দুঃখগাথার রাজকন‍্যা
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:৮

আরাভের মুখটা দেখার মতো হলো। ভেবেছিল কয়েকদিন সময় পাওয়া যাবে কিন্তু আজকেই যে ওকে বলি দেওয়া হবে ভাবতে পারেনি। রাত্রীর এমন হাসি দেখে ওর রাগ হচ্ছে। কথায় বলে,কারো পৌষ মাস,কারো সর্বনাশ। ওর বেলায়ও তাই হচ্ছে। মীরা মেয়েটাকে এতদিন ভালো না ভাবলেও এতোটা খারাপও কখনো ভাবেনি।। আরাভ মনে মনে কথাগুলো ভাবছিল হঠাৎ রাত্রীর কথায় ওর ধ‍্যান ভাঙলো।
> গায়ে হলুদ দিবেন না? আপার গায়ে হলুদ শেষ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনার আম্মা ভাইবোনেরা সবাই এসেছে। ভীষণ মজা হচ্ছে বাড়িতে।
> দাঁত বের করছো কেনো? মেজাজ খারাপ হচ্ছে এককাপ চা নিয়ে রুমে এসো।
আরাভ আর অপেক্ষা করলো না ওকে হুকুম করে গটগট করে চলে আসলো। ডাইনিং রুমে অনেকেই বসে আছে। হাসাহাসি করছে। বিয়ের তোড়জোড় বেশ ভালো ভাবেই চলছে। বাইরে গেট সাজানো হয়েছে। মেহমান আসছে। আরাভ রুমে এসে ধপাস করে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কি করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথা ধরে আছে। বাড়ি থেকে পালালে খালামনির সামনে কখনও আর দাঁড়াতে পারবে না অপরাধী হয়ে যাবে। এমন কিছু করতে হবে সেখানে সাপ ও মরবে না আবার লাঠিও ভাঙবে না। ওর এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরের দরজায় নক পড়লো। আরাভ বিরক্তি নিয়ে উঠে এসে দরজা খুলতেই রাত্রি চা নিয়ে ভেতরে চলে আসলো। আরাভ তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ভেতরে এসে ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে করুন কন্ঠে বলল,
> রাত্রী একটু সাহায্য করবে? আমি কথা দিচ্ছি তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।
> জ্বী বলুন?
> আমার বউ হবে?
আরাভের এমন প্রস্তাবে রাত্রীর চোখ গোলগোল হয়ে গেলো। ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেলো? এতো বড়লোক বাড়ির মেয়েকে রেখে কাজে মেয়েকে বউ করতে চাইছে। কিন্তু ও তো কারো বউ হতে এই শহরে আসেনি। ও এসেছে নিজের অধিকার আদায় করে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। না ওকে এসবে জড়ালে চলবে না। কথাগুলো ভেবে ও মুখটা কঠিন করে বলল,
> আপনার মাথায় সমস্যা হয়েছে। কোথায় আপনি আর কোথায় আমি। কাজের মেয়ে কখনও কি মনিবের বউ হতে পারে?
> সত্যি সত্যি বউ না কিছুদিন বউয়ের অভিনয় করবে। তবে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি কারো কাছে ছোট করবো না। তুমি যেমন তেমনই থাকবে শুধু এই মীরা মেয়েটার থেকে আমাকে বাঁচাও। ওই মেয়েকে বিশ্বাস নেই কিভাবে আমাকে ফাঁসাবে ওর মাথায় শুধু সেই চিন্তা।
> ফাঁসাবে কেনো? উনিও বিপদে আছেন। সকালবেলায় দেখলেন না খালাম্মা কিভাবে উনাকে মারলেন? বাচ্চা হলে সমাজে কিভাবে চলবেন?

> শুনো ওসব ওর নাটক। আমি আজকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওর গর্ভে কোনো বাচ্চাটাচ্চা কিছুই নেই। আমাকে বিয়ে করার জন্য ছেলেটার চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিয়েছে। এখন বলো এরকম স্বার্থপর মেয়েকে আমি কিভাবে গ্রহণ করি? এই মূহুর্তে তুমি ছাড়া কেউ নেই আমাকে সাহায্য করার মতো প্লিজ।

> আমার ভয় করছে । তাছাড়া বাড়িতে কিভাবে কি বলবেন? আমি এই বাড়িতে এসেছি কয়েকদিন হয়েছে। এর মধ্যেই আপনার সঙ্গে…

রাত্রী এইটুকু বলেই থামলো। ওকে থামতে দেখে আরাভ কিছুটা ভেবে ওকে বলল ও রাজি থাকলে আরাভ সবটা সামলে নিবে। রাত্রী অনেক ভেবে চিন্তে শেষমেশ রাজি হলো না। এগুলো করা ঠিক হবে না। অন‍্যকিছূ ভাবতে বলে ও চায়ের কাপ নিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে আসলো। খাবারের আয়োজন চলছে। কিছুক্ষণ পরে আরাভকে নিয়ে যাওয়া হলো গোসলের জন্য। ওর মুখে কোনো হাসি নেই। রাত্রী খুব মনদিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করছে। সবার মুখে মুখে থাকছে। সোনিয়া মির্জা একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো কমতি রাখতে চাইছেন না। উনি আশেপাশের প্রতিবেশীদের ডেকে এনেছেন। বিয়ের কাজকর্ম করতে করতে রাত হয়ে গেলো। রাত এগারোটার সময় বিয়ের সময় ধার্য করা হয়েছে। মীরাকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে। মোটামুটি সবাই রেডি। তমাল এসেছে,আরাভের ফোন পেয়ে ছেলেটা আর অপেক্ষা করেনি। বন্ধুর বিপদে বন্ধু থাকবে না এমন হতেই পারেনা। ওরা দুজনে দরজা বন্ধ করে অনেক প্লান পরিকল্পনা করলো কিন্তু তবুও কোনো উপায় মিললো না। শেষমেশ হারমেনে নিলো। আরাভ সিদ্ধান্ত নিলো বিয়ের পরদিন ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে যেদিকে মন চাই সেদিকে। মির্জা সাহেবে মনের আনন্দে সারা বাড়িতে ঘুরছেন। রাত দশটার দিকে আরাভের ডাক পড়লো। ও চুপচাপ নিচে নামছে পাশে তমাল ও আছে। এই মূহুর্তে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিবা করার নেই আছে ওর। ও যখন সিঁড়ির মাঝামাঝি ঠিক তখনই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে বিয়ের পোশাক পড়ে রিমঝিম আওয়াজ করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালো। উপস্থিত সবাই অবাক কারণ মীরা সোফায় বসে আছে। সবার মনে প্রশ্ন মীরা যদি এখানে থাকে তাহলে এই মেয়েটা কে? আরাভ দ্রুতগতিতে নেমে এসে মেয়েটার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে জিঙ্গাসা করলো,
> রাত্রী?
> হুম।
আরাভের ইচ্ছা হলো আনন্দে রাত্রীকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু আশেপাশে অনেকেই আছে। এই মূহুর্ত্তে নিজের আবেগ অনুভূতিকে কিছুটা দমিয়ে রাখতে হবে। প্রকাশ করলে কেচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে পড়বে। সবাই জেনে যাবে ওরা মিথ্যা বলছে। আরাভের ভাবতে ভাবতেই সোনিয়া মির্জা ওর পাশে এসে রাত্রীর ঘোমটা টেনে সরিয়ে দিয়ে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলেন,
> তুই এভাবে সেজেছিস কেনো?
> খালাম্মা সাহেব আমাকে পছন্দ করেন আমরা একে অন‍্যকে ভালোবাসি। তাছাড়া আমাদের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। দুদিন পর হয়তো আমি আপামনির মতো বাচ্চার মা…
রাত্রি আর কথা বলতে পারলো না। ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়লো ওর গালে। রাত্রি ছিটকে গিয়ে আরাভবের গায়ের উপরে গিয়ে পড়লো। ওর ঠোঁট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আরাভ ওকে পাশে রেখে সোনিয়া মির্জার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
> ওকে মারলে তো হবে না। আমাদের দুজনকেই মারো কারণ অন‍্যায় ও একা করেনি। দুজন মিলেই করেছি। তাছাড়া এসব রাত্রিকে আমি করতে বাধ্য করেছি। আমি ওকে পছন্দ করি।
> ছি তোর নজর এতো খারাপ শেষমেশ আমাদের বাড়ানো কাজের মেয়ের উপরে নজর দিয়েছিস? সৎ কখনও আপন হয়না। তোর মা যদি আমার আপন বোন হতো তাহলে তুই আমার মর্ম বুঝতে পারতি। এই মূহুর্তে তুই ওকে নিয়ে আমার বাড়ি ছেড়ে দূর হয়ে যা।

সোনিয়া মির্জা সব ক্ষোভ ঝেড়ে দিলেন কথার মধ্যে দিয়ে। উনার ইচ্ছা করছে দুটোকেই খুন করতে। উনার কথা শুনে আরাভের খারাপ লাগলো তবুও ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মীরা এসে রাত্রিকে থাপ্পড় দিতে গেলো কিন্তু পারলো না আরাভ আটকে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ওকে পিছিয়ে দিলো। মোটামুটি হৈচৈ পড়ে গেছে বাড়িতে। বাইরের অনেকেই আছে। সবাই কানাঘুষা করছে। মির্জা বাড়ির কেলেঙ্কারির কথা বলছে। অনেক ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে শেষমেষ রাত্রীর সঙ্গে আরাভের বিয়েটা হয়ে গেলো। মীরা ওর মাকে বুঝিয়ে বলেছে বেশিদিন রাত্রি মেয়েটাকে সহ‍্য করতে হবে না। যেভাবেই হোক আরাভের থেকে ওকে দূর করে দিবে। আর মির্জা সাহেব কখনও আরাভের বাবার থেকে দূরে যেতে পারেন না। কখনও রাগ করতে পারেন না। এই বিশাল সম্পত্তির মালিকানা উনি নিজের বুদ্ধিতে করতে পারেননি। আরাভবের বাবার বুদ্ধিতে হয়েছিল এবং এখনো পযর্ন্ত হচ্ছে। তাই উনি মাথা ঠান্ডা করেছেন। তারপর আবার মীরার মিথ্যাটা প্রকাশ ঘটেছে। যেহেতু মেয়ে এমন কিছু করেনি তাই ভেবে সবাই কিছুটা হলেও শান্ত আছে। মাঝখানে আরাভ আর রাত্রি ফেঁসে গেলো। বিয়ের ঝামেলা মিটতে মিটতে রাত তিনটা। বিয়ের পর তমাল রাত্রীকে আরাভের ঘরে নিয়ে গেলো। কেউ ওর সঙ্গে কথা বলছেনা। তমাল ওকে রুমে এনে বসিয়ে বলল,
> অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি বললাম কিছু মনে করোনা।
> ভাইজান কাজের মেয়েদের কিছু মনে করতে নেই আপনি আমাকে তুই করেও বলতে পারেন। তবে এই ঘরে কিন্তু আমি থাকতে পারবো না।
> বোন ভয়ের কিছু নাই। আমার বন্ধু খারাপ না। তবে সাবধান এই বাড়িতে থাকা তোমার জন্য কষ্টের হয়ে উঠবে।
> গরীবদের আবার কষ্ট কিসের? আমি ওসবে ভয় পাই না। চিন্তা করবেন না আপনারা আছেন না ঠিক মানিয়ে নিবো।
ওদের কথার মধ্যেই আরাভ এসে ঢুকলো। ও দরজা বন্ধ করে সোফায় গিয়ে হেলান দিয়ে বলল,
> তমাল অনেক রাত হয়েছে আজ এখানেই থাক আগামীকাল এক সঙ্গে বের হবো।
> এখানেই থাকবো মানে?
> মানে আবার কি, ঘরটা কি ছোট নাকি?। আমি আর তুই বিছানায় আর রাত্রী সোফায় শুয়ে পড়বে। রাত্রী তোমার অসুবিধা হবে?
> একদম না। বরং ভালো হবে। আপনারা বসেন আমি চা করে আনছি।
রাত্রি উঠতে গেলো কিন্তু আরাভ ওকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলো।
> তুমি বাইরে যাবে চা করতে তাও এই অবস্থায়? যেতে হবে না। আচ্ছা তুমিতো তখন আমার কথায় মানা করেছিলে তাহলে আবার রাজি হলে? তাছাড়া বিয়ের পোশাক গহনা এসব কোথায় পেলে?
> দেখলাম আপনি খুবই বিপদ আছেন তাই জন্য রাজি হলাম আর এই বিয়ের পোশাক গুলো আমার কাছে ছিল। সে অনেক কথা পরে একদিন বলবো।
রাত্রি কথা ঘুরিয়ে নিলো। এভাবেই ওদের রাতটা পার হলো। সকালবেলায় রাত্রি নিজের রুমে এসে বিয়ের পোশাক পরিবর্তন করে নাস্তা তৈরী করে টেবিলে সাজিয়ে দিলো। বাড়িতে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। অনেক রাতে ঘুমানোর জন্য কেউ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। রাত্রি আরাভের চা নিয়ে উপরে যেতে চাইলো ঠিক তখনই ও নিছে নেমে আসলো। ও চুপচাপ টেবিলে বসতে বসতে বলল,

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here