#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-দশ
মাহাবুবা বিথী

মোবাইলের স্ক্রীনে যে নামটা ভেসে উঠলো তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।ডাক্তার সারোয়ার আহমেদ পলাশ। এই পনেরো বছরে কতবার মোবাইল চেঞ্জ করেছি।অথচ নিজের অজান্তে এই নাম্বারটা সেভ করে রেখেছি। কি বিচিত্র মানুষের মন।

ফোনটা রিসিভ করার কোন ইচ্ছে আমার হলো না। বেজে বেজে নিজ থেকেই থেমে গেলো। আর এতো রাতেই বা আমাকে ফোন দিলো কেন? আচ্ছা ও ভাবলো কি করে যে ও ফোন দিলেই আমি ফোনটা রিসিভ করবো। কি বলতে চায় ও আমাকে? না এসবে আজ আমার কোন আগ্রহ নেই।

যেদিন ও আমাকে বলেছিলো সে নিজের ঔরসজাত সন্তানের বাবা হতে চায়। সেইজন্য আমাকে ডিভোর্স দিবে।এই কথা শুনে বুকের ভিতরটা ব্যথায় ভরে উঠলো।আমি তখন পলাশকে
বললাম,
—–আমরাতো সারাজীবন একসাথে পথ চলবো বলে
ভালবাসার বাঁধনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম।
তখন পলাশ বললো,
—–ভালবাসাতো ভালবাসার জায়গায়। কিন্তু আমি বাবা হতে চাই।বাবা হওয়ার প্রকৃত সুখ পেতে চাই।
অবশ্য বিয়ের পর থেকেই আমি অবাক হয়ে ওর
পরিবর্তন দেখছিলাম আর ভাবছিলাম মানুষ কি করে এতটা পাল্টে যায়।

বাবা মার বিপক্ষে গিয়ে ভালবেসে যাকে বিয়ে করলাম সন্তান হবে না বলে সে আমাকে ডিভোর্স
দিতে চায়। সেদিন আমার এই অক্ষমতার জন্য আল্লাহ পাকের কাছে অনেক কেঁদেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এই একই অক্ষমতা নিয়ে পলাশ আজকে আমার মুখোমুখি হয়েছে।

আস্তে আস্তে রাত ভোর হয়ে গেলো।ফজরের আযান শোনা যায়। আজ আর ঘুম এলো না। নির্ঘুম রাতটা পার হয়ে গেলো। ওজু করো ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম। মৌমিতাও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।ফজরের নামাজ পড়ে কফি মেকারে করে দুই মগ কফি বানালো। আমাকে এক মগ দিয়ে নিজে এক মগ নিলো।আমি মৌমিতাকে বললাম,
—–তুমি চুলো জ্বালিয়ো না।আমি বাইরে থেকে ড্রাইভারকে দিয়ে তোমার আর মামুনের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিবো।
মৌমিতা বললো,
—-মিরপুরে আমার এক ফুফু থাকে।আজকে উনি খাবার পাঠাবে।
আমি বললাম,
—-ভালই হল।আমি তাহলে হাসপাতালে রওয়ানা দেই।আজ আবার আমার চেম্বার আছে। যাওয়ার সময় হাসপাতালে তোমার বাবাকে দেখে যাব।
মৌমিতা বললো,
—–আন্টি আমি এদিকটা সামলে নিবো। আজকে রাতে আপনার আর থাকতে হবে না। গতরাতে আপনি ঘুমাতে পারেননি। অনেক সময় বিছানা চেঞ্জ
হলে ঘুম আসে না। এতে আবার আপনি অসুস্থ হয়ে
যাবেন।
মৌমিতার কথা শুনে আমার ভালই লাগলো।আমি জাহিদকে দেখতে হাসপাতালে চলে গেলাম। আজকে আবার আমার চেম্বার আছে।
হাসপাতালে পৌঁছে মাহিনকে বললাম,
—-তোমার বাবা কেমন আছেন।
মাহিন বললো,
—–আন্টি বেশী ভালো না। ডাক্তার এই সপ্তাহেই বাইপাস করাতে চেয়েছে।
আমি বললাম,
—ঠিক আছে মাহিন।জাহিদের জন্য যেটা মঙ্গল আমাদের সবার সেটাই ভাবা উচিত।
জাহিদকে বললাম,
—–কোন চিন্তা করো না। আল্লাহপাকের উপর ভরসা রাখো।মনোবল শক্ত রাখো। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
জাহিদ বললো,
—–মৌমিতা আর মামুন কি নিজেদের সামলাতে পেরেছে?
আমি বললাম,
—-কেন পারবে না।তোমার ছেলে মেয়েরা সবাই খুব বাস্তববাদী।সম্পা ওদের শিখিয়েছে সব পরিস্থিতির সাথে জীবনকে কি করে মানিয়ে নিতে হয়। জাহিদ আমার হাসপাতালে যাবার সময় হয়ে গেলো।

আমি জাহিদ আর মাহিনের কাছে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। হাসপাতালের কিছু প্রশাসনিক কাজ বাকী ছিলো।
সেগুলি শেষ করে চেম্বারে বসলাম। প্রথমেই যে পেশেন্ট দেখবো তার নাম তানিয়া। আমি ভাবিনি তানিয়া আমার কাছে আবার আসবে।কারণ পলাশ ওকে হয়ত আমার কাছে আসতে দিবে না।যাক যে ভাবনা থেকেই ও আমার কাছে আসুক না কেন এই মূহুর্তে ওরা আমার পেশেন্ট আর আমি ডাক্তার।এর বাইরে ওদের সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই।
—আসসালামু আলাই কুম।আপা ইনি আমার হাসবেন্ড।
আমি পলাশের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখে
বললাম,
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বসুন।আজ এতোদিন পরে ওকে দেখে স্মৃতির আর্গল ভেঙ্গে বেদনার বিষাদ সিন্ধু মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো ক্রমশ। মনে কত শত প্রশ্ন ভীড় জমাচ্ছিলো। একটা চেনা গন্ধ আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছিলো।আমার অনুভূতিগুলিকে অবশ করে দিচ্ছিলো। নিয়তির অমোঘ নিয়মে ও আজ একই সমস্যা নিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
আছে।এভাবেই মানুষ তার কর্মের ফল ভোগ করে।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
—–ডাক্তার সারোয়ার রিপোর্ট বলছে আপনার স্ত্রীর
কোন সমস্যা নেই।সমস্যাটা আপনার।এই কারনে আপনাদের বেবী হচ্ছে না। আপনাকে কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি।একমাস ওষুধ খাবার পর আমরা আই ভি এফ সিস্টেমে অগ্রসর হবো।আর এটা একটা ব্যায়বহুল প্রজেক্ট।আপনাদেরও প্রস্তুতি থাকা দরকার।
পলাশ লজ্জিত ভাবে মলিনমুখে আমার কথাগুলো শুনলো।মুখে কিছুই বললো না।আমি ওদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে বিদায় করলাম।
আমার কাছে ওদের ফিরে আসার একটাই কারন আমার এখানে খরচটা একটু কম।আমি প্যাকেজে এই প্রজেক্টগুলো সম্পন্ন করি। রোগী দেখা শেষ হয়ে গেলো।মাগরিবের আযান হলো।আমি নামাজ পড়ে আমার বাবার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।

আমার বাবার বাড়ির সামনে একটা বিএম ডব্লিউ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।আমি ভাবছি এতো দামী গাড়ি নিয়ে বাসায় কে আসলো?সাত পাঁচ ভেবে বাড়িতে ঢুকলাম। মা আমাকে দেখে বললো,
—-এতো দেরী করলি,তোর তো বিকালে আসার কথা ছিলো।ইকবাল তোর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য বসে আছে।
আমি মার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলাম,
—-উনি কে?
তবে ইলোরাকে দেখে আঁচ করেছিলাম ঐ ভদ্রলোক কে হতে পারে?
মা বললো,
—ফোনে তোকে যার কথা বলেছিলাম।
ভদ্রলোক আমাকে বললো,
—-আমরা আপনার কথাই আলোচনা করছিলাম।গাইনী ডাক্তার হিসাবে অল্প সময়ে আপনার অনেক পসার হয়েছে।
আমার মার উপর রাগ হলো।মা কি আমাকে এখনও কচি মেয়ে ভাবে, বাবার অসুস্থতার কথা বলে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। এসব নাটক আমার সাথে মা না করলেও পারতো।অনেক কষ্টে রাগ সংবরণ করে মাকে বললাম,
—-আমি সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিলাম।খুব ক্লান্ত লাগছে।এখুনি বাসায় চলে যাবো।
মা আমাকে বললো,
—-ভিতরের রুমে আয়।তোর সাথে কথা আছে।আমি ভদ্রলোক কে সালাম দিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—বাবা,তোমার শরীর কেমন আছে।
বাবা গম্ভীরভাবে বললো,
—-ভালো আছি।
বাবা আমার সাথে ভালো করে কথা বলে না।এখনও অভিমান পুষে রেখেছে।আমি মার সাথে কথা বলতে ভিতরের রুমে চলে গেলাম।
মা আমাকে বললো,
—-ইকবালকে তোর কেমন লাগলো।
আমি মাকে বললাম,
—-মা তুমি আমার সাথে এই নাটক না করলেও পারতে।তোমার কি মনে হয় আমি এখনও কচি খুকিটি রয়ে গেছি। আর সেদিন তোমাকে আমার মতামত জানিয়ে দেওয়া সত্বেও তুমি এই কাজটা কেন করলে?
মা বললো,
—-তোর ভালোর জন্য করেছি।একবার তো একটা ছোটলোককে নিজের পছন্দে বিয়ে করলি।কি লাভ হলো।সুখী হতে তো পারলি না।দুদিন তোকে টেস্ট করেই ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
আমি মাকে বললাম,
—-তুমি আমার সাথে এই ভাষায় কথা বলতে পারলে।তুমি জানো না আমার সমস্যা।পলাশ কেন যে কারো সাথে বিয়ে হলে আমার এই অবস্থা হতো।সমাজের চোখে পুরুষের কোন দোষ হয় না।তাই বন্ধা মেয়েকে নিয়ে কেউ সংসার করতে চায় না।
মা আমাকে বললো,
—-শাক দিয়ে মাছ ঢাকিস না। তোর চরিত্র আগে ঠিক কর।কি এক ঠিকাদারের সাথে তোর এতো কিসের সখ্যতা।এমন কি এখন ও বাড়িতে রাত ও কাটাচ্ছিস। তোর নজর সব সময় নিচের দিকে।
একজন ডাক্তার হলেও মেনে নিতাম।
আমি মাকে বললাম,
—-সে ঠিকাদার নাকি ছুইপার এতে আমার কিছু যায় আসে না।তবে মানুষ হিসাবে সে অনেক উঁচুমানের।আমার কাছে তার পরিচয় সে একজন ভালো মানুষ।আমার যখন ডিভোর্স হলো তোমরা কেউ আমার পাশে দাঁড়াওনি। ঐ লোকটার পরিবার আমার পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়িয়েছে।
মা বললো,
—-এমনি এমনি দাঁড়ায়নি।স্বার্থ আছে বলে দাঁড়িয়েছে।এমন মালদার পার্টি কেউ হাত ছাড়া করে। আর তুই তো আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখিসনি।
আমি বললাম,
—-কেমন করে রাখবো? তোমাদের ভাবভঙ্গি দেখে আমার মনে হচ্ছিলো আমার কারনে তোমাদের সম্মানহানি ঘটবে।তাই কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে নিজেকে
তোমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিলাম।অথচ সে সময় তোমাদের সাপোর্ট আমার প্রয়োজন ছিলো। বাবা এখনও আমার সাথে ভালো করে কথা বলে না।আর একটা কথা বাইরে থেকে মানুষ যেটা দেখে সবসময় ঠিক দেখে না।না জেনে শুনে কারো সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে হয় না।এমন সময় ইলোরা এসে মার সাথে সুর মেলায়।
—-আপু তুমি এবার মায়ের প্রস্তাবটা মেনে নাও। দেখবে জীবনে অনেক সুখী হবে।
আমি বললাম,
—তোর কেন মনে হলো আমি দুঃখী। আল্লাহ পাক সবাইকে সব কিছু দেন না।আমার যা দিয়েছেন তোকে তো সেটা দেননি।তোকে আল্লাহপাক ভরভরান্ত সংসার দিয়েছে।সেটা আবার আমাকে দেননি।তুই যদি তোর জীবন নিয়ে সুখে থাকিস আমিও তো আমার জীবন নিয়ে অনেক সুখী।আল্লাহপাক আমার হাত দিয়ে কত মানুষের উপকার করান।তারা আমার জন্য দুহাত তুলে আল্লাহ পাকের কাছে মোনাজাত করে। কত মানুষের হাসি মুখ দেখে আমার অন্তর জুড়িয়ে যায়। আমি
মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো। আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্বেও আমাকে মার কাছ থেকে নোংরা কথাগুলো শুনতে হলো।হয়ত মার কাছে মনে হয়েছে এই লোকটা পাত্র হিসাবে আমার উপযুক্ত। তাই মা বলেছে।খুব কষ্ট পেলাম। সবার সামনে আমি চোখের পানি ফেলি না।একান্ত গোপনে
আল্লাহর কাছেই নিজেকে সমর্পন করে কাঁদি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here