‘ধূম্রজাল’
তৃতীয় পর্ব
তাবিনা মাহনূর
____________
রক্তাক্ত মেঝে। ছোপ ছোপ লাল রঙে ধুলোময় মেঝে দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছেন গালিব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্রোধ তাকে গ্রাস করছে। সাদিকে মারতে মারতে নিস্তেজ করে ফেলেছেন। পাশে দাঁড়ানো দুজন এএসপি নাকিব আর তুহিন। সিআইডি সাগর বেশি মেরেছেন। গালিব প্রথমে এলোপাতাড়ি ঘুষি দিয়ে সাদির কথা বলার শক্তি কেড়ে নিয়েছেন। এরপর সাগর দিলেন একের পর এক লাথি। এখন সাদি মেঝের উপর অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
গালিব মারার সময় সাদির দাঁতের সাথে হাতে ঘর্ষণ খাওয়ায় কব্জির উপরের অংশে ছিলে গিয়েছে। এন্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে তিনি নিজ কেবিনে ফিরে গেলেন। পেছন পেছন সাগর গেলেন। দুজনে এসি ঘরে কিছুক্ষণ ঠান্ডা হয়ে বিশ্রামের ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে থাকলেন। কারো মুখেই কথা নেই। তবে প্রথম নীরবতা ভাঙলেন সাগর।
– সাংঘাতিক চিজ! কিছুই স্বীকার করছে না।
গালিব সাগরের দিকে তাকালেন। ঘাম শুকিয়ে যাওয়া তেলতেলে মুখে রুমাল চালিয়ে তিনি বললেন, ‘বুঝতে পারছি না। বারবার এক কথা বলছে, সিসিটিভি ফুটেজ ভুল, সে নাকি কিছু চুরি করেনি। সব তথ্য প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে থাকার পরও কিছুতেই স্বীকার করছে না। এখন আমিই দ্বিধায় পরে গিয়েছি।’
সাগর ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আরো একবার ভিডিওটা দেখবেন নাকি?’
– কোন ভিডিও?
– সিসিটিভি ফুটেজের কথা বলছি।
– আরেকবার দেখে কি হবে? ওখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাদির হাত ধরে গোপন কক্ষে প্রবেশ করলেন তোহা। এরপর সাদি একাই বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজা লক করে হেঁটে হেঁটে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
– এর মাঝে কি অন্যকিছু হতে পারে না? ধরুন ফুটেজে কিছু কাঁটটছাঁট করেছে হয়তো…
– না সাগর। এটা নিরবিচ্ছিন্ন ভিডিও। ভিডিওতে গরমিল থাকলে আমরা সহজেই টের পেতাম। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
– কোথায়?
গালিব পিঠ টানটান করে বসলেন, ‘সাদি হাসরাতের আগের পরিচয় সে প্রিয়ংশু ব্যানার্জি। বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার সময় থেকেই ডক্টর তোহা তাকে স্নেহ করতেন। যেহেতু তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারপর প্রিয়ংশু একটি বেসরকারি সংস্থার দায়িত্বে চাকরি নিলো, আর ওভার টাইম হিসেবে তোহা রিসার্চ সেন্টারে যোগদান করলো। সময়ের স্রোতে প্রিয়ংশু হয়ে গেল সাদি এবং তোহা সেন্টারের বিশ্বস্ত কর্মচারী, এতোটাই বিশ্বস্ত যে ডক্টর তোহা নিজের গোপন কক্ষের কথা মাত্র তিনজনকে বলেছিলেন। সেই তিন জনের একজন সাদি হাসরাত।’
– বাকি দুজন?
– উনার অ্যাসিস্টেন্ট তাহমিদ ইকবাল এবং উনার স্ত্রী, যিনি কিনা নিজেও একজন গবেষক, স্টেরি রোজারিও।
– রোজারিও? খ্রিস্টান?
– না-স্তিক বলা যেতে পারে। উনাদের তো কোনো ধর্ম নেই। গবেষকদের কাজ শুধু বিভিন্ন ধরণের আবিষ্কার নিয়ে। তাই গবেষণা করতে করতে কার সাথে প্রেম হয়ে গেল, এগুলোর ব্যাপারে তাদের কোনো চিন্তা ভাবনা থাকে না। এমনও হয়, গবেষণার স্বার্থে বিয়ে করেন অনেকেই।
– কিন্তু আপনার খটকা লাগছে কোথায়?
– সাদি যদি তোহার প্রিয়জন হয়ে থাকে এবং সাদি সম্পর্কে কেউই কোনো বিরূপ মন্তব্য না করে থাকে তাহলে সাদি কেন ডক্টরকে মারবে? বরং ডক্টর বেঁচে থাকলে একদিন সে অনেক উঁচু পর্যায়ে যেতে পারতো। যেহেতু কিছুদিন ধরেই টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজে ডক্টরের পাশে সাদিকে প্রায় সবসময় দেখা যেত।
– কাগজগুলো নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যার কারণে সাদি ডক্টরকে মেরে….
গালিব হঠাৎ সাগরকে থামিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যা দেখানো হচ্ছে তা পুরোটাই ইন্দ্রজাল?’
– এটা কিভাবে সম্ভব? এ ব্যাপারে সবার সাথে আলোচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো হবে মনে করি।
– তাহলে তাই হোক। আজ বিকেলে এই মামলার সাথে জড়িত সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একত্রিত হতে বলি।
________
তিন দিনের ছুটি শেষে বাহার এখন কাজে নেমে পড়েছে। এই তিনদিন বন্ধুদের সাথে সময় কেটে গেছে। আজ তাই কাজের বেশ চাপ। নতুন একটা মামলা এসেছে। এটাও মা-দক সম্পর্কিত। এবং এবারও একজন কিশোরের সাথে তাকে কথা বলতে হবে। তবে এবারের বিষয়টা একটু জটিল। কারণ কিশোর ছেলেটা শুধু নে-শা-দ্রব্য গ্রহণ করেই ক্ষান্ত দেয়নি, সে এগুলো পাচারের সাথেও জড়িত। কিন্তু ছেলেটাকে উত্তম মধ্যম দেয়ার পরও কোনো কথা বলছে না। তাই বাহারের সাহায্য নিতেই হলো।
বাহার একটা ব্যাপারে বেশ দক্ষ। কেউ মিথ্যে বললে সে চট করে ধরে ফেলতে পারে। তার সাথে কেউ সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। সে শুধু ধরেই না, কৌশলে অপরাধীর মুখ থেকে সত্য বের করে আনে। এবং আজও সে ছেলেটার মিথ্যে ধরে ফেললো। সেই সাথে সত্য বের করে আনলো তার নিজস্ব নিয়মে।
তাই অপরাধ মনোবিজ্ঞানের প্রধান সাইকিয়াট্রিস্ট শুভ্রত বেশ প্রশংসা করলেন বাহারের। এই বিভাগে বাহারের তুলনা হয় না। অন্য অনেক মনোবিজ্ঞানী আছেন, তারাও তাদের কাজে পারদর্শী। কিন্তু বাহার যেন অনন্য! এসব প্রশংসায় বাহার বিনিময়ে মুচকি হেসেছে। কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্য মামলা নেবার জন্য। যেই মামলায় তার মতো আগ্রহী আর কেউ নেই!
আরো এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, সাদি হাসরাতের মুখ থেকে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। সে বারবার এক কথা বলছে, ‘আমি খু-ন করিনি। আমি নির্দোষ। আমি জানি না পেপারগুলো কোথায়।’ তার সামনে সব তথ্য পেশ করা সত্ত্বেও সে ওগুলো ভুল বলে আখ্যায়িত করছে। অনেকেই হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘স্বীকার করুক আর না করুক, ও যে দোষী তা সবাই জানে। ওকে এখন আদালতে নেয়া প্রয়োজন। যা সিদ্ধান্ত কোর্ট থেকে দেয়া হবে।’
এভাবে বললেই তো হয়ে যায় না, অপরাধীর মুখ থেকে স্বীকার্য বাণী না শোনা পর্যন্ত তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা জটিল পর্যায়। তাই সাদিকে এখন বিশেষ সেলে রাখার আলোচনা চলছে। আরো তিন দিনের রিমান্ডে থাকার পরও যদি সাদি কিছুই স্বীকার না করে তাহলে তাকে ভয়াবহ শাস্তির মাঝে রাখা হবে।
অন্যদিকে স্টেরি রোজারিও স্বামীর মৃত্যুর কারণ না জানা পর্যন্ত পুলিশদের ছাড়ছেন না। প্রতিদিনই সাদির ব্যাপারে খোঁজ করেন তিনি, কিছুটা বিমর্ষ ভঙ্গিতে বলেন তিনি সাদিকে কত বিশ্বাস করতেন। তাহমিদ ইকবালও কিছুদিন হতাশায় ভুগেছিলেন সাদির মতো ছেলের এমন কুকীর্তি দেখে। মোট কথা, পুরো তোহা রিসার্চ সেন্টারের কর্মী থেকে শুরু করে গবেষক সকলেই হতবাক। তাই পুলিশদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে সাদির মুখ থেকে কথা বের করতে। তাদের ধারণা, সকলেই সাদিকে ভালো ছেলে বলে দাবি করায় সাদির বল চলে এসেছে যার কারণে সে কিছুতেই স্বীকার করছে না।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তিন দিনের রিমান্ডে সাদি একবারও বলেনি সে খু-ন করেছে। এবারও সে শুধুই বলছে সে নির্দোষ। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে নিয়ে যাওয়া হলো আর্মি স্কোয়াডে। সেখানে থাকা বিশেষ কারাগারে তাকে রাখা হবে যতদিন না সে স্বীকার করছে। এই কারাগারের বৈশিষ্ট্য, ছোট্ট একটা ঘর যেখানে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। এবং সেই ঘরের দরজা বন্ধ করলেই পুরো ঘর অন্ধকারে ডুবে যায়। রাত-দিন বোঝার উপায় থাকে না। প্রথম দিন কোনো খাবার বা পানি দেয়া হবে না। দ্বিতীয় দিন শুধু পানি দেয়া হবে। এরপর সাদির শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে খাবার দেয়া হবে, সেটা তিন দিন পরে হতে পারে অথবা দশ দিন পর।
কথা অনুযায়ী কাজ চললো। সাদিকে রাখা হলো একশো চার নং সেলে। তার নাম দেয়া হলো আসামি ওয়ান-জিরো-ফোর-এস। গভীর আঁধারে ডুবে সাদি শেষবার দেখতে পেলো গালিবের মুখ। এবং শুনতে পেলো, ‘এখানেই থাক। বসে বসে তসবি জপে প্রার্থনা কর।’
সাদির দিন নেই রাত নেই। দেহঘড়ি অনুযায়ী সে কল্পনা করে নেয় দিন রাত। তারপর ওয়াক্ত কল্পনা করে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করে। মাঝে মাঝে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হলে সেই ফাঁকে ওযু সেরে নেয়। আলো দেখে বুঝে নেয় বেলা গড়ালো নাকি। তবে কষ্ট হচ্ছে পানি ও খাবার ছাড়া থাকতে। দ্বিতীয় দিনও তাকে পানি দেয়া হয়নি। ফলে পেটের মাঝে গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে হড়হড় করে বমি করেছে সে। তৃতীয় দিন থেকে পানি দিলেও খাবার দেয়া হচ্ছে না। পেটের উপর হাত চেপে সে কোনোরকম পেট ভারী করে রাখছে। খুব কষ্ট হলেও চিৎকার চেঁচামেচি করা সাদির স্বভাবে নেই। তার পুরোনো রূপেও সে ছিল ভদ্র স্বভাবের শক্ত সামর্থবান যুবক। এখনও তেমনই আছে। তাই কেউ এসে মারধর করলেও সে কিছুই বলে না। চুপচাপ কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষায় থাকে।
আজ থেকে সাদিকে খাবার দেয়া হচ্ছে। গতকাল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। পরবর্তীতে তাকে আসামিদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে নিয়ে স্যালাইন দেয়া হয়েছে। আজ তার জ্ঞান ফিরেছে, সবচেয়ে সুখের বিষয় সে একটুখানি আলোর দেখা পেয়েছে। আলো ছাড়া অন্ধকারে বাস করতে কত যে কষ্ট তা সাদি খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছে।
প্রায় দু সপ্তাহ ধরে সাদি আর্মি স্কোয়াডে আছে। শেষ সপ্তাহে তাকে আবারো একশো চার নং সেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা সাদির জন্য ভিন্ন রকম। আজ একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আসবেন সাদিকে প্রশ্ন করতে। এমনই শুনেছে সে, যখন গালিব কথা বলছিলেন মেজর বিক্রমের সাথে।
________
– আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন হাসরাত।
সাদি একবারও মুখ তুলে তাকায়নি। বাহারের খুব বিরক্ত বোধ হচ্ছে। এখানে তো সাদির স্ত্রী নেই যে বাহারকে দেখলে তার জাত চলে যাবে। বাহার নিজের ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বললো, ‘সাদি হাসরাত, আপনি সরাসরি তাকিয়ে কথা না বললে আমি আমার কাজ ঠিকমতো করতে পারবো না। এবং ধরেই নিব আপনিই অপরাধী, তাই চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।’
কিন্তু সাদির উত্তর শুনে সে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো।
– কোনো পুরুষ সাইকিয়াট্রিস্ট নেই?
মেজাজ চড়ে যাচ্ছে বাহারের, তবু সে মৃদু স্বরে বললো, ‘কেন? নারীদের অক্ষম মনে হয়?’
এবারও সাদি নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘কোন ব্যাপারে অক্ষম বলতে চাইছেন?’
– কাজের ব্যাপারে। আমি একজন মনোবিজ্ঞানী, আমার কাজে কি আপনার সন্দেহ হচ্ছে? মনে হচ্ছে নারীরা দক্ষতার সাথে প্রশ্ন করতে পারে না?
– এটা ভাবলে আপনাকেই থাকতে বলতাম। কারণ আপনি প্রশ্ন করতে না পারলে আমারই লাভ।
বাহার থমকে গেল। কথা ভুল নয়, সে যদি দক্ষ না হয়ে থাকে তাহলে সাদির ক্ষতি নেই। কিন্তু সাদি পুরুষ কেন খুঁজছে? উত্তর সাদিই বলে দিলো।
– নারীদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দেয়ার পর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে অস্বস্তি হয় আমার।
বিরক্ত হলো বাহার। তবে মেজাজ হারালে সাদির মুখ থেকে কথা বের করতে অসুবিধা হবে তার। তাই সে মুচকি হেসে বললো, ‘এমন করছেন কেন বলুন তো? আগে বুঝি নারী দেখেননি?’
– আগে নারী দেখেছি বলেই এখন আর দেখতে চাই না। আর কত পাপ বাড়াবো? এখন তাওবা করতে চাই।
বিস্মিত বাহার দেখছে, কতটা পরিবর্তন হতে পারে একটা মানুষের। কিন্তু বাহারের মেজাজ এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে এসব কথা শুনে। কত কষ্টে সে এই জায়গায় এসেছে তা কি আর সাদি বুঝবে? সাদিকে দেখার জন্য সিনিয়র সাইকিয়াট্রিস্ট শাওন স্যারের আসার কথা ছিল। যেকোনো উপায়ে সে সেটা আটকে দিয়েছে। শাওন স্যার কিছুতেই তাকে আসতে দিতে চাননি। সে নিজের সফলতার প্রমাণ হিসেবে কিছু সার্টিফিকেট আর নিজের দক্ষতার পরিচয় জানিয়ে খুব কষ্টে এখানে আসতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় যেই তথ্য তাকে সাহায্য করেছে তা হলো, সাদির সাথে তার পূর্ব পরিচয়। সে চাইলেই অরিত্রীর সাহায্য নিয়ে সাদির ব্যাপারে আরো তথ্য জানতে পারবে। তাই তাকে বিশেষ চোখে দেখা হচ্ছে। তবে শর্ত দেয়া হয়েছে, সে যদি তিন দিনের কথোপকথনেও সাদির মুখ থেকে কোনো তথ্য বের করতে না পারে তাহলে তাকে এই কাজে আর কোনো সুযোগ দেয়া হবে না।
বাহার নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললো, ‘দেখুন সাদি, পুরুষ সাইকিয়াট্রিস্ট নিশ্চয়ই আছে। তবু আমাকে পাঠানোর কারণটা আপনার বোঝা উচিত। আমি এ পর্যন্ত যতগুলো কেস হ্যান্ডেল করেছি প্রায় প্রতিটি সফল হয়েছে। তাই আমাকে প্রাধান্য না দেয়ার কোনো কারণ নেই।’
সাদি চুপ করে আছে। বাহার এবার নিজের কৌশল অবলম্বন করলো। নরম কণ্ঠে বললো, ‘দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনি অনেক অসুস্থ। কিন্তু কি করবেন বলুন? পাপ করেছেন, শাস্তি ভোগ করতেই হবে।’
– আমি খু-ন করিনি। পেপার্স চুরি করিনি।
– সাদি, আপনাকে সবাই অনেক ভালোবাসে। এটা আমি শুনেছি যে তোহা স্যারও আপনাকে ভালোবাসতেন। তাই আমাদেরও সন্দেহ আছে আপনিই আসল খু-নি কিনা। কিন্তু দেখুন, আপনার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ আছে। আমরা কোনটা বিশ্বাস করবো বলুন? আপনি পারবেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে?
সাদি এবারও চুপ করে আছে। বাহার বলে উঠলো, ‘সাদি, আপনি যদি সব স্বীকার করে নেন তাহলে শাস্তি কমে আসতে পারে।’
– মিথ্যে বলছেন কেন? যাই হোক, শাস্তি আমার ফাঁসি। কারণ স্যারের মতো বড় মাপের মানুষের খু-নিকে কেউ ছেড়ে দিতে চাইবে না।
বাহার ঘাবড়ে গেল না। যদিও কথা সত্যি। কারণ সাদির পক্ষে এমন কেউ নেই যে তার শাস্তি কমানোর আবেদন করবে। বাহার একই সুরে বললো, ‘তবু আদালতের সিদ্ধান্ত কোনটা হবে বলা যায় না। আপনি স্বীকার করবেন কিনা সেটা আগে বলুন।’
সাদি হঠাৎ সরাসরি তাকিয়ে বললো, ‘কি স্বীকার করবো? যেখানে আমি খু-ন করিনি, চুরি করিনি, সেখানে আমার কি বলার আছে?’
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো বাহার। সাদি অবশ্য কথাগুলো বলেই মুখ নামিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাহারের দৃষ্টি থমকে গিয়েছে। যেন সে এখনো দেখতে পাচ্ছে নির্মল দুটো চোখ যেখানে বলা হচ্ছে সত্য কাকে বলে। সেই দৃষ্টি বাহারকে কিছু মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত করে দিলো। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ দুটো বন্ধ করে বললো, ‘এতক্ষণ তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন কিভাবে চোখ দিয়ে মিথ্যে ঢাকা যায়।’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সাদি। বাহার সেটা দেখে বললো, ‘এইবার চোখ তুলে তাকালেন এমনভাবে যেন সত্য কথা বলছেন। আমি একটু হলেই সব বিশ্বাস করে ফেলতাম।’
– আপনার বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে আমার কিছু আসে যায় না।
– কিন্তু আমার আসে যায়। কারণ এটা আমার চাকরি। আমাকে অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে।
বাহার চেয়ার নিয়ে সাদির সামনে অল্প দূরত্বে বসলো। সাদির পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বাহার মাথা নিচু করে সাদির চোখ দেখার চেষ্টা করছে। সাদি মুখ ঘুরিয়ে নিলে বাহার বলে উঠলো, ‘আপনার পছন্দ হবে না, কিন্তু আমি আপনার মুখে হাত দিয়ে চোখ দুটো সরাসরি নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করতে পারি।’
এ কথাই যথেষ্ট ছিল সাদির জন্য। সে এবার বাহারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কথা বলছি। আপনি একটু পিছিয়ে যান।’
বাহার চেয়ার নিয়ে পিছিয়ে গেল। সাদির নজর এদিক ওদিক ঘুরছে। বাহার প্রশ্ন করলো, ‘রবিবার আপনি তোহা সেন্টারে গিয়েছিলেন?’
– হুম।
– যাওয়ার আগে কারো সাথে কথা হয়েছিল?
– আমার মা।
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো বাহার, ‘আচ্ছা, আপনি যে আপনার মায়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন এ কথা পুলিশের কাছে বলেননি কেন?’
সাদি শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, ‘আমার বিরুদ্ধে রণজিৎ ব্যানার্জি চুরির অভিযোগ তুলেছেন। তাই আমার মা রাধিকা ব্যানার্জির সাথে আমার যোগাযোগ থাকার বিষয়টা পুলিশ নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না? আপনাকে বললাম কারণ আমি পারতপক্ষে মিথ্যে বলি না যেহেতু আপনি সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যেটা পুলিশ করেনি। আর আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনিও পুলিশকে এই বিষয়টা বলবেন না।’
হতবাক বাহার। সে একজন মনোবিজ্ঞানী, অথচ তাকেই যেন মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সাদি। এটা কিভাবে সম্ভব? কোন অবিনশ্বর সত্তা সাদিকে সাহায্য করছেন?
তিঁনি যে রক্ষাকর্তা, তিঁনিই আস সামাদ!
___________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)