‘ধূম্রজাল’
অষ্টাদশ পর্ব

তাবিনা মাহনূর

__________

বেশ রাত হয়েছে। একটু পরেই ফজরের আযান শোনা যাবে। এমন সময় ফোনের বিকট আওয়াজে পুরো ঘরে শব্দের আলোড়ন তৈরি হলো। প্রতিধ্বনি হওয়া শব্দগুলো বাহারের কানে যেন আঘাত করছে। ঘুম ভাঙা চোখে আবছা তাকিয়ে সে নিজেকে বিছানায় দেখলো। পাশে সিয়াম ঘুমন্ত অবস্থায় বালিশ জড়িয়ে নিজের কান ঢেকে রেখেছে। বাহারের জ্ঞান ফিরে এলো। উঠে বসে সে শাড়ি ঠিক আছে কিনা তা দেখে দ্রুত নেমে মোবাইলের কাছে গেল। আল্লাহর সাহায্য ছিল বলেই সিয়াম নিজের অধিকার ফলাতে আসেনি। নাহলে নৌ বাহিনীতে কর্মরত একজন পুরুষের দৈহিক শক্তির কাছে তাকে হেরে যেতেই হতো।

বেজে বেজে কল কেটে গিয়েছে। বাহার কল লিস্টে গিয়ে দেখলো, ফোন নম্বরটা অচেনা। বাহার ফোন সাইলেন্ট করে বিছানার কাছে এসে বালিশ নীচে ফেলতেই আবার ফোনের আলো জ্বলে উঠলো। এতো রাতে নিশ্চয়ই জরুরি কল করবে কেউ। আবার উটকো ঝামেলাও আসে মাঝে মাঝে। এক রাতে এমন এক অচেনা নম্বর থেকে কল এসেছিল। সে প্রয়োজনীয় ভেবে কল ধরেই বিপদে পড়ে গিয়েছিল। অপর পাশে থাকা মানুষ রূপী পিশাচ খুব নোংরা কথা বলেছিল তাকে। অশ্লীল সেইসব ভাষা শুনে সেই দিনের পর থেকে সে রাতের বেলা অচেনা নম্বর থেকে আসা কল ধরে না।

আজ অবশ্য দু’বার ফোন এসেছে। বাহারের কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় এখন ঘুম আসার সম্ভাবনাও কম। তাই দ্বিতীয়বার কল আসায় সে ধরে ফেললো, কিন্তু কোনো কথা বললো না। আগে দেখতে হবে এটা ছেলে নাকি মেয়ে।

ওপাশ থেকে ভেসে এলো অল্প পরিচিত কন্ঠ, ‘হ্যালো!’

বাহার চিনতে পারেনি। তবে কণ্ঠের অধিকারিণী একজন মহিলা। বয়সের ভারে গম্ভীর কণ্ঠ কিন্তু মেয়েলি ভাবটা এখনো আছে। বাহার বলে উঠলো, ‘কে?’

– আদাব আপনাকে। আমি প্রিয়ংশুর মা।

চমকে উঠলো বাহার। এই রাতে ফোন করার অর্থ কি? কোনো বিপদ আসেনি তো? বাহার বারান্দায় গিয়ে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম, জি বলুন?’

– আপনি প্রিয়ংশুর সাইকোলজিস্ট? আমার ছেলেটার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন? আমি আপনার চেম্বারে যাবো, আমার ছেলেকেও আসতে বলবেন। তাহলেই হয়ে যাবে।

বাহারের অনুতপ্ত মন, মৃদু স্বরে সে বলল, ‘আসলে আমি একজন ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট ছিলাম। চাকরি ছেড়ে দেয়ায় উনার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’

আর্তনাদ করে উঠলেন রাধিকা, ‘হায় হায়! আমি খুব কষ্টে আমার দারোয়ানের ফোন থেকে কল করেছি আপনাকে। অনেক আশা নিয়ে। আপনি একটু ব্যবস্থা করে দিন না? আমি ছেলেটাকে কতদিন দেখিনা।’

মায়ের কণ্ঠের আকুলতা বাহারের মনে বিষাদ নামালো। সে মলিন কণ্ঠে বললো, ‘দুঃখিত আন্টি, আমি…’

– যেকোনো উপায়ে? দয়া করো মা। আমি আমার ছেলেকে না দেখে থাকতে পারছি না আর।

বাহার বলে উঠলো, ‘এক মিনিট, আমি ব্যবস্থা করতে পারি কিনা দেখি।’

– একটা সেকেন্ডও সময় দিতে পারবো না মা। আমার স্বামী জেগে গেলে সব শেষ।
– ঠিকাছে আন্টি, আপনি কাল গুলশান আড়ং এ আসতে পারবেন?
– হ্যাঁ পারবো, কিন্তু বিকেল বেলা।
– ঠিকাছে সমস্যা নেই। পৌঁছে কোন নম্বরে ফোন করবো আপনাকে?
– আমিই ফোন দেব। আমাকে ফোন করো না। করলে রণজিৎ টের পেয়ে যাবে।

এ কথা বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন। বাহার ফোন নম্বরটা সেভ করে রাখলো। কালকে দেখা করবে সে এ কথা তো জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সাদিকে কীভাবে আনবে?

চিন্তিত বাহার বারান্দা জুড়ে পায়চারি শুরু করলো। একজন মানুষকে কথা দেয়া হয়েছে, সেটা ভঙ্গ করলে গুনাহ তো হবেই আবার মানুষটার নিরাশ মুখ দেখতে বাহারের ভালো লাগবে না। যেকোনো উপায়ে সাদির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। বিশাল এই দ্বিতল ভবনের এক প্রান্তে সিয়ামের ঘরের বারান্দায় রাজকীয় ছোঁয়ার প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন মূল্যবান তৈজসপত্র দ্বারা। এরই একটি হলো দামি ডিভান যেটা বারান্দার মাঝ বরাবর রাখা। এক কোণে আরামকেদারাও আছে। বাহারের ধারণা, সিয়াম দোলনা পছন্দ করে না। তাই এতো সুন্দর বারান্দায় একটা ছোট খাটো দোলনাও নেই।

ডিভানে শুয়ে বাহারের চোখে ঘুম চলে এলো। তবে হঠাৎ এক বুদ্ধি মস্তিষ্কে বিচরণ করায় নিমিষেই ঘুম ছুটে গেল। উঠে বসে সে ফেক আইডি দিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো। সাদি হাসরাতের আইডি খুঁজতেই পেয়ে গেল সে। বাহার কিছুটা বিস্মিত, সাদি কেন তাকে আনব্লক করেছে? দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে সে বুঝতে পারলো সাদি তাকে ব্লক করেনি। আইডি ডিএক্টিভেট করার কারণে সে সাদিকে অনলাইন দুনিয়ায় খুঁজে পায়নি। এখন একটিভ থাকায় বাহার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। দ্রুত লিখে রাখলো, ‘আসসালামু আলাইকুম সাদি, আপনি কি জেগে আছেন? অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। দয়া করে এড়িয়ে যাবেন না।’

__________

তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে সাদি জিকিরে ব্যস্ত। চোখ দুটো বন্ধ করে অনবরত ইস্তেগফারে মগ্ন থাকা সাদি দিন দুনিয়া ভুলে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে নিজের প্রাণ-মনন নিবেদিত রেখেছে। এ সময় এক নারী, যে তার আপন কেউ নয়, সেই নারীর বার্তা তার কাছে পৌঁছায়নি। ফজরের আযান না দেয়া পর্যন্ত তাকে কেউ খুঁজে পাবে না।

আজান শোনা গেল। সাদি চোখ খুলে আজানের জবাব দিতে শুরু করলো। মাঝে মাঝেই তার ভয় হয়, যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন? কত পাপ করেছে সে! সবচেয়ে বড় পাপ, শিরক। আবার সে কৃতজ্ঞতায় সিক্ত করে দু নয়ন। আল্লাহ কতই না মহান! তাকে পথভ্রষ্ট অবস্থায় পেয়ে পথ দেখিয়েছেন।

ফজরের সালাত আদায় শেষে কিছুক্ষণ বারান্দায় হেঁটে ভোরের শীতল হাওয়ায় মন ভেজালো সাদি। ডিসেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর, শিশির ঝরা মুগ্ধতা। সাদি দু চোখ বন্ধ করলো। তার কবি মন জেগে উঠছে।

‘শুভ্রতা,
আর্দ্র প্রণয়ে মেতে ওঠা উত্তাপ কি তোমার রূপকে কলঙ্কিত করে?
স্নেহ মাখা কণ্ঠে পাখির ঘুম ভাঙা আহ্বান,
প্রবোধ জাগায়, কাঞ্চন রঙা শুভ ভোরে।
স্বপ্ন যে সত্য বার্তা নিয়ে আসে না, সিক্ত নয়নে দেখি তোমার নির্বান।
শুভ্রতা, তুমি কি ছলনাময়ী?

শুভ্রতা,
চাদর গায়ে জড়িয়ে মনের নগ্নতা ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস,
নির্বাক শূন্য দৃষ্টির মায়ায় অবগাহন।
সব মিছে খেলা, পুষ্পহীন জীবনে কল্পিত সুবাস।
চাঁদ ডোবা সুবহে সাদিকে শিশির রোদন।
শুভ্রতা, তুমি কি ছলনাময়ী?

শুভ্রতা,
কৃষ্ণচূড়ার পথ মাড়িয়ে বিবাগী…’

থেমে গেল সাদি। একটা নাম মনে আসছে। ‘কৃষ্ণচূড়া’ নামটা তার উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। রাধা-কৃষ্ণ জুড়ির প্রেম কাহিনী তার এক সময়ের কণ্ঠস্থ বিষয় ছিল। সাবিত্রীকে সে বলতো, ‘আমরা হবো সেরা প্রেমিক। আমি কৃষ্ণ, তুমি রাধা।’ সাবিত্রী মুচকি হেসে বলতো, ‘অথচ আমি সত্যবানের স্ত্রী। সাবিত্রী!’ এতে সাদি কথা ঘুরিয়ে নিজেকে সত্যবান দাবি করতো। এসব মনে আসায় এখন তার মুখ কুঁচকে আসছে। ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়তে পড়তে সে ঘরে চলে গেল। সকালের শুরুটা তার ভালো মনে হলো না। সাবিত্রীকে মনে পড়লেই তার গালি চলে আসে, কিন্তু গালি দেয়া নাজায়েজ হওয়ায় বারবার সে বলে, ‘বেয়াদব সাবিত্রী, বেয়াদব…’

কিন্তু তার জন্য ভালো অপেক্ষা করছিল। ফোন হাতে নেয়ার সাথে সাথে গুলবাহারের ম্যাসেজ পেয়ে সে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করলো। ‘অসহ্য’ বলে উঠে সে ম্যাসেজের উত্তর জানালো, ‘আপনি দয়া করে ম্যাসেজ করবেন না। এখানেও ব্লক দেব আপনাকে।’

কিন্তু ম্যাসেজটা সে মুছে কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকলো। তারপর সে ম্যাসেজ না পাঠিয়ে সোজা চলে গেল ব্লক অপশনে। একবারে ব্লক করে দিলেই ঝামেলা চুকে যাবে। কিন্তু হঠাৎ উপরে আরেকটি বার্তার খবর আসায় তার হৃদপিন্ড থমকে গেল।

সাদি ম্যাসেজ সিন করে রেখে দেয়ায় গুলবাহার দ্রুত লিখে পাঠিয়েছে, ‘আপনার মায়ের সাথে আমি যোগাযোগ করেছি। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।’

সাদি হাত চালিয়ে লিখলো, ‘কীভাবে? কোথায়? আপনার সাথে কীভাবে কথা হলো?’

সাদির উত্তর দেখেই বাহার তার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো, ‘এতকিছু লিখতে পারবো না। শুধু দেখা করতে চাইলে বিকেলে গুলশান আড়ং এ চলে আসবেন।’

– এভাবে বললেই হলো? আপনার ষড়যন্ত্র কিনা…
– দেখুন, আপনি আসলে আপনারই ভালো। আমি আন্টিকে কথা দিয়েছি, তাই আপনাকে একটু জোর করেছি।
– আমি আসবো কিনা বলতে পারছি না।
– আমি আর আন্টি যাবো ইন শা আল্লাহ। আপনি এলে আমাকে ম্যাসেজ করবেন।

সাদি আর কিছু লিখতে পারলো না, এর পৃষ্ঠে কিছু বলার নেই। কথা যত সংক্ষিপ্ত হবে ততই ভালো। তবে বাহারকে নিয়ে অন্য ঝামেলায় পরে গেল সে। এখন পর্যন্ত নারীদের সাথে বেশ দূরত্ব মেনে চলেছে সে। এই একজন নারী তাকে বারবার টলিয়ে দেয়। সে একজন পুরুষ মানুষ, শয়তানের ওয়াসওয়াসা তাকে সর্বদা ঘায়েল করতে চেষ্টারত। সে নিজের ইচ্ছে ও শক্তি দমন করে আল্লাহর হিফাজতে চলছে, কতদিন এভাবে চলে যাবে জানা নেই। সে যা পরিকল্পনা করেছে তাতে কাউকে বিয়ে করলে ঝামেলা আরো বাড়বে।

সাদির ঘুম এলো না। ভোর থেকে সকাল, পুরোটা সময় তার অস্থিরতায় কাটলো।

_________

বাহার বাকিটা সময় ঘুমিয়ে নিলো। সিয়ামের আগে তাকে জাগতে হবে। এখন না ঘুমালে পরে ঘুম ধরবে, এ বাড়ি থেকে বের হতেও সমস্যা হবে। কিন্তু বাহারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হলো না। ঘুম ভাঙলো তার সিয়ামের ডাকে, ‘বাহারজান, তুমি এখানে কেন? ঘরে গিয়ে ঘুমাও।’

বাহার ভুলেই গিয়েছিল সিয়ামের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার অভ্যাস আছে। সকাল আটটায় উঠে সে ব্যায়াম করে। সিয়ামের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। বাহার উঠে বসে বললো, ‘আর ঘুমাবো না।’

– কিন্তু তুমি এখানে কেন ছিলে? আমার উপর এখনো রাগ করে আছো?
– আরে না, ফজরের সময় সালাত পড়ে এখানে এসেছিলাম। ভালো লাগছিল তাই এখানে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

বাহার ঝটপট মুখ ধুয়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে নীচে চলে গেল। কত পুরুষের আনাগোনা চলছে এখানে! বাহারের নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। এখানে যদি ফুপির মতো কেউ থাকতো তাহলে ভালো লাগতো তার। একজন মহিলাকে দেখেছিল চকচকে কারুকাজ করা আবায়া আর নিকাব পরতে। কিন্তু সেই মহিলার মেয়েটা হাতা কাটা ব্লাউজ দিয়ে পাতলা শাড়ি পরে ছিল। ওটা দেখেই বাহার বুঝে নিয়েছে দ্বীন বলতে তারা কি বুঝেন। যুবক সময়ে প্রদর্শন করে চলো, বুড়ো বয়সে পর্দা করো – এই পন্থায় বিশ্বাসী কিছু মানুষকে দেখলেই বোঝা যায়। তবে সুধারণা রাখা উচিত বলে বাহার সেই মহিলাকে বলেছিল, ‘মা শা আল্লাহ, আপনাকে অনেক ভালো লাগছে দেখে।’

উনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ভালো লাগছে? আমি আজ লাল আবায়া পরতে চেয়েছিলাম। তোমার আংকেল বললো গোল্ডেন কালারে আমাকে মানায় বেশি। আবার আমার মেয়েটাও গোল্ডেন শাড়ি পরেছে, দেখেছো আমার মেয়েকে? দাঁড়াও ডেকে আনি।’

এরপর তিনি মেয়েটাকে ডেকে এনে বললেন, ‘এইযে আমার মেয়ে। ও এবার মিস বিডিতে দশের মধ্যে আছে। দুআ করো ওর জন্য।’

বাহার বিব্রত ভঙ্গিতে হেসে, ‘ও আচ্ছা’ বলে কেটে পড়েছিল। মিস বিডি! আবার দুআ!

এখনো আশেপাশে অভিজাত চলনভঙ্গি দেখে বাহার কুণ্ঠিত বোধ করছে। গায়ের ওড়না আরো ভালো করে জড়িয়ে সে রান্নাঘরে যেতে চাইলে বাধা পেলো। নতুন বউ হওয়ার এই এক জ্বালা। সকালে উঠে ক্ষুধা নিবারণ করবে সেই সুযোগ নেই। এক ঝাঁক মহিলা এসে ঘিরে ধরবে, বউয়ের লজ্জিত মুখখানি দেখবে। তারপর কত কি উপমা জড়িয়ে কথা বলবে যা শুনে বউয়ের কান লাল হয়ে উঠবে সুখী লজ্জায়। বাহারও এই দলের একজন ছিল। নতুন ভাবি পেলে সে কোনো মন্তব্য যা করলেও এই দলের মহিলাদের সাথে দাঁড়িয়ে ভাবীর লজ্জিত মুখ দেখতো। তখন ভালোই লাগতো। কিন্তু আজ নিজে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকায় বেশ অনুভব করতে পারছে যে এটা কতখানি বিব্রতকর!

‘কই মা? দেখি দেখি তোমার সুন্দর মুখটা। চোরের মতো চলে যাচ্ছ আমাদের না দেখার ভান করে, নিশ্চয়ই কিছু লুকানোর চেষ্টা করছো!’ এই বলে সিয়ামের ছোট খালা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বাহারকে। বাহার মুচকি হেসে মনে মনে বললো, ‘আগে নাস্তা খেতে দিন। তারপর আমি এ বাড়ি ছেড়ে একবার বের হবো, আর আসবো না।’ কিন্তু তাকে মুখে বলতে হলো, ‘আমার ক্ষুধা লেগেছে তো, তাই সরাসরি রান্নাঘরে যাচ্ছিলাম।’

কম বয়সী এক মেয়ে বলে উঠলো, ‘ওমা! ভাবি কি খাদক গোছের নাকি? ভাবি মাইন্ড করবেন না। আমি একটু এমন করেই কথা বলি।’

সবাই প্রশ্রয়ের সুরে মেয়েটার বাহুতে হালকা আঘাত করলো এ ধরণের কথা বলায়। বাহার বুঝেছে এটা একটা ঢং। তারা মেয়েটার এসব কথায় মজা পান, কিন্তু মানুষের সামনে বোঝান এগুলো ঠিক নয়। এ ধরণের অদ্ভুত অভিনয় বাহারের রাগ আরো বাড়িয়ে দিলো। হাফসা এসে বাহারকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমরাই এখনো খাইনি। এখন সাড়ে আটটা বাজে। বিয়ে বাড়ি বলে একটু দেরি হলো। চলো ডাইনিং টেবিলে বসি।’

বাহারের খাওয়ার ঘরে যাওয়া হলো না। সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরেছে। এসব বাহারের অত্যন্ত বিরক্ত লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। একবার মনে হলো মুখ না ধুয়ে এখানে আসা উচিত ছিল। তাহলে আর কেউ কথা বলার সাহস করতো না। এখন এসব সহ্য করতে হবে। খেয়েই সে সিয়ামকে বলে বেরিয়ে যাবে। তারপর বাসায় গিয়ে কাউকে কিছু না বলে শুধুমাত্র ফুপির সহায়তায় অন্য পরিকল্পনা করবে। কারণ সে একদম নিশ্চিত, বসার লোকজন সিয়ামের অবিশ্বাসী মনোভাবের পৃষ্ঠে তালাক দেয়াটা একেবারেই মেনে নিবে না।

বাহার নাস্তা খেলো অপরিচিত কতগুলো লোকের সাথে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, শাড়ির সাথে ওড়না মাথায় দেয়ায় হাফসা তা কেড়ে নিয়ে বলেছেন, ‘ওড়নার প্রয়োজন নেই। আমরা আদিম যুগের শশুর শাশুড়ি নই যে তুমি মাথায় ঘোমটা না দিলে তোমাকে বকা দেয়া হবে।’ হাফসার কথার ধরণ ছিল মিষ্টি, কিন্তু তা বিষের মতো লেগেছে বাহারের। শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে দ্রুত নাস্তা খাওয়া সেরে সে ঘরে গেল। সিয়াম তখন গোসল করে বেরিয়েছে। ব্যায়াম করার পর সে গোসল করে, তা নাহলে ঘামে মাখা তৈলাক্ত শরীরে তার অস্বস্তি শুরু হয়।

সিয়ামকে দেখে বাহার বললো, ‘সিয়াম, আমি এখন একটু বের হবো।’

অবাক হলো সিয়াম, ‘কোথায় যাবে?’

– বাসায়।
– কেন?
– রাগ করো না, আমি আমার বাবাকে দেখেই চলে আসবো।

মিথ্যে বলার জন্য মনে মনে তওবা করলো বাহার। এখানে তার কিছুই করার নেই। সত্য বললে সিয়াম আটকে রাখবে, জোর করবে। তখন তাকে যিনার সংসার করতে হবে যা সে জীবন থাকতে কোনোদিন মানতে পারবে না। সিয়াম তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বললো, ‘আমি গাড়ি বের করছি তুমি নীচে এসো।’

বাহার দ্বিমত করলো না, ‘ঠিকাছে।’

সিয়াম নাস্তা খেয়ে গাড়ি বের করলো। বাহার ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে আছে। মেহেদী রাঙা হাত দুটো দেখে সে আনমনে হেসে উঠলো। এই মেহেদী কত রঙিন, যতটা তার জীবনে মলিনতা রয়েছে। সিয়ামকে গম্ভীর দেখা যাচ্ছে। বাহারের বাড়ি পৌছেই সিয়াম বললো, ‘আমি যাবো না। তোমার কথা শেষ হলে ফোন করবে, আমি চলে আসবো।’

বাহার কিছু না বলে গাড়ি থেকে নামলো। সে নিজেও চায়নি সিয়াম এখানে আসুক। সিয়াম আবার ডেকে বললো, ‘শোনো বাহার, একটা কথা বলে রাখি। তোমার মন খারাপ বলে আমি সবার কড়া দৃষ্টি উপেক্ষা করে তোমাকে নিয়ে এখানে এসেছি। আমার এই স্যাক্রিফাইসের দাম তুমি রেখো। নাহলে পরবর্তীতে তোমার জন্য কিছু করতে আমাকে ভাবতে হবে।’

বাহার মনে মনে বেশ কিছু বললো যে শুনলে সিয়াম হয়তো তাকে থাপ্পড় মেরে বসতো। বাহার উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বললো, ‘অবশ্যই সিয়াম। যথাযথ দাম দেয়া হবে।’

– কোথায়? এখনো দাওনি কিন্তু?

সিয়াম কি বলেছে তা বুঝতে বাকি নেই। বাহার এতোটাও বোকা নয়, সে মুচকি হেসে বললো, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই। তোমার বাড়ি গিয়ে দেখা যাবে।’

– আমার বাড়ি, তোমারও বাড়ি।

বাহার মুচকি হাসি দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। ফুপির সাথে পরামর্শ করা খুব জরুরি।

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here