দুঃখগাথার রাজকন্যা
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৩
রাত্রী দ্রুত নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করলো। কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ওর হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ভেবেছিল এখানে হয়তো ওর সন্ধানে কেউ আসবে না তাই নিজের নামটার নিয়ে কোনো মিথ্যা বলেনি। এখন যদি লোকটা ওর নাম আর বাড়ির ঠিকানা জেনে যায় তখন কি হবে? না না এই বাড়িতে থাকা ওর জন্য নিরাপদ হবেনা। রাত্রী আজকের মধ্যেই এখান থেকে পালিয়ে যাবে। ভোরবেলায় যখন কেউ উঠবে না ঠিক তখনই ওকে বেরিয়ে পড়তে হবে। কথাগুলো ভেবে ও তাড়াতাড়ি নিজের কাপড়গুলো পুটলি বেধে যেমন এসেছিল ঠিক তেমনই ভাবে গুছিয়ে নিলো। এমন সময় ওর দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পড়তেই রাত্রী চমকে উঠে মেঝেতে বসে পড়লো। আরাভ অনবরত দরজায় নক করছে। রাত্রী তাড়াতাড়ি উঠে নিজের ঘোমটা ঠিক করে দরজার খুলতেই ও হুড়োহুড়ি করে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সোফায় গিয়ে বসল। রাত্রী দরজার পাশে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরাভ ভ্রু কুচকে বলল,
> সারারাত কি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকার পরিকল্পনা করেছো? একটা বাজতে চলেছে।
আরাভের কথার রাত্রী উত্তর করলো না চুপচাপ বিছানায় গিয়ে জড়সড় হয়ে শুয়ে পড়লো। মনের মধ্যে নানারকম কথাবার্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এক নামে সারাদেশে হাজারো মানুষ আছে তবুও মনের মধ্যে নানারকম চিন্তা ভাবনার উদয় হচ্ছে। ও এপাশ ওপাশ করে মাঝরাতে ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘন গভীর জঙ্গল দূর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। ঘন গাছের জন্য দিন রাতের পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে না। রাত্রী জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। জঙ্গলের গভীরতা বুঝতে হলে পর্যাপ্ত আলোর প্রয়োজন কিন্তু এখানে চারদিকটা কেমন আবছা অন্ধকারে ছেয়েআছে। তাছাড়া চোখ যতদুর যায় গাছ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও ও আস্তে করে পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো। শুকনো পাতার উপরে পা পড়তেই মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। এভাবে কিছুদূরে আসার পরে হঠাৎ একটা জিনিসের উপরে ওর চোখ আটকে গেলো। কিছুদূরে গাছের গোড়ায় কয়েকটা ছোট চোখ ওর দিকে তাকিয়েআছে। রাত্রীর ভীষণ ভয় করছে। এই চোখগুলো কাদের হতেপারে ভেবে ও থেমে গেলো। চোখগলো ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। রাত্রী ভয়ে ওখানে আর উপেক্ষা করলো না পেছনের দিকে দৌড় দিলো চোখগুলোও ওর পেছনে ধাওয়া করলো। রাত্রী ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত। জঙ্গলরের মধ্যে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে তবুও থামলে চলবে না। কিছুদূরে আসার পরে ও বুঝতে পারলো ওগুলো শেয়ালের চোখ। শেয়ালগুলো ওকে তাড়া করছে। রাত্রী ঘেমে একাকার। কি করবে কিভাবে এদের থেকে বাঁচবে এসব ভেবে ও দোয়া পড়তে শুরু করলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ও পড়ে গেলো। ততক্ষণে শেয়ালগুলো ওর সামনে চলে এসেছে। রাত্রী ভয় পাচ্ছে। পা এখন আর চলছে না। ওর চোখদুটো শেয়ালগুলোর দিকে। আলো আধারে শেয়ালের চোখগুলো ইটের ভাটার মতো জ্বলছে। রাত্রী কষ্ট করে উঠতেই খেয়াল করলো শেয়াল গুলো কেমন পরিবর্তন হয়ে মানুষে রূপ নিচ্ছে। চারদিকে গগনবিদারী চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুরু হলো। রাত্রী নিজের কানে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। ও চোখ বন্ধ করে চিৎকার করছে।
> ওই এভাবে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছো কেনো? চমকে উঠেছি।
রাত্রীর কানে কথাটা যেতেই ও ঝট করে চোখ খুলে তাকালো। আরাভ ওর মুখের উপরে ঝুকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাত্রীর বুকের মধ্যে ধপাস ধপাস আওয়াজ হচ্ছে। এতক্ষণ ও স্বপ্ন দেখেছিল বিষয়টা বুঝতে পেরে ও উঠে বসলো। আরাভ এখনো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাত্রী বিড়বিড় করে বলল,
> কিছুনা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তাই ভয় পেয়েছি।
> তাও ভালো। যাইহোক নামাজ পড়ে রান্নাঘরে দৌড় দাও। বাড়িতে যিনি এসেছেন উনিও কিন্তু আমার মতোই। সকালবেলায় নাস্তা চাই।
> আচ্ছা উনি কি করেন?আর এতোদিন কোথায় ছিলেন?
> উনার একটা এজেন্সি কোম্পানি আর গার্মেন্টস আছে। লোকজন বাইরের দেশে পাঠানোর কাজ করেন। এই বাড়ির ছেলেদের মধ্যে সবথেকে কর্মঠ।
> লোকটা ভালো নাকি খারাপ? আচ্ছা আপনার কি মনে হয়?
> খুব একটা মেলামেশা হয়নি তবে লোকটা খারাপ না ভালো ।
> মাকাল ফল চিনেন?
> আচ্ছা হঠাৎ তুমি ওকে নিয়ে পড়লে কেনো? গতকাল দেখলাম ওকে দেখে তুমি ভয় পাচ্ছ।বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবো ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে বলে কথা হয়নি
> তেমন কিছুই না। আচ্ছা আপনার না লেট হচ্ছে? আজান হয়েছে কখন জানেন? আমি যাচ্ছি ।
রাত্রী কথা ঘুরিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। আরাভ কিছুই বুঝতে পারলো না। তাই বাইরে চলে আসলো।
সকাল ছয়টা বাজে। রাত্রী রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরী করতে ব্যস্ত। রবি ওকে সাহায্য করছে। ওটা এটা এগিয়ে দিচ্ছে। বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে খটখট শব্দ করে আরাফাত নেমে আসলো। ওর চা নাস্তা রাত্রী আগে থেকেই তৈরী করে রেখেছে। লোকটা ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো। রবি গিয়ে উনার খাবার দিতেই উনি ফিসফিস করে বললেন,
> রান্নাঘরে ওইটা কি আমাদের নতুন কাজের মেয়ে?
> জে না ভাইসাব। উনি আরাভ ভাইজানের স্ত্রী মানে বিবি। ওইযে আপার লগে ভাইজানের বিয়ার দিন কেমনে জানি মাইয়া পাল্টে গেছে।
< বলিস কি রে? এতোকিছু হয়েছে আমাকে কেউ কিছুই বলেনি। আরাভকে ডাক আমি কথা বলবো। আর শোন ওই মেয়েকেও ডাক।
> আচ্ছা।
ডাইনিং রুমের কথাগুলো রাত্রীর কানে ঝড় তুলেছে। ও চুপসে গিয়ে শাড়ির আচলটা আরও খানিকটা টেনে নিলো। কিভাবে এই কঠিন সময় পার করবে ভাবছে। ও একমনে দোয়া ইউনুছ পড়ছে। কিছুক্ষণ পড়ার পরে মনে হলো না এটা দোয়া ইউনুছ না টেনশনে সূরা ফাতেহা পাঠ করছে। হাতপায়ে কাপাকাপি থামছেই না। এমন সময় রবি ওকে ডাক দিলো। রাত্রী হাতের রুটিটা রেখে একপা দুপা করে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আরাফাত ওর ঘোমটা টানা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
> নাম কি তোমার?
> রাত্রী।
রাত্রী গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলতেই লোকটা আবারও প্রশ্ন করলো,.
> বাড়ি কোথায় ঠিকানা বলো।
> কিন্তু কেনো?
> কাজের মেয়েদের বিশ্বাস নেই। তাড়াতাড়ি বলো। আর তোমার বাসার নাম্বার বলো।
কথাটা বলেই আরাফাত নিজের ফোনটা বের করে ও সামনে ধরলো। রাত্রী বিড়বিড় করে কিছু বলল কিন্তু আরাফাতের কান পযর্ন্ত তা পৌঁছালো না। লোকটা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
> তোমাকে কেমন চেনাচেনা লাগছে। নামটাও কেমন পরিচিত। আচ্ছা যাও, তুমি আমি দেখছি।
রাত্রী এবার ঢোক গিলল। সজীব ভাইয়াকে ফোন দিলেই তো ও হাতেনাতে ধরা খাবে। লোকটা রাহুলের অফিসের বস। এজেন্সির নামে হয়তো মেয়েদের পাচার করার ব্যবসা শুরু করেছে। রাত্রী দ্রুত গতিতে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করলো। খাটের নিচে কাপড় গুলো এখনো পড়ে আছে। ভেবেছিল অবস্থা বুঝেই এখান থেকে বের হবে। লোকটা ভীষন চালাক আজ হোক কালহোক ওর পরিচয় ঠিক বের করে নিবে। এই বাড়িতে ওর থাকার সময় সীমা ফুরিয়ে আসছে। কথাটা ভেবেই ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আরাভ গতকাল ক্লাস করেনি তাই দ্রুত বেরিয়ে পড়লো ক্লাসের জন্য। ক্লাসের ফাঁকে তমাল ওর কানে কানে বারবার বলল সেই আগুন সুন্দরী পাত্তা নেই। সেদিনের পর থেকে আর কলেজে আসছে না। আরাভ ওর কথা আমলে আনেনি। পড়ন্ত বিকেলে ও বাড়িতে ফিরে অবাক হলো কারণ বাড়িতে আবারও পুলিশ এসেছে। ওরা বারবার রাত্রীর নাম বলছে। আরাভ অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে শুনলো রাত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না। আগের মেয়েগুলোর মতো রাত্রী কাউকে কিছুই না বলে বাড়ি থেকে উধাও। আরাব বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছেনা। রাত্রী কোথাও যেতে হলে ওকে অন্তত বলতো। ও তাড়াতাড়ি রাত্রীর রুমে গিয়ে তছনছ করে সব খুজে দেখলো সব আছে। রাত্রীর শাড়ি গুলোও পড়ে আছে কিন্তু রাত্রী নেই। শূণ্য শূণ্য লাগছে সব কিছু। চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য। কোথায় গেলো এই অচেনা শহরে?
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।