দুঃখগাথার রাজকন‍্যা
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১২

আরাভ একপা দুপা করে নিচে এসে থামলো। উপস্থিত সবার মুখে চিন্তার রেখা। হামিদা নামের মেয়েটা এক সপ্তাহ আগে এই বাড়ি থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে থানায় ডাইরি করাও আছে। তাছাড়া শুধুমাত্র হামিদা না ওর আগে রমেলা এবং কমলা নামের দুজন মেয়েও এই বাড়ি থেকে হঠাৎ করেই গায়েব হয়েছে। যাদের লাশ ও পাওয়া যায়নি। সবাই ভেবেছে হয়তো মেয়েগুলো নিজে থেকেই কাজ করবে না বলে পালিয়ে যায়। আরাভ পুলিশের সঙ্গে কিছু বলতে গেলো তার আগেই সামনে থেকে মির্জা সাহেব হাতের ইশারা করে ওকে থামিয়ে দিলো। আরাভ এতো কিছু বুঝে না যেটা সত্যি ও সেটাই বলবে। মির্জ সাহেব ওকে ভয় পাই। কোথায় কি বলে দিবে তখন ঝামেলায় পড়তে হবে। কথায় বলে পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা। আরাভ বলতে গিয়েও চুপচাপ ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। থানার বড় দারোগা মোকাম্মেল হোসাইন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করছেন। গতকাল নদীতে জেলেরা মাছ ধরার সময় হামিদার লাশ জালে উঠে এসেছে। পুলিশ ঘটনস্থল থেকে মহিলার একাটা কাপড়ের ব‍্যাগ পেয়েছে।ব‍্যাগ দিয়ে লাশটা একটা বস্তার মধ্যে বাধা ছিল। ব‍্যাগে মির্জা সাহেবের কার্ড ছিল। তারপর খোঁজ করে উনারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন। সোনিয়া মির্জা ভয়ে ভয়ে বলল,
> দেখুন মেয়েটা খারাপ ছিল না।বেশ ভালো ছিল কিন্তু ওর একটা ভয়ংকর নেশা ছিল। এ ফোন নিয়ে একটু বেশিই ব‍িজি থাকতো। সারাদিন কার সঙ্গে জানি কথা বলতো। আমার কি মনে হয় জানেন?
> জ্বী বলুন?
> ওর বাইরের কোনো ছেলের সঙ্গে চক্কর ছিল। এই জন‍্যই সেদিন আমার বাড়ি থেকে নগদ বিশ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। যেই ছেলেটার সঙ্গে পালিয়েছিল হয়তো সেই ছেলেই ওকে খুন করে টাকা পয়সা নিয়ে চলে গেছে।
> হতেই পারে।তবে ময়না ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে আমরা আবারও আসবো। আপনারা কিন্তু কেউ কোথাও যাবেন না যতদিন পযর্ন্ত সব ঠিক হচ্ছে।

আরাব সোনিয়া মির্জার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ভাবছে খালামনি কিভাবে মেয়েটার নামে বদনাম করছে? হামিদা সারাদিন কেনো,সপ্তাহে একবারও ফোন হাতে করতো কিনা সন্দেহ আছে। তবুও ও চুপচাপ থাকলো।পুলিশ চলে গেলে আরাভ সোফায় গিয়ে বসলো। ওর বাবা মা এসেছে। মির্জা সাহেব আরাভের বাবার সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছেন। কিছু একটা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা চলছে সেখানে তৃতীয় চতুর্থ ব‍্যাক্তির প্রবেশ নিষেধ।। রাত্রী রান্নাঘরে তদারকি করছে। সোনিয়া মির্জা ওকে বসার অবসর দিচ্ছে না। হুকুমের পর হুকুম চলছে। তবুও ভালো উনি ওকে কাজের জন্য ডেকেছে এটাই সান্ত্বনা। এতো ঝামেলার মধ্যেও হঠাৎ সৌরভ বন্ধুদের সঙ্গে ইন্ডিয়া যাবার পরিকল্পনা করেছে । আগামীকাল সকালে ওর ফ্লাইট। ছেলেটা ভ্রমণপিপাসু কিন্তু নিজের পরিবারকে এমন বিপদে রেখে ভ্রমণে যাবার কি মানে আরাভ বুঝতে পারছে না। ও ভেবেছিল নিষেধ করবে কিন্তু পরে আর কিছুই বলা হয়নি। পুলিশ আশার পর থেকে রবি কেমন চুপচাপ আছে। হয়তো ভয় পাচ্ছে। এক সঙ্গে বেশ কিছু মাস কাজ করেছিল হয়তো তাই ওর জন্য মনের মধ্যে খারাপ লাগা বা মায়া কাজ করছে। মেয়েটা স্বামী পরিত্যক্তা। ছেলেমেয়ে ছিল না। হয়তো হবেও না কখনও। দশ বছরের সংসার শুধুমাত্র সন্তান হয়না তাই স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়েছিল। কিছু মানুষের আচরণে বোঝা যায় মেয়েদের শুধু সন্তান পয়দা করা আর স্বামীর সেবা করার জন্যই জন্ম হয়েছে। মেয়েটা এতো বছরের সংসারজীবনে ওর স্বামী নামক লোকটার প্রয়োজন ছাড়া প্রিয়জন হতে পারেনি। ভালোবাসা নামক অদৃশ্য বস্তুর অস্তিত্ব সেখানে নেই বললেই চলে। রবির মনে মেয়েটার কথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে। এভাবেই দিন পেরিয়ে রাত নামলো। নির্জন মির্জা বাড়িটা আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে। রাতের খাবার শেষ করে সবাই নিজ নিজ রুমে চলে গেছে কথা বলেনি কেউ। মির্জা সাহেব আজ খুবই চুপচাপ। আরাভ বুঝেছে বিষয়টা অনেক জটিল। রাত্রী রাতের কাজ শেষ করে নিজের রুমে এসে বসলো। দরজার একটা পাল্লা আলগা করা আছে। রাত্রী হাতটা ভালো করে দেখছে। রান্নার সময় গরম তেলে ফোসকা পড়েছিল এখন জ্বলছে। হঠাৎ বাইরে থেকে দরজা ধাক্কা দিয়ে আরাভ ভেতরে প্রবেশ করতেই রাত্রী দাঁড়িয়ে পড়লো। ওকে দাঁড়াতে দেখে আরাভ নিজের চশমাটা ভালো করে পরিস্কার করে পড়তে পড়তে বলল,
> হাত ধরে বসে আছো ব‍্যাপার কি?
> তেমন কিছু না। আপনি আবারও আমার ঘরে?
> তাহলে কি আমার ঘরে থাকবো?
> জ্বী আপনার ঘরেই থাকবেন।সবাই কেমন ভাবে আমার লজ্জা লাগে।
> বাহ তোমার লজ্জাও আছে দেখছি। আচ্ছা শোনো তাড়াতাড়ি জিনিসপত্রগুলোকে ব‍্যাগে বন্দি করে নাও। আমিও সাহায্য করবো।
> মানে সব গুছিয়ে নিয়ে কোথায় যাবো আমি? আপনি আমাকে এই রাত্রের বেলায় তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
রাত্রী ছলছল দৃষ্টিতে কথাগুলো বলতেই আরাভ ভ্রু কুচকে বলল,
> কিছুক্ষণ আগে তুমিই না বললে আমার রুমে থাকাই ভালো। আমিও দেখলাম প্রতিদিন এখানে আশার থেকে আমার রুমেই ভালো। চলো।

আরাভের কথা শুনে রাত্রী চোখ বড়বড় করে ফেলল। ছেলেটার মাথায় সত্যিই সমস্যা আছে। নিজের রুমে একটা কাজের মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছে। উনি এতোটা উদার না হলেও পারতেন। রাত্রীকে চুপচাপ ভাবতে দেখে আরাভ সোফায় বসতে বসতে বলল,
> ভাবনা চিন্তার অনেক সময় পাবে। এখন চলো।
> একদম না। আমি এখানেই ভালো আছি। আপনাকে রোজরোজ আমার ঘরে আসতে কে বলেছে শুনি? আমি আপনাকে সাহায্য করেছি কিছু পাওয়ার আশা করে না বুঝলেন?
> সে যাইভেবেই করোনা কেনো করেছো তো?আমরা কিন্তু স্বামী স্ত্রী। সম্পর্কটা একদম হালাল।অনেক ভেবে দেখলাম বিয়ে যখন একবার করেই ফেলেছি তখন সম্পর্কটা ভেঙে কাজ নেই। মেনে নিয়ে আসো সংসার করি। আগামী বছর আসতে আসতে দুইবাচ্চার জনক হতে চাই।

রাত্রী ওর এমন কথা শুনে ভয়ে ঢোক গিলে চমকে উঠে পিছিয়ে গিয়ে বলল,

> একদম না। খুব খারাপ হবে কিন্তু। আমি শুধুমাত্র আপনাকে সাহায্য করেছি আর কিছুই না। এইসব আগ বললে আপনাকে আমি জীবনেও বিয়ে করতাম না।
রাত্রী একদমে কথাগুলো বলে থামলো। ওকে এভাবে ভয় পেতে দেখে আরাভ মুখটা গম্ভীর করে বলল,

> তোমার জন্য লোকেরা আমাকে সেকেন্ড হ‍্যান্ড বলে মজা নিবে এটাতো হতে পারে না। লোকে আমাকে দেখিয়ে বলবে ওর বউ ওকে ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেটা ডিভোর্সী। এসব হবে না। সংসার তোমাকে করতেই হবে। দরকার হলে তোমার পা দুটো আমি বেঁধে রাখবো।

রাত্রী এবার কেঁদে ফেলেছে। ওর প্রচণ্ড ভয় করছে। আরাভের কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে তো সামনে বিপদ। রাত্রী চোখের পানি মুছে নাক টানতে টানতে বলল,

> দয়াকরে এমন করবেন না। আমি এখানে থাকবো না। চলে যাবো। দেখবেন আগামীকাল সকালবেলায় আমি নিখোঁজ।

ওর এমন কথা শুনে আরাভ শব্দ করে হেসে বলল,

> রাত্রি তুমি সত্যিই অনেক ভালো মেয়ে। তুমি জানো আমার জন্য কতো মেয়ে পাগল ছিল এবং আছে?। কখনও বিয়ে করবো না ভেবে কারো সঙ্গে নিজেকে জড়ানো হয়নি। তবুও তোমার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি তবে চিন্তা করোনা আমি এমন কিছুই করবো না। বাড়ির ঝামেলা ঠিক হলেই তোমাকে একটা কাজ খুজে দিবো। আমিও এবাড়ি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিবো। তোমার মনে আমার জন্য কোনো অনুভূতি তৈরী হয়েছে কি পরীক্ষা করলাম।

ওদের কথার মধ্যে ডাইনিং রুম থেকে কথার আওয়াজ আসলো। শোরগোল হচ্ছে। ওরা চুপচাপ বোঝার চেষ্টা করছে বাইরে কে আছে। ঠিক তখনই বাইরে থেকে দরজায় নক পড়লো। সোনিয়া মির্জা ডাকছেন। মির্জা সাহেবের ছোট ভাই মইনুল মির্জার ছেলে আরাফাত মির্জ এসেছে। ওর জন্য খাবার তৈরী করতে হবে। রাত্রী উঠে আসতেই ওর পিচুপিছু আরাভ ও উঠে আসলো। আরাভ আরাফাতের সঙ্গে গল্প করতে বসলো। আর রাত্রী ঘোমটা টেনে রান্নাঘরে গিয়ে চা তৈরী করে রবিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে ডাকতে গিয়ে সোফায় বসা লোকটাকে দেখে চমকে গেলো। রাত্রীর হাতপা ঠকঠক করে কাঁপছে। ওর সামনে বসা লোকটার মুখটা ওর ভীষণ চেনা। এই লোকটাই তো সেই যার জন্য ও বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছিল। এখন কি হবে যদি ধরা খেয়ে যায় তখন? কথাগুলো ভেবে ও ওখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে আসলো। আরাভ রাত্রীর গতিবিধি লক্ষ্য করছে। মেয়েটার জন্যই ও এখানে বসে আছে। রাত্রীকে নিয়ে ও চিন্তিত থাকে। বিশেষ করে রাতের বেলা। এই বাড়িতে যতগুলো কাজের মেয়ে নিখোঁজ হয়ে সবাই রাতেই হয়েছে। হঠাৎ করেই সবাই যেনো হাওয়া হয়ে যায়।
চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুস নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here