#ত্রিমোহনী
(৪)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_____________________________
প্রশ্ন করতে করতেই বারান্দায় চলে এলো নয়ন। রুপশ্রীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বারান্দার বাইরের দিকে তাকালো। বিল্ডিংয়ের দেয়াল ছেড়ে একটুখানি খালি অংশ তারপরই আট কি ন’ফুট উচ্চতার দেয়াল। দেয়ালের পরই এক বাড়ি। এই বারান্দা থেকে সেই বাড়ির প্রথম যে ঘরটি এবং দরজা চোখে পড়ে তা ওই বাড়ির পেছন দিক। দেখলেই বোঝা যায় এ ঘরের প্রধান দরজা অন্য এক ঘরের ভেতর। এটা হয়তো আলাদা সুবিধার জন্যই করা। নয়ন একবার সে ঘরের দরজা তো আরেকবার রুপশ্রীর মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখে কোন উত্তেজনা নেই। কাল রাতেই তার বাগদান হলো এবং এই মুহূর্তে তার বাগদত্তা তারই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এ নিয়ে সে মোটেও অন্যরকম কোন অনুভূতি টের পাচ্ছে না। বরং নয়ন যে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেজন্যই হয়তো মেয়েটা অস্বস্তিতে ভুগছে। ওর চোখ,মুখ এমনকি তার হাতের আঙ্গুলগুলোও অস্থিরতা প্রকাশ করছে। এই অস্থিরতা ভালোলাগায় নয় তা নয়নের বোঝা হয়ে গেছে।
‘বললে না তো কি দেখছিলে ওদিকে? স্পেশাল কাউকে!’
‘স্পেশাল!’ আওড়ালো রুপশ্রী। আসলেই কি সে বিশেষ কিছু দেখছিলো? কই সেখানে তো কেউ নেই উল্টো তার মনে হলো নয়ন এসেছে বলে তাকে আবার রাতের মত অজস্র কথায় ভাসতে হবে তাইতো একটুখানি সময় নষ্ট করছিলো এখানে দাঁড়িয়ে। হয়তো তার দেরি দেখে নয়ন চলে যেত। কিন্তু এমন তো কিছুই হলো না উল্টো লোকটা তার শোবারঘরেই এসে হাজির হয়েছে। নয়ন রুপশ্রীকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায় তা জানিয়েছিলো রুপশ্রীর মাকে। তিনি অনুমতি দিয়েছেন এমনকি শ্রেয়সীকে সাথে করে এ ঘরেই পাঠিয়েছিলেন।শ্রেয়সী সবেই স্কুল থেকে ফিরেছিলো। নয়নই ইচ্ছে করে দোতলায় উঠতেই শ্রেয়সীকে বোঝালো সে সারপ্রাইজ দিতে চায় তার বোনকে। অতএব, শ্রেয়সীকে নিজের ঘরে চলে যেতে হলো। তারও স্কুলের পোশাক পাল্টে খাবার খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো এই মুহূর্তে। নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছে বলেই হয়তো নয়নকে একা ছেড়ে চলে গেল সে।
‘তুমি নিশ্চয়ই এখনও সকালের নাশতা করোনি?’ নয়ন প্রশ্ন করতেই রুপশ্রী জবাব দিলো, ‘ নাহ।’
‘তবে চলো আমরা বাইরে খেতে যাই।তোমার মায়ের অনুমতি নেওয়া হয়ে গেছে আগেই।’
রুপশ্রী কোন জবাব না দিয়ে পা বাড়ালো যাওয়ার জন্য তখনি ধরাম করে আওয়াজ হলো৷ নয়ন আগেই তাকিয়েছিলো পাশের বাড়ির সেই দরজায় এবার শব্দে রুপশ্রীও ফিরে তাকালো। ইকবাল দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলো মাত্রই। উপর দিকে তাকাতেই চোখে পড়েছে বারান্দায় থাকা নয়নকে আর তাতেই সে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে চলে গেছে। নয়নকে সে আগেও কয়েকবার দেখেছে এই বাড়িতে আসতে কিন্তু কখনও এ ঘরে ঢোকে বলে মনে হয়নি।
‘চলুন’ রুপশ্রী বলেই নিজ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। নয়নও আর দাঁড়ালো না। ভর দুপুরে বাইরে যাওয়ার মত ইচ্ছে তনুশ্রী কিংবা শ্রেয়সী কারোরই নেই তবুও বাধ্য হয়ে দুজনকে বের হতে হয়েছে।মেয়ের বাগদান হয়েছে বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি তাই রুপশ্রীর মা মেয়েকে নয়নের সাথে একা ছাড়তে নারাজ। ইনিয়েবিনিয়ে অনেকভাবেই তনুশ্রী, শ্রেয়সীর কথা বলতেই নয়নও আর মুখে না করতে পারেনি। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেছে তার। সবে কলেজ থেকে ফিরেই আবার বাইরে যাবে ভাবতেই রাগ হচ্ছে তনুর। একেতো সে নয়নকে মোটেই পছন্দ করে না কেন করে না তা সে নিজেও জানে না। হয়তো চোখের দেখা তার ভুল ছিলো সেদিন আবার হতে পারে যা দেখেছিলো সেটাই সত্যি! তার নয়নকে অপছন্দ , রুপশ্রীকে পছন্দ করে তাদের ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার পদে থাকা সুন্দর রহমানকেও অপছন্দ এমনকি রুপশ্রীর জন্য গোপনে মরতে থাকা শ্রেয়সীদের স্কুলে গণিত স্যারকেও অপছন্দ । ভেবে পায় না তনুশ্রী সে রুপশ্রীকে ভালোবাসে এমন ছেলেদেরই কেন অপছন্দ করে! তবে কি সে চায় না তার বোনকে কেউ ভালোবাসুক অথবা বোন কখনো বিয়ে করুক? অযৌক্তিক তার অপছন্দ, একদমই মিনিংলেস তার সকল ভাবনা৷ রুপশ্রী আর তনুশ্রী তার সবচেয়ে আপন সবচেয়ে প্রিয়। তাদের কেউ ভালোবাসলে সে অখুশি কেন হবে! একজন ভুল করেছে বলে কি ভালোবাসে এমন প্রত্যেকটা মানুষই ভুল?
বাড়ি থেকে একটু দূরেই বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্টে আসলো নয়ন। তিন বোন রুপশ্রী, তনুশ্রী এবং শ্রেয়সী তিনজনই যারপরনাই বিরক্ত নয়নের ওপর। সারাটা পথ সে নিজের মত বকবক করেই গেছে মাঝে মাঝে হু হা করে রুপশ্রীকে জবাবও দিতে হয়েছে। শ্রেয়সী ঘুমের ভান করে তনুশ্রীর কাঁধে পড়েছিল কিন্তু তনুশ্রী বাঁকা বাঁকা কথা বলেছে দু একটা যা হয়তো নয়ন বোঝেনি অথবা বুঝেই ইচ্ছে করে অবুঝ হয়েছিলো। গাড়ি যখন রেস্টুরেন্টের সামনে থামলো শ্রেয়সী তখন রাস্তার পাশে ফুসকাশপের সামনে ইরফান দাঁড়িয়ে আছে৷ হাতে তার ক্রিকেট ব্যাট সাথে কয়েকজন বন্ধুও। ইরফান হলো রুপশ্রীর প্রেমে আছার খাওয়া কোমরবাঁকা ইকবালের বড় ভাই। ইরফান বয়সে বড় হলেও ম্যাচিউরিটিতে ইকবালকেই বড় মনে হয়। ইরফান শ্রেয়সীকে দেখেই যতোটা সম্ভব বন্ধুদের ভীরে লুকিয়ে পড়লো। আজ তার ক্রিকেট ম্যাচ আছে বাজিতে। পাঁচ হাজার টাকার বাজি আর তাই বন্ধুরা মিলে এখানে বসেই ছোট্ট একটা আলোচনা করছিলো। স্বভাববশতই শ্রেয়সী যে তাকে দেখেই চিৎকার করে ভাইয়া বলে ডেকে উঠবে তা তার অজানা নয়। এখানে অনেক গুলো ছেলে আর এটাই তার লুকানোর কারণ। শ্রেয়সীকে তাদের পরিবারের সবাই খুব স্নেহ করে, বলা যায় নিজের বাড়ির মেয়ের মতোই ভালোবাসে। পাশে থাকা ছেলেরা বন্ধু হলেও বোনের মত শ্রেয়কে এখানে দাঁড় করিয়ে কথা বলার মত ভরসা তার হয় না।
গাড়ি থেকে নেমে সকলেই যখন রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় শ্রেয়সী তখন দৌড়ে যায় ইরফানের দিকে।
‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয় আর আমার বেলায় যেখানেই লুকানোর দরকার হয় সেখানেই ধরা খাই।’ বিড়বিড় করলো ইরফান৷ আর লুকিয়ে কাজ নেই দেখে সে নিজেই এগিয়ে এলো একটু।
‘আমার গুড্ডিবাবু এখানে কি করছে?’ নকল হাসি হেসেই জিজ্ঞেস করলো সে শ্রেয়সীকে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেগুলোর দিকেও তাকালো কেউ তার বোনের দিকে তাকাচ্ছে কিনা দেখতে। শ্রেয়সী মুখ ভার করলো ইরফান ভাইয়া তাকে আবার গুড্ডিবাবু বলেছে! ইকবাল,ইরফান দুজনেই তাকে ছোট্টবেলা থেকে গুড্ডিবাবু বলে ক্ষেপায়। তনুশ্রী কিংবা রুপশ্রী সেদিক থেকে বহুদূরে। তারা দুজন কখনোই ইরফানদের বাড়িতে যাতায়াত করতো না কালেভদ্রে প্রতিবেশি হিসেবেই এক ঈদ উৎসবে যেত। ইকবাল অবশ্য রুপশ্রীর মায়ের খুব আদুরে তাই তাকে প্রায়ই আসতে হতো দেওয়ান বাড়িতে।
ইরফানের কাছে শ্রেয়সীর এমন দৌড়ে যাওয়া দেখে নয়ন জানতে চাইলো কে সে? রুপশ্রী জবাব দিলো, ‘ইনি ইরফান ভাইয়া পাশের বাড়ির।’
‘শ্রেয়সী এমন করে গেল কেন তার কাছে?’ নয়নের এ প্রশ্নে রাগ হলো তনুশ্রীর। নয়নের প্রশ্নে কেমন বাজে ইঙ্গিত মনে হলো তার। মুখ ঝামটি মেরেই জবাব দিলো, ‘ কারণ তারা মনে প্রাণে ভাইবোন। শ্রেয়র কোন ভাই নাই ইরফান ভাইয়ারও কোন বোন নেই। বোধগম্য হলো কিছু?’ শেষের কথাটা যেন নয়নকে কটাক্ষ করতেই বলল তনু৷ রুপশ্রী কোন কথাই বলল না আর। শ্রেয়সী আরও কিছু কথা বলে তবেই ফিরলো। আসতে আসতে ইরফানকে জানিয়েও এলো তাদের সাথে আসা ছেলেটা তার হবু দুলাভাই। ইরফান নিজে কথা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে আর এগুলো না তাদের দিকে। তবে মনে মনে অভিনন্দন ঠিকই জানালো রুপশ্রী আর নয়নকে।ইরফান চলে গেছে যেখানে খেলা হবে সেখানেই। আর রুপশ্রীরাও রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। ঘন্টাখানিক সময় ব্যয়ে খাওয়া শেষ করে নয়ন তাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে তনুশ্রী গম্ভীর মুখে বলল, তাদের যেন বাড়িতে দিয়ে আসে। আপু চাইলে যাক কিন্তু তারা দুজন কোথাও যাবে না। দু বোন না গেলে যে রুপশ্রীও যাবে না তা রুপশ্রীর মুখ দেখেই বুঝে গেছে নয়ন। মনে মনে বলে চলল, ‘ মাত্র কয়েকটা মাস এরপরই আমি তোমার এই বোনদের নিয়ে আদিখ্যেতা বের করবো। হবু হাজব্যান্ডের সাথে একটু সময় কাটাবে তাতেও দেখতে হবে বোনেরা যাবে কি না! এতোটাই কি অবুঝ তুমি ? আর বোনগুলোও হয়েছে তেমন। প্রথমবার আমরা বেরিয়েছি আঠার মত এসেছে তো এসেছে এখন আবার আঠার মত বোনকে সাথে নিয়েই যাবে।জাস্ট ডিজগাস্টিং!’ মনের ভেতর রাগ চরকির মত ঘুরপাক খাচ্ছে নয়নের কিন্তু তা মুখে প্রকাশ করবার জো নেই। নিতান্তই বুদ্ধিহীন হয়ে নয়ন রুপশ্রীদের তিনজনকে বাড়ি পৌঁছে দিল অল্প সময়ের মধ্যেই। বাড়ি ফিরে যে যার মত রেস্ট নিলো কিছুক্ষণ । সেদিন আর নয়ন একটিবারও কল করেনি রুপশ্রীকে৷ এ যেন রুপশ্রীর জন্য বড় কিছু পাওয়া ছিলো। কি আশ্চর্য! মাত্র তো একরাত কথা বলেছিলো সে নয়নের সাথে এতেই কি হাঁপিয়ে উঠেছিলো? পরপর কাটলো আরও পাঁচদিন নয়ন রুপশ্রীকে ফোন করেনি। রুপশ্রীও তাকে মিস করেছে কিনা জানে না। তবে মনে হয়েছিলে নয়ন হয়তো তার ওপর রাগ করেছে কিন্তু তার কি করার সেটাই যেন বুঝতে পারছেনা।
সময় স্রোতের মত বয়ে চলছে। নয়ন চলে গেছে ইন্ডিয়া রুপশ্রী এখন নিজেই মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করে নয়নের সাথে। তার মা খুব করে বোঝায় হবু বরকে সময় দেওয়া জরুরি । নয়ন ফিরে আসলেই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে দ্রুত৷ তনুশ্রী আজকাল নিজের পড়াশোনার বাইরে একদমই সময় নষ্ট করে না। আগে প্রতিটা বিকেল ছিল তিনবোনের একসাথে ছাঁদবিলাসের সময়৷ এখন আর সেটা হয়ে উঠে না তাদের। শ্রেয়সী পড়াশোনায় সারাবছরই ফাঁকিবাজি করতো এখন তার সে সুযোগটাই রইলো না৷ সময়মত পড়া আর ঘুমটাই সে কভার করে। প্রয়োজনে কখনো কখনো ইকবালের কাছে যাওয়া হয় তার পড়াশোনার খাতিরে আর চকোলেটের লোভে। আজকাল শ্রেয়সীর মন খারাপ হয় তার ইকবাল ভাইয়ার জন্য। বড় আপুর প্রেমে পিছলে পড়া কোমরবাঁকা ইকবাল ভাই যে আপুর জন্য কষ্ট পায় তা সে খুব বোঝে। কিন্তু কিছু করার নেই তার। ইরফান নিজেই এসে জানিয়েছিলো ইকবালকে, ‘ওই বারান্দায় তাকিয়ে থেকে আর ঘাড় বাঁকানোর দরকার নেই। রুপশ্রীর আংটিবদল হয়ে গেছে সেই ডাক্তারের সাথেই।এবার থেকে অন্য কাউকে ভালোবাস যাকেই বাসবি লেভেলটা দেখে বাসিস। অর্থের লেভেল ঠিক না হলে প্রেমিক হতে পারবি না।’
ইকবাল খুব একটা অবাক হয়নি রুপশ্রীর এনগেজমেন্ট এর কথা শুনে যেন সে আগে থেকেই জানতো এমনটা হবে।
চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)