#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১২ ||

কারীব আর সা’দ জঙ্গলটায় ঘুরাফেরা করছে। সা’দ ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে বিভিন্ন পোজে বিভিন্ন জায়গার ছবি তুলছে। সা’দের ফটোগ্রাফি ভিষণ পছন্দ। যখন ভার্সিটি অধ্যায়নরত ছিলো তখন এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে তার ছবিটি ম্যাগাজিনে গিয়েছিলো। সেই থেকে মূলত এই মুভী-ড্রামাতে তার আগ্রহ শুরু হয়। আজও সা’দ যেন সেই বয়সে চলে গেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে সে ছবি তুলছে অনবরত। কারীবের হঠাৎ দূরে খেয়াল যেতেই দেখলো সেহের জঙ্গলে ঢুকছে। এ দেখে কারীবের খুশির রেশ রইলো না। সে তখনই সা’দকে বলে উঠলো,

—“স্যার! আমার ওই দিকটা থেকে ঘুরে আসি আপনি আপনার ফটো ক্লিক কন্টিনিউ করুন।”

বলেই সা’দকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কারীব সেই স্থান থেকে কেটে পরলো। সা’দ ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। আবারও সে ছবি তোলায় মনোযোগী হলো। হঠাৎ তার ক্যামেরায় চলে আসলো সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুখটি! সা’দ আবার স্থির হয়ে গেলো, আবারও সেই অদ্ভুত অনুভূতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। বুকের ভেতরের ধুকধুক শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এভাবে এই জায়গায় তার মায়াবীনিকে দেখতে সা’দ তা ভাবতেই পারেনি। কতোদিন পর তার মায়াবীনিলে সশরীরে দেখলো আহ! ভাবলে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মায়াবীনি প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে না, মনে হচ্ছে সে কোনো কিছু নিয়ে বড্ড চিন্তিত। সেই চিন্তার রেশ তার চেহারা দৃশ্যমান! সেহের সা’দের প্রায় কিছুটা দূরে, তাইতো সা’দ সেহেরকে ক্যামেরা জুম করে দেখছে। আর এটাও ফলো করছে সেহের ঠিক কোথায় যাচ্ছে। হঠাৎ সা’দ খেয়াল করলো তার মায়াবীনির কেউ পিছু নিচ্ছে। এটা দেখে সা’দ ক্যামেরা নামিয়ে দেখলো। হ্যাঁ আসলেই কেউ ফলো করছে৷ ব্যাপারটা কেন যেন সা’দের ঠিক লাগলো না। সা’দ তৎক্ষনাৎ ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে সে নিজেও পিছু নিলো।

সেহেরের তখন থেকে মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিচ্ছে কিন্থ যতবার সে পেছনে ফিরছে ততবারই কাউকে দেখতে পায় না। পরে মনের ভুল ভাবলেও এখন নিস্তেজ জঙ্গলে শুকনো পাতায় পা পরার মতো খসখস শব্দ সে ঠিকই পাচ্ছে। তার ঠিকই অনুভব হচ্ছে সে ছাড়াও কেউ তার পিছে আছে। সেহের পিছে না ফুরে আল্লাহ’কে ডাকতে ডাকতে জঙ্গল থেকে জলদি বের হওয়ার দোয়া করছে। মাগরিবের আযান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। আস্তে আস্তে আঁধার নেমে আসছে। হঠাৎ একজায়গায় এসে থেমে গেলো সেহের। ভয়ে তার গলা বারবার শুকিয়ে আসছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। সেহের যেন নড়তে ভুলে গেছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে। সেই মানুষটা আর কেউ নয় রাফসান! সেই পুরানো বিশ্রী হাসি দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেহের ভয়ে এক ঢোক গিলে পিছে ফিরে দৌড় লাগাতেই কারো বুকে গিয়ে ধাক্কা খেলো। সেহের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার সামনে থেকে সরে ছেলেটার দিকে তাকালো। অচেনা একটা ছেলে যাকে সেহের কখনো দেখেনি। তবে এই ছেলেটার দৃষ্টিতেও নোংরামি স্পষ্ট! সেহের ভয়ে ভয়ে একবার পিছে তো আরেকবার সামনে তাকাচ্ছে। রাফসান পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,

—“কী সুন্দরী ভয় লাগছে? চিন্তা করো না সোনা আজকের রাতটায় এমনিতেই একটু আকটু কষ্ট লাগবে, পরে আর লাগবে না। খুব আনন্দ পাবে তুমি জানেমান!”

রাফসানের এসব বিশ্রী কথাবার্তায় সেহেরের গা গুলিয়ে আসছে। সেহের নাক সিটকিয়ে কাঁপা গলায় বলে,

—“তোদের আমি কোনোদিন ধরা দিবো না!”

বলেই উত্তর দিকে দিলো দৌড়! কিন্তু সে বেশিদূর যেতে পারলো না তার আগেই রাফসান তার কাঁধের জামার অংশে ধরে আটকায়। কাঁধের অংশ এতো জোরেই টান দেয় যে কাঁধ থেকে ডানপাশের অর্ধেক হাতা ছিঁড়ে রাফসানের হাতে চলে আসে। আর সেহের ছিটকে দূরে পরে যার ফলে এক ধারালো গাছের ডালের সাথে তার ডানহাতের শিনা কেটে যায়! সেহের ব্যথায় কিছুটা শব্দ করে উঠলো। রাফসান জামার ছেঁড়া অংশ ফেলে সেহেরের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেহেরের ওড়নাসহ চুল টেনে উঠে দাঁড় করালো! চুলের ব্যথায় সেহের গোঙ্গানি করে নিজের চুল থেকে রাফসানের হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু ডানহাতে গভীর চট পাওয়ায় সেহের প্রায় নেতিয়ে আছে তার উপর চুল টেনে ধরার অসহ্য যন্ত্রণা! রাফসান আরও জোরে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—“যতো যা-ই করিস আজ তুই আমার হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না! চল আমার সাথে!”

বলেই রাফসান টেনে হিঁচড়ে সেহেরকে নিয়ে যেতে লাগলো। আর সেহের বারবার রাফসানকে অনুরোধ করছে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সেহেরের আকুতি ভরা কথাগুলো রাফসানের কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। সে এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে। রাফসানের সাথের ছেলেটাকে ইশারা করতেই ছেলেটা চলে গেলো আর রাফসান সেহেরকে নিয়ে একটা মাটির বানানো পুরানো কুড়েঘরে ঢুকলো। সেখানে কিছু নেই বললেই চলে৷ রাফসান সেহেরকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সেই কুঁড়েঘরে ফেললো। এতে একটা শুকনো কাঠ সেহেরের হাঁটুতে লাগলো যার ফলে সেই কাঠ ভেঙ্গে দুই খন্ড হয়ে গেলো। সেই কাঠের চাপেও সেহেরের হাঁটুর অনেকখানি ছিলে যায় এবং গড়িয়ে গড়িয়ে রক্তও পরা শুরু হলো। সেহের চিল্লিয়ে “আল্লাহ গোহ” বলে উঠলো। রাফসান পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,

—“কী সুন্দরী কষ্ট হচ্ছে? চিন্তা করিও না সোনা, আমি আদর দিয়ে দিয়ে তোমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবো।”

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। সেহের রাফসানের কন্ঠে নিজের আহত দেহ নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো আর পিছে দিকে যেতে যেতে বললো,

—“আমার ধারেকাছে আসবি না। আসলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো, তাও তোর মতো অমানুষের কাছে নিজের সতিত্ব বিসর্জন দিবো না!”

রাফসান উচ্চসরে হেসে বললো,

—“বাহ বেশ বুলি ফুটেছে আজ তোর! এই অবস্থা এতো তেজ আসে কোথা থেকে তোর? তবে আমিও দেখে ছাড়বো তুই তোর সতিত্ব কতক্ষণ আগলিয়ে রাখিস!”

সারাশরীরের অসম্ভব যন্ত্রণা এবং রক্তক্ষরণের ফলে বারংবার সেহেরের চোখ বুজে আসছে আর সব আবছা লাগছে। কিন্তু সেহের হার মানবে না, এর চেয়েও কষ্ট সহ্য করেছে সে। এই কষ্ট তার কাছে খুবই স্বল্প। তবুও সেহের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দুর্বল হয়ে কিছুদূর পিছু যেতেই সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে পরলো। রাফসান হাসতে হাসতে নিজের গাঁয়ে থাকা শার্টটা খুলে সেহেরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। সেহেরের এখন আর কোনো উপায় নেই একমাত্র আল্লাহকে ডাকা ছাড়া। সেহের বারংবার আল্লাহকে ডাকছে আর অনেককিছু নিয়্যত করে চলেছে। রাফসান আর দুই ধাপ এগোতেই কেউ তার পিঠে জোরে লাথি দিলো। এতে রাফসান অন্যদিকে ছিটকে পরলো। বিকট শব্দে সেহেরের নিভু নিভু চোখ অটোমেটিক বড় হয়ে গেলো। সে এখন রাফসানকে স্পষ্ট পরে কাতরাতে দেখছে। এবার সেহের সামনের মানুষটাকে আবছা আলোয় দেখে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো। এ যে সেই বিদেশি যে ওই এক চেয়ারেই বসে থাকতো। তাকে এই মুহূর্তে এরকম একটা জায়গায় কল্পনায়ও আশা করেনি। সা’দ রক্তচক্ষু নিয়ে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক কষ্টে সে এই কুঁড়েঘরে পৌঁছিয়েছে। তখন পিছু নিতে নিতে সে একটা শিকলের সাথে পেঁচিয়ে পরে গিয়েছিলো। যা ছুটাতে ছুটাতে তার অবস্থা খারাপ। নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় সে কারীবকেও সাহায্যের জন্য ডাকতে পারেনি। তবে মেসেজ করেছে।

সা’দ রাফসানের কাছে গিয়ে রাফসানকে সর্বশক্তি দিয়ে ইচ্ছা মতো পিটালো। সা’দ কপট রেগে চেঁচাতে চেঁচাতে বললো,

—“তোদের মতো জানোয়ারের জন্য আমাদের পুরুষজাতিকে আজ অবধি বেশিরভাগ মেয়ে বিশ্বাস করতে পারে না! তোর সাহস কী করে হলো এভাবে মেয়েটার উপর অত্যাচার চালিয়ে তার সর্বনামশ করার চেষ্টা করা? মেয়েরা ভোগবিলাসের বস্তু নয়! অন্য মেয়ের দিকে এমন বিশ্রী নজর দেয়ার আগে পারলে নিজের মা-বোনের দিকে নজর দিয়ে দেখ কেমন লাগে! শালা কুলাঙ্কারের বাচ্চা! তোকে তো মন চাচ্ছে কুপিয়ে মেরে ফেলি! এতো লালসা থাকলে নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়ে নিজের ভোগ-লালসা পূরণ কর না, ওদের মতো নিষ্পাপ মেয়েদের কেন নজর দিয়ে তাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছি! সবার সামনে ভালো মানুষ আর ভেতরে ভেতরে কুত্তার মতো লেজ নাড়লেই তুই ভালো হিয়ে যাবি না!”

সা’দের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেহের। কী এক মুগ্ধতা যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না, তার আগেই সেহের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এদিকে সা’দের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাফসান নিজের শার্ট নিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। সা’দ নিজের হাত ঝাড়তে ঝাড়তে রাগ দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ তখনই তার সেহেরের দিকে নজর গেলো। কী করুণ অবস্থা সেহেরের। সা’দ নিজের গাঁয়ের কোর্ট খুলে সেহেরের গাঁয়ে জড়িয়ে দিলো। অজানা আতঙ্কে তার বুক কাঁপছে, আরেকটু দেরী করে ফেললে কী সর্বনাশটাই না করে ফেলতো ওই জানোয়ারটা। ভাবতেই সা’দের গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠছে। সা’দ এখন ভাবতে লাগলো কী করবে! শেষে উপায় না পেয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে নেটওয়ার্ক আনার জন্য হাত উঁচু করে আশেপাশে ঘুরছে সে। কারীবকে এখন তার ভিষণ প্রয়োজন।

এদিকে এক মহিলা সেই কুঁড়েঘরের সামনে দিয়ে যেতে নিতেই দুজনকে এক ঘরে দেখে ফেলে, সাথে সেহেরের করুণ অবস্থাও সে ভালোভাবে দেখলো। মহিলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। তার চেহারায় আতঙ্ক দৃশ্যমান! মহিলা আর এক মুহূর্ত দেরী না করে দৌড়ে গ্রামে ছুটে গেলো।

চলবে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here