#দুঃখগাথার_রাজকন্যা
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_6
আরাভ তাড়াতাড়ি মীরাকে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। রাত্রি পানি গ্লাস আরাভের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলো মিরার চোখে মুখে ছিটিয়ে দেবার জন্য। আরাভের হৈচৈ শুনে সোনিয়া মির্জা উঠে এসেছেন। মীরার বড়ভাই সৌরভ ঘুমঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে সোফার এক কোনে গিয়ে হেলান দিলো। ছেলেটা প্রচণ্ড ঘুমকাতুরে। সকাল দশটা না হলে তার ঘুম ভাঙেনা। উনি গতদুদিন বাড়িতে ছিলেন না বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়েছিলন। বাড়িতে ফিরতেই এমন ড্রামা ওর অসহ্য লাগছে। সোনিয়া মির্জা মেয়ের পাশে বসে অনবরত ওর চোখেমুখে পানি দিয়ে আরাভকে বললো ডাক্তারকে ফোন করতে। মেয়েটার শরীর এমনিই অনেক দুর্বল। খাওয়া দাওয়া করে না মোটা হয়ে যাবে সেই ভয়ে তারপর হঠাৎ এমন ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। উনি মেয়েকে বকছেন আর পানি দিচ্ছেন। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মীরার জ্ঞান ফিরলো। ও কাঁদো কাঁদো হয়ে মায়ের হাতখানা জড়িয়ে ধরে বলল,
> আম্মা বাড়িতে খুন হয়েছে,বাইরে অনেক রক্ত।
মেয়ের কথা শুনে উনি কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলেন,
> কিসের রক্ত? আর কে খুন হবে শুনি?
> চলো আমার সঙ্গে।
মীরা সোফা থেকে নেমে সবাইকে নিয়ে বাড়ির পেছনে গেলো। জবা গাছের নিচে জমাট বাধা অনেক রক্ত পড়ে আছে। আরাভ তাড়াতাড়ি পুলিশে ফোন করলো। রক্ত আছে কিন্তু কারো লাশ নেই বিষয়টা কেমন অদ্ভুত লাগছে। বাড়িতে সবাই উপস্থিত তাহলে রক্ত গুলো কার? পুলিশ এসে তদন্তের পরেও কোনো কিছুই বুঝতে পারলো না। পরে বলল হয়তো কোনো বন্য পশু এখানে এসে আহত হয়েছিল ফলে এমন হয়েছে।এসব দেখে রাত্রী অনেক ভয় পেয়েছে ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।। এসব ঝামেলায় বেশ সময় পার হয়ে গেলো। আরাভ এসব বাদ দিয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে ওকে যেতেই হবে। তমাল ওর জন্য ইউনিভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। ও এসেছে কিছুক্ষণ আগে তবে ওর মুখে বিরক্তি নেই আছে হাসির ঝলক। ওর এমন রহস্যময় হাসির কারণ জিঙ্গাসা করতেই তমাল মুখ টিপে আরও একটুখানি হেসে উঠে বলল,
> বন্ধু তুমি যার জন্য দেওয়ানা তার ঠিকানা পাইছি।
> আমি আবার কার জন্য দেওয়া হলাম? শোন রহস্য ভালো লাগে না ক্লিয়ার করে বল।
> আরে গতকালের সেই আগুন সুন্দরীটার কথা বলছি। ওর নাম অবন্তি, এই শহরের নামকরা পরিবারের মেয়ে বুঝলি।
> এটা পরিচয় হলো? শুধু নাম আর পরিবারের অবস্থা!ওর পরিবারের অবস্থা দিয়ে কি আমি লন্ডন যাব অদ্ভুত।
> অদ্ভুত না দোস্ত অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে এখন থেকে নিয়মিত দেখতে পাবি সেই আগুন সুন্দরীকে।
> তোর আগুনে আমি পানি দিয়ে দিবো। বলবো নাকি তোর ওকে?
> ঠিক কি বলবি? অদ্ভুত কথাবার্তা আমি কি নিজের জন্য বলেছি? আমি তো তোর জন্য ওর ঠিকানা বের করার চেষ্টা করছি।
> শোন দিনকার বড়ই খারাপ। অনেক মানুষকে দেখেছি বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের লগে ভেগে গেছে। আবার অনেকেই বউ নিয়ে টানাটানি পযর্ন্ত করে তাই তোর এমন সাধু মার্কা কথায় ঘাসজল খাবে না। ক্লাসে চল আমার কোনো আগুন পানি লাগবে না।
আরাব ওর দিকে বাঁকা নজরে তাকিয়ে ক্লাসের দিকে ইঙ্গিত দিলো। ওর এমন করতে দেখে তমাল গম্ভীর হয়ে বলল,
> যাচ্ছি মানুষের ভালো করলেও দোষ।
> থামবি?
ওরা চুপচাপ ক্লাসে ঢুকলো। আরাভের মধ্যে ছেলেমানুষী ভাবটা খুবই কম। ও সব সময় গম্ভীর থাকতে পছন্দ করে কিন্তু তমাল উল্টোটা করে। অনেকেই মজা করে বলে ওর মুখের হাসি একদিন না গলার ফাঁসি হয়ে উঠে। পরপর দুটো ক্লাসের পরে কিছু সময় আপাতত ক্লাসের ঝামেলা থাকে না। আরাভ বাসা থেকে খেয়ে আসেনি প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে তাই তমালকে নিয়ে ক্যান্টিনে ছুটলো চা কফি বা হালকা কিছু খাওয়ার উদ্দেশ্যে। ক্লাস টাইমে ক্যান্টিন খালি থাকে। গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে বসে আছে। ওরা দুজন খাবারের অর্ডার দিয়ে বসতেই হঠাৎ পাশ দিয়ে ঝড়ের গতিতে একটা মেয়েকে ঢুকতে দেখলো। আরাভ বিষয়টা এড়িয়ে গেলেও তমাল তাকিয়ে আরাভ কে ফিসফিস করে বলল” দোস্ত সামনে তাকা” আরাভ চোখ ঘুরিয়ে দেখলো সেই মেয়েটা খাবারের অর্ডার দিয়ে ওদের পাশের টেবিলে এসে বসলো। মেয়েটার মুখে কোনো হাসি নেই। মনে হচ্ছে অনেক তাড়া আছে খাবার শেষ করেই বেরিয়ে পড়বে। সেদিন সাদা রঙের গাউন পড়েছিল কিন্তু আজ এসেছে আকাশী রঙের গাউন পড়ে। ওড়না দিয়ে মোটামুটি মাথাটা ঢেকে রেখেছে তবুও চুলগুলো বাইরে পড়ে আছে। সাধারণ সাজুগুজুতেই মেয়েটাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আরাভ কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। টেবিলে খাবার চলে এসেছে। তমাল খাবার রেখে মেয়েটার ওখানে উঠে গেছে দেখে আরাভের বিরক্ত লাগলো তবুও ও চুপচাপ আছে। পরে ঠিক পুষিয়ে নিবে। তমাল মেয়েটার পাশে বসতেই মেয়েটা ভ্রু কুচকে বলল,
> কিছু বলবেন ভাইয়া?
> তেমন কিছুই না আসলে তুমি একা বসে আছো বিষয়টা খারাপ লাগলো।আমাদের ওখানে বসতে পারো।
> সমস্যা নাই ভাইয়া। আমি এখানেই ঠিক আছি।
> বোইন আমরা থাকতে তুমি এখানে একা খাবে তাই হয়নাকি। চলো আমাদের ওখানে।
তমালের এমন ব্যবহারে মেয়েটা বিব্রত হলো। উপাই না পেয়ে উঠে আসতে ও বাধ্য হলো। ওকে নিয়ে তমাল নিজেদের টেবিলে ফিরে আসতেই আরাভ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“বাড়াবাড়ি করাটা মুদ্রা দোষ হয়ে গেছে তাইনা?”
“আরে ও আমাকে ভাইয়া বলেছে।বোন হয়না আমার? ”
তমাল হাসিমুখে কথাটা বলে মেয়েটার দিকে কফির মগটা এগিয়ে দিলো। আরাভ আড়চোখে মেয়েটাকে দেখলো। মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত এবং ভয় পাচ্ছে। ভয় ভাবটা লুকানোর চেষ্টা করছে তবুও বারবার ছাপটা ওর চোখে মুখে ফুঁটে উঠছে। ওকে এমন ঢোক গিলতে দেখে আরাভ কফির মগ থেকে মুখ উঠিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল,
> আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
আরাভের এমন কথায় মেয়েটা চমকে উঠে ঢোক গিলে জোরকরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> ভয়ের কি আছে। আমার একটু তাড়া আছে। বাড়িতে ফিরতে হবে।
>সেকি এতো তাড়াতাড়ি ফিরবেন? এখনো যে ক্লাস শেষ হয়নি।
> বাড়িতে একটু সমস্যা আছে। আপনারা খাওয়া শেষ করেন আমি আসছি। আলাপচারিতায়ের এখনো অনেক সময় পাওয়া যাবে। আমি নিয়মিত আসবো ইনশাআল্লা।
নাম ঠিকানা না বলেই মেয়েটা উঠে আসলো। ওদের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলো না। ওকে এভাবে উঠতে দেখে আরাভ তমালের দিকে তাকিয়ে কাকে একটা ফোন করলো। তারপর ফিসফিস করে বলল,
> তোর ব্যবস্থা হচ্ছে অপেক্ষা কর।
আরাভের কথা শেষ হতে দেরি কিন্তু একটা মেয়ে উপস্থিত হতে দেরী হলো না। মেয়েটা ঝড়ের গতিতে এসে তমালের পাশে চিপকে বসে ওর কলার ধরে টানাটানি শুরু করলো। আরাভ সামান্য হেসে উঠে আসলো। তমালের গার্লফ্রেন্ড দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে। প্রচণ্ড জেদি মেয়েটাকে সামাল দিয়ে ওর রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। আধুনিক যুগের প্রেম বলে কথা। যুগের সঙ্গে ভালোবাসার হয়েছে অসীম পরিবর্তন। না জানিয়ে পানি খেলেও বিপদে পড়তে হয়। যখন ফোন ছিল না চিঠিতে ভাবের আদান প্রদান করতে হতো তখন লোকে কি করতো কে জানে। বিষয়টা ভাবতে ভাবতে আরাভ চলে আসলো।
পড়ন্ত বিকাল বাড়িতে কয়েকজন মানুষ আছে। রাত্রি সবার জন্য নাস্তা রেডি করে চা তৈরী করলো। এই বাড়িতে শুধু চা না কফিও তৈরী করতে হয়। উপরে একজন ভদ্রলোকের জন্য আজ ব্লাক কফির অর্ডার এসেছে। রাত্রি কফি তৈরী করে গুটিগুটি পায়ে উপরের দিকে চলল। উপরে এসে ও দাঁড়িয়ে আছে।রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে ও হালকা ধাক্কা দিতেই পুরোপুরি খুলে গেলো। সৌরভ আয়নার সামনে সৌরভ খালি গায়ে টাওয়েল দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুজতে ফোনে কথা বলছে। ওকে এভাবে দেখে রাত্রি পিছিয়ে গিয়ে নক করলো,
> ভাইজান আপনার কফি।
সৌরভ ফোনটা রেখে ওকে ভেতরে আসতে বলল। রাত্রি ভয়ে ভয়ে ট্রি টেবিলের উপরে কফির কাপটা রাখতে রাখতেই শুনলো,
> নতুন এসেছো?
> জ্বী।
> শুনো আমার পিঠে এই ওয়েলটা লাগিয়ে দাওতো।
পিছনে আমার হাত পৌঁছে না। তাড়াতাড়ি করো।
এমন হুকুম শুনে রাত্রি তাড়াতাড়ি নিজের হাতটা আচলের নিচে লুকিয়ে ঢোক গিলে ফেলল। কি ভয়ানক বিপদ। অপরিচিত একজন যুবকের পিঠে তেল মালিশ করতে হবে ভেবেই ওর হাতপা কাঁপাকাঁপি করছে। তারপর আবার হাতের আঙ্গুলে কালি আছে। তেলের ছোঁয়া পেয়ে গুলিয়ে উঠে লোকটার পিঠে লেগে যাবে বিষয়টা খুবই খারাপ হবে। নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ পাবে। রাত্রির ঘোর কাটলো পেছনে মীরার কথা শুনে। মীরা হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এসে বলল,
> এই মেয়ে এখানে কি তোমার? শুধু ফাঁকি দেবার ধান্দাবাজি। যাও আম্মু তোমাকে ডাকছে।
মীরার এমন কথায় সৌরভ ওকে বলল,
> ওর দোষ কোথায়? আমি ওকে হুকুম করেছি তাই দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা তুমি যাও।
রাত্রি আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। প্রায় দৌড়ে আসলো। খাবার টেবিলে আরাভ বসে আছে। রাত্রিকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে ও গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> কফি ঘরে পৌঁছে দিতে হবে কেনো? রান্নাঘরের দায়িত্ব ছাড়া খালামনি তোমাকে কি এই বাড়ির সব মানুষদের দায়িত্বও দিয়েছে নাকি ?
> জ্বী
> কথায় কথায় জ্বী জ্বী বলবে না ঠিক আছে? আর শুনো নিজের ঘর আর রান্নাঘর ছাড়া কোথাও যাবেনা। এই বাড়িতে একটা সমস্যা আছে যেটা ক্রমশই প্রকাশ পাবে। আমি চাইছি না পরবর্তী ভিকটিম তুমি হও।
> মানে?
> কিছুনা যাও।
আরাভের কথার মানে রাত্রি কিছুই বুঝলো না। ও চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসলো। সকালবেলায় রবি দুদিনের ছুটিতে বাড়িতে গেছে। রাত্রি বসার অবকাশ পাচ্ছে না। একেরপর এক হুকুম এসে হাজির হচ্ছে। সোনিয়া মির্জা কথা রাখেনি উনি টিভির সামনে বসলে নাওয়া খাওয়া ভুলে রাত্রিকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। রাতে সবাইকে খাবার দিয়ে তবেই রাত্রির ছুটি। গভীর রাত আরাভ নিজের রুমে বই নিয়ে বসে আছে। মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। কিন্তু সূত্র মিলছে না। এমন সময় বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শুনে ও তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিতেই দেলো রাস্তার উপরে একটা রহস্যময় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে আসলো এক সাদা চুলের বৃদ্ধ মহিলা।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন তেলোয়াত করি।