দুই বোনের ইসলাম গ্রহণের গল্প

পর্ব-২
আমার বোন তখন সাথে তার কথাকে সাপোর্ট করে এটা নিয়ে পরে মা, খালা,নানীকে নিয়ে নিদ্রা করে।

তখন ওয়েলকাম টুন নতুন নতুন চালু হয়েছে। আমার বোন মাইকেল জ্যাকসনের peace গানটা ওয়েলকাম টুনে দেয়। গান একটু হলেই কল রিসিভ করে ফেলতো তাই মা ধরতে পারেনি এটা ইসলামিক গান। কিন্তু আমার মামা একদিন সিহিন্তাকে কল করে পুরাটা শুনে এবং মাকে জানায় যে ও ইসলামিক গান দিয়ে রেখেছে। মা রাগারাগি করে তখনই ওকে দিয়ে গানটা ডিলেট করায়। আমি একটা ডায়রিতে কিছু সূরা আর দুআ লিখে রেখেছিলাম পরে মুখস্ত করবো বলে। কিন্তু ওটাও কিভাবে জানি মার হাতে পরে। মা কেন আমার রুমে ঢুকে আমার ডায়রি বের করে জানিনা। কিন্তু ওটা পড়ে ফেলার পর অনেক রাগারাগি করে। ওটা ছুড়ে বাইরে ফেলে দেয়।

আমি তখন ক্লাসে ছিলাম। সিহিন্তা কল করে আমাকে জানায়। বাসায় আসতেও ভয় পাচ্ছিলাম। এবং বাসায় এসে অনেক বকা খাই ওটার জন্য। তাছাড়া আমাদের ফুলহাতা কাপর পরা, চার্চে যেতে না চাওয়া, আমাদের আচরণে, কথা বার্তায় পরিবর্তন ইত্যাদির কারনেও মার মনে সন্দেহ জাগতে থাকে। তবে তখনো সে বুঝেনি যে আমরা ততদিনে মুসলিম হয়ে গেছি। সিহিন্তাকেই সবাই বেশি সন্দেহ করতো। আমার ব্যপার তখনো তারা ধরতে পারেনি কারণ আমি তখনও ওর মতো জ্ঞান অর্জন করতে পারিনি ফলে ইসলামের ব্যপারে কথাই বলতাম না।

এরপর থেকে আমরা আরো সাবধান হয়ে যাই। সিহিন্তা ইসলামিক বই গুলো,যেমন কুরআনের অনুবাদ গুলো, বুখারী শরীফ ইত্যাদি বই এর উপর মলাট লাগিয়ে রাখতো যাতে কেও না বুঝে। দুআ বা সূরা লেখা শিট গুলো ভার্সিটির লেকচার শিটের মাঝে রাখতাম যাতে কেও খুলে না দেখে। ইসলাম চর্চা থেমে থাকেনি কোনো কারণেও আলহামদুলিল্লাহ। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে বই পড়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট ও পিস টিভি থেকে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারি আমরা। বই এর ক্ষেত্রে মরিস বুখাইলির বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান বইটার কথা আমার বেশি মনে আছে। বইটা থেকে কুরআনের মিরাকাল সম্পর্কে একটা ধারনা পাই। কিছু বিদা’তি বইও আমরা পড়েছিলাম তবে আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ পথভ্রষ্ট হতে দেয়নি। সিহিন্তা পিস টিভিতে ইউসুফ এসটেস, হুসেইন য়ে, আসিম আলহাকিম, জাকির নায়েক এদের লেকচার রেগুলার দেখতো। আমি বিকালের আগে ফ্রি হতে পারতাম না তাই পিস টিভি দেখার সুজোগ পেতাম না খুব একটা। আমার ভাই একদিন মাকে বলে দিয়েছিলো যে সিহিন্তা পিস টিভি দেখে। এরপর থেকে বাসায় কেও থাকলে ও-ও পিস টিভিতে লেকচার দেখতে পারতোনা। অনেক বেশি সাবধানে থাকতে হতো।

আমরা youtube এ বাবা আলী ও ইউসুফ এস্টেস এর লেকচার দেখতাম। ইউসুফ এস্টেসের ইসলামে আসার কাহিনী অনেক ইনফ্লুয়েন্স করে আমাকে। উনার প্রতিটা লেকচার খুব খুব ভালো লাগতো। বাবা আলীর লেকচারও তখন খুব ভালো লাগতো, মজা পেতাম দেখে। যদিও এখন আর আগের মতো ভালোলাগেনা। তবে অনেক কিছুই যে জানতে পারি এখান থেকে এতে সন্দেহ নাই। সিহিন্তা নেট থেকে সার্চ দিয়ে ইউসুফ এস্টেসের ইসলাম টুমরো ওয়েবসাইট টা পেয়েছিলো। ওটা ও রেগুলার ব্রাউজ করতো। ওখান থেকেই ও ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির সন্ধান পায়। এরাবিক রিডিং রাইটিং এর কোর্সটাতে এনরোলও করেছিলো। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে ইসলাম চর্চা চলতে লাগলো।

সিহিন্তার প্রতি সবার সন্দেহ ছিলো। তাই আমার চেয়ে বেশি ওকে সাবধানে চলতে হতো। তখন সুজোগ ছিলোনা কিন্তু ইসলাম চর্চা থেমে থাকেনি। আর এখন এতো সুজোগ তাও আগের মতো পড়িনা বা লেকচার শুনিনা। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিক। লিখতে গিয়ে আবার সেই ঈমানের স্বাদ পেতে ইচ্ছা করছে। কতো কষ্ট করেছি তাও কতো মানসিক শান্তি ছিলো,অন্য রকম এক ভালোলাগা যা লিখে বুঝানো যাবেনা! আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের বাবার জন্ম মুসলিম পরিবারে হলেও অন্যান্য সাধারন মুসলিম নামধারী তরুনদের মত তিনিও সেকুলার ছিলেন। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে কোন ধর্মই মানতেন না উনি। “বরং যার যার ধর্ম তার তার” এ বিশ্বাসী ছিলেন (আলহামদুলিল্লাহ আমরা মুসলিম হবার অনেক পরে বাবাও তাওবা করে ইসলাম গ্রহন করেন এবং এখন তিনি একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম)।

বাবা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন আমার খ্রিস্টান মাকে। ফলে আমারা জন্মের পর থেকে খ্রিস্টান হিসেবে বেড়ে উঠি আমাদের খ্রিস্টান আত্বিয়দের সাথে। মুসলিম আত্বিয়দের সাথে তেমন যোগাযোগ ছিলনা।হয়তো ঈদে দাদীমার বাসায় যেতাম। এছাড়া সারা বছরে দেখাও হতোনা। বাবাও ইসলাম সম্পর্কে আমাদের সাথে আলাপ করতেন না। সিহিন্তা দাদীর বাসার কাছে এক কোচিং এ পড়াতো। ও দাদীর বাসায় যাওয়া শুরু করলো ইসলাম সম্পর্কে আরো জানতে। দাদীর থেকে কিছু বই আনে ও যেগুলা বিদ’আত আর বানোয়াট কাহিনীতে ভরা। তবুও ও খুব আগ্রহ নিয়ে বইগুলো পড়তো। আমি যে মুসলিম হয়েছি তা দাদী জানতোনা তবে তিনি সিহিন্তার ইসলামের আসার কথা শুনে খুব খুশি হন। দাদীর একটা ব্যপার আমার খুব ভালো লাগতো। উনি অনেক অসুস্থ্য ছিলেন। কিডনি প্রায় ৯০% ড্যামেজ। হার্টে ৪/৫টা ব্লক ধরা পরে। বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না। তাও উনি সালাত বাদ দিতেন না।

সিহিন্তা দাদীর সাথে সময় কাটাতো জেনে মা খুশিই হয়। অসুস্থ্য দাদীর সাথে নাতী নাতনিরা দেখা করতে গেলে উনার ভালো লাগবে জানতেন। তাই মা কিছু বলতেন না।অবশ্য মা কখনো বাবার পরিবারের সাথে মিশতে বাধা দিতনা। তারা যে আমাদের মুসলিম বানাতে চেষ্টা করবেনা তা মা জানতো। কিন্তু বাবা খ্রীস্টান বিয়ে করাতে এবং আমরা খ্রীস্টান থাকাতে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। উনারা কেও আসতোনা তেমন আমাদের বাসায়, আমরাও যেতাম না। সবাই নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। আমরা আমাদের খ্রীস্টান আত্মিয়দের সাথেই সব সময় মিশতাম। সিহিন্তা দাদীর থেকে বই আনতো, দাদীর সাথে গল্প করতো, আমিও মাঝে মাঝে যেতাম। এভাবেই দিন চলতে লাগলো।

আমরা কোনো নির্দিষ্ট মানুষের কাছ থেকে ইসলাম শিখিনি। আমরা নিজেরাই বই সংগ্রহ করে, পিস টিভি দেখে, নেট থেকে ইসলাম শিক্ষা পাই। একমাত্র আল্লাহই আমাদের গাইড করেছেন। ফলে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাইনি আলহামদুলিল্লাহ। বই ও পিস টিভি ছাড়াও আমরা ইসলামিক ফোরাম, islamqa, islamhouse, islamic online university ইত্যাদে ওয়েব সাইডে রেগুলার ব্রাউজ করতাম। নেটে ব্রাউজ করতে গিয়ে শিয়া ও অন্যান্য ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা সৃষ্টিকারী ওয়েব সাইটের পোস্টও আমরা রেগুলার পড়তাম। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারলাম এসব ওয়েবসাইট authentic না তখন সেসব পড়া বাদ দিয়ে দিলাম।

আল্লাহ নিজে আমাদের গাইড করার কারনে প্রথম থেকেই আমরা সঠিক ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করতে পারি। প্রথম থেকেই আমরা বুঝেছিলাম যে বাংলাদেশে সঠিক ইসলাম পালন করা হয়না। বাংলাদেশে যে এমনও মানুষ আছে যারা সঠিক ইসলামিক পদ্ধতিতে চলতে চেষ্টা করে সে ধারনাও আমাদের ছিলোনা। আমাদের খ্রীস্টান নামে id ছিল ফেসবুকে। সিহিন্তা একদিন অন্য নাম দিয়ে ফেসবুকে একটা নতুন আইডি খুলে। ওই আইডি দিয়ে ও বিভিন্ন ইসলামিক গ্রুপ সার্চ দিয়ে বের করে ফেসবুকে। তখন fb তে গ্রুপ গুলোতে discussion board খুব চালু ছিলো। তেমন একটা Discussion board থেকে সিহিন্তার আমাদেরই সমবয়সি সোহানা আপুর সাথে পরিচয় হয়। সোহানার পোস্ট পড়ে ও বুঝতে পারে যে সোহানাও সঠিক ইসলাম পালন করে এবং ও বাংলাদেশে,ঢাকাতেই থাকে দেখে খুবই অবাক হয়। সিহিন্তা সোহানাকে fb তে এ্যাড করে। সোহানা ওর কথা জানতে পেরে ওর থেকে ফোন নাম্বার নেয়। একদিন কল করে দেখা করার ব্যবস্থাও করে। আমি দেখা করতে যেতে পারিনি। সিহিন্তা একাই যায় দেখা করতে। বসুন্ধরা সিটির চার তালায় মেয়েদের নামায পড়ার স্থানে ওরা দেখা করে। প্রথমে আমরা বই পড়ে সালাত পড়া,অজু করা শিখেছিলাম। ফলে অনেক ভুল ছিলো আমাদের সালাত আর অজুতে।

সেদিন সোহানাই প্রথম সিহিন্তাকে হাতে কলমে সালাত, অজুর সঠিক পদ্ধতি শিখায়। পরবর্তীতে সিহিন্তা নেট থেকে একটি ফ্ল্যাশ নামায় যেটা থেকে সঠিক পদ্ধতিতে নামায পড়ার পদ্ধতি আরো ভালোমতো শিখতে পারি আমরা। সোহানার মাধ্যমে nsu এর আরো কিছু আপুর সাথে আমাদের পরিচয়। তাদের মাধ্যমে ঢাকায় সঙ্গঠিত ইসলামিক কনফারেন্স গুলোর খোঁজ পাই। সেখান থেকেও অনেক আপুর সাথে পরিচয় হয়। [সিহিন্তার কাহিনী আমি লিখতে গেলে অনেক কিছুই বাদ পরে যায়। তাছাড়া ওর সাথে আলাপ করার সময়ও পাচ্ছিনা। ইন শা আল্লাহ এখন থেকে আমার কাহিনীটাই আগে শেষ করবো]

সিহিন্তার সাথে fb থেকেই এক আপুর সাথে পরিচয় হয়। ফারিহা আপু। সেই আপুই আমাদের এনাম আঙ্কেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এনাম আঙ্কেল আমাদের মসজিদে শাহাদা নেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শারিয়াত অনুযায়ী আসলে শাহাদা নেয়ার নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। মুসলিম হতে হলে আল্লাহতালাকে সাক্ষী রেখে একাকী মন থেকে পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে আল্লাহকে একমাত্র প্রকৃত ইলাহ মেনে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসালামকে আল্লার নাবী মেনে সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আরবীতে কালিমা-এ-শাহাদাহ মুখে উচ্চারণ করলেই হয়ে যায়। সেই মুহুর্ত থেকে সালাত, সিয়াম, হাজ্ব, যাকাত ওই ব্যক্তির উপর ফরয হয়ে যায়, এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। মাসজিদে শাহাদাহ নেয়া, গুসল ইত্যাদি হল নিছক আনুষ্ঠানিকতা। আমরা আগেই সেভাবে মুসলিম হয়েছিলাম, তবে গোপনে হওয়ায় অল্প কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউ জানতোনা। ফারিয় সিহিন্তাকে বলেছিল আরেক নও-মুসলিম ভাইয়ের কথা যে হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছিল, আনুষ্ঠানিকভাবে শাহাদাহ না নেয়াতে, কোন সাক্ষী না থাকাতে মারা যাওয়ার পর তাকে হিন্দুদের শশ্বানে পোড়ানো হয়। আর সিহিন্তার ক্ষেত্রে যেহেতু খৃস্টানের সাথে বিয়ের চেষ্টা চলছিল, স্বাধীনভাবে ইসলাম পালন করা অসম্ভব ছিল…

এমন অবস্থায় একটা মুসলিম কমিউনিটির সাথে যুক্ত হওয়াটা জরুরী ছিল। ওর নাম বদলানোরও প্রয়োজন ছিলনা, তারপরও এফিডেবিট করে নাম বদলাতে হয়েছে, কাগজে কলমে প্রমান রাখতে হয়েছে যে ও নিজের ইচ্ছায় মুসলিম হয়েছে – কারো মাধ্যমে ব্রেইনওয়াশের স্বীকার হয়নি। যাই হোক,আমরা কবে মসজিদে যেতে পারবো আঙ্কেলকে জানালাম। মনে আছে ওইদিন আমি প্রথম কামিজের সাথে মাথায় সুন্দর করে হিজাব পরেছিলাম। এনাম আঙ্কেল আর ফারিহা আমাদের গাড়িতে করে নিতে আসলো। আমার গাড়িতে খারাপ লাগে, তারুপর প্রথম হিজাব পরা, গাড়িতে আমার মাথা ঘুরানো শুরু হয়। মুহাম্মদপুর ইকবাল রোডের আল-আমীন মসজিদে আমরা শাহাদা নেই।

মসজিদে অনেক মানুষ এসেছিলো আমাদের শাহাদা উপলক্ষ্যে। আমরা মসজিদের দ্বিতীয় তালায় গিয়ে বসি। আমার মাথা ঘুরাচ্ছিলো তাই প্রথমে একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসি। যখন একটু সুস্থ্য হয়ে তাকাই এতো মানুষ দেখে লজ্জা লাগছিলো। সবার মাঝে একটা খুশি খুশি ভাব। শরীফুন্নেসা আন্টি আমাকে আর সিহিন্তাকে আইনে রাসূল বই দেন ও দুটা খিমার উপহার দেন। এরপর ঈমামের সাথে সাথে আমরা কালিমা পড়ি। আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবার সামনে ইসলাম গ্রহণ করি!! কেমন যে লাগছিলো বোঝাতে পারবোনা। মুসলিম হবার আনন্দ, বাসায় জানলে কি হবে তার ভয়, সামনের জীবনের কথা ভেবে উদ্বিগ্নতা, আবার অদ্ভূত এক শান্তির অনুভূতি ছিলো মনে। সব মিলিয়ে অন্য রকম মিস্র এক অনুভূতি। কালিমা পড়লাম সবার সামনে, এরপর গোসল করে দুই রাকাত সালাত আদায় করতে হবে। হুমায়রা আন্টি বলেছিলেন উনার বাসায় গিয়ে গোসল করে সালাত পড়ে নিতে। কিন্তু দেরি হয়ে যাবে বলে আমরা বাসায় চলে আসি।

এসে দুজন গোসল করে নেই। এরপর একসাথে দুই রাকাত সালাত আদায় করে নেই। সেদিনের কথা কখনোই ভুলবনা। আমার তখনো অনেক জানা বাকি, বুঝা বাকি ইসলাম সম্পর্কে। সিহিন্তার মতো এতো পড়তাম না আমি ইসলাম নিয়ে। জানতাম সবাই জানতে পারলে মুসলিম হবার কথা সামনে অনেক বড় পরীক্ষায় পরতে হবে। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। তবুও একবারো মনে হয়নি ভুল ডিসিশন নিয়েছি। আল্লাহর উপর এতো বেশি বিশ্বাস করেছি যে এই কথা কখনো মাথায়ই আসেনি। এখনো মনেহয় যে আল্লাহ যে আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন, এজন্য সারা জীবন সেজদায় পরে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলেও তা কম হবে। ইসলামের স্বাদ যে কি তা, যে পায়নি সে কখনোই বুঝবেনা। সিহিন্তার বিয়ের জন্য তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হল। ও বিয়ে করতে চাইতোনা বলে ওকে না জানিয়েই পাত্রী দেখানোর ব্যবস্থা করা হতো মাঝে মাঝে। কিন্তু খ্রীস্টান ছেলে তো ওর পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না।

ইসলাম গ্রহণের পর সবচেয়ে কঠিন যে পরীক্ষায় আমাদের পরতে হয়েছে তা হলো মাকে কষ্ট দেয়া। আমরা জানতাম মা অনেক কষ্ট পাবে, ভেঙ্গে পরবে। কিন্তু মাকেও তো আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্ট জীবকে খুশি করতে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার থেকে তো আমরা দূরে যেতে পারিনা। ইসলামে মা বাবার গুরুত্ব অনেক। তাদের সকল কথা মান্য করতে বলেছেন আল্লাহ। তবে শুধু মাত্র আল্লাহর বিরুদ্ধে যায় বা আল্লাহর আদেশ কে অমান্য করা হবে এমন কথা মানা যাবেনা। তাই মা কষ্ট পাবে জেনেও আমাদের আর কোনো উপায় ছিলনা। প্রচুর মানসিক কষ্টের মধ্যে থাকতাম। যাকে আমরা অনেক ভালোবাসি তাকে এভাবে জেনে শুনে কষ্ট দেয়ার মানসিক যন্ত্রনা যে কি বুঝানো যাবেনা। সত্য একদিন সামনে আসবেই জানতাম কিন্তু সে সত্যর সম্মুখীন হবার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। সিহিন্তাকে এমন অবস্থায় দুজন মানুষ অনেক সাহস ও সাপোর্ট দিয়ে সহায়তা করেন। তারা হলেন রেহনুমা আপু ও তারিন আপু। প্রকৃত দ্বীনি বোনের মতোই এরা সকল কষ্টে পাশে ছিলেন আলহামদুলিল্লাহ!

আমরা শাহাদা নেই ২০০৯ এর জুন মাসের ২১তারিখ, পরের মাসে মানে জুলাই মাসে শরীফুন্নেসা আন্টি তার ছেলে শরীফ আবু হায়াত অপুর জন্য সিহিন্তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। সে মাসেই এনাম আঙ্কেলের সহায়তায় ICD তে অপু ভাইয়া ও সিহিন্তা দেখা করে কথা বলে। সিহিন্তা বিয়ের ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলোনা। মাকে কষ্ট দেয়ার কথা ভেবে খুবই মানসিক চাপ অনুভব করছিলো। তখন এনাম আঙ্কেল, হুমায়রা আন্টি, তারিন আপু, রেহনুমা আপু সিহিন্তাকে মানসিক সাহস ও সাপোর্ট দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সাহায্য করেন (আমিও সাথে সাপোর্ট করি)। সিহিন্তা বিয়ে করতে রাজী হয় কিন্তু মেয়েদের বিয়ের জন্য দরকার একজন ওয়ালি। বাবাকে তো বলা যাবেনা মুসলিম হবার কথা, তাই সিহিন্তা দাদীমার সাথে দেখা করে তাকে জানালো সব। সিহিন্তা বার বার নিষেধ করে দিয়েছিলো সবাইকে যেন কেও বাবা মা কে কিছু না জানায়। কিন্তু আমার ছোট চাচা হয়তো খুশি হয়েই বাবাকে ফোনে সব বলে দেন। কিন্তু আমরা যে ভয় পেয়েছিলাম তাই হলো। বাবার মাধ্যমে মাও সব জেনে যায়। এরপর যে ভয় আমরা মুসলিম হওয়র পর থেকে করছিলাম তার সম্মুখীন হবার সময় আসলো।

আজকাল দাড়িওয়ালা, ইসলামিক বেশভূষার পাত্র হলে অনেক মুসলিম মায়েরাই মেয়ে বিয়ে দিতে চায়না। সেখানে একজন অমুসলিম মা – যার সঠিক ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই তিনি যে রাজী হবেন না এটাই তো স্বাভাবিক। সিহিন্তা মুসলিম ছেলের সাথে বিয়ে হতে চায় জানতে পেরে মা স্বাভাবিকভাবেই অনেক কষ্ট পান, এবং পরে তা রাগে পরিণত হয়। সিহিন্তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় আর দিন রাত শুধু কাঁদতেন। । অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে দেখে ও বাসায় বলে দেয় যে ও মুসলিম হয়েছে। কিন্তু সবাই ভেবেছে যে ও অপু ভাইয়াকে আগে থেকে পছন্দ করতো এবং ভাইয়াকে বিয়ে করতে মুসলিম হয়েছে। ও যে মনে প্রানে ইসলামকে নিজের দ্বীন হিসেহে গ্রহন করেছে এটা কেউ বুঝতে চাইল না। অবশেষে মা অপু ভাইয়ার সাথে কথা বলতে রাজি হলেন।

কিন্তু ভাইয়ার ইসলামিক পরিবার ও ভাইয়ার দাড়ি দেখে না করে দেয়। মা কিছুতেই সিহিন্তাকে ইসলামিক পরিবারে বিয়ে দিতে চায়নি। সিহিন্তা যাতে ইসলামিক ভাবে চলতে না পারে সেদিকেও কড়া নজর রাখা হয়। সবাই ভাবতো ভাইয়াকে ভুলে গেলে ও ইসলামকেও ভুলে যাবে। মার আরো ধারনা ছিলো যে সিহিন্তার মুসলিম বান্ধবিরা ওর মগজ ধোলাই দিচ্ছে মুসলিম হওয়ার জন্য। তাই সবার থেকে ওকে দূরে রাখার চেষ্টা করতো। অবস্থা এতোই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে এভাবে প্রেশারে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিলোনা। জোর করে তো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ইসলামের প্রতি ভালোবাসা, আল্লাহর ইবাদত করা বন্ধ করে দেয়া যায়না। তাই প্রচুর মানষিক কষ্টের মধ্য দিয়ে ওকে যেতে হয়েছে।

মা অনেক কষ্ট পাচ্ছিলো, অনেক কান্নাকাটি করতো। না পারছিলো সিহিন্তা মার কষ্ট দূর করতে না পারতো সঠিক পথ থেকে ভুল পথে যেতে। আমার এখনো মনে আছে সিহিন্তা শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছিলো টেনশনে। আমার কথা কেও সন্দেহ করেনি বলে আমাকে তখন এই যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়নি। তবে সিহিন্তার অবস্থা দেখে খুব কষ্ট লাগতো। মা যখন আমার কথাও জানবে তখন যে কি হবে আল্লাহই জানেন। আমি নিজেও মানসিক কষ্ট পাচ্ছিলাম। আগেই বলেছি কারো ধারনাও ছিলোনা যে আমরা ইসলামকে সঠিক ধর্ম মানি। ভাবতো হয় সিহিন্তা ব্রেইন ওয়াশড হয়েছে না হয় প্রেমে পরেছে। সিহিন্তা বিয়ে করে ইসলাম পালনের সুযোগ পাবে। কিন্তু আমার কথা জানতে পারলে এই কষ্টের মধ্য দিয়ে কতোদিন যেতে হবে তার ঠিক নাই। আর মার কষ্ট কমানোর জন্যও তো কাওকে এখন মার সাথে থাকা লাগবে।

তাই আমার মুসলিম হওয়ার কথা আর প্রকাশ করিনি কারো কাছে। খ্রীস্টান সেজেই থাকতে লাগলাম সবার সাথে। এবং খুবই সাবধানে নামায পড়তাম। বাসার সব ইসলামিক বই লুকিয়ে ফেলেছিলাম। মাকে কোনো ভাবেই মুসলিম ছেলের সাথে সিহিন্তার বিয়ের জন্য রাজী করানো গেলোনা। সিহিন্তা সিদ্ধান্ত নিয়ে পারছিলোনা কি করা উচিত এখন। আগেও বলেছি এই কঠিন সময়ে এনাম আঙ্কেল, হুমায়রা আন্টি, রেহনুমা আপু, তারিনাপু মানসিক ভাবে সাপোর্ট দেয় ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। এরপর অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হলো মা-বাবাকে না জানিয়েই সিহিন্তার বিয়ে দেয়া হবে। আমার এক চাচা হবেন ওয়ালি, যার সাথে সারা জীবনে মাত্র কয়েকবার আমাদের দেখা হয়েছে। বিয়ে হবে দাদীর বাসায়। যেহেতু কর্মদিবস ছাড়া ছুটির দিন ও বাসা থেকে বের হতে পারবে না, আবার সন্ধ্যার পরও বের হওয়া যাবেনা, তাই দিন ঠিক হল ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯; সোমবার সকালে।

রামাদানের ২৬ তারিখ। ঐ পক্ষ থেকে বিয়ের হালকা পাতলা শপিং করা হলো। আমিও টিউশনির টাকা থেকে টুকটাক কিছু শপিং করলাম ওর জন্য। কলেজে যাওয়ার পথে লুকিয়ে ওর কিছু জামা-কাপড় দিয়ে আসতাম অপু ভাইয়ার কাছে। এদিকে ভাইয়া ওর এফিডেবিটের কাজটাও সেরে ফেললো। বিয়ের আগের দিন খুব বৃষ্টি ছিল, বৃষ্টির মধ্যে আমরা দুই বোন শেষবারের মত ঘুরতে বের হলাম। বসুন্ধরা সিটিতে ইফতার করলাম একসাথে। সিহিন্তার যে বিয়ে হয়ে যাবে, ও দূরে চলে যাবে সবই জানতাম কিন্তু তখনো মন থেকে মেনে নেইনি। সব এতো দ্রুত হচ্ছিলো যে কখন কিভাবে কি হয়ে যাচ্ছে বুঝে উঠতেই পারছিলাম না। যেন সব আগে থেকেই প্ল্যান করা। আল্লাহ কখন কি হবে সব ঠিক করে রেখেছিলেন। বাসায় ফিরে সিহিন?

ইনশাআল্লাহ্ চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here