‘ধূম্রজাল’
নবম পর্ব

তাবিনা মাহনূর
_________

সাদির জামিন ঘোষণা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ থাকলেও তার পক্ষের উকিলের সাহায্যে তার জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ কারণে। সাংবাদিকদের কৌতুহল কমে যাওয়ার বদলে বেড়েই চলছে। কেন সাদিকে জামিন দেয়া হলো? তাও ঘটনার দুই মাসের মাঝেই! কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই সাদিকে জামিন দেয়া হয়েছে।

এই ঘটনায় সবচেয়ে অবাক হয়েছে গুলবাহার। গত এক মাস ধরে সে সাদির বিষয়ে কোনো খবর পায়নি। তবে সাদিকে নিয়ে আদালতে দৌড়াদৌড়ি চলছিল, এ খবর সে জানতে পেরেছিল। এবং সে কিছুটা আভাস পেয়েছিল সাদির জামিনের ব্যাপারে। তবে সে বিশ্বাস করেনি। কারণ সাদি এখনো কিছু স্বীকার করেনি। তাহলে সে কি এমন বলেছে যার জন্য তাকে ছেড়ে দেয়া হলো?

এর পেছনের অসহনীয় কষ্টের বর্ণনা বাহার জানে না। ফারহানার নোংরা অঙ্গভঙ্গি, সাগরের লাথি আর গালিবের হাতে উত্তম মধ্যম খেয়ে সাদির শরীরের কোনো অংশে আঘাতের চিহ্নের অবশিষ্ট বাকি নেই। ফারহানা আসতেন, এসেই সাদির মুখ চেপে ধরতেন। নোংরা ভাষায় কথা বলতেন। সাদির হাত দুটো ধরে তিনি নিজের হাতের মুঠোয় আটকে রাখতেন। তারপর সাগর একের পর এক ঘুষির বর্ষণ ঘটিয়ে সাদিকে বলতেন, ‘বল পেপার্স কোথায়? বল! তুই খু-ন করেছিস। তুই খু-ন না করলেও করেছিস!’

অর্থাৎ সাদি যে খু-ন করেনি তা সবাই জানেন। সাদির মুখ থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ সেই পেপারের খোঁজ চাইছে। সাদি কাটা ঠোঁটে বারবার বলেছে, ‘আমি পেপার্স চুরি করিনি। আমি চুরি করিনি।’ কিন্তু তারা সেই ঠোঁটে ঝাল শুকনো মরিচ ডলেছে, পিঠে বিছুটি পাতা ঘষে দিয়েছে। ঘা শুকিয়ে যাওয়ার সময় দেয়নি। সেই ঘা এর উপর আবার আঘাত করেছে। দ্রুত সাদিকে হাসপাতালে না নিলে গুরুতর রোগ হওয়ার ঝুঁকি আছে। কারণ কারাগারের দেয়ালগুলো স্যাঁতস্যাঁতে। মেঝে নোংরা, ঘরের চাল থেকে রঙের আস্তরন খসে পড়ে। এমন পরিবেশে সাদির স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে।

তাই জামিন পাওয়ার পরপরই সাদি গিয়েছে নিজের বাড়িতে। টানা দুই ঘন্টা বাথরুমে ঝর্ণার নীচে দাঁড়িয়ে সে নিজের সবটুকু অংশ পরিষ্কার করেছে। শরীর চলতে চায় না, হাঁটু ভেঙে আসে। কিন্তু তার মনের জোর প্রবল, তাওয়াক্কুল সাগর সম। গোসল শেষে সে আছরের সালাত আদায় করেছে। লম্বা সিজদাহ দিয়ে আল্লাহর গুনগান গেয়েছে। নফল সালাত আদায় করে সে দুআ করেছে, যেন তার পরিকল্পনা সঠিক পথে চলে। সে যেন সফলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাফিরদের মুখোশ খুলে দিতে পারে।

সালাত শেষে সাদি তার প্রিয় স্থানে গেল। বারান্দার উঁচু অংশে একটা দোলনা আছে। দোলনাটা বারান্দার বাম পাশে, আর ডান পাশে চিকন তোশক বিছিয়ে তাতে দুটো বালিশ রাখা। তোশক জড়িয়ে রাখা চাদরটা কুসুম রঙা, বালিশ দুটো হালকা গোলাপি ও আকাশি রঙের। হালকা রঙে ঘর সাজাতে সে ভালোবাসতো, ভালোবাসতো সাবিত্রীও। বারান্দার নিচু অংশে আছে ইনডোর গাছ আর একটা জলপ্রপাতের আদলে তৈরি ঘর সাজানোর শো-পিস। এটা তার খুব বেশি পছন্দ নয়, কৃত্রিম জলপ্রপাতে সে প্রশান্তি খুঁজে পায় না। তবে এটা সে ব্যানার্জি প্যালেসে নিজের ঘরে রেখেছিল মায়ের দেয়া উপহার হিসেবে। তাই যেদিন একবারে বাড়ি ছেড়েছে, সেদিন ভ্যানে চড়ে সঙ্গে করে এটাও নিয়ে এসেছে।

পুরো বারান্দাটা সে ব্যানার্জি প্যালেসে তার নিজের ঘরের বারান্দার রূপে সাজানোর চেষ্টা করেছে। তফাৎ এতটুকুই, তার এই বারান্দা আকারে অনেকটা ছোট। ঘর সাজানোর কাজ সচরাচর মেয়েদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। এদিক দিয়ে সাদি কিছুটা বিপরীত স্বভাবের। তার ফ্যাশন ডিজাইনার স্ত্রী সাবিত্রী প্যালেসের একটা ঘর নিজের করে নিয়েছিল শুধুমাত্র বাড়িতে বসে ডিজাইনিং এর কাজগুলো করার জন্য। সেই ঘরের মেঝে জুড়ে বিরাজ করতো টুকরো কাপড়ের রাজত্ব। যেসব নকশা পছন্দ হয় না, সেসব নকশার কাগজ সাবিত্রী দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রাখতো সারা ঘরে। সাদি যখন সেই ঘরে স্ত্রীর সঙ্গ পেতে প্রবেশ করতো, তখন তার কাছে ঘরের মেঝেতে হেঁটে হেঁটে সাবিত্রী পর্যন্ত পৌঁছানো অনেকটা রণাঙ্গন জয়ের সমান মনে হতো। সে একটু একটু করে এগিয়ে যেতো আর বলতো, ‘সুশ্রী দেখো, আমি আসছি কিভাবে! যেন ঘন জঙ্গলে রাজকন্যা উদ্ধারে এসেছি।’

রূপসী স্ত্রীকে ভালোবেসে সুশ্রী ডাকতো সাদি। সাবিত্রী তা শুনে কলকলিয়ে হেসে উঠতো। তার হাসির রিমঝিম ধ্বনি প্যালেসের এ কোণ ও কোণ ছড়িয়ে যেতো, যেমনটা সাদির বুকের সায়রে ঢেউ তুলতো। অথচ এই স্ত্রীকে ছেড়ে আজ পাঁচ বছর ধরে সে নিঃসঙ্গতাকে আপন করে নিয়েছে।

বারান্দার কোণে থাকা তোশকের উপরে বসলো সাদি। একটা বালিশ পিঠের পেছনে দিয়ে আরেকটা কোলের উপর রেখে চোখ বন্ধ করলো সে। মনে পড়লো তার কারাগারের ক্ষণিক মুহূর্তের কথা…

– জামিন? তুই কি বোকা পেয়েছিস আমাদের?

ওসি গালিবের এই কথার পৃষ্ঠে রক্ত মাখা ঠোঁটে উত্তর দিলো সাদি, ‘বোকা নয়, আপনাদের চালাক মনে করি বলেই জামিনের কথা বলছি। জামিনের ব্যবস্থা করলে আমি বলবো পেপার্স আর আপনাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু কোথায় আছে।’

এই প্রস্তাবের পর সাদির উপর নেমে আসে অসহনীয় যন্ত্রণার পাথুরে বর্ষণ আর নিকৃষ্ট আচরণের খেলা। এমন কোনো আঘাত তারা বাকি রাখেনি, যখন তারা জানতে পেরেছে সাদি সত্যিই পেপার্স সরিয়েছে। এবং সে জানে কোথায় আছে তা। শারীরিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার, নারী কনস্টেবল দ্বারা অশ্লীল আচরণে জোর করা, সব রকম নোংরামির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েও সাদি সব স্বীকার করে নেয়নি। যখন তার অবস্থা নাজুক, তাকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন পড়লো, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলো সাদিকে জামিন দেয়া হবে এই শর্তে, মাত্র পনেরো দিনের মাঝে তাকে গুরুত্বপূর্ণ সেই কাগজ খুঁজে দিতে হবে ও কাগজে লেখা তথ্যের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সেই অনুযায়ী কাজ করলে সাদিকে খু-নের মামলা থেকেও বাঁচিয়ে নেয়া হবে। এ ব্যাপারে ওসি গালিব, সিআইডি সাগর, এএসপি নাকিব, সিআইডি ফারহানা, মেজর বিক্রম এবং বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে ওসি রূপমের একটি আলোচনা কমিটি গঠন করা হয়। তারা সকলে মিলে এসব সিদ্ধান্তে পৌঁছান।

সাদিকে তারা প্রথম তিন দিন সব রকম কাজ থেকে ছুটি দিয়েছেন। সাদি এতে বেশ অবাক হলেও বুঝতে পেরেছে এখানে কোনো ‘কিন্তু’ আছে। কিন্তুটা হলো তাকে পর্যবেক্ষণ করা, নজরে রাখা। সাদির পরিকল্পনা কোনো ফাঁদ কিনা তা দেখা। সাদি অবশ্য নিশ্চিন্ত মনে নিজেকে সময় দিচ্ছে। তিন দিন পরই তাকে কাজে নেমে পড়তে হবে। আপাতত বারান্দায় গোধূলি বিলাস শেষ করে মাগরিবের সালাত আদায় করবে সে। তারপর হাসপাতালে গিয়ে কিছু সন্দেহমূলক রোগের টেস্ট করাবে। শরীরটা বেশ খারাপ।

_______

বাহারের বাগদান শেষ হওয়ার পর সিয়াম চলে গিয়েছে চট্টগ্রাম পোর্টে। ব্যস্ততার কারণে ছেলেটা সপ্তাহে একদিন ফোন করে। এতেও বিরক্ত হয় বাহার। ফোনে কথা না বললে সিয়ামের শান্তি হয় না। বেশিরভাগ কথা তার আভিজাত্য নিয়ে। কয়টা দেশে ঘুরেছে, মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে, ছোট থেকে সে কত বুদ্ধিমান, এসব নিয়েই তার বাহারের সাথে আলাপন। বাহার মাঝে মাঝে উদাস মনে সেসব শোনে আর বারবার হাই তোলে। অবশ্য একদিক থেকে সে বেঁচে গিয়েছে। তাকে কথা বলতে হয় না, সিয়ামের মতো বাঁচাল ছেলে একা কথা বলতেই ভালোবাসে।

আজ বেশ উত্তেজনায় বাহারের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সাদির সাথে দেখা করা জরুরী। সে জানতে চায় সাদি কি বলেছে, কি করেছে। সাদি কি হার মেনে নিয়েছে? সেও কি দুনিয়ার সুখে হারিয়ে যেতে চাইছে? সে কি খারাপ লোকদের মতো হয়ে গেল?

এতগুলো প্রশ্নের কোনো উত্তর পায়নি বাহার। প্রথম কারণ, ইদানিং কাজের ব্যাপারে তার উদাসীনতা বড় স্যারদের চোখে পড়েছে তাই তাকে যেকোনো মামলা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ, তার বাগদানের পর থেকে আবির তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শেষ একটা কথাই আবির বলেছে, ‘আমাকে এভাবে না ঠকালেও পারতে।’

বাহার বুঝতে পারেনি আবির প্রতারণার কথা কেন বলছে। সে কখনোই আবিরকে প্রশ্রয় দেয়নি, কখনো এমন কিছু বলেনি যে সেও আবিরের প্রতি আকৃষ্ট।আবির নিজে থেকেই বাহারকে সঙ্গী ভেবে বসে থাকলে এখানে কারো কিছুই করার নেই। আবির সহকর্মী হিসেবে অনেক সহযোগিতাপূর্ণ মানুষ। কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে আবিরের মতো মেয়েলি পুরুষ বাহারের পছন্দ নয়।

বিয়ের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু হয়েছে। আজ হাফসা বেগমের সাথে বাহারকে ডায়মন্ডের আংটি কিনতে শপিং মলে যেতে হবে। আর গহনার কাজটাও এই হাতে সেরে ফেলতে চান হাফসা। হানজালা খুবই খুশি বড় মেয়ের জন্য এমন অমায়িক শাশুড়ি পেয়ে। তিনি এবার অনেকটা চিন্তা মুক্ত হয়েছেন। তিনিও যাবেন মেয়ের বিয়ের বাজারে অংশ নিতে। হাফসা হানজালাকেও এক জোড়া স্বর্ণের দুল উপহার দিয়েছেন। তার টাকার গরম দেখাতে নাকি মনের বড়ত্ব প্রমাণে, এ বিষয়টা এখানে পরিষ্কার হয়নি। যাই হোক, বাহারের শাশুড়ি হিসেবে মানুষটা বেশ আন্তরিক।

শপিং মলে ঘুরতে ঘুরতে অপ্রসন্য মনে বাহার দোকানের বাইরে খোলা জায়গায় হাঁটাহাঁটি করছে। ভেতরে তার আংটির মাপ পছন্দ করা হয়ে গিয়েছে। তাই সে হাফসাকে বলে বাইরে হাঁটছে। মূলত তার বিক্ষিপ্ত মন তাকে কোনো কাজে মনোযোগী হতে দিচ্ছে না। তাই মনকে বোঝাতে সে পায়চারি করছে ফাঁকা জায়গাটায়।

হাফসা, হানজালা আর সিয়ামের ভাবি সুতপা দোকানের ভেতরে অন্যান্য গহনা দেখছে। সেসময় দোকানের দরজা ঠেলে সিয়ামকে ভেতরে ঢুকতে দেখলো বাহার। থমকে গিয়ে সে ডেকে উঠলো, ‘সিয়াম!’

সিয়াম দোকানে ঢুকে হাঁটছে। তবে বাহারের ডাক শোনার কিছুক্ষণ পর সে পিছে তাকালো। যেন সে বিদেশে থাকে, নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে শুনতে দেরি করে ফেলেছে। এমন ভঙ্গিতে সিয়াম বাইরে বেরিয়ে এসে হেসে ফেললো। বাহার বিস্মিত কণ্ঠে বললো, ‘তুমি এখানে! কবে এসেছো?’

সিয়াম শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। সে হঠাৎ ডেকে উঠলো, ‘মা! দেখো ভাবি আমাকে সিয়াম ভেবেছে।’

বাহার কিছুই বুঝতে পারছে না। হাফসা বেরিয়ে এসে মৃদু হেসে বললেন, ‘সিয়াম আর সিজান দুজন আমার যমজ ছেলে। সিয়ামের প্রায় এক দেড় মিনিট পর সিজানের জন্ম হয়েছিল। তাই সিয়ামকে মেজো বলি, ওকে ছোট বলি।’

বাহারের বিস্ময় এখনো কাটেনি। এতোটা মিল কিভাবে থাকতে পারে দুজন মানুষের চেহায়ার! সিজানই উত্তরটা দিয়ে দিলো, ‘আমরা আইডেনটিক্যাল টুইন ভাবি। আমাদের আলাদা করতে আপনার বেশ বেগ পেতে হবে।’

বাহার ঈষদ হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘সরি, আমি সত্যিই চিনতে পারিনি সিজান ভাই।’

– একদম ভাই বলবেন না। এক দুই মিনিটের হলেও ছোট আমি। আমি নিজেকে ছোট ভাবতে বেশ ভালোবাসি। তাই আমার নাম ধরে ডাকবেন ভাবি।

সিজান দেখি সিয়ামের চেয়েও এক ডিগ্রি বেশি কথা বলে! সিয়াম শুরুতে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করতো। আর সিজান শুরু থেকেই চঞ্চলতা প্রমাণে অস্থির। সে এসেছে আংটির টাকা নিয়ে। ব্যাংক থেকে আসতে একটু দেরি হওয়ায় সে একসাথে আসতে পারেনি। মনে পড়লো বাহারের, সিয়ামকে সে ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। সিয়াম তখন দুষ্টু হেসে বলেছিল, ‘তোমার জন্য সারপ্রাইজ রাখলাম আমার ছোট ভাইকে।’

সত্যিই সারপ্রাইজ হিসেবে হাজির হয়েছে সিজান। আর কাটিয়ে দিয়েছে কিছু ধোঁয়াশা।

শপিং মলে বাহারের পুরো সময়টা কাটলো নিরামিষ ও চিন্তাকে বন্ধু বানিয়ে। প্রয়োজনীয় কলটা সে করতে পারছে না বাইরের মানুষগুলোকে অসম্মান করা হবে বলে। অথবা তারা ভাবতে পারে বাহার কাজের চাপ দেখাচ্ছে, ভাব দেখাচ্ছে। তাই বাহার বাসায় যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো।

বাসায় গিয়ে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে অরিত্রীকে ফোন করলো। বাইরের কাপড় ছাড়েনি সে, কুলকুল করে ঘামতে থাকা শরীরকে শীতলতা প্রদানে ফ্যানটাও ছাড়েনি সে। অরিত্রী ফোন ধরছে না। সে আবার করলো। এবার ফোন ধরেছে অরিত্রী। কিন্তু তাকে ভালো-মন্দ কিছুই বলতে না দিয়ে বাহার বলে উঠলো, ‘প্রিয়ংশু ব্যানার্জির কি কোনো যমজ ভাই আছে?’

অরিত্রী চমকে উঠলেও বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’

উত্তেজনায় বাহারের কন্ঠ কেঁপে উঠছে, ‘তারা কি আইডেনটিক্যাল টুইন?’

– হ্যাঁ, দুজনের চেহারায় এতো মিল যে এখনো বুঝতে পারি না আমরা। শুধু প্রিয় দাদা মুসলিম হয়ে যাওয়ায় আমরা এখন হিম দাদাকে চিনতে পারি।
– কি নাম বললি? হিম?
– হিমাংশু ব্যানার্জি। আমরা হিমদা বলি।

হেসে উঠলো বাহার, তবে নিঃশব্দে। অরিত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চোখ বন্ধ করে হাসলো সে। দ্রুত ফেসবুক জগতে ঢুকে সে খুঁজতে শুরু করলো হিমাংশুর আইডি। প্রথমেই চলে এলো বি-অ্যারোমা কোম্পানির উত্তরসূরি হিমাংশু ব্যানার্জির আইডি যেখানে নামের পাশে নীল টিক চিহ্ন দ্বারা বোঝা যাচ্ছে সে বিশেষ ব্যক্তি। এবাউট অপশনে লেখা, ‘লিভস ইন লন্ডন। স্টাডিস বার অ্যাট ল ইন ব্রিটিশ কাউন্সিল।’

একজন সুপরিচিত কোম্পানির উত্তরাধিকারি, উচ্চ ডিগ্রি সম্পন্ন ব্যারিস্টারের কাছে লাইসেন্স যুক্ত পিস্তল থাকা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়?

_________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)’ধূম্রজাল’
নবম পর্ব

তাবিনা মাহনূর
_________

সাদির জামিন ঘোষণা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ থাকলেও তার পক্ষের উকিলের সাহায্যে তার জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ কারণে। সাংবাদিকদের কৌতুহল কমে যাওয়ার বদলে বেড়েই চলছে। কেন সাদিকে জামিন দেয়া হলো? তাও ঘটনার দুই মাসের মাঝেই! কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই সাদিকে জামিন দেয়া হয়েছে।

এই ঘটনায় সবচেয়ে অবাক হয়েছে গুলবাহার। গত এক মাস ধরে সে সাদির বিষয়ে কোনো খবর পায়নি। তবে সাদিকে নিয়ে আদালতে দৌড়াদৌড়ি চলছিল, এ খবর সে জানতে পেরেছিল। এবং সে কিছুটা আভাস পেয়েছিল সাদির জামিনের ব্যাপারে। তবে সে বিশ্বাস করেনি। কারণ সাদি এখনো কিছু স্বীকার করেনি। তাহলে সে কি এমন বলেছে যার জন্য তাকে ছেড়ে দেয়া হলো?

এর পেছনের অসহনীয় কষ্টের বর্ণনা বাহার জানে না। ফারহানার নোংরা অঙ্গভঙ্গি, সাগরের লাথি আর গালিবের হাতে উত্তম মধ্যম খেয়ে সাদির শরীরের কোনো অংশে আঘাতের চিহ্নের অবশিষ্ট বাকি নেই। ফারহানা আসতেন, এসেই সাদির মুখ চেপে ধরতেন। নোংরা ভাষায় কথা বলতেন। সাদির হাত দুটো ধরে তিনি নিজের হাতের মুঠোয় আটকে রাখতেন। তারপর সাগর একের পর এক ঘুষির বর্ষণ ঘটিয়ে সাদিকে বলতেন, ‘বল পেপার্স কোথায়? বল! তুই খু-ন করেছিস। তুই খু-ন না করলেও করেছিস!’

অর্থাৎ সাদি যে খু-ন করেনি তা সবাই জানেন। সাদির মুখ থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ সেই পেপারের খোঁজ চাইছে। সাদি কাটা ঠোঁটে বারবার বলেছে, ‘আমি পেপার্স চুরি করিনি। আমি চুরি করিনি।’ কিন্তু তারা সেই ঠোঁটে ঝাল শুকনো মরিচ ডলেছে, পিঠে বিছুটি পাতা ঘষে দিয়েছে। ঘা শুকিয়ে যাওয়ার সময় দেয়নি। সেই ঘা এর উপর আবার আঘাত করেছে। দ্রুত সাদিকে হাসপাতালে না নিলে গুরুতর রোগ হওয়ার ঝুঁকি আছে। কারণ কারাগারের দেয়ালগুলো স্যাঁতস্যাঁতে। মেঝে নোংরা, ঘরের চাল থেকে রঙের আস্তরন খসে পড়ে। এমন পরিবেশে সাদির স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে।

তাই জামিন পাওয়ার পরপরই সাদি গিয়েছে নিজের বাড়িতে। টানা দুই ঘন্টা বাথরুমে ঝর্ণার নীচে দাঁড়িয়ে সে নিজের সবটুকু অংশ পরিষ্কার করেছে। শরীর চলতে চায় না, হাঁটু ভেঙে আসে। কিন্তু তার মনের জোর প্রবল, তাওয়াক্কুল সাগর সম। গোসল শেষে সে আছরের সালাত আদায় করেছে। লম্বা সিজদাহ দিয়ে আল্লাহর গুনগান গেয়েছে। নফল সালাত আদায় করে সে দুআ করেছে, যেন তার পরিকল্পনা সঠিক পথে চলে। সে যেন সফলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাফিরদের মুখোশ খুলে দিতে পারে।

সালাত শেষে সাদি তার প্রিয় স্থানে গেল। বারান্দার উঁচু অংশে একটা দোলনা আছে। দোলনাটা বারান্দার বাম পাশে, আর ডান পাশে চিকন তোশক বিছিয়ে তাতে দুটো বালিশ রাখা। তোশক জড়িয়ে রাখা চাদরটা কুসুম রঙা, বালিশ দুটো হালকা গোলাপি ও আকাশি রঙের। হালকা রঙে ঘর সাজাতে সে ভালোবাসতো, ভালোবাসতো সাবিত্রীও। বারান্দার নিচু অংশে আছে ইনডোর গাছ আর একটা জলপ্রপাতের আদলে তৈরি ঘর সাজানোর শো-পিস। এটা তার খুব বেশি পছন্দ নয়, কৃত্রিম জলপ্রপাতে সে প্রশান্তি খুঁজে পায় না। তবে এটা সে ব্যানার্জি প্যালেসে নিজের ঘরে রেখেছিল মায়ের দেয়া উপহার হিসেবে। তাই যেদিন একবারে বাড়ি ছেড়েছে, সেদিন ভ্যানে চড়ে সঙ্গে করে এটাও নিয়ে এসেছে।

পুরো বারান্দাটা সে ব্যানার্জি প্যালেসে তার নিজের ঘরের বারান্দার রূপে সাজানোর চেষ্টা করেছে। তফাৎ এতটুকুই, তার এই বারান্দা আকারে অনেকটা ছোট। ঘর সাজানোর কাজ সচরাচর মেয়েদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। এদিক দিয়ে সাদি কিছুটা বিপরীত স্বভাবের। তার ফ্যাশন ডিজাইনার স্ত্রী সাবিত্রী প্যালেসের একটা ঘর নিজের করে নিয়েছিল শুধুমাত্র বাড়িতে বসে ডিজাইনিং এর কাজগুলো করার জন্য। সেই ঘরের মেঝে জুড়ে বিরাজ করতো টুকরো কাপড়ের রাজত্ব। যেসব নকশা পছন্দ হয় না, সেসব নকশার কাগজ সাবিত্রী দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রাখতো সারা ঘরে। সাদি যখন সেই ঘরে স্ত্রীর সঙ্গ পেতে প্রবেশ করতো, তখন তার কাছে ঘরের মেঝেতে হেঁটে হেঁটে সাবিত্রী পর্যন্ত পৌঁছানো অনেকটা রণাঙ্গন জয়ের সমান মনে হতো। সে একটু একটু করে এগিয়ে যেতো আর বলতো, ‘সুশ্রী দেখো, আমি আসছি কিভাবে! যেন ঘন জঙ্গলে রাজকন্যা উদ্ধারে এসেছি।’

রূপসী স্ত্রীকে ভালোবেসে সুশ্রী ডাকতো সাদি। সাবিত্রী তা শুনে কলকলিয়ে হেসে উঠতো। তার হাসির রিমঝিম ধ্বনি প্যালেসের এ কোণ ও কোণ ছড়িয়ে যেতো, যেমনটা সাদির বুকের সায়রে ঢেউ তুলতো। অথচ এই স্ত্রীকে ছেড়ে আজ পাঁচ বছর ধরে সে নিঃসঙ্গতাকে আপন করে নিয়েছে।

বারান্দার কোণে থাকা তোশকের উপরে বসলো সাদি। একটা বালিশ পিঠের পেছনে দিয়ে আরেকটা কোলের উপর রেখে চোখ বন্ধ করলো সে। মনে পড়লো তার কারাগারের ক্ষণিক মুহূর্তের কথা…

– জামিন? তুই কি বোকা পেয়েছিস আমাদের?

ওসি গালিবের এই কথার পৃষ্ঠে রক্ত মাখা ঠোঁটে উত্তর দিলো সাদি, ‘বোকা নয়, আপনাদের চালাক মনে করি বলেই জামিনের কথা বলছি। জামিনের ব্যবস্থা করলে আমি বলবো পেপার্স আর আপনাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু কোথায় আছে।’

এই প্রস্তাবের পর সাদির উপর নেমে আসে অসহনীয় যন্ত্রণার পাথুরে বর্ষণ আর নিকৃষ্ট আচরণের খেলা। এমন কোনো আঘাত তারা বাকি রাখেনি, যখন তারা জানতে পেরেছে সাদি সত্যিই পেপার্স সরিয়েছে। এবং সে জানে কোথায় আছে তা। শারীরিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার, নারী কনস্টেবল দ্বারা অশ্লীল আচরণে জোর করা, সব রকম নোংরামির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েও সাদি সব স্বীকার করে নেয়নি। যখন তার অবস্থা নাজুক, তাকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন পড়লো, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলো সাদিকে জামিন দেয়া হবে এই শর্তে, মাত্র পনেরো দিনের মাঝে তাকে গুরুত্বপূর্ণ সেই কাগজ খুঁজে দিতে হবে ও কাগজে লেখা তথ্যের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সেই অনুযায়ী কাজ করলে সাদিকে খু-নের মামলা থেকেও বাঁচিয়ে নেয়া হবে। এ ব্যাপারে ওসি গালিব, সিআইডি সাগর, এএসপি নাকিব, সিআইডি ফারহানা, মেজর বিক্রম এবং বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে ওসি রূপমের একটি আলোচনা কমিটি গঠন করা হয়। তারা সকলে মিলে এসব সিদ্ধান্তে পৌঁছান।

সাদিকে তারা প্রথম তিন দিন সব রকম কাজ থেকে ছুটি দিয়েছেন। সাদি এতে বেশ অবাক হলেও বুঝতে পেরেছে এখানে কোনো ‘কিন্তু’ আছে। কিন্তুটা হলো তাকে পর্যবেক্ষণ করা, নজরে রাখা। সাদির পরিকল্পনা কোনো ফাঁদ কিনা তা দেখা। সাদি অবশ্য নিশ্চিন্ত মনে নিজেকে সময় দিচ্ছে। তিন দিন পরই তাকে কাজে নেমে পড়তে হবে। আপাতত বারান্দায় গোধূলি বিলাস শেষ করে মাগরিবের সালাত আদায় করবে সে। তারপর হাসপাতালে গিয়ে কিছু সন্দেহমূলক রোগের টেস্ট করাবে। শরীরটা বেশ খারাপ।

_______

বাহারের বাগদান শেষ হওয়ার পর সিয়াম চলে গিয়েছে চট্টগ্রাম পোর্টে। ব্যস্ততার কারণে ছেলেটা সপ্তাহে একদিন ফোন করে। এতেও বিরক্ত হয় বাহার। ফোনে কথা না বললে সিয়ামের শান্তি হয় না। বেশিরভাগ কথা তার আভিজাত্য নিয়ে। কয়টা দেশে ঘুরেছে, মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে, ছোট থেকে সে কত বুদ্ধিমান, এসব নিয়েই তার বাহারের সাথে আলাপন। বাহার মাঝে মাঝে উদাস মনে সেসব শোনে আর বারবার হাই তোলে। অবশ্য একদিক থেকে সে বেঁচে গিয়েছে। তাকে কথা বলতে হয় না, সিয়ামের মতো বাঁচাল ছেলে একা কথা বলতেই ভালোবাসে।

আজ বেশ উত্তেজনায় বাহারের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সাদির সাথে দেখা করা জরুরী। সে জানতে চায় সাদি কি বলেছে, কি করেছে। সাদি কি হার মেনে নিয়েছে? সেও কি দুনিয়ার সুখে হারিয়ে যেতে চাইছে? সে কি খারাপ লোকদের মতো হয়ে গেল?

এতগুলো প্রশ্নের কোনো উত্তর পায়নি বাহার। প্রথম কারণ, ইদানিং কাজের ব্যাপারে তার উদাসীনতা বড় স্যারদের চোখে পড়েছে তাই তাকে যেকোনো মামলা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ, তার বাগদানের পর থেকে আবির তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শেষ একটা কথাই আবির বলেছে, ‘আমাকে এভাবে না ঠকালেও পারতে।’

বাহার বুঝতে পারেনি আবির প্রতারণার কথা কেন বলছে। সে কখনোই আবিরকে প্রশ্রয় দেয়নি, কখনো এমন কিছু বলেনি যে সেও আবিরের প্রতি আকৃষ্ট।আবির নিজে থেকেই বাহারকে সঙ্গী ভেবে বসে থাকলে এখানে কারো কিছুই করার নেই। আবির সহকর্মী হিসেবে অনেক সহযোগিতাপূর্ণ মানুষ। কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে আবিরের মতো মেয়েলি পুরুষ বাহারের পছন্দ নয়।

বিয়ের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু হয়েছে। আজ হাফসা বেগমের সাথে বাহারকে ডায়মন্ডের আংটি কিনতে শপিং মলে যেতে হবে। আর গহনার কাজটাও এই হাতে সেরে ফেলতে চান হাফসা। হানজালা খুবই খুশি বড় মেয়ের জন্য এমন অমায়িক শাশুড়ি পেয়ে। তিনি এবার অনেকটা চিন্তা মুক্ত হয়েছেন। তিনিও যাবেন মেয়ের বিয়ের বাজারে অংশ নিতে। হাফসা হানজালাকেও এক জোড়া স্বর্ণের দুল উপহার দিয়েছেন। তার টাকার গরম দেখাতে নাকি মনের বড়ত্ব প্রমাণে, এ বিষয়টা এখানে পরিষ্কার হয়নি। যাই হোক, বাহারের শাশুড়ি হিসেবে মানুষটা বেশ আন্তরিক।

শপিং মলে ঘুরতে ঘুরতে অপ্রসন্য মনে বাহার দোকানের বাইরে খোলা জায়গায় হাঁটাহাঁটি করছে। ভেতরে তার আংটির মাপ পছন্দ করা হয়ে গিয়েছে। তাই সে হাফসাকে বলে বাইরে হাঁটছে। মূলত তার বিক্ষিপ্ত মন তাকে কোনো কাজে মনোযোগী হতে দিচ্ছে না। তাই মনকে বোঝাতে সে পায়চারি করছে ফাঁকা জায়গাটায়।

হাফসা, হানজালা আর সিয়ামের ভাবি সুতপা দোকানের ভেতরে অন্যান্য গহনা দেখছে। সেসময় দোকানের দরজা ঠেলে সিয়ামকে ভেতরে ঢুকতে দেখলো বাহার। থমকে গিয়ে সে ডেকে উঠলো, ‘সিয়াম!’

সিয়াম দোকানে ঢুকে হাঁটছে। তবে বাহারের ডাক শোনার কিছুক্ষণ পর সে পিছে তাকালো। যেন সে বিদেশে থাকে, নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে শুনতে দেরি করে ফেলেছে। এমন ভঙ্গিতে সিয়াম বাইরে বেরিয়ে এসে হেসে ফেললো। বাহার বিস্মিত কণ্ঠে বললো, ‘তুমি এখানে! কবে এসেছো?’

সিয়াম শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। সে হঠাৎ ডেকে উঠলো, ‘মা! দেখো ভাবি আমাকে সিয়াম ভেবেছে।’

বাহার কিছুই বুঝতে পারছে না। হাফসা বেরিয়ে এসে মৃদু হেসে বললেন, ‘সিয়াম আর সিজান দুজন আমার যমজ ছেলে। সিয়ামের প্রায় এক দেড় মিনিট পর সিজানের জন্ম হয়েছিল। তাই সিয়ামকে মেজো বলি, ওকে ছোট বলি।’

বাহারের বিস্ময় এখনো কাটেনি। এতোটা মিল কিভাবে থাকতে পারে দুজন মানুষের চেহায়ার! সিজানই উত্তরটা দিয়ে দিলো, ‘আমরা আইডেনটিক্যাল টুইন ভাবি। আমাদের আলাদা করতে আপনার বেশ বেগ পেতে হবে।’

বাহার ঈষদ হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘সরি, আমি সত্যিই চিনতে পারিনি সিজান ভাই।’

– একদম ভাই বলবেন না। এক দুই মিনিটের হলেও ছোট আমি। আমি নিজেকে ছোট ভাবতে বেশ ভালোবাসি। তাই আমার নাম ধরে ডাকবেন ভাবি।

সিজান দেখি সিয়ামের চেয়েও এক ডিগ্রি বেশি কথা বলে! সিয়াম শুরুতে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করতো। আর সিজান শুরু থেকেই চঞ্চলতা প্রমাণে অস্থির। সে এসেছে আংটির টাকা নিয়ে। ব্যাংক থেকে আসতে একটু দেরি হওয়ায় সে একসাথে আসতে পারেনি। মনে পড়লো বাহারের, সিয়ামকে সে ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। সিয়াম তখন দুষ্টু হেসে বলেছিল, ‘তোমার জন্য সারপ্রাইজ রাখলাম আমার ছোট ভাইকে।’

সত্যিই সারপ্রাইজ হিসেবে হাজির হয়েছে সিজান। আর কাটিয়ে দিয়েছে কিছু ধোঁয়াশা।

শপিং মলে বাহারের পুরো সময়টা কাটলো নিরামিষ ও চিন্তাকে বন্ধু বানিয়ে। প্রয়োজনীয় কলটা সে করতে পারছে না বাইরের মানুষগুলোকে অসম্মান করা হবে বলে। অথবা তারা ভাবতে পারে বাহার কাজের চাপ দেখাচ্ছে, ভাব দেখাচ্ছে। তাই বাহার বাসায় যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো।

বাসায় গিয়ে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে অরিত্রীকে ফোন করলো। বাইরের কাপড় ছাড়েনি সে, কুলকুল করে ঘামতে থাকা শরীরকে শীতলতা প্রদানে ফ্যানটাও ছাড়েনি সে। অরিত্রী ফোন ধরছে না। সে আবার করলো। এবার ফোন ধরেছে অরিত্রী। কিন্তু তাকে ভালো-মন্দ কিছুই বলতে না দিয়ে বাহার বলে উঠলো, ‘প্রিয়ংশু ব্যানার্জির কি কোনো যমজ ভাই আছে?’

অরিত্রী চমকে উঠলেও বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’

উত্তেজনায় বাহারের কন্ঠ কেঁপে উঠছে, ‘তারা কি আইডেনটিক্যাল টুইন?’

– হ্যাঁ, দুজনের চেহারায় এতো মিল যে এখনো বুঝতে পারি না আমরা। শুধু প্রিয় দাদা মুসলিম হয়ে যাওয়ায় আমরা এখন হিম দাদাকে চিনতে পারি।
– কি নাম বললি? হিম?
– হিমাংশু ব্যানার্জি। আমরা হিমদা বলি।

হেসে উঠলো বাহার, তবে নিঃশব্দে। অরিত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চোখ বন্ধ করে হাসলো সে। দ্রুত ফেসবুক জগতে ঢুকে সে খুঁজতে শুরু করলো হিমাংশুর আইডি। প্রথমেই চলে এলো বি-অ্যারোমা কোম্পানির উত্তরসূরি হিমাংশু ব্যানার্জির আইডি যেখানে নামের পাশে নীল টিক চিহ্ন দ্বারা বোঝা যাচ্ছে সে বিশেষ ব্যক্তি। এবাউট অপশনে লেখা, ‘লিভস ইন লন্ডন। স্টাডিস বার অ্যাট ল ইন ব্রিটিশ কাউন্সিল।’

একজন সুপরিচিত কোম্পানির উত্তরাধিকারি, উচ্চ ডিগ্রি সম্পন্ন ব্যারিস্টারের কাছে লাইসেন্স যুক্ত পিস্তল থাকা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়?

_________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here