#ত্রিমোহনী
(৩)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________________
আকাশটা ছাইরঙা মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ঝুপ করে এক পশলা বৃষ্টি নামবে এখনই। স্কুলে আজ কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না শ্রেয়সীর ৷ সামনেই তো টেস্ট পরীক্ষা তাই স্কুলের চেয়ে বাসায় বসেই সিলেবাস কমপ্লিট করা ভালো। মায়ের কানের কাছে এই বলে সেই কখন থেকে ঘ্যানঘ্যান করছে সে। তনুশ্রী কলেজে যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে।নাশতার টেবিলে সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ির প্রায় সকলেই উপস্থিত হলো এক রুপশ্রী ছাড়া। কাল নয়ন চলে যাওয়ার এক ঘন্টা পরই রুপশ্রীকে কল করে। আর সেই ফোন কল চলে ঠিক রাত তিনটায়। তনুশ্রী আর শ্রেয়সী কাল শখ করেই বোনের কাছে ঘুমুবে বলে গেলেও মাঝ রাত্তিরে ফিরে এসেছিলো সেই ফোনালাপে বিরক্ত হয়ে। রুপশ্রীও ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে কতবার যে দেয়ালে,তনুর গায়ে আবার কখনও টেবিলের কোণে পড়ে পড়ে চোট পেয়েছে তা শুধু সে’ই জানে৷ রাতে যখন ফোনের চার্জ শেষের দিকে রুপশ্রী বলেছিলো নয়নকে। নয়নের কি হলো কে জানে সে ফোন রাখতে চায় না বলে বুদ্ধি দিলো চার্জার লাগিয়ে নেওয়ার। বিরক্ত, ঘুমে কাতর রুপশ্রী অনুভূতিহীনের মত তাই করলো।

বৃষ্টি নামবে নামবে করে আর নামলো না। শ্রেয়সীর স্কুলে না যাওয়ার বায়নাটাও আর টিকলো না কারো কাছে। তনুশ্রী নাশতা শেষ হতেই চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে কলেজে যাবে বলে। বা হাতের কব্জিতে ঘড়িটা পরতে পরতে গাড়ির কাছে গেল তনুশ্রী। দৃষ্টি তার পূবের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে। চোখ দুটো বড্ড ঘোলাটে তার কাল রাত থেকেই। সকল আনন্দ, উৎসাহ কাল রুপশ্রীর আংটিবদলের পরই কেমন শরতের মেঘের মত জায়গা বদল করলো।গোলগাল ভরাট মুখটাতে ভার ভার ছাপ যা কারোই দৃষ্টিগোচর হয়নি। হওয়ার কথাও না ; তনুশ্রী বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের হৈ হুল্লোড়েও তার শব্দোচ্চারণের ভঙ্গি বড্ড শান্ত। তাই তার এমন ভাব কারোই বোঝার বাইরে। একমাত্র রুপশ্রীই পরিচিত তার এই শান্ত স্বভাবে বিষন্নতার আদল কিন্তু কাল থেকে সে নিজের মধ্যেই গুম। আজ বড় চাচার গাড়িতে করে কলেজে যাবে দুবোন। চাচা আজ ব্যবসায়িক কোন কাজেই থাকবেন না। চাচার মার্সিডিজ বেঞ্জের পুরনো মডেলটা শ্রেয়সীর খুব পছন্দ বলেই আজ স্কুলের জন্য এই গাড়িটির আবদার করেছে। তনুশ্রী গাড়িতে বসতেই শ্রেয়সীও দৌড়ে এসে বসলো পাশে।গাড়ি বাড়ি গেইটে ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠতেই ড্রাইভারকে থামাতে বলল শ্রেয়সী।

‘ হালিম চাচা গাড়ি থামান’ তাড়া দিলো শ্রেয়সী গাড়ি থামাতে। ড্রাইভারও থামিয়ে দিলো।

‘কি হলো?’ তনুশ্রী জিজ্ঞেস করলো।

‘এক মিনিট আমি আসছি’ বলেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল শ্রেয়সী। রাস্তার ধারে শিমুল গাছের নিচে দাঁড়ানো ইকবাল মাত্রই পকেট থেকে সিগারেট বের করছিলো। শ্রেয়সীকে দৌড়ে তার দিকে আসতে দেখেই সিগারেট রেখে দিলো পকেটেই। দূর থেকে লক্ষ্য করলো তনুশ্রী তার দিকে একপলক চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

‘ইকবাল ভাইয়া আমার চকলেট?’ শ্রেয়সী দম ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞেস করলো। অবাক চোখে তাকালো ইকবাল শ্রেয়সীর দিকে৷ সময় এখন কটা বাজে! নয়টার কমই হবে এত সকালে তো সে দোকানের দিকে যায়নি। কোন এক অজানা কারণেই কাল সারারাত তার ঘুম হয় নি। উঠোনজুড়ে পায়চারী করে সকালেই চোখ বুজেছিলো। এরপর এই মাত্রই তার ঘুম ভাঙলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। আজকে তার পকেট শূন্য এক প্যাকেট সিগারেটই কেবল সম্পদ সাথে৷ প্রতিদিনই পকেটে তার চকলেট থাকে শ্রেয়সী ভেবেছে আজও পাবে৷ ইকবাল পকেট হাতড়ে চকলেট পেলো না৷ থমথমে আকাশে মেঘ ডাকছে গুড়গুড় করে৷ শ্রেয়সী হাত পেতেছে চকলেটের জন্য কিন্তু ইকবাল হতাশ হলো। প্রতি রাতেই সে টিউশনি থেকে ফেরার পথে এক মুঠো চকলেট নিয়ে বাড়ি ফেরে। সকালে কিংবা বিকেলে দেখা হতেই মুঠোভরে চকলেট এগিয়ে দেয় সে শ্রেয়সীকে। আবার প্রতিদিনই বলবে একটা চকলেট তোমার রুপ আপুর দুটো চককেট তনু আপুর আর বাকিগুলো বাবুই সোনার। কালকে সে বিকেল থেকেই বের হয় নি বাড়ি ছেড়ে। তাই নিয়মের বাইরে আজকে তার পকেটশূন্য। মন খারাপ হলো বুঝি মেয়েটার চকলেট না পেয়ে!

‘ বাবুই পাখি মন খারাপ করো না। প্রমিস করছি বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় আমি তোমার চকলেট পাঠাবো৷’ শ্রেয়সীর মাথ হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো ইকবাল।পাশের বাড়ির তিনটি মেয়ের এই মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই ইকবালের খুব আদুরে৷ ছেলেহীন দেওয়ান বাড়িতেও পাশের বাড়ির এই ছেলেটি সবার প্রিয়।সময়ে অসময়ে সব কাজেই ইকবাল আসতো তাদের বাড়ি। কিন্তু গত একমাসে এ আসা যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে ইকবালের।

‘আমি তো আজ চকলেটের জন্য আসিনি৷ তুমি বলো কালকে কেন আসোনি? কালকে বড় আপুর আ,,,,,

‘শ্রেয় দেরি হচ্ছে আমার’ তনুশ্রী ডেকে উঠলো। ইকবাল ঘাড় বাঁকিয়ে আবার দেখলো তনুশ্রীকে। মেয়েটা দিনকে দিন বড্ড রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সেই এতোটা গাম্ভীর্য ভালো মনে হলো না ইকবালের।

‘ওই বুড়িটা এমন গোমড়া মুখে আছে কেন?’ একগাল হেসে শ্রেয়সী জবাব দিলো, ‘ জন্মের সময় মধুর জায়গায় চিরতার রস খাইয়েছিলো তনু আপুকে। আচ্ছা আমি চলি বিকেলে চকলেট দিবে মনে থাকে যেন।’ চলে গেল শ্রেয়সী ইকবাল চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে আবারও সিগারেট বের করলো। পকেটে দিয়াশলাই না পেয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্যাকেটাকেই দেখতে লাগলো সে৷ আজকের আবহাওয়াটা দারুণ লাগছে। সকাল সকাল বাদলা আকাশ গুড়গুড় মেঘের ডাক। কোথাও কেউ নেই বিশ্বচরাচর আজ মেঘের হাতে বন্দী। এই মেঘ ঝরবে না শুধু পাহারাদারের মত ভূলোকের প্রতিটা কোণায় ঘুরবে।

গাড়িটা প্রথমে শ্রেয়সীর স্কুলে থামবে। শ্রেয়সীকে নামিয়ে পরেই যাবে তনুশ্রীর কলেজে। স্কুলের সামনে গাড়ি থামতেই তনুশ্রী বলল, ‘ এখন আর তুই ছোট্ট পাঁচ, দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে না কথাটা মনে রাখিস।’ শ্রেয়সী চমকে তাকালো বোনের দিকে । কেমন নিস্পৃহ দেখাচ্ছে তনুকে ঠিক যেন অনুভূতিহীন কোন কাঠের পুতুল। অথচ কথাটা সে কতোই না গম্ভীর আর কঠোর গলায় বলল। শ্রেয়সী ভীষণরকম অবাক হলো তার ব্যবহারে। গত রাত থেকেই চোখ, মুখ কেমন কঠিন লাগছে। শ্রেয়সীর একবার মনে হলো তনু আপু বুঝি নয়ন ভাইয়াকে দুলাভাই হিসেবে পছন্দ করেনি। কিন্তু কই আগে তো কখনও তেমন বলেনি তবে কাল আংটিবদলের কথা শোনার পর থেকেই এমন আচরণ করছে কেন! গাড়ি থেকে নামতে নামতে শ্রেয়সী বলল, ‘ আমি বড় হই কিংবা ছোট তার সাথে ইকবাল ভাইয়ার চকলেট নিয়ে কোন তুলনা করবে না বলে দিচ্ছি৷ নইলে আমি চাচুকে বলব তুমি ইকবাল ভাইয়াকে ভালোবাসো।’ চলে গেল শ্রেয়সী একটাবার যদি ফিরে তাকাতো তবে দেখতে পেত তনুশ্রীর আচমকা বিধ্বস্ত হওয়া মুখটা। কাঠিন্যের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল মুখটা কতোটা করুণ দেখাচ্ছিলো তখন।

ভর দুপুরে আগাম কোন বার্তা ছাড়াই হাজির হলো নয়ন। গাড়ি বোঝাই তার অসংখ্য র্যাপিং করা গিফট প্যাকেট। রুপশ্রী তখনও বেঘোরে ঘুমুচ্ছে নিজের ঘরের দোর বন্ধ করে। বাড়ির নিচ তলায় হৈচৈ পড়ে গেছে বাড়ির হবু জামাইয়ের আগমনে। বসার ঘরে প্রায় সব গুলো সোফা,কর্ণার টেবিল,সাইড সোফা এমনকি ফ্লোরে আছে গিফটের প্যাকেট সেই সাথে মিষ্টিও। রুপশ্রীর বাবা বাড়িতেই ছিলেন। নয়নকে এত কিছু আনার জন্য প্রথমেই একদফা রাগ দেখালেন যদিও তিনি মনে মনে বেশ গর্ববোধ করলেন এমন একটা ছেলেকে মেয়েরজামাই হিসেবে পাবেন বলে। মেয়ের ভাগ্য যে বিশাল ঠিক রাজরানীর মত থাকবে মেয়ে তার ভেবেই পুলকিত হলেন খুব। রুপশ্রীর ছোট চাচী নিজে গিয়ে ডেকে উঠালেন তাকে। বাকি মা আর মেঝো চাচী কি খাওয়াবেন কেমন আপ্যায়ন করবেন সে ব্যপারে মনযোগী হলেন। কয়েক মিনিটেই দেওয়ান বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেল। উৎসব উৎসব এক আমেজ তৈরি হয়ে গেছে। তনুশ্রী কলেজ থেকে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। সকালের মেঘলা মেঘলা আবহাওয়া অনেক আগেই পাল্টে গিয়ে রৌদ্রজ্জ্বল হয়েছিলো৷ এখন রীতিমতো ভ্যাপসা গরমও অনুভূত হচ্ছে৷ সেই গরমে তনুশ্রীর ফর্সা গোলগাল মুখটা হালকা ঘামে ভেজা ভেজা। গাল দুটো আর নাক একটু একটু গোলাপি দেখাচ্ছে। বসার ঘরে নয়ন তনুশ্রীকে খেয়াল করতেই খুশি খুশি মুখ করে ডাকলো, ‘ কেমন আছো তনু?’

‘ভালো।’

‘কলেজ থেকে ফিরলে বুঝি?’

‘ড্রেস দেখে কি মনে হলো?’

‘হুম বুঝতে পারছি তুমি খুব ক্লান্ত৷ একটু জিরিয়ে এক গ্লাস লেমনেড খাও স্যালাইন মিশিয়ে৷ দেখবে ক্লান্তি একদম দূর হয়ে যাবে।’

‘শুকরিয়া’ বলেই চলে যাচ্ছিলো তনুশ্রী। আমতা আমতা করে নয়ন আবার ডাকলো, ‘তনু।’

‘তনুশ্রী।
আমার নাম। আমাকে প্লিজ সেই নামে ডাকলেই খুশি হবো।’

‘আচ্ছা তনুশ্রী একটু কি রুপশ্রীকে,,,,’

‘ডেকে দিচ্ছি’। আর দাঁড়ালো না তনুশ্রী। ড্রয়িংরুমে নয়ন একাই বসে আছে। তনুর মা নাশতার ট্রে নিয়ে আসছিলেন আর তাই শুনতে পেয়েছিলেন তনুশ্রী আর নয়নের কথা। অবাক হলেন তনুর মা। তার মেয়ে স্বভাবে চুপচাপ তাই বলে বেয়াদব তো নয়। অথচ নয়নের সাথে এ কেমন করে কথা বলল!

কাঠের দরজায় ধরাম ধুরুম শব্দে গাঢ় ঘুমটা ভেঙে গেল রুপশ্রীর। দরজার বাইরে তনুশ্রী প্রচন্ড রেগে কাঠের একটা টুকরো কোথা থেকে জোগাড় করে এনে তাতেই বারি মারছে দরজায়। হঠাৎ এমন জোর শব্দে ঘুম ভেঙে হকচকিয়ে যায় রুপশ্রী। কোনদিক না দেখেই অপ্রকৃতস্থের মত দরজা খোলে। তার নিঃশ্বাস ফুলে ফেঁপে উঠছে যেন। বাইরে কি ডাকাত পড়লো!

দরজা খুলতেই তনুশ্রী বলল, ‘ রোমিও এসেছে ডাকছে তোমায় বসার ঘরে।’ কথাটা শেষ করেই হনহনিয়ে চলে গেল তনুশ্রী আর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো রুপশ্রী।

কয়েক মিনিট সময় নিলো রুপশ্রী তারপর নিজেকে পরিপাটি করে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো৷ ঠিকঠাক লাগছে এবার নিশ্চয়ই যাওয়া যায় নিচতলায়৷ এক পা বাড়াতেই কোন এক দৈবশক্তি তাতে উল্টো টানতে লাগলো। দরজা রেখে উল্টো ঘুরে বারান্দায় দাঁড়ালো। এক পলক এদিক ওদিক করে কিছু খুঁজতে লাগলো। এই বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির উঠোন এবং পাশেই একটা ঘরের দরজা। অবচেতন মন সে দরজাতেই যেন খুঁজছে কিছু। কিন্তু কি!

‘ওদিকে কি কেউ আছে? স্পেশাল!’

চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here