথিত লেখিকা হতে পারবে।

এই ইচ্ছেটা ফুপির কাছে প্রকাশ করলে ফুপি একটা ভালো পরামর্শ দিলেন, ‘লিখতে ইচ্ছে করছে, লিখবি। কিন্তু দেখিস সেটা যেন গুনাহে জারিয়া না হয়।’

– গুনাহে জারিয়া? সেটা কি ফুপি?
– গুনাহে জারিয়া হলো এমন গুনাহ যা মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।
– যেমন?
– যেমন তুই কাউকে একটা গান শুনতে বললি। সে গানটা শুনলো, তার পছন্দ হলো। সে আরো কয়েকজনকে গান শুনতে বললো। এভাবে যত জন গানটা শুনবে, তত জনের গুনাহের ভাগও তোকে পেতে হবে। তোর মাধ্যম দিয়ে যত জনের কাছে পৌঁছে যাবে, সবার গুনাহের ভার তোকেও বহন করতে হবে।
– সাংঘাতিক ব্যাপার!
– হুম, আবার ধর তুই এমন এক সন্তান পৃথিবীতে রেখে গেলি যে সমাজের অনিষ্ট করে। তার পাপ কাজের গুনাহের ভার তোকেও নিতে হবে।
– কিন্তু সেখানে আমার যদি দোষ না থাকে? মানে আমি চাইলাম আমার ছেলে বা মেয়ে ভালো মানুষ হোক কিন্তু সঙ্গ দোষে বা যেকোনো কারণে সে খারাপ মানুষ হলো। তাতে আমার গুনাহ কেন হবে?

সালমা মুচকি হেসে বললেন, ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক। তিনি অবশ্যই জানবেন তুই কতটুকু চেষ্টা করেছিস। তাই তোর চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সন্তান খারাপ পথে গেলে তুই গুনাহগার হবি না ইন শা আল্লাহ।’

– এমন দিন যেন কখনো না দেখতে হয়।
– আমিন। এজন্যই লেখালেখির ক্ষেত্রেও বিষয়টা মাথায় রাখিস। তুই প্রেম কাহিনী লিখলে সেটা পড়ে যারা উৎসাহিত হবে তাদের গুনাহের ভাগ তোকে নিতে হবে। আবার তোর মৃত্যুর পর সেই লেখাটা থাকবে। যতদিন থাকবে ততদিন যারা পড়বে আর উৎসাহিত হবে, তাদের গুনাহের ভাগ তোকে নিতে হবে।

মুখ ফুলিয়ে বাহার চিন্তিত কণ্ঠে বললো, ‘সিয়ামের সাথে আমি প্রেম করি না। কিন্তু কথা বলি, এটা কি গুনাহ ফুপি?’

– অবশ্যই গুনাহ। তোরা বিয়ে করবি ইন শা আল্লাহ, কিন্তু তোদের বিয়ে তো হয়ে যায়নি তাই না? বিয়ের চুক্তি হলেও বিয়ে হয়নি, তাই তোরা চাইলেই দ্বিধাহীনভাবে কথা বলতে পারিস না।

বাহারের মুখ আরো গোল হয়ে এলো। এমন রূপ দেখে সালমা হেসে বাহারের চিবুকে হাত রেখে বললেন, ‘বাবু একটা! এতো চিন্তা করতে হবে না। কথা বলা বন্ধ করে দে। তোকে একটা বুদ্ধি দিই। আজকেই তুই ফোন করে বলবি বিয়ের আগে কোনো কথা বলবি না তোরা।’

– এতো সহজে মেনে নিবে সিয়াম?
– বলবি এটা একটা নতুন অনুভূতি। বিয়ের আগেই যদি এতো কথা বলিস তাহলে বিয়ের পরে নতুন বলে কিছু থাকবে না।
– বিয়ে হতে এখনো এক মাস দেরি আছে। সিয়াম আসলেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে।
– তুই ফোন ধরবি না, তাহলেই হবে।
– আর আম্মু? সেদিন কি হয়েছে জানো? সিয়ামের সাথে ঝগড়া করে ওর ফোন ধরিনি। পরে ওই রাত বারোটার সময়েই সে আম্মুকে ফোন করেছে যেন আমি তার ফোন ধরি। অসহ্য একটা!

সালমা একটু হতাশ হলেন। এরকম জোঁকের মতো পিছে লেগে থাকা ছেলে কথা না বলে থাকবে না। সাথে আছে হানজালার প্রশ্রয়। সালমা তবু এই কাজটা করতে বললেন বাহারকে। মনে আত্মবিশ্বাস আনতে হবে, তাওয়াক্কুল আনতে হবে – এই বলে তিনি বাহারকে সিয়ামের সাথে কথা বলা বন্ধ করতে বললেন।

ফুপির সাথে কথা বলে বাহার নিজের ঘরে গেল। আপাতত লেখালেখির চিন্তা বাদ, এখন তাকে সিয়ামের বিষয়টা থামাতে হবে। যদিও এই সপ্তাহে সিয়াম আর ফোন করবে না। করলেও বৃহস্পতিবার। সেদিনই নাহয় বোঝাপড়া করা যাবে। আজ অন্য কাজে লেগে পড়লো বাহার। হঠাৎ করেই তার সাদির মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। দ্রুত অরিত্রীর নম্বরে ফোন করে রাধিকার নম্বর জোগাড় করলো বাহার। অরিত্রী এবারও বেশ বিরক্ত হলো। বাহার নিশ্চিত, এরপরের বার অরিত্রী তার ফোন ধরবে না। এরপরে তাকে প্রয়োজনও পড়বে না। কারণ আসল কাজটা হয়ে গিয়েছে। রাধিকার নম্বর পেয়ে গিয়েছে সে। প্রিয়ংশু থেকে সাদি হওয়ার গল্পটা তাকে জানতেই হবে।

ফোন দুবার রিং হতেই ধরলেন রাধিকা, ‘হ্যালো?’

– আসসালামু আলাইকুম, আপনি কি মিসেস ব্যানার্জি বলছেন?

সালাম দিয়েই জিভ কাটলো বাহার। অমুসলিমকে সালাম দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। অভ্যাসবশত দিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু রাধিকা সালামের উত্তর দিলেন ভুল উচ্চারণে। আজকাল অন্য ধর্মীয় লোকজন সালামের উত্তর দিতে জানে, এটাকে তারা মুসলিম সংস্কৃতি মনে করে। অথচ তারা জানেই না উত্তর দেয়ার সময় তারা কোন অবিনশ্বর সত্তার নাম নিয়েছে।

– ওয়ালাইকুম সালাম। জি, আমি রাধিকা ব্যানার্জি। আপনি?
– আমি গুলবাহার।
– চিনতে পারলাম না। পরিচয় দিলে…
– জি, আমি একজন সাইকোলজিস্ট। আপনার ছেলে প্রিয়ংশু ব্যানার্জির সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট করেছিলাম।

থমকে গেলেন রাধিকা। মৃদু স্বরে বললেন, ‘প্রিয়?’

– জি। যিনি এখন সাদি হাসরাত। আসলে, আমার খুব জানা প্রয়োজন উনার মুসলিম হওয়ার পেছনের ঘটনা কি। আপনাকে কি আন্টি বলে ডাকতে পারি?

রাধিকা কোনো কথা বললেন না। বাহার অপেক্ষা করতে করতে বলে উঠলো, ‘মিসেস ব্যানার্জি, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’

হঠাৎ রাধিকা বললেন, ‘হ্যালো? হ্যালো!’

ভ্রু কুঁচকে গুলবাহার বলে উঠলো, ‘হ্যালো মিসেস ব্যানার্জি, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’

– হ্যালো, হ্যালো!

বাহার ফোন নামিয়ে নেটওয়ার্ক ঠিকাছে কিনা দেখলো। তারপর আবার কানে ফোন নিয়ে বললো, ‘মিসেস ব্যানার্জি? হ্যালো!’

কল কেটে গেল। বাহার আবার ফোন করলে যান্ত্রিক কন্ঠ ভেসে এলো, ‘আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে, কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করুন। ধন্যবাদ। The call…’

বাহার খুব ভালো করেই বুঝেছে রাধিকা শুনতে পেয়েও অভিনয় করেছেন। অর্থাৎ তিনি কথা বলতে চাননি। এখন ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, তিনি যদি সত্যিই শুনতে না পেতেন তাহলে তার গলার স্বর পরিবর্তিত হতো না। বাহারের মতো বিচক্ষণ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রাধিকার কন্ঠস্বর শুনেই বুঝে গিয়েছে সবকিছু। কিন্তু রাধিকা এমনটা কেন করলেন বাহার বুঝতে পারলো না।

এদিকে রাধিকা যেন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে হিমশিম খাচ্ছেন, তার ঘর্মাক্ত দেহ দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। প্রিয়র ব্যাপারে তিনি সর্বদা সতর্ক থাকেন। এই ফোন কলের বিষয়টা যদি রণজিৎ জানতে পারেন তাহলে ফোন ব্যবহার করা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ তার ফোনে কারো সাথে কথা বললে সেটা রেকর্ড হয়ে থাকছে। তবে তিনি বাহারের নম্বরটা কাগজে টুকে রেখেছেন। পরে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ করবেন।

_________

সমুদ্রের হিংস্র রূপ সাদি আগে কখনো দেখেনি। আজ একাকী নৌকায় নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। অবাধ ঢেউয়ের নৃত্য আর গর্জে ওঠা ধ্বনি তার বুক কাঁপিয়ে তুলছে। নৌকার পাটাতনে আধো বসে শক্ত করে দড়ি আর কাঠ ধরে আছে সে। কোনো উপায়ে যদি সমুদ্র থেকে বেঁচে সমতলে ফেরা যেতো! হঠাৎ চিৎকার ভেসে এলো। নারী কণ্ঠে কেউ বললো, ‘আমাকে না নিয়ে যেও না!’

সাদি মাথা তুলে তাকালো। প্রবল বর্ষণে তার শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। মৃদু আর্তনাদ করে সে ঝাপসা চোখে দেখলো, একজন নারী তার হাত নৌকার উপর রেখে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সাদি সেই হাত ধরতে চায়নি, কিন্তু করুণ কন্ঠ কানে বাজছে, ‘আমাকে নিয়ে যাও!’

হাত ধরে ফেললো সাদি। এক হাতে দড়ি শক্ত করে ধরে অন্য হাতে নারীর হাত ধরে সে অজানা মেয়েটিকে নৌকায় তোলার চেষ্টা করছে। আছড়ে নৌকায় পড়লো অচেনা মেয়েটি। অনেকক্ষন পানিতে ভেসে থাকায় সাদা ধবধবে শরীরটা কেমন রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। সাদি চিৎকার করে বললো, ‘আপনাকে নিতে চাই না আমি!’

নিতে চায় না সাদি, অথচ সে নিজেই নৌকায় তুলে নিলো মেয়েটিকে। মেয়েটি উপরে তাকাতেই সাদি চমকে উঠলো। মেয়েটি বললো, ‘আমাকে না নিয়ে কোথায় যাবে তুমি?’

– বাবা? বাবা আপনি ঠিক আছেন?

কেঁপে উঠছে সাদি। ঘুমের মাঝে মৃগী রোগীর মতো কাঁপছে সে, চোখ বন্ধ কিন্তু নড়ছে খুব। ইমাম রওশন কেবলই আছরের সালাত আদায় করবেন বলে মসজিদে এসেছিলেন। যুহরের পর তিনি বাড়ি গিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিয়েছিলেন। আছরের সালাতের সময় হয়নি এখনো, তবু তিনি প্রতিবারই আগে আগে চলে আসেন। এবারও এসে দেখলেন লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠেনি মসজিদ। কিন্তু দুই একজন এমনিই বসে জিকির করছে। এর মাঝে সাদিকে এক কোণে বসে কাঁপতে দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। প্রথমে ভাবলেন ছেলেটা আবার ‘শাহী বাবা, জালাল বাবা’ বলে কাঁপাকাঁপি করছে না তো? আজকাল ডিজিটাল জিকির বের হয়েছে অনেক। পরবর্তীতে কাছে গিয়ে দেখলেন ছেলেটা রীতিমতো ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে। ভয় পেলেন তিনি। জোরে জোরে ডাকলেন আর ধাক্কা দিতে থাকলেন।

সাদি চোখ খুলেছে। নভেম্বরের হালকা শীত আর এসির মৃদু হাওয়া থাকা সত্ত্বেও ঘেমে একাকার সে। উঠে বসলে ইমাম তার হাত ধরে বললো, ‘পানি দেব বাবা?’

‘বাবা!’ এই ডাকটা কতদিন পর শুনতে পেলো সাদি। সাদি দেখতে পেল উজ্জ্বল চোখের অধিকারী নূরানী চেহারায় ইমাম চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তার এক হাত সাদির কাঁধে, অন্য হাত তার হাতের মুঠোয়। এমন আদর কণ্ঠস্বর আর শুভ্র মাখা রূপ সাদির মন গলিয়ে দিলো। সে প্রশ্ন করলো, ‘একটু জড়িয়ে ধরি আপনাকে?’

ইমাম হতভম্ব হলেও হাত প্রসারিত করলেন। সাদি তাকে জড়িয়ে ধরলো। ইমামের কাঁধ ভিজে যাচ্ছে….

________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here