‘ধূম্রজাল’
দ্বিতীয় পর্ব

তাবিনা মাহনূর

________

রাত নেমেছে। বাহার তার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো ল্যাপটপে টুকে রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। অনেকক্ষণ একভাবে বসে থেকে কাজ করায় ঘাড়ে ব্যথা করছে। আজকে যেই মেয়েটার সাথে সে দেখা করেছে সেই মেয়েটা নেশাদ্রব্য সেবনের কারণে বাসার কাজের মেয়েটাকে খু-ন করেছে। কিশোরী মুনিয়াকে কিশোর সংশোধনাগারে রাখা হবে। তার আগে মুনিয়ার মানসিক অবস্থা যাচাই করে তাকে কেমন সেবা দিলে সে কতটুকু উন্নতি করবে, এসব বিষয় পরিকল্পনা করে রাখা হলো।

কিশোরী মুনিয়ার বয়স কম নয়। দেখে মনে হলো আঠারো পার হয়েছে, কিন্তু সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স এখন সতেরো। বাহার তাকে দেখেই বুঝেছে মুনিয়া মোটেও কিশোরী নয়। মিথ্যে বয়স আর আঠারো বছরের অদ্ভুত নিয়মের কারণে মুনিয়া খু-নের মতো বড় পাপ করেও কেমন ছোটখাটো শাস্তি পাচ্ছে! বাহার যখন মুনিয়ার মানসিক অবস্থা যাচাই করছিল, তখনো সে বুঝেছে মুনিয়া ছোট নয়।

এভাবেই অপরাধ জগৎটা তার নিজস্ব মতে চলছে। চাইলেই তারা শাস্তির বিধান বদলে, মানুষকে পুতুলের মতো চালিয়ে নিজেদের নোংরা উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে। বাহারের মাঝে মাঝে সব ছেড়ে একাকী ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। চারিপাশের নোংরা বলয়ের মাঝে থাকতে থাকতে তার মনের রং ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, বিবশ তার অনুভূতি।

মা হানজালা সেই রং ফিরিয়ে আনতে প্রায়ই বিয়ের কথা বলেন। কিন্তু বাহারের মনে কারো প্রতি আকর্ষণ কাজ করে না। আবির ছেলেটা ভালো হলেও তাকে দেখে কেন যেন মনের মাঝে কোনো ঘন্টা বাজে না। তাই আজও বাহার একা, ধূসর রঙা মন নিয়ে মরীচিকার পেছনে ব্যস্ত।

ফোনের আওয়াজ শুনে বাহার ফোন হাতে নিলো। আবির কল করেছে। ছোট এক শ্বাস ফেলে সে কল ধরে বললো, ‘আবির? এত রাতে?’

– কোথায় রাত? কেবল একটা বাজে।
– রাত একটা তোমার কাছে রাত নয়?
– উহু, আচ্ছা এসব ছাড়ো। তুমি কালকে অফিসে আসবে?
– না। আজ মুনিয়ার কেসটা শেষ হলো। এখন নতুন কোনো কেস হাতে নেই। তাই আগামী তিনদিনের জন্য অফিস ছুটি নিয়েছি।

আবিরের মন খারাপ হয়ে এলো। তবে সে সেটা প্রকাশ না করে বললো, ‘কাল এমনিই একটু বের হবে? ধরো বিকেল বেলা একসাথে দুজন কোথাও বেরিয়ে এলাম…’

– না আবির। আমি অন্তত একটা দিন আরাম করতে চাই। কাল পুরো দিন বাসায় থেকে বিশ্রাম নিব। বাইরে যদি যাই তাহলে পরশু দিন যাবো।
– ওকে ফাইন। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
– তোমার কাজ নেই কাল?
– আমার তো প্রায় সবসময়ই কাজ। এদিকে আবার নতুন মামলা। ডক্টর শামসুজ্জামান তোহার মামলা বেশ জটিল। ওহ বাহার! জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা, তুমি কি সাদিকে চেনো? তখন প্রশ্ন করা সত্ত্বেও তুমি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গিয়েছিলে।

মনে পড়লো বাহারের, সাত বছর আগে তার বান্ধবী অরিত্রী চক্রবর্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে সে দেখেছিল প্রিয়ংশুকে। প্রিয়ংশু ব্যানার্জির আরো একটা পরিচয় আছে। প্রিয়ংশুর সেদিনের আলাপে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল বাহারের মুখে। অরিত্রীর বিয়েতে সে পরেছিল কালো রঙের জামদানি শাড়ি এবং মুক্তার গয়না। তার খোঁপায় ছিল বেলির সুবাস। সবাই চোখ জুড়িয়ে তার দিকে তাকালেও সে খেয়াল করেছিল প্রিয়ংশু একবারও তাকে দেখে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনি।

এরপর তার কেন যেন নিজেকে বেদামি মনে হয়েছিল। হিন্দু থেকে মুসলিম, সকল পুরুষের চোখে সে ছিল অনিন্দ্য সুন্দরী। অথচ প্রিয়ংশু যেন তাকে দেখেও না দেখার ভান করছে। বাহার সেদিন বুঝতে পারেনি প্রিয়ংশুর সেই অনাগ্রহী মনোভাব কেন সে মেনে নিতে পারছিল না। তবে সে স্বেচ্ছায় যায়নি। তার হাত ধরে তারই এক বান্ধবী প্রিয়ংশুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। যখন সে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘আমি গুলবাহার সাখাওয়াত।’

তখন প্রিয়ংশু তার টোল দৃষ্টিগোচর করে হালকা হেসে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘আমি প্রিয়ংশু ব্যানার্জি।’

আর বাহার থমকে গিয়েছিল সেসময়। এ যে হিন্দু ছেলে! সে কেন যে হিন্দু বাড়িতে এসে ছেলেটাকে মুসলিম ভেবে বসে ছিল! বাহার তার মনের অবস্থা বুঝতে না দিয়ে নিজের পরিচয় জানিয়েছিল। এভাবেই সে জানতে পারে প্রিয়ংশু ব্যানার্জি সম্পর্কে অরিত্রীর মামাতো ভাই এবং সেই সাথে নামকরা কোম্পানি বি-অ্যারোমার প্রতিষ্ঠাতার নাতি।

প্রিয়ংশু বাহারের মতো রূপবতীকে দেখে টলেনি এর কারণ তার প্রিয়তমা স্ত্রী। স্ত্রী সাবিত্রীকে দেখামাত্রই সে হাত বাড়িয়ে কেমন আদুরে ভঙ্গিতে জড়িয়ে নিয়েছিল নিজের বাহুদ্বয়ের মাঝে। বাহার অবাক হয়ে দেখেছিল, প্রিয়ংশু কত প্রাণবন্ত হাসি হাসছে স্ত্রীকে কাছে পেয়ে!

ভাবনার সুতো কাটলো আবিরের কন্ঠ শুনে, ‘হ্যালো, হ্যালো! তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে বাহার?’

বাহারের সম্বিৎ ফিরলো। সে বলে উঠলো, ‘হুম, দেখেছিলাম একটা অনুষ্ঠানে। অরিত্রীর কথা মনে আছে?’

– কোন অরিত্রী? চক্রবর্তী নাকি চৌধুরী?
– চক্রবর্তী। ওর বিয়েতে তুমি যাওনি মনে হয়।
– না, অরিত্রী চক্রবর্তির সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল না। দূর থেকে দেখা হলে হাই-হ্যালো ছাড়া আর কোনো কথা হতো না।
– আমি ঐ লোকটাকে অরিত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। উনার বয়স আছে, দেখে বোঝা যায় না।
– মানে?
– মানে কম করেও তেত্রিশ চৌত্রিশ বছর হবে উনার। আমার বয়সই তো ঊনত্রিশ হলো।
– তোমার সাথে উনাকে মেলাচ্ছ কেন তুমি?
– আরে, সাত বছর আগে দেখেছিলাম উনাকে। ওইসময় বিবাহিত ছিল লোকটা। এখনো তেমনই আছে দেখতে। তাই মিলিয়ে দেখলাম ছেলেরা সহজে বুড়ো হয় না।

হেসে উঠলো আবির, ‘আর মেয়েরা?’

বাহার বললো, ‘মেয়েদের বয়স আর বুড়ো হওয়ার অনুপাত আপেক্ষিক। এটা নির্ভর করে ছেলেদের উপর। তারা যেভাবে মেয়েদের বয়স কল্পনা করবে, সেটাই সেই মেয়ের বয়স অনুযায়ী বুড়ো হওয়ার অনুপাত।’

– বাহ! ফিলোসফি নিয়ে পড়া শুরু করেছো নাকি?
– মজা করছি না আবির। তোমার বয়সও আমার মতো। অথচ তুমি এখনো যুবকের মতো দেখতে। আমাকে দেখলেই বোঝা যায় ত্রিশের কাছাকাছি চলে এসেছি।
– তাতে কি? মেয়েরা পঞ্চাশ হলেও ছলনাময়ী থেকে যায়।

বাহারের কথা বলতে ভালো লাগছে না। এখন তার ঘুমের প্রয়োজন। সে কথা শেষ করতে বলে উঠলো, ‘আবির, এখন রাখি। ঘুম ধরেছে।’

আবির দ্রুত বলে উঠলো, ‘এই এই! আমাকে উত্তর দাও যে সাদির সাথে তোমার কিভাবে পরিচয়? ওকে দেখে কি মনে হয় ও অপরাধী হতে পারে?’

‘আমার পরিচয় সাদি না, প্রিয়ংশুর সাথে ছিল’, এই বলে বাহার কল কেটে দিলো। নাহলে আবির যেকোনো অজুহাতে কথা চালিয়ে রাত তিনটা বাজিয়ে ফেলবে।

__________

আজ অফিসে কাজ নেই। বাসায় থেকে বিশ্রাম নিতে চাইলেও বাহারের মন যেন ক্লান্ত হতে চায় না। তাই আজও বাহার নেমে পড়লো তথ্য সন্ধানে। আজকের বিষয় প্রিয়ংশু ব্যানার্জি যার এখনকার পরিচয় সাদি হাসরাত।

বন্ধু নিলয়, তারপর প্রান্ত এবং সবশেষে রাশার কাছ থেকে অরিত্রীর ফোন নম্বর জোগাড় করলো বাহার। অরিত্রীর মামাতো ভাই প্রিয়ংশু। তাই সাদি হাসরাতের পরিচয় জানতে অরিত্রীর সাহায্য নিতে হবে তাকে। অরিত্রী ফোন ধরলে সে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললো, ‘কি খবর অরি? আমাকে চিনেছিস?’

– আরে বাহার! চিনবো না কেন? তোর কন্ঠ সবচেয়ে অনন্য। একবার শুনলে যে কেউ মনে রাখতে পারবে।

অরিত্রী এমনই হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু এতোটা খুশি আচরণ বাহার আশা করেনি। নিজের আত্মীয় খু-নের দায়ে জেল খাটতে চলেছে, অথচ অরিত্রীর যেন কোনো চিন্তাই নেই! বাহার শুরুতেই সেই প্রসঙ্গে গেল না। প্রথমে কিছু সাধারণ কথাবার্তা সেরে সে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা দোস্ত, তোর একটা মামাতো ভাই ছিল না?’

– কোন ভাই?
– প্রিয়ংশু ব্যানার্জি?

চুপ করে আছে অরিত্রী। বাহার উত্তরের অপেক্ষায়। কিছুটা ধীর স্বরে অরিত্রী বলে উঠলো, ‘প্রিয়ংশু বলে আমাদের পরিবারে কেউ নেই। তুই এই নামের কারো কথা জিজ্ঞেস করবি না।’

– ওমা! আমার সাথে উনার পরিচয় হয়েছিল তোর বিয়ের দিন। উনি তো…
– ছিল একজন। এখন কেউ নেই। কিন্তু তুই হঠাৎ তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
– তুই টিভি দেখিসনি? দোস্ত, আমাকে ভুল বুঝিস না। আগেই বলে রাখি, আমি পাশের বাসার আন্টিদের মতো নই যে তোদের বংশের বদনাম করতে প্রিয়ংশুর কথা তুলে আনছি। তুই হয়তো জানিস না, আমি অপরাধ মনোবিজ্ঞানের কর্মী। এ কারণেই…
– আমি তোকে ভুল বুঝছি না বাহার। তবে আমাকে এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করলেই খুশি হবো।
– শুধু এটুকু বল যে উনি কি মুসলিম হয়েছেন?
– হুম।
– তাহলে আমি ভুল দেখেনি। আচ্ছা, উনি হঠাৎ মুসলিম কেন হলেন?
– আমি জানি না। তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

বাহার বুঝতে পারলো অরিত্রী বিরক্ত বোধ করছে। সে মিষ্টি হেসে বললো, ‘আচ্ছা সমস্যা নেই। অনেক ধন্যবাদ তোকে। উনার সম্পর্কে জানা খুব প্রয়োজন ছিল এই কেসের জন্য।’

ফোন রাখার পর বাহারের মনের অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। সাদি হাসরাতের জীবনী না জানা পর্যন্ত সে স্বস্তি ফিরে পাচ্ছে না। বিকেলে আবিরের সাথে বের হলে হয়তো একটু মনের প্রশান্তি মিলবে। এই ভেবে আবিরকে ফোন করে দেখা করার কথা বলে রাখলো।

বিকেল বেলা আবিরের সাথে ধানমন্ডি লেক, চন্দ্রিমা উদ্যান, এসব জায়গায় ঘুরে একটা পিজ্জার দোকানে গিয়ে দুজনে বসলো। আবিরকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে সে বড় এক প্ৰশ্বাস নিয়ে বললো, ‘রোদ নেই কিন্তু গরম লাগছে।’

– হুম, তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি খুব ক্লান্ত। আগে ঠান্ডা ধরণের কোনো খাবার খাও। আইসক্রিম অর্ডার করবো?
– আমি করছি, তুমি বসো।
– আমি করছি তো, তুমি আরাম করে বসো।

যেসব দোকানে সেল্ফ সার্ভিস সিস্টেম, সেসব জায়গায় আবিরের যেতে ইচ্ছে করে না। এই যেমন এখন বাহারকে উঠে গিয়ে আইসক্রিমের অর্ডার করতে হলো। ছেলে মানুষ হিসেবে নিজেকে অযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু তার শরীর আজ সত্যিই খারাপ। নতুন এক আসামিকে মারতে মারতে দুটো দাঁত ফেলে দিয়েছে তবু সেই আসামি ডাকাতির ঘটনা স্বীকার করছে না। আপাতত সাদিকে নিয়ে বড় বড় সিআইডি-রা কাজ করছেন। তাই এই ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। ছোট মামলাগুলোই সামলে রাখছে সে। আজকে সে এমনভাবে মেরেছে যে নিজের হাতে পায়ে ব্যথা করছে।

তবে একটা বিষয় ভেবে আবির আনমনে হেসে উঠলো। তা হলো নারী-বাদ। এখানে কোনো কোমলমতি মেয়ে থাকলে সে শত বারণ উড়িয়ে নিজেই যেতো অর্ডার করতে। কিন্তু বাহার একজন প্রতিষ্ঠিত এবং স্বাধীন নারী। সে যেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী, আবির তাতে নাক গলানোর অধিকার রাখে না। বাহারকে মানা করলে সে সেটা পুরুষদের কর্তৃত্ব ফলানোর অপচেষ্টার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে থাক নাহয়! বরং তারই ভালো হলো। কষ্ট করে উঠে যেতে হলো না। সে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না নারীরা কেন যেচে এসবের ভার নিতে চায়? পুরোপুরি ভার নিতে হয় না বলে তারা এখনো বোঝে না কত কষ্ট আর যন্ত্রণার পর দিনটা শেষ হয় রাত্রির স্পর্শে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা নারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান গড়েছেন, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এমন কিছু নিয়মের যা নারীদের জন্যই মঙ্গল। অথচ আজকের নারীরা সেইসব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের গড়া অদ্ভুত নিয়মে চলছে। ঠিক নিয়ম নয়, বিশৃঙ্খল জীবন। সাজানো গোছানো একটা অধ্যায়কে তারা উল্টে-পাল্টে নিজেদের অবস্থান করেছে ভঙ্গুর। একটা সময় আসবে, যখন বেশিরভাগ পুরুষ পূর্বের নারীদের মতো ঘরে থাকবে অথবা কাজের ভার বহন করতে অস্বীকৃতি জানাবে। সেসময় নারীরা কেমন পুরুষত্ব দেখিয়ে সমাজ চালাবে, তা যেন অকল্পনীয়! কারণ এখন পর্যন্ত দু পক্ষ থেকে সমান চলে আসছে। একটা সময় ছিল শুধু পুরুষের, এরপর আসবে শুধু নারীদের। তখন বোঝা যাবে নারীরা সত্যিই পারে, নাকি শুধুই মিথ্যে বুলি ওড়ায়।

ভাবনার নৌকা পাড়ে এনে আবির দেখলো বাহারকে। আজ বাহার একটা ফতুয়া আর পায়জামা পরেছে। গলায় ওড়না ঝোলানো। মেয়েটার পেশা অনুযায়ী মেয়েটাকে ছেলেদের মতো কোট-প্যান্ট পরতে হতো। কিন্তু সে অপশনাল পোশাক শাড়িটাকেই মূল পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাহলে বাহারের মনে হয়তো কিছুটা শালীনতা আছে। আজকাল আবার দ্বীনি নারী-বাদীও বের হয়েছে অবশ্য। তবে বাহার অতটাও ধার্মিক নয়। আবির মনের মাঝে চেপে রাখা প্রশ্নটা আজ করেই ফেললো, ‘বাহার, তুমি শাড়ি কেন পরো? তোমার পেশা অনুযায়ী শার্ট প্যান্ট পরাটাই শোভা পেতো না?’

বাহার হাত দুটো টেবিলের উপর রেখে বললো, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

– না মানে, তোমাকে আমি আধুনিক মুক্তমনা মেয়েদের মতোই চলতে দেখেছি। কিন্তু পোশাকে কেন যেন তোমার মাঝে বাঙালি নারীদের ছাপ দেখতে পাই। সবসময় একটা শালীনতা, আই মিন, বাঙালিয়ানা ভাব বজায় থাকে।

বাহার উত্তরটা গুছিয়ে দিলো, ‘প্রথমত, আমি এমন এক ঘরের মেয়ে যেখানে পাশ্চাত্য পোশাকের মূল্য কম, বাঙালিয়ানা বেশি। এবং দ্বিতীয়ত, আমার নিজস্ব একটা স্বাধীনতা আছে। আমার মন সবসময় বাঙালি পোশাক, সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট বোধ করে। তাই শার্ট প্যান্ট কিংবা কোট টাই পরার ইচ্ছে কোনোকালেই ছিল না।’

আবিরের মনে হলো বাহার রেগে যাচ্ছে। হয়তো এমন প্রসঙ্গ তার পছন্দ হয়নি। সে কথা ঘুরিয়ে বললো, ‘বুঝেছি, তুমি তোমার বৈশিষ্ট্যে অনন্য!’

মুচকি হাসলো বাহার। ইতিমধ্যে পিজ্জা চলে এসেছে। আইসক্রিম খাওয়া শেষে পিজ্জার দিকে হাত বাড়ালো আবির। খাওয়ার মাঝে আবির খেয়াল করলো, বাহারের মনোযোগ খাবারের দিকে নেই। সে আনমনে অন্য জগতে বিচরণ করছে। আবির বললো, ‘তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে, কিছু হয়েছে বাহার?’

কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাহার বলে উঠলো, ‘আবির, তুমি কি প্রিয়, মানে সাদি হাসরাতের মামলাটা হ্যান্ডেল করছো?’

আবির বুঝতে পারছে না সাদিকে নিয়ে বাহারের এতোটা কৌতূহলের কারণ কি। সে ভ্রু জোড়া দুবার উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তার আগে তুমি বলো, সাদিকে নিয়ে তোমার এতো আগ্রহ কেন? একটা গুরুতর আসামিকে নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ বুঝতে পারছি না বাহার।’

– আবির, তুমি কি ভাবছো জানি না। কিন্তু আমাকে ভাবতেই হচ্ছে, মোট কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। সাদির আসল পরিচয় তুমি জানো?
– কোন পরিচয়? প্রিয়ংশু?
– হুম।
– প্রিয়ংশুর আগে পরে কোনো পদবি নেই? দেবনাথ কিংবা…
– ব্যানার্জি। প্রিয়ংশু ব্যানার্জি।
– এটা তো ব্রাক্ষ্মণ বংশের পদবি। খুবই উচ্চমানের। তাহলে সাদি কি কোনো জ-ঙ্গি দলের চাপে পড়ে…
– আমি এটাই বুঝতে পারছি না সে কিভাবে বদলে গেল? আরো বড় কথা, সে যেন তেন পরিবারের কেউ নয়। তার একটা বিশেষ পরিচয় আছে।
– কি? কে সে?

বাহার বলার পূর্বেই কেউ ‘বাহার’ বলে উচ্চস্বরে ডেকে দৌড়ে কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। হতভম্ভ বাহার দেখলো, তার বান্ধবী রাশা এবং পেছন পেছন নিলয় ও প্রান্ত এসেছে। অনেকদিন পর বন্ধুমহলের কয়েকজনকে পেয়ে সে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লো। গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো চাপা পড়ে গেল আনন্দ উল্লাসের ভারে।

_________

– স্যার, আসামি সাদি রমনা থানার অধীনে রয়েছে। তাই ওসি রূপম সমস্ত দায়িত্ব আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি আপনাকে অনেক ভরসা করেন।

ওসি গালিব পরিশ্রান্ত মুখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। এইতো কিছুদিন আগে এক মন্ত্রীর ছেলে নিজের স্ত্রীকে মেরে ফেলায় বিষয়টা ধামাচাপা দেয়ার কাজে তাকে বেশ খাটতে হয়েছে। এখন আবার বিশাল মামলা। ডক্টর তোহার মৃত্যু কোনো সাধারণ বিষয় নয়। তিনি ছিলেন দেশের গর্ব, রত্ন। তার অমূল্য অবদান তাকে যেমন বেঁচে থাকতে সম্মানিত করেছে, তেমন মৃত্যুর পরও তার জন্য সকলের শ্রদ্ধা ও সচেতনতা শীর্ষে। তাই তার মৃত্যুর পেছনের রহস্য উদঘাটনে জোর তদন্ত চলছে। তাছাড়া তার অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যপূর্ণ প্রমাণপত্র হারিয়ে গিয়েছে যেটা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ওসি গালিব এএসপি নাকিবকে চলে যেতে বললেন। এই মুহূর্তে নিজের দায়িত্বের কথা ভাবলেই জ্বর চলে আসছে। এসব ভরসা বাক্য শোনার পর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার উপর পেয়েছেন একটা আসামি। মুখ থুবড়ে ভেঙে ফেললেও কথা বের হয় না।

এমন সময় আরেকটা খবর তার ক্লান্ত মনকে নিমিষেই আনন্দে ভরিয়ে তুললো। নাকিব এসে ফরেনসিক রিপোর্টের প্রমাণপত্র তার সামনে রেখে বললো, ‘স্যার, সিসিটিভি ক্যামেরায় সাদির চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’

___________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here