#দুঃখগাথার_রাজকন্যা
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৩
রাত্রিকে রবি মোটামুটি রান্নাঘরের সবকিছুই দেখিয়ে দিয়েছে। রাত্রি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছে আপাতত কোনো ভুলত্রুটি করে নিজের জায়গাটা নড়বড়ে করার ইচ্ছা নেই ওর। অন্যদিকে সোনিয়া মির্জা বেশ খুশি নতুন কাজের মেয়ে পাওয়ার জন্য। মেয়েটিকে আর হাতছাড়া করা যাবে না। দরকার হলে ওকে অতিরিক্ত ভালোবাসা এবং সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে যা আজ অবধি এই বাড়িতে কাজের লোকের উপরে করা হয়নি।। কারো থেকে ভালো কিছু পেতে হলে তাকেও কিছু দিতে হয়। সামান্য মুখের মিষ্টি কথাতেই এসব গরিব মানুষের মন খুব ভালো করেই পাওয়া যায়। তাহলে কিছু মিষ্টি করে কথা বললে সমস্যা কিসের।। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে নিজের পেটের শত্রুটাকে নিয়ে।মেয়েটাকে একটু বোঝাইতে হবে। মেয়েটা হয়েছে বাপের মতো। খিটখিটে মেজাজ আর জমিদারে মতো স্বভাব। এখনো সময় আছে বুঝিয়ে শুনিয়ে তৈরী করতে না পারলে কপালে দুঃখ নাচছে। অন্যদিকে আরাভ ছেলেটা হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই ভালো। ওতটা ভালো হওয়ার দরকার ছিল বলে উনার মনে হয়না তবুও হয়েছে। এই ছেলেটির জন্য আমার মেয়েটার না জানি ঝামেলা হয়ে যায় । স্বামীর আল্লাদের জন্য ওর সঙ্গে মেয়ের বিয়ের কথা ভেবেছেন নয়তো উনি কিছুতেই রাজি হতেন না। উনার দুলাভাই উজির আলী মেয়ের জন্মের আগে থেকেই নিজের ছেলে জন্য মেয়েটাকে চেয়েছিলেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই উনি রাত্রিকে থাকার জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের পাশের রুমটাতে ওর জায়গা হয়েছে যদিও রুমটা খুব একটা ভালো না তবে খারাপও না।। আসবাবপত্র বলতে পুরাতন আমলের কিছু জিনিসপত্র তবে সেগুলোর যত্ন নিলে একদম নতুন হয়ে উঠবে। রাত্রির বেশ পছন্দ হলো ঘরটা দেখে। রবি ওকে সঙ্গে নিয়ে সব পরিস্কার করতে শুরু করলো। রাত্রি কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে না পেরে জিঙ্গাসা করলো,
> আচ্ছা ভাইজান উনারা কাজের লোকদের কি এরকম বিশাল বিশাল রুমে থাকতে দেন?
> একদমি না আফা।। আসলে এদের কুনো কামের বেডি থাহে না তাই আফনারে পাইয়া এমন আলগা পিরিত দেখাইতেছে। তই সাবধানে থাইকেন। ওইযে এদের বাড়িতে একটা বেডাসোল আছে না ওডির নরজ ভালা না।
> সব কপাল গো ভাইজান। বিপদ আছে জেনেও থাকতে হবে কিছুই করার নাই। আচ্ছা ভাইজান ওইযে যেই বাডাই আসছে ওইডা নাকি?
>দুর আরাভ ভাইজান ভালা মানুষ। থাহেন পরে বুঝবেন।
রবির কথা শেষ হলো না এর মধ্যেই সোনিয়া মির্জা হাজির। উনি জানেন রবির মুখটা বেশ চলে। বেশ বলতে ভালোই চলে। এই ছেলেটা বেশ কাজের তবে ওর মুখের দোষের জন্য মাঝেমধ্যে লাথি দিয়ে বিদায় করতে মন চাই তবুও পারেন না। বাড়িতে কাজের মানুষ না থাকলে সব উনার ঘাড়ে এসে জুটবে। কেউ কুটোটিও কাটবে না। কথাগুলো ভেবে উনি রাত্রিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন। বাকিটা রবির কাজ ও করে নিবে। রাত্রিকে নিয়ে উনি চা নাস্তা তৈরী করতে ঢুকলেন। আজ থেকেই ওর কাজ শুরু,বসে থাকার অবকাশ নেই। রাত্রি বেশ মন দিয়ে কাজগুলো করছে। এভাবে দিন পেরিয়ে রাত নামলো। নির্জন কক্ষে এপাশ ওপাশ করছে রাত্রি। বাড়ির খবর নেওয়া দরকার ছিল। মায়ের মুখটা বারবার মনেপড়ছে। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার। রাতটা কিছু মানুষের কাছে ভীষণ প্রিয় আবার কিছু মানুষের জন্য বেদনার। কাঁদতে কাঁদতে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
গভীর রাত হঠাৎ দমকা হাওয়ায় জানালাটা খুঁলে যাওয়ার শব্দে রাত্রির ঘুমটা ভেঙে গেলো। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই দেখলো জানালার পাল্লা গুলো বাতাসের ঝাপটায় শুধু বন্ধ হচ্ছে আর খুঁলছে। দমকা হাওয়া আটকানোর জন্য রাত্রি তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করতে গেলো। আকাশে মেঘ করেছে কি দেখার জন্য ও বাইরে উঁকি দিলো। শনশন ঝড়ো বাতাস হচ্ছে কিন্তু আকাশে চাঁদ আছে আর জোছনার আলোতে চারদিকটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। জানালা থেকে কিছুদূরে কেউ একজন মাটি খুঁড়ছে। রাত্রি ভ্রু কুচকে ব্যাপারটা ভালো করে লক্ষ্য করলো কিন্তু কিছুই বুঝলো না। অদ্ভুত লোকজন সব। রাতে মাটি খুঁড়ছে ঘটনা কি জানার জন্য ও জানালা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমে নীল রঙের ড্রিম লাইট জ্বলছে। আবছা অন্ধকারে ওর মনে হলো উপরে কেউ একজন কাঁদছে। ও তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। উপরে উঠে ওর চোখ ছানাবড়া। দরজায় একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রি বাচ্চাটার পেছনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে চমকে উঠে চিৎকার দিয়ে উঠলো। হঠাৎ ওর পায়ের বল কমে গেলো আর ও মেঝেতে ঝুপ করে বসে পড়লো। কিছুক্ষণের জন্য চারদিকটা কেমন পরিবর্তন হয়ে গেলো। রাত্রি তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই চোখগুলো গোলগোল হয়ে গেলো। ও নিজের রুমেই আছে। তবে বিছানায় না মেঝেতে পড়ে আছে। এতক্ষণ ও যা কিছু দেখেছে ওগুলো সব স্বপ্ন ছিল। জীবন্ত স্বপ্ন, একদম পনেরো বছর আগের সেই দৃশ্য। ওর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। এসব ভাবতে ভাবেই ফজরের আযান দিয়ে দিলো। রাত্রি তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করে বাইরে আসলো। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। একটু হাঁটাহাটি করলে যদি ভালো লাগে এই আশায় ও বাইরে বেরিয়ে আসলো। বাড়িটা কেমন দৈত্যাকার লাগছে। রাত্রি বাইরে এসে বাগানে দিকে এগিয়ে গেলো।ততক্ষণে অন্ধকার কেটে আলো ফুঁটেছে। বাগানের মধ্যে কেউ একজন দৌড়াদৌড়ি করছে দেখে রাত্রি সেদিন এগুলো। সামনে লেনের পাশে লাগানো জবা ফুলের গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ও দেখলো একটা ছেলে রাউন্ড রাউন্ড ঘুরছে। ও ভ্রু কুচকে লোকটাকে চেনার চেষ্টা করলো। একে কখনও দেখেনি।তবে মনে হয় লোকটা এই বাড়ির লোক হবে হয়তো।কিন্তু লোকটাকি পাগল নাকি ভুতের ধরেছে? শুনেছিল ভুতে ধরলে এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করে থাকে। ভুতের কথা মনে হতেই ওর সারা শরীর কেমন শিউরে উঠলো। গায়ে কাটা দিচ্ছে। বিড়বিড় করে বলল” তিনাদের নামে হাজার সালাম। ছেলেটাকে ছেড়ে দিন আপা”। রাত্রি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ কেউ ওর কাধে হাত রাখলো আর ও চমকে উঠে পিছিয়ে এসে বলল,
> ক্ষমা করবেন আপা আমি আর কখনও আপনার বলির সামনে আসবো না।
> কিসের বোলি?
কোনো পুরুষ মানুষের কন্ঠ শুনে রাত্রি তাড়াতাড়ি চোখ খুলে তাকিয়ে এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলল। ওর মুখের দিকে ছেলেটি এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। ও কথা বলছে না দেখে ছেলেটি আবারও বলল,
> নতুন কাজের মেয়ে তাইনা?
> জ্বী
> তো এখানে কি তোমার? যাও আমার নাস্তা তৈরী করো। খালামনি বলেনি আমার ভোরবেলা ক্ষুধা পাই?
> বলেছিলেন কিন্তু বুঝিনি সকালেই করতে হবে। আমি এখুনি যাচ্ছি।
কথাটা বলে ও তাড়াতাড়ি সরে আসতে চাইলো। ভীষণ লজ্জা লাগছে। ছেলেটা ভয়ানক সুন্দর দেখতে। রাত্রি শাড়ির আচলটা আরও টেনে মাথায় নিয়ে চলে আসতে গিয়ে পেছন থেকে আবারও প্রশ্ন আসলো,
> কালো রঙটা তোমার গায়ের সঙ্গে মিলছে না। কিছু একটা ঝামেলা লাগছে। আচ্ছা তুমি দেখতে কি এমনিই কালো,নাকি অন্যকিছু?
ছেলেটার কথা শুনে রাত্রি ভড়কে গেলো। ভাবলো এই সেরেছে। এই পন্ডিতের সামনে আর আসা ঠিক হবেনা। লোকটা গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করে মনে হচ্ছে। ও নিজের ঘোমটা আরও কিছুটা টেনে মিনমিন করে বলল,
> আমি এমনিই দেখতে। খালাম্মা রাগ করবেন আমি আসছি এখন।
রাত্রি আর পেছনে তাকালো না। তাড়াতাড়ি কেটে পড়লো। পেছনে তাকানোর সাহস পেলো না। গায়ের রঙটা ঠিকই আছে ছেলেটা অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।