#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

১০. (অন্তিম পর্ব)

আনন্দের উচ্ছ্বাস যার মনের কোণে কিরণ ছড়াচ্ছে, কিছু্ক্ষণ পরই যে অন্ধকারের খনঘটা তাঁর সর্বমনে বিষাদের বীজ বুনতে যাচ্ছে তা সে আন্দাজও করতে পারছে না। পুরোটা পথ শ্রুতির আনন্দে কেটেছে। এতদিন বাদে আবার সবার সাথে দেখা হবে, সেই খুশিতেই সে আত্মহারা। বৃষ্টির শ্বশুরবাড়ি আসার পর হরেক রকম আয়োজন দেখা যায়। ওর শ্বশুর-শ্বাশুরীও ভীষণ মিশুক। তবুও শ্রুতির অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছিল। কেননা রুমকির মতো সেও তো বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিল। মনের ভেতর ভয় জন্মেছিল যদি পেছনের কথাগুলো তুলে আনে! কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। তাদের কথাবার্তা কিংবা আচরণে বোঝার উপায়ও নেই যে অতীতে এমনকিছু ঘটেছিল।

খাওয়ার পরে সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল শ্রুতি তখন ভাবছিল কী করে সে অরিত্রদের বাড়িতে যাবে। কেউ তো একা ছাড়তে রাজিও হবে না। পিয়ুশের সাহায্য প্রয়োজন এখন। তার আগে শ্রুতিও একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়। রিমি পাশেই শুয়ে আছে। এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে। শ্রুতিও বালিশে মাথা রাখতেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে উঠে আগে ফ্রেশ হয়ে নেয়। এরপর খুঁজতে থাকে পিয়ুশকে। চোরের মতো করে খুঁজতে থাকার দৃষ্টি ধরে ফেলে বৃষ্টির শ্বাশুরী। পাশে বৃষ্টিও ছিল। তাঁর ধারণা শ্রুতি পিয়ুশকেই খুঁজছে। তবে সরাসরি সে এই কথা বলল না। জিজ্ঞেস করল,’কাউকে খুঁজছ শ্রুতি?’
আচমকা শ্রুতি থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,’না, মানে পিয়ুশ ভাইয়া কোথায়?’
‘ও তো ওর ঘরেই আছে। ঐতো ঐটা ওর ঘর। যাও তুমি।’
শ্রুতির ইতস্ততবোধ হচ্ছিল তবুও যাওয়া প্রয়োজন। কেননা ঐ বাড়িতে যাওয়ার জন্য এখন একমাত্র পিয়ুশই সাহায্য করতে পারে।

পিয়ুশের ঘরের দরজা কিছুটা ভেজিয়ে রাখা। দরজায় টোকা দিয়ে শ্রুতি পারমিশন চাইল। ‘ভেতরে আসব?’
‘আসুন।’ ভেতর থেকেই পিয়ুশের জবাব এলো। শ্রুতি ভেতরে গিয়ে দেখে পিয়ুশ কম্পিউটারে কাজ করছে। একগাল হেসে পিয়ুশ বলল,’হঠাৎ কী মনে করে আসলেন বেয়াইন? বসুন।’
শ্রুতি খাটের ওপর বসল। এখনও সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। হাসার চেষ্টা করে বলল,’এমনি আসলাম। কেন আসা বারণ নাকি?’
‘একদমই না। আপনার জন্য এই ঘর সবসময়ই উন্মুক্ত।’
শ্রুতি মৃদু হাসল। বলল,’এসেছি একটা কথা বলতেই।’
পিয়ুশ এবার চেয়ারসহ নিজেও শ্রুতির দিকে ঘুরে বসল। হেসে বলল,’তা আমিও জানি। নয়তো আপনার দর্শন পাওয়া যে এত সহজ নয় সেটাও তো আমার অজানা নয়।’
প্রত্যুত্তরে এবারও শ্রুতি হাসি প্রদান করে বলল,’একটা জায়গায় যাব। নিয়ে যাবেন?’
‘আবার পালানোর মতলব আছে নাকি?’
‘পালালে আপনাকে সাথে নেব কেন?’
‘কে জানে! আমায় নিয়েও পালাতে পারেন।’ বলেই শব্দ করে হাসল পিয়ুশ। শ্রুতি মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,’আপনার মাথা। বলুন না নিয়ে যাবেন নাকি?’
‘অবশ্যই নিয়ে যাব। কোথায় আর কবে যাবেন বলুন?’
‘কবে নয়। আজই যাব আর এখনই।’
‘কোথায়?’
‘পালিয়ে গিয়ে যেখানে ছিলাম আমি, সেই বাসায়।’
‘আজই যেতে হবে?’
‘হ্যাঁ, আজই। আপনার সমস্যা আছে কোনো?’
‘একদম নয়। চলুন তাহলে যাওয়া যাক।’

যাওয়ার সময়ে ওরা রিমিকেও সাথে নিয়ে নিল। বাড়িতে জানিয়েছে আশেপাশেই ঘুরতে যাচ্ছে। গাড়ি যতই বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তত বেশিই যেন উত্তেজনা বাড়ছিল। ফুসকার স্টলের সামনে পিয়ুশ গাড়ি থামিয়ে বলে,’ফুসকা খাবেন?’
শ্রুতি কিছু বলার পূর্বেই রিমি ফট করে বলে বসল,’আমি খাব।’
ফুসকা পছন্দ করে না এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া বিরল প্রায়। শ্রুতিরও ভীষণ পছন্দ। কিন্তু আনন্দের জন্য মনে হচ্ছে তাঁর পেটও ভরে রয়েছে। তবে রিমি যখন একবার বলে বসেছে খাবে তখন খেতেই হবে। খাওয়ার সময়ও শ্রুতি বারবার রিমিকে তাড়া দিচ্ছিল তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য। এক সময়ে রিমি বিরক্ত হয়ে বলেই বসল,’আহা! এমন করতেছ কেন আপু? শান্তিতে কি একটু খেতেও দেবে না?’

পিয়ুশও শ্রুতির অস্থিরতা খেয়াল করছিল বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই। এই পর্যায়ে সে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,’কোনো সমস্যা শ্রুতি? আপনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন কেন?’
শ্রুতি হাসার চেষ্টা করে বলল,’না, মানে এমনি।’।
এরপর সে নিজেও যথাসম্ভব ওদের সঙ্গে নিজেকে যোগ করার চেষ্টা করল। জায়গায় জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে এটা, সেটা খেল সবার সঙ্গে। কিন্তু মনে মনে সে অস্থিরতায় ভেঙে পড়ছিল বারংবার। ঢাকা-শহর ঘুরতে ঘুরতেই রাত দশটা পার হয়ে গেছে। এখনও তো কতদূরে অরিত্রদের বাড়ি পড়েই রয়েছে।

শাই শাই বাতাসের তোড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবার গাড়ি চলছে অবিরতভাবে। জানালার ওপর হাত রেখে তাতে থুঁতনি ভর দিয়ে শ্রুতি রাতের ঢাকা-শহর পর্যবেক্ষণ করছে। কী অমায়িক, সুন্দর! হাইওয়েতে আসার পর সে একটু নড়েচড়ে বসে। এটা সেই জায়গা যেখানে পিয়ুশের সঙ্গে শ্রুতির দেখা হয়েছিল। পিয়ুশেরও ঘটনাটি এখনও মনে আছে। তাই সে জিজ্ঞেস করল,’এখানেই আপনি ডাকাতের মতো আমার হাতে কামড় বসিয়েছিলেন। মনে আছে?’
শ্রুতি হেসে ফেলল। সোজা হয়ে বসে বলল,’আছে। আপনিও তো গুণ্ডাদের মতো আমার হাত চেপে ধরেছিলেন।’
‘বিয়ের পোশাকে দেখে আপনাকে আমার সন্দেহ হয়েছিল।’
‘সন্দেহ কিন্তু সঠিকও ছিল।’
‘তা ঠিক। কিন্তু ধরতে আর পারলাম কই? চড়ুই পাখির মতোই তো পালিয়ে গেলেন।’
শ্রুতি এ কথার প্রত্যুত্তর করল না। শুধু শব্দ করে হাসল।

অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময়, সকল উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে অরিত্রদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামে। শ্রুতির হার্ট দ্রুত থেকে আরও দ্রুততরভাবে কম্পিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে হাত-পা’ও অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। রিমি এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওকে আর কেউ জাগাল না। গাড়ি লক করে শ্রুতি পিয়ুশকে নিয়ে ভেতরে গেল। উপরে গিয়ে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিল মাঝ-বয়সী এক মেয়ে। শ্রুতির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,’কাকে খুঁজছেন?’
‘অদিতি আন্টি, অনিক ওরা আছে?’
‘চিনতে পারলাম না। আমরা তো এখানে নতুন এসেছি। আপনি বাড়িওয়ালার সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।’
‘আচ্ছা, ধন্যবাদ।’ বলে শ্রুতি সেখান থেকে সরে দাঁড়ায়। প্রচণ্ড পরিমাণে মন খারাপ হয়ে গেছে তাঁর। শ্রুতিকে মনঃক্ষুণ্ণ দেখে পিয়ুশ জিজ্ঞেস করল,’রুম চেঞ্জ করেছে।’
‘হু।’
‘এখন তাহলে কী করবেন?’
শ্রুতি কিছু বলল না। পিয়ুশ ফের জিজ্ঞেস করল,’কী হলো?’
এবার শ্রুতি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। পিয়ুশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হলো শ্রুতি? আপনি কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে? আমায় বলেন।’
কথা বলার মতো অবস্থায়ও সে নেই। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পিয়ুশ এটাই বুঝতে পারছে না এই সামান্য বিষয়ে কান্নার কী আছে! কিন্তু সে তো আর জানে না শ্রুতির মনের আসল কথা।

পিয়ুশ আর কিছু জিজ্ঞেস না করে শ্রুতিকে নিয়ে নিচে নামে। আগে শ্রুতিকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে গাড়িতে উঠে। তখনও শ্রুতি কেঁদেই চলছিল। একটা ফাঁকা নিরিবিলি স্থানে নিয়ে পিয়ুশ গাড়ি থামায়। শ্রুতিকে একা সময় দিয়ে নিজে গাড়ি থেকে নেমে বাইরে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রচুর বাতাস এখানে। সামনেই বিশাল বড়ো একটা নদী। আশেপাশে দু, তিনটে চায়ের দোকান শুধু। এত রাতে মানুষের চলাচল নেই। বেশ কিছু্ক্ষণ পর শ্রুতিও নেমে আসে। কান্না থামিয়ে নিজেও কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। পেছন থেকে সে পিয়ুশকে জিজ্ঞেস করল,’বাড়ি যাবেন না?’
শ্রুতির কণ্ঠস্বর শুনে সে পিছু ফিরে তাকায়। পলকহীনভাবে কিছু্ক্ষণ শ্রুতির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,’কাঁদলেন কেন আপনি?’
‘এমনি।’
‘মিথ্যা বলবেন না আমার কাছে। কী হয়েছে আমায় বলুন?’
‘খারাপ লাগছে খুব।’
‘শুধু তাদের খুঁজে না পাওয়ার জন্যই?’
‘হু।’
‘শুনেছিলাম যেদিন পালিয়েছিলেন সেদিন এক ছেলের সাথে আপনার পরিচয় হয় এবং তাঁর বাড়িতেই উঠেছিলেন। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি কি ঐ ছেলেকে ভালোবাসেন?’
টলমল করা অশ্রুসিক্ত নয়নে শ্রুতি পিয়ুশের মুখপানে তাকায়। শ্রুতির রক্তজবার মতো চক্ষুযুগল দেখে পিয়ুশের খুব খারাপ লাগছিল। অন্যদিকে সে শ্রুতির নিরবতার মানেও বুঝে নেয়।

শ্রুতির মাথায় তৎক্ষণাৎ একটা বুদ্ধি আসে। সেই টং দোকানের কথাটা মনে পড়ে যায়। সে উৎফুল্ল হয়ে বলে,’আমি যেভাবে যেভাবে বলব আপনি সেভাবে সেভাবেই যাবেন এক জায়গায়।’
‘কোথায়?’
‘চায়ের দোকানে।’
‘কী? এত রাতে চায়ের দোকানে?’
‘সেখানেই অরিত্রর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। এরপরও আমরা সেখানে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। আজ যদি সে সেখানে আসে? চলুন না যাই!’
শ্রুতির চোখেমুখে আবারও আনন্দ ফিরে এসেছে। অরিত্রকে খুঁজে পাওয়ার একটা আশা পেয়েই মেয়েটা আবারও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। সেখানে কি পিয়ুশ তাকে না নিয়ে গিয়ে পারে? হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে পিয়ুশও শ্রুতিকে পছন্দ করে। হয়তো ভালোওবাসতে শুরু করেছিল। তবে সেটা সম্পূর্ণ ভালোবাসা বললে ভুল হবে। সে শ্রুতিকে চেনে নয়দিনের মতো আর অন্যদিকে শ্রুতি এবং অরিত্র দুজন দুজনের আদ্যপ্রান্ত জানে। শ্রুতি যখন অরিত্রকে ভালোবেসে ফেলেছে সেখানে অরিত্ররও ভালোবাসার সম্ভাবনা কম নয়। এখানে বলা চলে, শ্রুতি পিয়ুশের পছন্দের মানুষ। সেহেতু পছন্দের মানুষটির ভালোবাসা খুঁজতে সাহায্য করা অতিআবশ্যক।

পিয়ুশ গোপন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে শ্রুতিকে সেই স্থানে যায়। দোকান ফাঁকা। শুধু বুড়ো-বুড়ি বসে আছে। তারাও শ্রুতিকে চিনতে পারে। জিজ্ঞেস করে,’এতদিন কুনে আছিলা?’
‘বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম দাদু।’
পিয়ুশ বেঞ্চের ওপর বসে রয়েছে। চা অর্ডার দিয়ে শ্রুতিও বসে। অরিত্রর প্রসঙ্গ তু্লে জিজ্ঞেস করে,’সে কি আর আসেনি?’
‘কেডা? তোমার লগে যেই পুলা আইতো?’
‘হ্যাঁ।’
‘হ আহে তো। মাঝে মাঝেই আহে। আজকেও আইছিল।’
শ্রুতি প্রফুল্ল হয়ে বলে,’আজও এসেছিল?’
‘হ।’
‘সে কোথায় থাকে জানেন আপনারা?’
‘তা তো জানিনে দাদুভাই।’

শ্রুতির মন আবারও খারাপ হয়ে যায়। এতক্ষণে চা-ও হয়ে গেছে। পিয়ুশ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,’মন খারাপ করছেন কেন? উনারা তো বলল অরিত্র নাকি মাঝে মাঝেই এখানে আসে রাতে। আমরা না হয় কাল আবার আসব।’
শ্রুতি কিছু বলল না। শুধু মেকি হাসল। চায়ের বিল পিয়ুশই দিল। আসার আগে শ্রুতি নিজের নাম্বারটা তাদের কাছে দিয়ে বলল,’কাল যদি সে আবার আসে তাহলে এই কাগজটা তাকে দেবেন।’
‘আচ্ছা।’
একরাশ মন খারাপ আর বিষণ্ণতা নিয়ে শ্রুতি চলে যায়।
_________
রাত ১২টা ৩৫ মিনিট

নিখিলকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবারও সেই টং দোকানে এসেছে অরিত্র। এখান থেকে ফিরে গিয়ে বাড়িতে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু ঘুম আসেনি। তাই নিখিলকে ফোন করে সাথে নিয়ে এসেছে। কিছুটা গল্প করা হবে আর সময়ও কাটবে এই আশায়। ঐ বাড়ি ছাড়ার পর থেকে অরিত্র আরও বেশি আফসোস করেছে। শ্রুতির স্মৃতির চিহ্নটুকুও নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে পাগলপারা হয়ে গেছে। এখন এই একমাত্র স্থানই রয়েছে; যেখানে আসলে মনে হয় এইতো শ্রুতি সাথেই রয়েছে।

দোকানে এসে বেঞ্চের ওপর বসে অরিত্র বলল,’দাদা দুইটা চা দেন। আগে একটা সিগারেট দিয়েন।’
সিগারেট নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া উড়াতে শুরু করেছে অরিত্র। তখন বুড়ি বলল,’ঐ মাইয়াটা আসছিল।’
অরিত্র চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,’কোন মেয়ে?’
‘তোমার লগে যে আইত।’
‘শ্রুতি?’
‘নাম তো মনে থাহে না ভাই। এই কাগজটা দিয়া গেছে।’ নাম্বার লেখা কাগজটি অরিত্রর দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
অরিত্র অতি দ্রুততার সাথে কাগজটি হাতে তুলে নিল। সেখানে একটা নাম্বার এবং শ্রুতির নাম লেখা। মুহূর্তেই অরিত্রর মনে হলো মরুভূমিতে সে পানির দেখা পেয়েছে। সময় বিলম্ব না করে নাম্বারটিতে সে কল দিল। রিং হচ্ছে। কল কেটে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ফোন রিসিভ করে শ্রুতি। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,’হ্যালো।’

অরিত্রর হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক ভালোলাগা কাজ করছে মনের ভেতর। আজ কতগুলো দিন পর সে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সুপরিচিত ভয়েসটি শুনতে পাচ্ছে। এরচেয়ে খুশির, এরচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত আর কী হতে পারে? এপাশ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে শ্রুতি বিরক্তমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কে বলছেন? কথা বলেন না কেন?’
‘শ্রুতি! আমি অরিত্র।’
অরিত্রর কণ্ঠস্বর এবং তাঁর মুখে নিজের নাম শুনেই সকল ঘুম উবে যায় শ্রুতির। লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। সে ভাবতেই পারেনি আজই অরিত্র কল করবে, কথা হবে। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে সে বলল,’আপনি সত্যিই ফোন করেছেন? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
‘বিশ্বাস তো আমারও হচ্ছে না অনেক কিছু। আপনি এখানে কীভাবে?’
‘সে অনেক কাহিনী।’
‘কোথায় আছেন এখন?’
‘ঢাকাতেই।’
‘ঠিকানা দিন। আমি এখনই আসব।’
এবারে শ্রুতি অভিমানীস্বরে বলল,’কেন আসবেন? আসার দরকার নেই। খুঁজে যেন না পাই এজন্যই তো বাড়ি পাল্টিয়েছিলেন তাই না? এখন তাহলে কেন আসবেন?’
‘আপনি বাড়িতেও গিয়েছিলেন?’
‘জি, হ্যাঁ।’
‘প্লিজ ঠিকানাটা দিন!’

অরিত্রকে দেখার জন্য শ্রুতি নিজেও অস্থির হয়ে রয়েছে। তাই অভিমান সব ঝেড়ে ফেলে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেয়। এরপর থেকে বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে। কিছু্ক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করে,কিছু্ক্ষণ রুমে। আবার কিছু্ক্ষণ ড্রয়িংরুমে। ড্রয়িংরুমে হাঁটাহাঁটি করার সময়ে বৃষ্টি চলে আসে। রান্নাঘরে যাচ্ছিল পানি আনতে। ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে শ্রুতিকে এখানে দেখে জিজ্ঞেস করে,’কীরে? এভাবে হাঁটছিস কেন এখানে?’
শ্রুতি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। উপায়ন্তর না পেয়ে বৃষ্টিকে সব খুলে বলে। এমনকি এটাও বলে যে সে অরিত্রকে ভালোবেসে ফেলেছে। সব শুনে বৃষ্টি হাসে। মুচকি হেসে বলে,’অবশেষে তাহলে তোর স্বপ্ন সত্যি হতে চলল। ভালোবেসে বিয়ে করার খুব শখ ছিল না?’
‘ধুর! সে আমায় ভালোবাসে নাকি তা তো জানিনা।’
‘বাসে বাসে। আলবৎ ভালোবাসে। যদি ভালোই না বাসতো তাহলে এই এত রাতে উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসতো নাকি দেখা করার জন্য?’
‘সত্যি বলছিস তুই? যদি এমনটা না হয়?’
‘তাহলে পার্বতী হয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবি।’
‘তোর মাথা।’
শ্রুতির ফোন বেজে ওঠে তখন। অরিত্র ফোন করেছে। বাড়ির নিচে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি শ্রুতিকে বাড়ি থেকে বের হতে সাহায্য করে এবং বলে,’যখন আসবি আমায় ম্যাসেজ দিস। দরজা খুলে দেবো। জেগেই আছি আমি।’
খুশিতে বৃষ্টির গালে চুমু খেয়ে শ্রুতি বলল,’আমার মিষ্টি বোন।’

মেইন গেইট থেকে বের হওয়ার পরই অরিত্রকে দেখতে পেল। সোডিয়াম লাইটের আলোতে অরিত্রর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কালো রঙের একটা শার্ট পরে আছে। চুলগুলো আজও উসকোখুসকো। শ্রুতির ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু নিজের এ ইচ্ছেকে সে সংবরণ করে নিল। কাছে গিয়ে অতি শীতলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
তুমি! এই প্রথম অরিত্র শ্রুতিকে তুমি বলে সম্বোধন করল। শ্রুতির অনেক বেশি আনন্দ লাগছিল। সে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি।’
‘সামনে হাঁটি?’
শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। পাশাপাশি দুজনে হাঁটছে। দুজনই নিরব। অরিত্র নিজেই বলল,’একটা কথা বলব?’
‘হ্যাঁ।’
‘রাগ করবে না তো?’
‘না।’
‘কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।’

অরিত্র দাঁড়িয়ে পড়ে। তাই শ্রুতিও দাঁড়িয়ে যায়। লজ্জায় তাকাতেও পারছে না। অথচ আগে কখনও অরিত্রর সামনে লজ্জা লাগেনি তাঁর।
‘শ্রুতি, তুমি যখন আশেপাশে ছিলে, কাছে ছিলে আমি ক্ষুণাক্ষরেও টের পাইনি যে আমি তোমায় ভালোবাসি। যেদিন তোমায় গ্রামে রেখে আসলাম সেদিন ফিরে আসার পথেই বুকে মোচর দিয়ে ওঠে।বারবার মনে হচ্ছিল পাশের সিটে তুমি আছো। তোমার অনুপস্থিতি আমায় জানিয়ে দিয়েছিল, আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি। আমার জানা নেই, তুমি আমায় ভালোবাসো নাকি। কখনও হয়তো বলতামও না। তবে আজ তোমায় সামনে পেয়ে অনুভূতিগুলো প্রকাশ না করেও থাকতে পারলাম না। আমাদের আর্থিক অবস্থা তোমাদের তুলনায় ভালো নয়। তোমার পরিবার হয়তো মানবে না। তুমি নিজেও হয়তো চাইবে না এমন পরিবারে আসতে। তবুও সবকিছু জানা সত্ত্বেও আমি আমার মনের কথাগুলো আজ তোমায় জানিয়ে দিলাম।’ একদমে কথাগুলো বলল অরিত্র।

শ্রুতি মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা কথা শুনছিল। এবার সে বলল,’আমার নিজের পরিবার বলতে মামা-মামি আছে। বাবা-মা কেউ নেই। বাবার সম্পত্তিও আমার নামে নেই। কারণ সে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকে। এই সত্যিটা আপনার অজানা ছিল। সেহেতু আমার নিজের বলতে কোনো সম্পত্তিও নেই। যা আছে সব মামা-মামির। বাবা-মায়ের থেকে যতটা না ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়েও অধিক বেশি ভালোবাসা পেয়েছি তাঁদের থেকে। আপনার পরিবারের মতো খুব কম সংখ্যক পরিবারই দেখেছি। আপনার মাকে পেয়ে মনে হয়েছিল ইনিই আদর্শ মা। আপনার বাবাকে পেয়ে আমি পেয়েছিলাম বাবার স্নেহ। এখন এই সবকিছুর পর যদি বলি, আমিও আপনাকে ভালোবাসি; তবে কি আপনি আমায় ফিরিয়ে দেবেন?’

অরিত্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে তাঁর কথা বলার শক্তিও লোপ পেয়েছে। তবে সে খুঁজে পেয়েছে নিজস্ব ভালোবাসা। সে ভালোবাসে শ্রুতিকে। অনেক বেশিই ভালোবাসে। সে বলল,’তোমার হাতটা একবার ধরতে পারি?’
শ্রুতি হাত বাড়িয়ে দিল। হাতটি মুঠোবন্দি করে নিল অরিত্র। হাতের দিকে কিছু্ক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে শ্রুতির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’এইযে হাত ধরেছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর ছাড়ব না। আমার শ্রুতিকে আমি ভালোবেসে আগলে রাখব সারাজীবন। তুমি শুধু ভালোবেসে যেও।’
শ্রুতির চোখে পানি চিকচিক করছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,’জড়িয়ে ধরব?’

অরিত্র দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়াল। তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় শ্রুতি ঝাঁপিয়ে পড়ে অরিত্রর বুকে। দু’হাতে আবদ্ধ করে নেয় অরিত্রও। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,’এক দ্বিপ্রহরের রাত্রিতে তোমায় প্রথম দেখেছিলাম। আরেক দ্বিপ্রহরে তোমায় ভালোবাসার সঙ্গী করে নিলাম।’

(সমাপ্ত)

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। সাধারণ প্লটে লেখা গল্পটি আপনাদের কেমন লেগেছে অবশ্যই জানিয়ে যাবেন। হ্যাপি রিডিং।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here