‘ধূম্রজাল’
দশম পর্ব
তাবিনা মাহনূর
_________
– এক্সকিউজ মি! আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
সাদির দুদিনের ছুটি শেষে আজ তৃতীয় দিন সে গিয়েছিল রিসার্চ সেন্টারে। সেখানে গিয়ে নিজের কক্ষে কিছু টেস্টিং কীট তৈরি রেখে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে সে। তবে সে সরাসরি বাসায় যাবে না। এখন যে বাসায় আছে, সেই বাসা ছেড়ে নতুন ছোট বাসা নিবে সাদি। কারণ সে রিসার্চ সেন্টারের চাকরিও হারাতে বসেছে। আর কয়দিন পর আর্থিক সংকট দেখা দিলে বড় বাসায় থাকা সম্ভব হবে না।
সেই প্রয়োজনে হেঁটে হেঁটে অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে কোনো বাসায় টু-লেট আছে কিনা তা দেখছে সাদি। কিন্তু পথিমধ্যে বোরখা পরিহিত এক নারী তাকে ডেকে উঠলো। সাদি ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে নাকে হাত দিয়ে অচেনা নারীকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলো। ফুটপাত থেকে নেমে সে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলে অচেনা নারীটি দ্রুত নেমে তার পিছু নিলো। পেছন থেকে তার শার্ট খামচে ধরে নারীটি বললো, ‘আমি ছেলেধরা নই যে নাকে হাত চেপে রাখবেন। আমি গুলবাহার।’
সাদি এক ঝটকায় শার্ট ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালো। কপালে রেখা টেনে সে বললো, ‘সরে দাঁড়ান। কাছে আসবেন না একদম!’
বাহার তার নিকাব উঁচিয়ে চেহারা দেখিয়ে বললো, ‘আপনি আমাকে অবিশ্বাস করবেন না দয়া করে। আমি আপনার বিষয়ে জানতে পেরেছি বলেই এসেছি। কেউ যেন চিনতে না পারে তাই ফুপির বোরখা পরে এসেছি।’
সাদি কোনো গুরুত্ব দিলো না। তার বিষয়টা সম্পর্কে সিআইডি বিভাগের প্রত্যেকেই অবগত। সবাই জেনেশুনেও না জানার ভান করছে। তাই তারা বাহারকে নতুন টোপ হিসেবে ব্যবহার করে সাদিকে জালে জড়িয়ে নিতে চাইছে কিনা, তা সাদি নিশ্চিত নয়। সে পকেটে দু হাত গুঁজে বললো, ‘যা বলতে চান এখানে দ্রুত বলে ফেলুন।’
বাহার বললো, ‘আপনার আইডেনটিক্যাল টুইন ব্রাদার হিমাংশু ব্যানার্জি খু-ন করেছে, তাই তো?’
সাদি ঠোঁটে উপহাসের হাসি এঁকে বলে উঠলো, ‘নতুন কিছু বলুন। এ কথা সবাই জানে।’
অবাক হলো বাহার, ‘মানে! আমি তো জানতাম না। আমি নিজেই এটা সমাধান করে বের করেছি।’
‘খুব ভালো করেছেন’, এই বলে সাদি আবার চলে যেতে চাইলে বাহার বলে উঠলো, ‘আপনার ভাইয়ের পিস্তল আছে, তার চেহারা আর আপনার চেহারায় কোনো অমিল নেই তাই সে চেকইন করতে পেরেছে। আর আইডেনটিক্যাল টুইনদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট একই রকম হয়ে থাকে যেটা সাধারণ যমজদের থাকে না।’
সাদি হেঁটে চলে যাচ্ছে। এসব পুরোনো কথা শুনে কানের কাজ আর বাড়াতে চায় না সে। কিন্তু বাহার পিছু ছাড়েনি। সে পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘কিন্তু গোপন কক্ষের খবর আপনার ভাই কিভাবে জানতে পারলো?’
থেমে গেল সাদি। পেছনে না ফিরেই সে বলে উঠলো, ‘অর্ধেক তথ্য বের করেছেন, বাকিটাও নিজেই বের করুন।’
সাদি কোনোকিছু সরাসরি বলে না। এই ব্যাপারে বাহার বরাবরই বিরক্ত। এবারও সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শূন্যে হাত ঝাঁকিয়ে নিজের রাগ প্রকাশ করে বললো, ‘ওহ! এরকম ঘাড়ত্যাড়া মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি।’
সাদির তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এখন এই ফাঁকা গলি থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজবে। তাড়াতাড়ি এই মহিলার থেকে নিস্তার না পাওয়া পর্যন্ত তার শান্তি হবে না। কিন্তু বাহার তাকে ছাড়ছে না। পেছন পেছন আসছে আর কথা বলেই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে সাদি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘স্টেরি রোজারিও হিমকে গোপন কক্ষের খবর দিয়েছে। রণজিৎ, হিম, স্টেরি, এরা তিনজনই ওই পেপার্স নিয়ে তোহা স্যারের বিরুদ্ধে ছিল। তাই স্যারকে মেরে ফেলতে তারা দেরি করেনি। আর আমিও ছিলাম স্যারের পক্ষে। তাই আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে সব রকম ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে পেপার্স নিয়ে। যেটা কোথায় আছে তারা কেউ জানে না।’
বলেই সাদি দ্রুত হেঁটে গলি পার হয়ে হাঁক ছাড়লো, ‘মামা! আজিমপুর যাবেন?’
সাদি গড়গড়িয়ে অনেক তথ্য বলে দিয়েছে। তারপরও বাহারের মনে তৈরি হওয়া সব প্রশ্নের উত্তর মিলেনি। ইতিমধ্যে সাদি একটা রিক্সা খুঁজে পেয়েছে। তাতে চড়ে সে মামাকে যেতে বললে বাহার দ্রুত পথ রোধ করে বললো, ‘আপনি যে বলেছিলেন পেপার্স আপনি চুরি করেননি?’
হেসে উঠলো সাদি, ‘তোহা স্যার নিজে আমাকে আমানত হিসেবে সেগুলো রাখতে বলেছিলেন। আমি কেন চুরি করবো?’
বিস্মিত কণ্ঠে আরো একটি প্রশ্ন করলো বাহার, ‘আসলে কী আছে ওই পেপারে?’
রিকশা চলতে শুরু করেছে। সাদি দৃঢ় মুখে সম্মুখে তাকিয়ে। বাহারকে হতবাক করে দিয়ে সে কিছু না বলেই চলে গেল।
__________
বেশ কয়েকমাস পূর্বে…
– সাদি, তুমি আমাকে এই শেষ বয়সে এসে কী বোঝাতে চাইছো বলো তো? আমার ছেষট্টি বছরের জীবনে আমি কখনোই ধর্মের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিনি। তুমি রাগ করো না, আমি ধর্ম বিষয়টাকে স্রেফ মানুষের দুর্বলতা মনে করি।
কফির মগটা টেবিলে রেখে ঠোঁট ভিজিয়ে সাদি প্রশ্ন করলো, ‘দুর্বলতা? কেমন?’
তোহার উত্তর, ‘প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজতে আগে নিজের বুদ্ধি খাটিয়েছে। তারপর যখন তারা সমাধান করতে ব্যর্থ হতো তখন আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করতো, যেন কোনো অলৌকিক সত্তা তাদের সমস্যার সমাধান করে। এভাবেই ধর্মের উৎপত্তি। মানুষ নিজের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ধর্ম নামক একটি অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। এখনকার সমাজ অনেক উন্নত। যেকোনো সমস্যার সমাধান বিজ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব। আমরা জানি, অলৌকিক সত্তা বলে কিছু নেই। ওগুলো মানুষের দুর্বল সত্তার অস্তিত্বহীন প্রকাশ। তাই আমরা কেন ধর্ম বিশ্বাস করবো বলো তো?’
সাদি মুচকি হাসতে গিয়ে কিছুটা শব্দ করে ফেললো। তোহা কৈফিয়তের সুরে বললেন, ‘না দেখো, আমি এটাকে যার যার ব্যক্তি স্বাধীনতা মনে করি। তাই তোমার যদি ধর্ম পালন করতে ইচ্ছে হয় তাতে আমি বাধা দিব না অবশ্যই। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে তোমাকে হিন্দু দেখেছি। এখন দেখছি তুমি মুসলিম। এতেও আমার কোনো অসুবিধা নেই। কারণ এটা তোমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু সাদি, আমাকে একটা কথা বলো। এইযে তুমি বললে জিন ক্লোনিং ক্ষেত্র বিশেষে হারাম, আর এই কারণে এটার সাথে তুমি সম্পৃক্ত থাকতে চাও না, এই সিদ্ধান্ত নেয়া কি উচিত হয়েছে? জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং না থাকলে আমরা উন্নত প্রজাতির জীব পেতাম কি করে? তুমি আসলেই বোকা সাদি। এতো এতো উন্নয়ন এভাবে অস্বীকার করতে পারো না।’
– অস্বীকার করছি না স্যার। অবশ্যই বিজ্ঞান আমাদেরকে উন্নতির পথ দেখিয়েছে। বৈদ্যুতিক আলো, যাতায়াতের সুবিধা সহ জীবনযাত্রায় অনেক ভূমিকা আছে এই বিজ্ঞানের। কিন্তু বিজ্ঞানের সৃষ্টি করেছে মানুষ, আর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা, আল খলিক। তাঁকে আমরা কয়জন স্বীকার করি? তিঁনি যদি আমাদের জ্ঞানী রূপে, আশরাফুল মাখলুকাত রূপে না পাঠাতেন তাহলে এসব উন্নয়ন কোথা থেকে আসতো?
তোহা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি সত্যিই চিনতে পারি না তোমাকে। আমার সেই ছাত্র, যে টপ রেজাল্ট করতো। শুধু তাই না, যে দেশ বিদেশ থেকে বিতর্কের উপর ট্রফি নিয়ে এসেছে, দাবা খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সেই ছাত্র এমন অদ্ভুত চিন্তাধারার কিভাবে হতে পারে!’
সাদি মৃদু হেসে বললো, ‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিঁনি আমাকে দয়া করেছেন তাই আমি আলোর পথ দেখেছি।’
– প্রি… সাদি শোনো। জিন ক্লোনিং এর ব্যাপারে তোমার ধর্ম কোনো পূর্বাভাস দেয়নি? যেকোনো তথ্যই নাকি ক্বুরআনে লেখা আছে।
সাদি উত্তরটা গুছিয়ে বললো, ‘প্রথমত একটা বিষয় এই যে, সবকিছুর খোঁজ ক্বুরআনে করে একে প্রশ্নবিদ্ধ করা একদম অনুচিত। কারণ সূরা বাক্বরার দ্বিতীয় আয়াতেই আল্লাহ সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে দিয়েছেন, এই কিতাবকে সন্দেহমুক্ত ঘোষণা করে। তাই বিজ্ঞান অতীতে কি আবিষ্কার করেছে, ভবিষ্যতে কি আবিষ্কার করবে তা ক্বুরআনে খোঁজ না করাটাই শ্রেয়। কারণ এভাবে ক্বুরআনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।’
এর পৃষ্ঠে তোহা কিছু বললেন না। তিনি সহনশীল প্রকৃতির মানুষ। তাই তিনি চুপচাপ সাদির কথা শুনলেন।
– আর দ্বিতীয়ত, কা-ফিরদের প্রশ্নের অত্যাচারে কিছু মুসলিম বাধ্য হন ক্বুরআনের সায়েন্টিফিক দিকগুলো তুলে ধরতে। এতে অবশ্য ঈমান কমে না, বরং আরো বৃদ্ধি পায় যে আল্লাহ কতই না প্রজ্ঞাবান! তাই আমাদের মুসলিম সমাজের কিছু ভাইয়েরা না-স্তি-কদের প্রশ্নের জবাব দিতে ক্বুরআনের কি ওয়ার্ড গুলো থেকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। যেমন, মিরাজে ভ্রমণের ব্যাখাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমান করা যায়। এটা সরাসরি ক্বুরআনে লেখা নেই। এটা তাফসীরবিদগণ ভালো প্রমাণ করতে পারেন, কারণ তারা ক্বুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু চর্চা করেন। এবার আসি আপনার প্রশ্নে।
সাদি পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে আবার বলতে শুরু করলো, ‘জিন ক্লোনিং মূলত একটা জীবের কোষ থেকে পূর্ণাঙ্গ জীব তৈরি। এটা আপনি জানেন। যেমন, সর্ব প্রথম ভেড়ার একটি কোষ নিয়ে একদম ঐরকমই আরেকটি ভেড়া তৈরি করা হয়েছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল ডলি। ডলি মানুষের তৈরি ভেড়া, এটা বললে অবশ্য ভুল হবে। কারণ মানুষ ডলিকে তৈরি করলেও আল্লাহ যদি না চাইতেন তাহলে এটা সম্ভব হতো না।
হেসে উঠলেন তোহা, ‘আচ্ছা? ইন্টারেস্টিং! জিন ক্লোনিং হারাম অথচ আল্লাহ চাইছেন এটা হোক। এটা কেমন কথা সাদি?’
সাদিও হেসে উঠলো, ‘যেমনটা মানুষ চুরি করার ক্ষেত্রে করে। চুরি করা হারাম, কিন্তু তাকে আল্লাহ একটা হাত দিয়েছেন। তাকে হাতের ব্যবহার করার তৌফিক দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ তা দিয়েছেন ভালো কাজে ব্যবহারের জন্য। অথচ মানুষটা চুরি করে হাতকে খারাপ কাজে ব্যবহার করলো। এর দায় কখনোই স্রষ্টার নয়। এই ব্যাখ্যা অন্য কোনোদিন স্যার, আজ জিন ক্লোনিং নিয়ে বলি। আমি একদিন হুট করে এই ব্যাপারে একটা তথ্য পেয়ে যাই। সেটাই বলবো আপনাকে।’
– প্লিজ! আমি অপেক্ষায় আছি।
– আপনি জানেন, নবী আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন?
– হুম জানি।
– তারপর তিনি যখন নিঃসঙ্গতা অনুভব করলেন, তখন তার বুকের পাঁজরের হাড় থেকে হাওয়া আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়।
‘পয়েন্ট!’, বলে মৃদু চিৎকার করে উঠলেন তোহা। সাদি তা দেখে হেসে ফেললো। এরপর তাকে কিছুই বলতে হলো না। তোহা নিজেই বলে গেলেন, ‘পাঁজরের হাড়ের কোষ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি। জিন ক্লোনিং!’
সাদি বললো, ‘জি, ডিএনএ মিলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি হাওয়া আলাইহিস সালামকে একদম ভিন্ন এক মানবী রূপ দান করলেন। অর্থাৎ, জিন ক্লোনিং এর ব্যাপারটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। এটা মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই হয়ে আসছে।’
তোহা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘তাহলে তো আরও একজন আদম আলাইহিস সালাম তৈরি হওয়ার কথা ছিল?’
– সেটাই তো বললাম স্যার। আল্লাহ ক্লোন তৈরি না করে মানবী তৈরি করেছেন। আল্লাহর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তিঁনি পাঁজরের হাড় কেন ব্যবহার করলেন, এটাও তিঁনিই ভালো জানেন। কিন্তু আমি শুধু এটা বোঝাতে চাইছি যে পন্থাটা মোটেও মানবসৃষ্ট নয়। বরং মানুষের তো লজ্জা পাওয়া উচিত। তারা এক মানব থেকে অন্য মানব সৃষ্টি করে স্রষ্টার সাথে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। অথচ তারা ভিন্ন মানব তৈরি করতে পারেনি, এতে তাদের বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। সবকিছুই তারা স্রষ্টার সাথে তুলনা করে মেনে চলে। অথচ স্রষ্টা তুলনাহীন, তিঁনি আস সামাদ।
– আর ঐযে ক্ষেত্র বিশেষে বললে?
– জিন ক্লোনিং এর মাধ্যমে যদি চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে অণুজীবের উপর এই পরীক্ষা চালানো হয় তবে কিছু কিছু আলেমের মতে তা হালাল। কারণ আল্লাহ তা’লা ক্বুরআনে মূলত সেই সৃষ্টির ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন যেটা কোনো কিছু থেকেই উৎপত্তি হয়নি।
– আমি বুঝছি না।
সাদি বললো, ‘অর্থাৎ আমরা কখনোই অস্তিত্বহীন কোনো কিছুকে অস্তিত্ব দিতে পারব না। এটা একমাত্র আল্লাহই পারেন, কারণ তিনি স্রষ্টা। আর এ কারণে আলেমদের মতে, ক্লোনিং একটি অস্তিত্ব থেকে আরেকটি অস্তিত্ব তৈরি করার পদ্ধতি বলে এটা কিছু ক্ষেত্রে হালাল। তবে বেশিরভাগ আলেম ক্লোনিং কে সার্বিকভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন।’
চুপ করে আছেন তোহা। তিনি চিন্তায় মগ্ন। তারপর তিনি হঠাৎ বললেন, ‘শেষ কথা এই যে, তুমি আমাকে আমার রিসার্চ পেপারগুলো পাবলিশ করতে মানা করছো?’
– জি স্যার। শুধু মানা নয়, এগুলো যেন কারো কাছে না যায়।
– কিন্তু সাদি, আমি যে তোমার বাবা, মানে রণজিৎ ব্যানার্জির সাথে চুক্তি করে ফেলেছি।
– ভেঙে ফেলুন সেই চুক্তি। যেই ক্লোনিং এর কারণে মানবজাতির অকল্যাণ হবে, সেই কাজ করবেন না স্যার।
তোহা তার আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে বললেন, ‘আমি যে হালাল হারাম মানি না।’
– স্যার, আপনি কি বিশ্বাস করেন যে আপনি একদিন মারা যাবেন?
এই একটি কথাই তোহার সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই ঘুরিয়ে দিলো। তিনি বললেন, ‘আমি আজ রণজিৎ ব্যানার্জির সাথে কথা বলবো। আর আমার স্ত্রীর সাথেও। ধন্যবাদ সাদি, তুমি খুব সুন্দর পরামর্শ দিয়েছো।’
__________
সাদির টেস্ট রিপোর্ট এসেছে। আল্লাহর রহমতে তার গুরুতর কোনো রোগ ধরা পড়েনি, শুধুমাত্র ছত্রাক জনিত একটি চর্ম রোগ ধরা পড়েছে। এটার জন্য আজ সে ডাক্তারের কাছে যাবে। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধ সেবন করলে এবং মলম জাতীয় ঔষধ নির্দিষ্ট স্থানে লাগিয়ে এই রোগ সারিয়ে তোলা যাবে। এছাড়া তার সাধারণ কিছু সমস্যা যেমন ঠান্ডা লেগে যাওয়া, শরীর ব্যথার কারণে হালকা জ্বর এগুলো আছে যা ঔষধের উসিলায় সেরে যাবে ইন শা আল্লাহ।
মাগরিবের সালাত আদায় করে সাদি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। একটু আগে এএসপি নাকিব ফোন করে সতর্ক করে দিয়েছে যেন সাদি কোনোরকম চালাকি না করে। আগামীকাল সে রিসার্চ সেন্টারে যাবে যেখানে এখন এমডি ও সিইও হিসেবে আছেন স্টেরি রোজারিও। এবং সাদি যেখানেই কাগজগুলো রাখুক, তা সঙ্গে করে সেন্টারে যেতে হবে। স্টেরি নিজ চোখে কাগজগুলো দেখবেন, ফটোকপি করবেন এবং সাদির মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করবেন। তবে বাংলাদেশে কাগজের লেখা অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব নয়। তাই সাদিকে প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে দেশে বসে। এবং পরবর্তীতে তাকে নিয়ে স্কটল্যান্ডে যাওয়া হবে, যেখানে তোহা দীর্ঘ আঠারো বছর রিসার্চ করেছিলেন এবং স্থানীয় স্টেরির সাথে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
বের হওয়ার পূর্বে মোবাইলের ওয়াইফাই বন্ধ করতে গিয়ে নোটিফিকেশনের আওয়াজ শুনে সে ভ্রু কুঁচকে দেখলো, গুলবাহার সাখাওয়াত নামের একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে। সাদি বেশ বিরক্ত হলো। এক নম্বর কারণ, মেয়েটা পিছু ছাড়ছে না। জোঁকের মতো লেগেই আছে। দুই নম্বর কারণ, মেয়েটা গোয়েন্দা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও সাদির ব্যাপারে নাক গলানোর কারণে চাকরি হারাতে পারে। সেই সাথে সে ফেঁসেও যেতে পারে। সাদি সব দিক বিবেচনা করে বাহারকে ব্লক মেরে দিলো। নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ছেড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে। যত দ্রুত সম্ভব সে কাজ সেরে বাসায় ফিরবে। কালকের কথোপকথনের প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে।
অন্যদিকে, বাহার সাদির আইডি হারিয়ে ফেলায় হতবাক হয়ে বসে আছে। বারবার সার্চ করেও খুঁজে পেলো না সে। হঠাৎ তার মনে হলো, সাদি তাকে ব্লক করেছে। সে তার ফেক আইডি দিয়ে সার্চ করে সাদির আইডি খুঁজে পেলো। মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে এলো তার। সাদি কেন এই কাজ করলো সে বুঝতে পারলো না। সে একটা ম্যাসেজ দিয়েছিল সাদিকে, ‘প্রয়োজন আছে।’ সেটা কি সাদি দেখেনি?
এমন সময় হানজালা এলেন ঘরে। এসেই তিনি বললেন, ‘এই, তুই নাকি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিস?’
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)