দুঃখগাথার রাজকন্যা
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১১
ফিসফিস শব্দে লোকটা আবারও রাত্রীর নাম ধরে ডাকলো। আরাভ এবার রাত্রীর কাছে ফিরে আসলো। ভাবলো ওকে দিয়ে দরজা খোঁলাতে হবে। হাতেনাতে চোর ধরবে কথাটা ভেবে ও রাত্রীকে ফিসফিস করে ডাকলো কিন্তু ও কোনো সাড়াশব্দ করলো না। কয়েকবার ডাকার পর হঠাৎ ওর মনে হলো মেয়েটার জ্বরটর আসেনিতো? কথাটা ভেবে ও রাত্রীর কপালে হাত রাখতেই তুলে নিলো। গায়ে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। না ওকে ডাকলে চলবে না। নিজেকেই কিছু করতে হবে। আরাভ আবারও দরজার কাছে ফিরে এসে এবার আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত দরজা খুলতেই দেখলো সৌরভ কালো হুডি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভ কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে রাত্রীর জায়গাই আরাভকে দেখে। ও ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল,
> ভাই তুই এখানে?
> আমার বউয়ের ঘরে আমি থাকবো না তো কে থাকবে?তাছাড়া তুই এতোরাতে রাত্রীকে ডাকছিস কেনো? রাতে কবে থেকে কফি খাওয়া শুরু করেছিস? আমার যতদুর মনে পড়ে তুই তো রাতে এসব না অন্যকিছু খাস।
> হঠাৎ ইচ্ছে হলো। আচ্ছা আমি যায়।
> কফি খাবি না?
> না আমি যাচ্ছি।
সৌরভ আর অপেক্ষা করলো না। তাড়াতাড়ি নিজের রুমের দিকে পা পাড়ালো। আরাভ দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটার মতিগতি ঠিক ভালো ঠেকলো না। এই গরমের মধ্যে কেউ হুডি পড়ে নাকি তবুও ছেলেটা পড়ে আছে।তাছাড়া কফি খাওয়ার এতো তীব্র নেশা যে নিজের রুমে কফি রেখে কাজের মেয়ের ঘরে কফি নিতে ছুটে এসেছে। আরাভ ভাবতে ভাবতে দরজা বন্ধ করে রাত্রীর পাশে এসে বসলো। রাতে চোখে আলো লাগলে চোখ জ্বালাপোড়া করে তাই ও রুমের লাইট আর অন করলো না। ড্রিম লাইটের আলোতে রাত্রীর মুখটা তেমন চোখে দেখা যাচ্ছে না। মানুষ এতোটা কালো কিভাবে হয় আরাভের জানান নেই। কেমন কুচকুচে গায়ের রঙ। উপর থেকে মনে হয় এই রঙটা নেচারাল না আলগা। কিছু দিয়ে পরিস্কার করে দিলেই মুছে যাবে। মাঝেমাঝেই ইচ্ছা করে এমনটা করতে কিন্তু বিষয়টা কেমন দৃষ্টিকটু দেখাবে। আরাভ মগ থেকে পানি নিয়ে রাত্রীর শাড়ির আচলটা ভিজিয়ে ওর কপালে দিয়ে দিলো। অন্ধকারে কাপড় খুঁজে পাওয়া কঠিন এই জন্য। তাছাড়া পানি পটি দিলে জ্বর কিছুটা হলেও কমবে। রাত ঠিক কয়টা বাজে জানার উপাই নেই।আরভ ফোনটা নিজের রুমে রেখে এসেছিল। এভাবে অনেক সময় পার হলো। রাত্রীর জ্বর কিছুটা কমে গেছে। আরাভ বসে থাকতে থাকতে রাত্রীর পাশেই ঘুমিয়ে পড়লো। ভোররাতে রাত্রীর ঘুম ভাঙতেই ও হামি ছেড়ে উঠে বসলো। মাথাটা ভারি হয়ে আছে। কপালটা ব্যাথায় টনটন করছে।ও পিছিয়ে আসতে গিয়ে বুঝলো পাশে কেউ আছে। ও তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে দেখলো আরাভ ওর পাশে ঘুমিয়ে আছে।রাত্রী তাড়াতাড়ি করে উঠতেই ভেজা আচলটা ওর হাতে লাগলো। রাত্রীর বুক কাঁপছে। মনে হলো আরাভ কি সব জেনে গেল?ও আর সময় নষ্ট করলো না তাড়াতাড়ি করে বাথরুমের দিকে ছুটল। আয়নায় খেয়াল করল কপালের অর্ধেক টা সাদা হয়ে আছে। ও আর অপেক্ষা করলোনা তাড়াতাড়ি কালো রঙটা ঠিক করে রুমে ফিরে আসলো। আরভ এখনো ঘুমিয়ে আছে। রাত্রী বুঝতে পেরেছে গতকাল রাতে আরাভ ওর কপালে পানিপটি দিয়েছিল। কিন্তু কিছু বুঝতে পেরেছে কি এটা জানতে হলে ওকে জিঙ্গাসা করতে হবে। কাথাটা ভেবে ও ফিসফিস করে আরাভের পাশে গিয়ে ডাকলো। কয়েকবার ডাকার পরেই ও উঠে পড়লো। রাত্রী ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। আরাভ উঠে হামি ছেড়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> তুমি ঠিক আছো? রাতে অনেক জ্বর ছিল। আসোতো দেখি কেমন এখন?
আরাভ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাট বললো কিন্তু রাত্রী চুপসে গেলো। ও দ্রুত সরে এসে বলল,
> একদম না। আমি ঠিক আছি। আপনি জগিং করতে যাবেন না?
> হুম যাইতে হবে।
>বেরিয়ে পড়ুন আমি রান্নাঘরে ছুটছি। শুনেন গরীবের ঘরে মানুষ হয়েছি সামান্য জ্বরে আমাদের কিছুই হয়না।
রাত্রী কথাটা শেষ করে ওখানে আর অপেক্ষা করলোনা। দ্রুত প্রস্থান করলো। এখানে থাকা মানে বিপদে পড়া। রাতে আল্লাহ্ সহায় ছিল তাই বেঁচে গেছে। কথাটাগুলো ভেবে ও রান্নাঘরে চলে আসলো। মাথাটা টলছে। ঝিমঝিম করছে। এককাপ চা খেলে ভালো হতো ভেবে ও চায়ের পানি বসিয়ে দিল। চারদিকে বেশ আলো ফুটেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির লোকজন উঠে পড়ছে। রবি গতকাল মির্জা সাহেবের কিছু কাগজপত্র এসেছে ওগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রী চায়ের কাপে মুখ ঢুবিয়ে রবিকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
> ভাইজান ওগুলো কি?
> তোমার জাইনা ক্যাম কি? কামের বেডি কামে মন দাও।
রবির এমন কথায় রাত্রী সামান্য হাসলো। ছেলেটা মীরার একানিষ্ঠ ভক্ত। হয়তো মীরার জন্যই ওকে পছন্দ করছে না। সে যাইহোক রাত্রীর এতে কিছু জায় আসে না। ও নিজের কাজে মন দিলো। রবি ওগুলো নিয়ে উপরে উঠে গেলো। আরাভ আজ জগিং করতে যায়নি। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। রাত্রী চলে আসার পরে ও আবারও ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ও প্রায় বেলা করে উঠেছে। রাত্রীর রুম থেকে ওকে বের হতে দেখে সোনিয়া মির্জার চোখ কপালে। উনি বিড়বিড় করলেন। “ছেলেটার মাথা পুরাই খেয়ে নিয়েছে। এইসব মেয়েদের উপরে ভরসা নেই। কি কপাল করেই যে এমন কাজের মেয়ে পেয়েছিলাম আল্লাহ্ ভালো জানে”আরাভ ওসবে পাত্তা না দিয়ে উপরে চলে যেতে চাইলো ঠিক তখনই মির্জ সাহেব ডাকলেন,
> মান সম্মান রাখলেনা ওসব নিয়ে কিছু বলবো না কিন্তু অন্য বিষয়ে একটু সাহায্য পাবার আশা তো করতে পারি তাইনা?
> জ্বী বলুন কি করতে হবে?
> কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে একবার দেখে এসো। বিষয়টা তুমি ভালো বুঝবে।।
> জ্বী আচ্ছা।
আরাভ কথা শেষ করে উপরে চলে গেলো। রাত্রী টেবিলে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। আরাভ দ্রুত রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে বিষয়টা নিয়ে মির্জা সাহেব বেশ চিন্তিত। আরাভ কোটে পৌঁছে উকিলের সঙ্গে কথা বলে অবাক। মির্জা সাহেবের নামে সম্পত্তির দখলের অভিযোগ করে উনার কোন আত্মীয় অভিযোগ করেছে। আরাভ ভ্রু কচকে ফেলল। ওর জানা মতে মির্জা সাহেব কঠোর পরিশ্রম করে এই বিশাল সম্পত্তি অর্জন করেছেন কিন্তু এর মধ্যে আবার উনার কোন আত্মীয়র উদয় হলো কে জানে। আরাভ উকিলের সঙ্গে কথা বলে লোকটার পরিচয় জানতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। এক মাসের সময় আছে এর মধ্যেই যদি উনি সবকিছু ছেড়ে না দেন তবে সম্পত্তির আসল দাবিদার সামনে আসবে এবং সব দখল নিবে। আরাভ অনেক ঘাটাঘাটি করেও কিছুই জানতে পারলোনা। তাই আবারও বাড়িতে ফিরে আসলো। রাত্রী রান্নাঘরে গুনগুন করে গান গাইছে আর চা তৈরী করছে। সোনিয়া মির্জা মুখে হাত রেখে স্বামীর সঙ্গে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে আরাভ ফিরে এসে সবটা বলেছে। মির্জা সাহেব আরাভের বাবাকে ফোন করে আসতে বলেছেন। এই কঠিন সময়ে উনিই একমাত্র ভরসা। মীরা নিজের রুমে রূপচর্চাবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখছে। সৌরভ বাবার উপরে বিরক্তি। লোকটার কোনো আঙ্কেল জ্ঞান নেই বলে ওর আফসোস হচ্ছে। কোথাকার কাকে কি দিয়ে বসে আছে তার ঠিক নেই। এই সম্পত্তির ভাগ ও কাউকে দিতে রাজি না। ও এদিক থেকে সেদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যরিকে আরভ চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে আছে। রাত্রী চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরে আসতে আসতে বলল,
> সবাই কেমন চুপচাপ বিষয়টা কি বলবেন?
আরাভ চোখ বন্ধ করেই উত্তর করলো,
> ছোটদের সব বিষয় জানতে হয়না। চা রেখে বাইরে যাও।
> আমি ছোট নেই। আমার আঠারো পার হয়েছে। এবং আমি বিবাহিত
রাত্রী কথাটা বলে তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা রেখে দ্রুত রুম থেকে পালিয়ে আসলো। আরাভ ততক্ষণে চোখ খুলেছে। ওর বলা কথাটা আরাভের চোখ খুলতে বাধ্য করেছে। মেয়েটা নিজেকে বিবাহিত দাবি করছে মানে ও আরাভকে এখন স্বামি হিসেবে মানতে শুরু করেছে কিন্তু আরাভ তো এটা চাইনা। ভালো খারাপ বা ধনী গরীবের জন্য না। আরাভ তো ওকে মন থেকে মানেনা। ওকে নিজের স্ত্রীর ভাবতেও পারবে না। ভালোবাসা ঠিক ওরকম না। যে অনুষ্ঠান করে আসবে। ভালোবাসা মনের অজান্তেই হয়ে যায়। আরাভ বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখলো রাত্রীকে বুঝিয়ে বলতে হবে নয়তো হিতের বিপরীতে চলে যাবে। বাড়ির ঝামেলা মিটলে ওকে কোনো বাড়িতে কাজ খুজে নিজের দায়িত্ব পালন করে মুক্তি নিবে।। কথাগুলো ভেবে ও চায়ের কাপে মুখ বসালো ঠিক তখনই নিচে থেকে হৈচৈ শোনা গেলো। আরাভ চা শেষ করতে পারলোনা।। বাধ্য হয়ে বাইরে এসে দেখলো বাড়িতে পুলিশ এসেছে। আরাভ ভ্রু কুচকে একপা দুপা করে নিচে আসতেই শুনলো এই বাড়িতে আগে যে মহিলা কাজ করতো গতকাল রাতে শহরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীতে তার ডেডবডি পাওয়া গেছে। উনাকে খুন করা হয়েছে।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।