#দুজনা পর্ব-০২
#রোকসানা_আক্তার
#পর্ব-০২
আদিল ঢাকায় ফিরেছে গোনে গোনে আজ তিনদিন হলো।এই দিনগুলোর মধ্যে আদিল একটিবারও আমাকে কল করে নি।ও গতবার যাওয়ার সময় আমাকে একটা সিমের নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল।ওটায় ডায়াল করেছি।বন্ধ পাচ্ছি।এছাড়া উনার আর কোনো নাম্বার নেই আমার কাছে।ভেতরটা এবার সত্যিই শুষ্ক মরুভূমির মতন হাহাকার করে উঠে আমার।শাশুড়ী মাকে জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আদিলের ব্যাপারে।কিন্তু উনাকে জিজ্ঞেস করতেও ভয় করছে।দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে ফোনটা খাটের উপর রেখে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।দৃষ্টিটা দূরে দিয়ে দেয়ালের সাথে গা এলিয়ে দাঁড়াই!হঠাৎ নাঁকে-মুখে গন্ধের একটা ঝাঁঝ আসে।গন্ধের ঝাঁঝ কোথা থেকে আসতেছে এখানে?ভাবতে ভাবতে পরক্ষণেই আমার হুঁশ ফিরে!আমিতো রান্না ঘরে করলা ভাঁজি ছড়িয়ে রুমে চলে এসেছি আদিলকে আবার একটু ট্রাই করতে।কিন্তু ফোনটা হাতে নেওয়ার পর করলা ভাঁজির কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছি।সেটা পুঁড়ে যেয়ে আবার গন্ধ বের হয় নি ত?হন্তদন্ত পায়ে ছুটে যাাই রান্নাঘরের দিকে।আসলে যা ভাবনা তা-ই সত্য হলো।করলার অংশবিশেষ পুঁড়ে গিয়েছে।পাশের রুম থেকে শাশুড়ী মা প্রচন্ডভাবে কাশতেছেন।আর কাঁশতে কাঁশতে বোধহয় রান্নাঘরের দিকেই আসতেছেন।আমার ভেতরের চেপে থাকা সেই ভয়টা আরো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবার!আমি উপায়ন্তর না পেয়ে ভাঁজির ভেতর পানি ঢেলে দিই।শাশুড়ী মা এসেই,
“রান্না টুকু করতে জানো না?বাপ-মা রান্না শেখায় নি তোমাকে?কাঁশতে কাঁশতে তো আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছে!”
বলে উনি চুলার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসেন।মাথাটা হালকা উঁচিয়ে করলার পাতিলে চোখ রাখেন।কোটর থেকে যেনো চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম শাশুড়ী মায়ের এবার।সাথে রাগটা আকাশ ছুই ছুই।প্রচন্ড বিকট আওয়াজে বলে উঠেন,
“সে কি!তোমাকে না বলেছি?ভাঁজি করতে?তুমি এ রান্না করতেছো কেনো?বড় বউ মা?সাথী?সাথী?”
সাথে সাথে আমার জা এবং ননদ রান্নাঘরে এসে হাজির হয়।ননদ বলে,
“কি হয়েছে,মা?”
“দ্যাখো,ও কি রান্না করেছে?”
ননদ শাশুড়ী মাকে পাঁশ কাঁটতে কাঁটতে বলে,
“দেখি কি রান্না করেছে?”
বলে পাতিলের দিকে তাকায়।খুন্তি ছিল পাশে। তা দিয়ে করলাগুলো নাড়া দেয়।নাড়ার মাঝেই চোখমুখ কুঁচকে আসে উনার।করলা এক পিচ মুখে দেয় টেস্ট করতে।সাথে সাথে “ওয়াক ওয়াক” করে মুখ থেকে আবার সেই করলার পিচটা ফেলে দেয়।তেঁজি কন্ঠে বলে উঠে,
“এ’তো সব পুঁড়িয়ে ফেলেছে,মা!”
“কি!আবার পুঁড়িয়েও ফেলেছে!” (জা)
বলে জাও পর্যবেক্ষণ করে করলাটা।ননদের উক্তির সাথে সেও একই উক্তি প্রকাশ করে।আমি অপরাধী দৃষ্টিতে শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকাই। শাশুড়ী মায়ের মুখ দেখে বেগ পেতে হলো না বেশিক্ষণ উনি যে খুব রেগে গেছেন আমার উপর!আমি সত্যটা এবার বলে দিই,
“মা আমি ভাঁজিই করেছিলাম।রুমে গিয়েছিলাম আর একটু ফিরে এসে দেখি পুঁড়ে গেছে।বিশ্বাস করুন মা আমি তা ইচ্ছে করে করিনি।”
“বিয়ে করিয়েছি ছেলেকে।আজ পর্যন্ত এক পয়সা বাপের বাড়ি থেকেতো আনতেই পারলে না।তারউপর রান্নাবান্নাটাও ভালো করে জানো না।কোনো কাজই ভালো করে জানো না তুমি।শুধু রক্ত-মাংসের একটা মানুষ হয়ে এই বাসায় এসেছো।এটুকুই তোমার গুণ!”
“বাপের বাড়ি থেকে একটা পয়সাও আনতে পারো নি”-বিয়ের পর আজ এই প্রথম শাশুড়ীর মুখ থেকে এ’কথাটা শুনলাম।এর আগে কখনো বলেন নি। কেনজানি খুব কষ্ট লাগলো।খুব!শান্ত স্বরেই বলে উঠলাম,
“মা?আপনিতো আমাকে দেখেশুনেই আপনার ছেলের জন্যে বিয়ে করিয়ে এনেছেন।আর আমার পরিবারের সেই অবস্থা এখনতো আর নেই। বাবা ক্যান্সারের একজন রোগী!”
“হয়েছে রাখো তোমার অজুহাত।বিয়ে করিয়ে আনার পর থেকেই সেই একই অজুহাত” ক্যান্সার ক্যান্সার!যে ভিক্ষা করে খায় না?সেও তার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ভ্যানগাড়ি ভর্তি জিনিস পত্র পাঠায়।যাও সামনে থেকে আমার!বড় বউমা,ফ্রিজে করলা আছে?”
“জ্বী,মা।”
“কয়কটা করলা বের করে কেটেকুটে তোমার হাতে ভেঁজে নাও।আমি আজ করলা ভাঁজি দিয়ে ভাত খাবো।”
বলে শাশুড়ী মা চলে যান।পেছন পেছন ননদও।আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আগের জায়গায় নির্জীব এবং নিষ্পলক!জা আমার দিকে ধমকের সহিত তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“যাবে?নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো ন্যাঁকা অভিনয় দেখাবে?”
চলে এলাম।দরজাটা বন্ধ করলাম।চোখ থেকে অজস্র পানির ধারা টপটপ করে বেয়ে পড়তে লাগলো!অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলাম।চারদিকে আসরের আযান পড়তে বুঝতে পারলাম বিকেল হয়েছে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে বসা থেকে উঠপ বাথরুমে ঢুকলাম।নামাজের ওযু করলাম।জায়নামাজ হাতে নিয়ে নামাজে দাঁড়াবো কল বেঁজে উঠে।এগিয়ে যেয়ে স্ক্রিনে তাকালাম।মায়ের কল।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলটা রিসিভ করলাম।ওপাশ থেকে মায়ের কান্নামিশ্রিত কন্ঠস্বর!
“প্রিয়ারে?কত জায়গায় টাকা চাইলাম।কোথাও টাকা পেলাম না।তোর বাবার থেরাপী দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।এখন কি করবো?কোথা থেকে এতগুলা টাকা জোগাড় করবো মাথায় কিছুই আসতেছে না!”
“মামার কাছে চেয়েছো?”
“চেয়েছি।তোর মামার হাত পুরা খালি।আর কত দেবে আমাদের!আমাদের দিতে দিতে সে নিজেই এখন শেষ!”
“মা কান্না করো না।সমস্যা আল্লাহ দিয়েছে।একটা সমাধান নিশ্চয়ই হবে!”
“কীভাবে সমাধান হবে!জমি যেটুকু শেষ সম্বল ছিল তাও বন্ধক।একটা কড়িও যে কোনোভাবে নিব আর সেই পথ নাই।”
বলে মার কান্নার স্বর আরো বিকট হতে থাকলো।আমার মুখে ভাষা নেই কী জবাব দেব এই মুহূর্তে। বিধাতাকে শুধু এটুকুই বলতে ইচ্ছে হলো,জীবনটা কেন এত কষ্টের!”মা আবার বললেন,
“আচ্ছা রাখি।পরে কথা বলবো তোর সাথে।দেখি সুদের মাধ্যমে কেউ দেয় কি না!”
বলে মা কল কেঁটে দেন!
———————————————————
রাতে ঘুমাতে গেলে কতরকমের চিন্তা মাথায় আসে।আদিল কল করছে না।কেনো করছে না?রাতে আবার ফেরত দেওয়ায় অভিমানে রাগ করে নয়তো?নাকি অন্য কোনো কারণে?কিভাবে জানবো?কোন উপায়ে!ওদিক দিয়ে বাবার থেরাপি দেওয়ার সময় চলে এসেছে।হাতে এক কড়িও নেই।কি হবে?কীভাবে?মাথায় কিচ্ছু আসছে না।কিচ্ছু না!চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ!নিস্তব্ধতার ঘোর কাঁটে ফোনের আওয়াজে।নাম্বার না দেখে হাতরিয়ে ফোনটা তুল কানের কাছে নিই,
“হ্যালো,প্রিয়া?”
চির পরিচিত কন্ঠস্বরটা কানে ঢুকতেই ভেতরটা ধক করে উঠে।আর মুহূরে আমি কেঁদে ফেলি।অভিমানী কান্না।বলতে থাকি,
“এতদিন কেনো কল করেন নি?কি হয়েছে আপনার?”
“কান্না থামাও তুমি প্রিয়া।বলতেছি!”
“নাহ কান্না থামাবো না।আপনি আমাকে খুব যন্ত্রণা দিয়েছেন এই ক’দিনে!”
“আসলে সমস্যা হয়ে গিয়েছিল প্রিয়া!”
“যত সমস্যা থাকুক।ফোন তো দিয়ে ত অন্তত একটু খবর জানাতে পারতেন আপনার!তাও করেননি।আপনি খুবই পাষাণ!”
“প্রিয়া?বউ?লক্ষ্রী বউ?দয়া করে একটু শোন!”
এবার নিজেকে যথেষ্ট দমানোর চেষ্টা করি।উনি বলেন,
“বাসা থেকে আসার সময় ট্রেনে আমার ফোনটা চুরি হয়ে যায়।যখন বাসায় এসে পৌঁছায় তখন ব্যাগ খুলে দেখি ফোনটা নাই।তন্নতন্ন করে খুঁজি ব্যাগে,আমার পকেটে। তবে আমার মনে ছিল ফোনটা আমি ব্যাগের পকেটে রেখেছিলাম।তা আর কি করার!উপায় ছিল না কারো সাথে যোগাযোগ করার।পরে বন্ধু ছিল ওর একটা ফোন ছিল পুরনো ওটা আজ আমাকে দিয়ে যায়।তাই ওই ফোন দিয়ে এখন তোমাকে কল করলাম।”
চুপ করে রইলাম।আসলে আমি মানুষটাকে কতভাবে ভাবলাম!এত বড় বিপদের মুখ দিয়ে গেলো।আমার নিশ্চুপতায় আদিল,
“প্রিয়া শুনতেছো আমার কথা?”
“জ্বী,বলুন…!”
এভাবেই রাত বারোটা বেঁজে যায় আদিলের সাথে কথা বলতে বলতে।কথার মাঝে ভেতরটা বারবার হাহাকার করে উঠে আদিলকে কিছু বলতে!কিন্তু বাবার অসুখের টাকার চিন্তা সবকিছুতে মনটা বিষিয়ে যায়।চেপে গেলো মনের যত অতল কষ্ট!হয়তো আদিল কখনোই আমার মনোকষ্টের জানবে না!কখনোই না!কল কেঁটে আবারো দুই ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এলো।
চলবে…..