#ত্রিকোণ তৃতীয়_পর্ব
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#তৃতীয়_পর্ব

— ‘মানে কি স্যার? আমার কি এমন রোগ হয়েছে যে অফিস যেতে পারব না আমি?’
— ‘অভিনন্দা আমি তোমার বস, আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখিও না। আমি বলছি, আগামী সাতদিন যেন তোমার মুখটা অফিসে না দেখি! এটা আমার অর্ডার।’ রাগী স্বরে বলে ওঠে ঐশিক।
— ‘অভিনন্দা মা, এই ফ্ল্যাটে তো তুই একাই থাকিস, শরীরের এই অবস্থায় এখানে থাকবি? তার চেয়ে বরং তুই আমার সাথে আমাদের বাড়িতে চল, ওখানে থাকলে আমরাও নিশ্চিন্ত থাকি।’
— ‘এই কথাটা যে আমি ভাবিনি মা তা নয়, কিন্তু ওই বাড়িতে থাকলে ওকে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হবে, আর কার জন্য হতে হবে সেটাও নিশ্চয় তোমার অজানা নয়!’
— ‘হ্যাঁ, এটা অবশ্য তুই ভুল বলিসনি বাবা।’
— ‘আর এই যে অভিনন্দা, তোমায় বলছি, ফোন করলে বা মেসেজ করলে দয়া করে সেগুলোর রেসপন্স কোরো।’ বলেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঐশিক।
— ‘আসলে তোকে নিয়ে খুব টেন্সড ছিল তো ও, তাই এইভাবে রেগে গেছে। এখন তুই ওর রাগটা সামলে নিস মা।’ বলেই তৃষা বেরিয়ে গেলেন।

কেটে গেল আরও বেশ কয়েকদিন। একদিন ঐশিক তৃষাকে বলল, ‘মা, আমি অভিনন্দার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ও না তো আমার ফোন ধরছে, না মেসেজের রিপ্লাই করছে। অফিসেও আসছে না, আর ফ্ল্যাটে তালা ঝুলছে। ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা অফিস থেকেই পেয়ে গেছি আমি, আজ ওখানেই যাচ্ছি আমি।’

শহর থেকে প্রায় তিনঘন্টা ড্রাইভ করে ঐশিক পৌঁছল অভিনন্দাদের গ্রামে, তারপর ঠিকানাটা গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞেস করে অভিনন্দার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল ও।

— ‘স্যার আপনি? আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।’ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অভিনন্দার মা বাবা।
— ‘অভিনন্দা বাড়িতে আছে?’
— ‘হ্যাঁ স্যার, ওই তো ওর ঘরেই আছে। আর বলবেন না স্যার, দুদিন হল বাড়িতে ফিরেছে, কিন্তু ফিরে থেকেই ওর মুখে হাসি নেই, আমাদের সাথে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলেনি, ঠিক করে খাচ্ছে দাচ্ছে না, শুধু সারাদিন দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে থাকে চুপচাপ, আর কি যে আকাশকুসুম ভাবে কিছুই বুঝি না!’ অভিনন্দার মা বলেন।
— ‘শুধু কি তাই? এসে থেকেই নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে, বাড়ির বাইরে পর্যন্ত বেরোয়নি।’ অভিনন্দার বাবা বললেন।
— ‘হুম, ওর ঘরটা কোন্ দিকে?’

ঐশিক অভিনন্দার ঘরের সামনে গেল। ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, ঐশিক নক করল।
— ‘মা, প্লিজ যাও!’ ভেতর থেকে শোনা গেল অভিনন্দার গলা, ‘আমার খিদে নেই, কিচ্ছু খাবো না আমি!’
— ‘অভিনন্দা আমি ঐশিক রায়চৌধুরী, দরজাটা খোলো।’
— ‘স্যার আপনি? আপনি কেন এসেছেন স্যার?’
— ‘তার আগে বলো তুমি কি দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে আমায়?’
অভিনন্দা এসে দরজাটা খুলল।
ঐশিক ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপরেই বলল, ‘তুমি কেন এরকম আচরণ করছ সেটা আমার জানা’, বলেই অভিনন্দার মেডিকেল রিপোর্টটা ও ধরল ওর সামনে।
অভিনন্দা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ঐশিক বলে যেতে লাগল, ‘তুমি অনেক আগেই পেয়ে গেছ রিপোর্টটা, আবার ডাক্তারবাবুকে অনুরোধও করেছ যেন আমায় এই ব্যাপারে কিছুই না জানানো হয়, কিন্তু তুমি বোধহয় জানোনা যে ডাক্তারবাবু আমার বাবার বিশেষ বন্ধু, তোমার অনেক আগে থেকে উনি আমায় চেনেন, তাই একটু চেপে ধরতেই উনি দিয়ে দিলেন তোমার রিপোর্টটা।’ ঐশিক বলে যেতে লাগল, ‘কোনো অবিবাহিতা মেয়ে প্রেগন্যান্ট শুনলে বেশিরভাগ মানুষই মেয়েটার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলে, কিন্তু তুমি ভালোভাবেই জানো যে আমি বাঁধা গতে চলি না কখনো, ভবিষ্যতেও চলব না, তাই আমি ছুটে এলাম এতদূর। তুমি তো ভীতু, লাজুক মেয়ে কোনোদিন ছিলে না অভিনন্দা, তাহলে আজ কি হল যে তোমার মতো একজন স্মার্ট, আধুনিকা, বুদ্ধিমতী মেয়ে এভাবে নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে ফেলল?’
অভিনন্দা মাটির দিকে তাকিয়ে রইল নীরবে। ঐশিক বলে যেতে লাগল, ‘অভিনন্দা, তোমার কি কোনো প্রেমিক আছে?’
অভিনন্দা ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিল, ‘না।’
— ‘তাহলে? তাহলে কি তোমার ফিজিক্যাল হ্যারাসমেন্ট হয়েছিল? চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো!’ অভিনন্দার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল ঐশিক।
— ‘না।’ ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দিল অভিনন্দা।
— ‘তাহলে? তুমি যদি না বলো তাহলে কিভাবে জানব যে কে তোমার এই অবস্থার জন্য দায়ী?’
— ‘সব প্রশ্নের উত্তরই যে আপনাকে জানতে হবে তার তো কোনো মানে নেই স্যার তাই না? এই প্রশ্নের উত্তরটা না ই বা জানলেন!’
— ‘জানতে হবে বৈকি! সত্যিটা জানব বলেই তো এলাম এতদূর’, ঐশিক বলে চলে, ‘আর একবার যখন তোমার সামনে এসেছি, তখন উত্তর না নিয়ে কিন্তু আমি ফিরব না!’
— ‘সে আপনি চাইলে থাকতেই পারেন এখানে, কিন্তু আমি কিছুতেই আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব না।’
— ‘আচ্ছা অভিনন্দা, কেউ কি ভয় দেখিয়েছে তোমায়? হুমকি টুমকি দিয়েছে? শোনো তুমি ভয় পেও না, কালপ্রিটের নামটা শুধু বলো, সে যত বড়োই প্রভাবশালী হোক, ঐশিক রায়চৌধুরীর সামনে সে কিছুই না, তুমি নিশ্চিন্তে বলোই না।’
— ‘স্যার আপনি যাকে কালপ্রিট বলছেন, আমি তো তাকে কালপ্রিট বলে মনে নাও করতে পারি।’
— ‘আরে কিসব আবোলতাবোল বকছ? একটা সহজ প্রশ্ন করছি, তার সোজা উত্তর দাও! আর এমনি সময় তো তোমার মুখে কথার ফোয়ারা ছোটে, এখন হঠাৎ মৌনব্রত পালন করছ কেন?’ গর্জে ওঠে ঐশিক, ‘আর তুমি যদি মুখ বন্ধও রাখো, আমি ঠিকই তাকে খুঁজে বের করব যে তোমার সাথে এত বড়ো অন্যায়টা করেছে।’
— ‘স্যার আমি তো বারবার বলছি আমার সাথে কোনো অন্যায় হয়নি, তাও কেন….’

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here