বিয়ের আসরে তিনবার কবুল বলেই উঠে চলে গেলো শুদ্ধ ভাইয়া।বধুবেসে ঘরে বসে আছি তবে বাইরের কোলাহলে বেশ বুঝতে পারছি আমি যে কি ঘটেছে।আমার চারপাশে বসে থাকা কাজিনগুলো কেউ কেউ সবটা বুঝে কথা ঘোরাতে ব্যস্ত,কেউ বা না বুঝে এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।মেজোমা রুমে ঢুকেই মরা কান্নার স্বরে বললো,
-ইনসু রে!শুদ্ধ চলে গেছে রে!
স্বাভাবিকভাবেই শক্ত হয়ে বসে রইলাম।রুমের বাকি সবাই অবাক হওয়ার পর্ব শেষ করে বলাবলি করতে লাগলো।আমার দুর্ভাগ্য,পোড়াকপাল এইসব।সবটা কানে আসলেই,কিছুই মনে হলো না আমার।কিছুক্ষন পরই সেজোকাকু এসে মেজোমাকে বললেন,
-এভাবে বলছেন কেনো ভাবি?শুদ্ধ বিয়ের আসর থেকে চলে গেছে,পৃথিবী থেকে না।আর ও ওর দায়িত্ব করেই বেরিয়ে গেছে।কবুল বলা শেষেই বেরিয়েছে।
দায়িত্ব!কতোটা সহজ শোনায় এই শব্দটা।এই শব্টার মান রাখতেই হুজুর এসে কবুল বলতে বলার সাথে সাথেই গরগর করে বলে দিয়ে নিজের তকদিরকে স্বীকার করে নিলাম।আজ থেকে আমি শুদ্ধ ভাইয়ার মতো একটা জঘন্য লোকের বউ।আর এ সবটা আমার আব্বুর স্বেচ্ছায় হয়েছে।দায়িত্ব পালন করেছি আমি তার প্রতি।নিজের জীবনটাকে ওই ঘৃন্য মানুষটার সাথে জরিয়ে!
অবশ্য আমার দিক থেকে যতোটা সম্ভব বিয়েটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম আমি।বয়োজৈষ্ঠ্য দিদুনকে বলেছিলাম আব্বুকে বোঝাতে,দরজা লক করে ভয়ও দেখিয়েছিলাম,কষ্ট পাচ্ছি তাও বুঝিয়েছি,বিয়েতে অমত আমার তাও বুঝিয়েছি।কিছুতেই মন গলেনি আব্বুর।বিদায়ের সময় আমাকে বাসার বাইরে ফুল দিয়ে সাজানো একটা গাড়ির সামনে দাড় করানো হলো।ছোট বোন এসে ইরাম জরিয়ে ধরে কাদতে লাগলো।ওকে জরিয়ে ধরে শান্ত গলায় বললাম,
-দোয়া রইলো তোর জন্য ইরু।তোর কপালটা যেনো আমার মতো না হয়।আমি যেখানেই থাকি না কেনো সবসময় দোয়া করে যাবো তোর জন্য। ভালো থাকিস বোন।
একপলক সবার দিকে তাকালাম।আমি বাদে বাকি সবার চোখে অশ্রু।যেমনটা হয় মৃত ব্যাক্তিকে খাটিয়ায় করে কবর দিতে নিয়ে যাওয়ার সময়।মৃত্যু তো আমার হয়েই গেছে।আব্বু ইচ্ছা করেই দুনিয়াতেই জাহান্নামে আমার নিবাস ঠিক করে দিয়েছেন।তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম শব্দ না করে পাথরের মতো দাড়িয়ে কাদছেন উনি।এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-আপনার কথাকে কোনোদিন অগ্রাহ্য করিনি।আজও করলাম না।হয়তো যা ভালো মনে করেছেন,সেটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমার জন্য।চোখ বন্ধ করে সবটা মেনে নিলাম।আফসোস একটাই,আপনার এমন সিদ্ধান্তের কারনটা জানলাম না।আশা করি এবার আপনি খুশি হয়েছেন?আপনার খুশিতেই আমি খুশি।তাই আমিও খুশি আজ!এ জীবনে আর আপনার কোনো কথা রাখতে পারবে না এই ইনসিয়া।কারন জীবন বলে ওর আর কিছু নেই।আজকে আপনার একটা সিদ্ধান্তে ওর মৃত্যু হয়েছে।আসছি।না না,ভুল বললাম। চললাম।ভালো থাকবেন।
আব্বু হুহু করে কেদে দিলেন।হাত বাড়িয়ে হয়তো বুকে টেনে নিতে যাচ্ছিলেন আমাকে।সে সুযোগ দেইনি আমি।সরে এসেছিলাম।আম্মু দম মেরে বসে বসে আছে।তারো চোখের পানি অবাধে ঝরছে,কিন্তু চেহারা থমকে আছে।বড়মনি বারবার করে আম্মুকে জোরে জোরে কাদার জন্য ধাক্কাচ্ছে।কিন্তু আম্মু ওভাবেই আছে।চোখ সরিয়ে পিছন ফিরে সাজানো গাড়িটার দিকে তাকালাম।
সেজোকাকু আব্বুর হাত মুঠো করে বললেন,
-ভাইরে,তোর মেয়েকে আমি রাজকন্যা করে রাখবো।কোনো কমতি রাখবো না ওর তুই দেখিস।সব ঠিক হয়ে যাবে।তুই যা করলি,তা বিফলে যাবে না।খুব তাড়াতাড়ি সবটা ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।
গাড়ির লুকিং গ্লাসে দু ভাইয়ের মহামিলনের দৃশ্য দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি ছাড়া আর কি বেরোলো না ভিতর থেকে।আব্বু সেজোকাকুকে জরিয়ে ধরে কাদছেন।ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িতে লাগানো একটা গোলাপ ছুয়ে দিলাম।জীবনে কি গ্রহন করলাম আমি?এটা কি আদৌও গোলাপের কোমলতা?নাকি তার কন্টকের আঘাত?এসব হওয়াটা কি খুব জরুরি ছিলো?কি দোষ ছিলো আমার?আমিই কেনো?বা আমার জন্য শুদ্ধ ভাইয়াই কেনো?
-ইনসু,ভেতরে ওঠো।
সেজোকাকু গাড়ির দরজাটা খুলে দিলেন।তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ভেতরে উঠে বসলাম।ওপাশের জানালা দিয়ে ফুপাতো বোন যীনাত আপু মুখ বাড়িয়ে বললো,
-ইনসু,আমি আসতে চাই তোর সাথে।
-যে জাহান্নামে আমি যাচ্ছি,তা নিতান্তই আমার ভাগ্যের দোষ।তুমি কেনো তাতে জড়াবে?এসো না।
-কিন্তু ইনসু…
-কেউ আসবে না আমার সাথে!
চেচিয়ে বলায় যীনাত আপু কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে বললো,
-নিজের খেয়াল রাখিস ইনসু।
গাড়ি ছেড়ে দিলো।সবাই আরো জোড়ে কাদছে।গাড়ির জানালার কাচ তুলে দিলাম আমি।শক্ত হয়ে বসে রইলাম। নিজের অবস্থা নিয়ে নিজের উপরই হাসি আসছিলো আমার।চার দিন আগে বের হওয়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম সারির মেডিকেলে চান্স হয়ে গিয়েছিলো আমার।সাদা এপ্রোন,স্থেটোস্কোপ,মেডিকেল করিডোরে বারবার রাউন্ড দেওয়ার স্বপ্নগুলো সবে বাস্তবের রঙ পেতে চলেছিলো আমার।
ঠিক সেই মুহুর্তে!সেই মুহুর্তে শুদ্ধ ভাইয়া আমার জীবনটা শেষ করে দিলেন।অবশ্য ওনাকে সম্পুর্ন দোষ দেওয়া চলে না।আমার নিজের আব্বুই এসবের মুল। সবটা দিয়ে আমি তার ইচ্ছাপুরনে সদা প্রস্তুত ছিলাম।তারই দাম এভাবে দিতে হলো আজ আমাকে।বড়লোক বাবার টাকায় বিগড়ে যাওয়া সন্তান হিসেবে খ্যাত লোকটা আজ থেকে আমার বর।
শুদ্ধ ভাইয়াকে নিয়ে এ তিনবছরে কোনো ভালো কথা কারো মুখে শুনি নি।তার আগে অবশ্য সবটা উল্টোই ছিলো।কিন্তু জানি না কি হয়েছিলো!এ তিনবছরে শুনেছি তো শুধুই তার অপকর্মের কথা।নিজের খামখেয়ালিমতো চলা,টাকা উড়ানো,সিগারেট খাওয়া,ড্রিংক করা,এমনকি জেলফেরত আসামী হিসেবে এ পরিবারের কাজিনসমাজ চেনে ওনাকে।আমিও তেমনটাই জানি।তাই সবার মতো প্রচন্ড ঘৃনা তার প্রতি আমার।কিন্তু এই মানুষটাই এভাবে আমার জীবনে জরিয়ে যাবে কোনোদিনও ভাবি নি।
হুট করে দুদিন আগে কাকু বাসায় চলে আসে।পরদিন সকালেই জানতে পারি একদিন পরই আমার সাথে নাকি শুদ্ধ ভাইয়ার বিয়ে!কারন জিজ্ঞাসা করলেই আব্বু বলেছেন তার সিদ্ধান্ত এটাই বড় কারন।কিন্তু উনি নিজেও দুদিন আগ অবদি শুদ্ধ ভাইয়াকে পছন্দ করতেন না।কি এমন হয়ে গেলো যে সেজোকাকু বাসায় আসাতেই তার ধ্যানধারনার পরিবর্তন হলো?সারাদিন দরজা লক করে রুমে বসে কেদেছি।সবাই অনেক ডাকাডাকি করেছিলো।খুলি নি দরজা।বিয়েটা যখন আব্বুর সিদ্ধান্ত তবে সেটা হবেই!কেদে কেদে নিজেকে শান্তনা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না আমার।
সন্ধ্যায় যীনাত আপুর গলা শুনলাম।এই মেয়েটাই একমাত্র বোঝে আমাকে।আজ তো আম্মুও আব্বুর চিন্তায় আমাকে শান্তনা দিতে ভুলে গেছে।আব্বু হার্ট পেশেন্ট।কোনদিক সামলাবে তা হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না আম্মু।যীনাত আপুর কোলে মাথা রেখে কাদলে আরেকটু শান্তি পাবো,এমনটা ভেবে যেইনা দরজা খুলেছি,কেউ একজন ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকে দরজার সাথে চেপে ধরলো আমাকে।একহাতে মুখ চেপে ধরে আরেকহাতে আমার কনুইর উপরে ধরে দরজার সাথে আটকে রেখেছে আমাকে।চোখ তুলে তাকাতেই ভয় বিস্ময় দুটোই কাজ করতে লাগলো।শুদ্ধ ভাইয়া!
তিনবছর আগে যখন এ বাসায় এসেছিলেন উনি,চেহারায় এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা দেখেছিলাম।কেনো জানি না তাকে বরাবরই ভয় করতো আমার অন্যান্য ভাইবোনদের চেয়ে।হয়তো উনি বাসায় কম আসতেন তাই।কখনো বাকা হেসে তাকিয়েছেন আমার দিকে,কখনো বা কথা বলার চেষ্টা করেছেন আমার সাথে,কিন্তু আমিই ভয়ে কথা বলতাম না।পালিয়ে পালিয়ে চলতাম তার থেকে।তার চোখ এড়িয়ে।
কিন্তু আজকের পরিস্থিতি?কাল নাকি এই মানুষটার সাথেই আমার বিয়ে!চোখদুটো লাল,চোখের নিচে কালোদাগ।চেহারাতেও বিষন্নতা।চোয়াল রাগে শক্ত করে রেখেছেন উনি।অতিরিক্ত ফর্সা চেহারায় একরাশ রাগ কোনো অংশে লেগে থাকা ক্লান্তিকে ছাপিয়ে গেছে।অফ হোয়াইট শার্টটার বুকে বগলে ঘেমে ভিজে আছে কিছুটা। হাতা কনুই অবদি ফোল্ড করে রেখেছেন।মানুষটা বেশ লম্বা বলে ঝুকে দাড়িয়ে আছে আমার দিকে।কপালের চুলগুলো নড়ছে।শুদ্ধ ভাইয়া দাতে দাত চেপে বললেন,
-কোন সাহসে তুই সারাদিন দরজা লাগিয়ে রেখেছিলি?
চমকে উঠলাম আমি।এই মানুষটা এর আগেও কথা বলার চেষ্টা করেছে আমার সাথে।তুই করেই।কিন্তু আজকের কথায় এতো অধিকারবোধ কেনো?আমি শুধু নড়াচড়া করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ছিলাম।ভয় পাই ওনাকে।তার উপর এতোটা কাছে দাড়িয়েছেন উনি যে দম বন্ধকর পরিস্থিতি হয়েছে আমার জন্য।উনি আমাকে ঝাকিয়ে বললেন,
-দরজা লাগিয়েছিস কেনো?
কথা বলতেই দিচ্ছেন না,মুখ আটকে রেখেছেন,আবার প্রশ্নও করে চলেছেন।শুধু নড়াচড়া করা ছাড়া করার কিছুই নেই আমার।উনি আরো কাছে এসে দাত কিরমিড়িয়ে বললেন,
-কথা বল ড্যামিট!এই রাস্তা কিভাবে এসেছি আমি জানি।খবরদার আর রাগ বাড়াবি না আমার!বল দরজা লাগিয়েছিস কেনো?
অবাক হলাম।আমার জন্য এতোটা হাইপার হবার কি আছে?উনি এভাবে ঢাকা থেকে রাজশাহী এসেছেন আমার জন্য?নাহ্!এসব ভাবাও মানায় না আমাকে।জানিনা কোথা থেকে সাহসের সঞ্চার হলো!তার হাত এক ঝটকায় মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে ধাক্কা লাগালাম তার বুকে।কিছুটা পিছিয়ে নিজেকে সামলে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে।তার চাওনি দেখে ভয়ে কাপছি আমি।তবুও একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
-আমার ইচ্ছা!আপনি কোন সাহসে ছুয়েছেন আমাকে?রুমে ঢোকার সাহস হলো কি করে আপনার?
শুদ্ধ ভাইয়ার চাওনির পরিবর্তন হলো।রাগী চেহারায় নমনীয়তা চলে এলো হঠাৎই।ধুপ করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পরলেন উনি।মাথার চুলগুলো টেনে পিছনে ঠেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিলেন।আমি শুধু চেয়ে দেখছি ওনার কাজ।বোঝার চেষ্টা করছি এরপর কি করবেন উনি!চোখ খুলে মেঝের দিকে তাকিয়েই উনি বললেন,
-বাসায় কি হয়েছে বল।
-কি হয়েছে?আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।আপনারা সবাই মিলে খেলছেন আমাকে নিয়ে।
-ত্যাড়া কথা ছাড়!রাইট নাও,সোজাভাবে বল এ বাসায় কে তোকে কি বলেছে!
রাগ হলো আমার।লোকটা সব জেনেও এভাবে প্রশ্ন করছে কেনো?কিছুটা রাগ প্রকাশ করার প্রয়োজন আমারও আছে।নইলে শ্বাস আটকে মারা যাবো আমি।বললাম,
-নাটক করছেন?জানেন না সেজোকাকু কি বলে চলেছেন?জানেন না আমার আব্বুকে তিনি অহেতুক কোনো ভয় দেখিয়ে কথা আদায় করিয়েছেন?জানেন না কাল আমার আর আপনার জীবনে বিয়ে নামক ছেলেখেলা ঘটতে চলেছে?জানেন না আপনার মতো মানুষের সাথে জড়িয়ে কাল আমার জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে?
এতোগুলো কথা একদমে বলে তার আতকে ওঠা রিয়্যাকশনে নিজেও কিছুটা পিছিয়ে গেলাম।উনি এমনভাবে তাকালেন আমার দিকে যেনো কিছু জানেনই না।তারপর নিচদিক তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললেন,
-যা ভেবেছিলাম তাই হলো।এরা আমাকে…
কান পেতে শোনার চেষ্টায় ছিলাম।উনি নিচদিক তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
-কাল তুই কবুল বলবি না!
বিস্মিত না হয়ে পারলাম না।আকাশ থেকে পরা সম অবাক হওয়া যাকে বলে।কোনো কারনে আমার মনে একটা ভ্রম ছিলো।ভেবেছিলাম হয়তো উনি বিয়েটাতে রাজি।কেনো ভেবেছিলাম তা নিজেও জানি না।কিন্তু উনি তো আমাকে কবুল বলতে মানা করছেন।তারমানে উনি চাননা এই বিয়ে হোক।শুদ্ধ ভাইয়া এবার আমার দিকে তাকিয়ে ধমকে বললেন,
-শুনিসনি কি বলেছি?তুই কাল কবুল বলবি না!বল!বল যে ঠিকাছে,কবুল বলবো না আমি।বল!
মাথা নিচু করে ধীর গলায় বললাম,
-বলার সুযোগ থাকলে আজই বলে দিতাম।কিন্তু আমি নিরুপায়।আব্বু অসুস্থ্য।ওনাকে এখন কোনো বিষয় নিয়ে…
শুদ্ধ ভাইয়া তেড়ে এলেন আমার দিকে।হাত বাড়িয়েও তা নিজের মাথায় নিয়ে চুলগুলো টানতে টানতে বললেন,
-যার যা হয় হোক!তোকে বিয়ে করবো না আমি।এই বিয়ে হবে না!
এবার আমি তার চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বললাম,
-তাহলে কাকুকে বলছেন না কেনো?আপনি কেনো মানা করছেন না?বলে দিন বিয়ে করবেন না।আপনারও ইচ্ছেপুরন হবে,আমিও বেচে যাবো।
শুদ্ধ ভাইয়া আবারো রাগ নিয়ে তাকালেন আমার দিকে।দু পা এগোলেন উনি।আমি দম আটকে পিছিয়ে আবারো দরজায় লেগে গেছি।রাগে ওনার কপালের রগগুলো দেখা যাচ্ছে।ওভাবেই রেগে আঙুল উচিয়ে বললেন,
-আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা।কান খুলে শুনে রাখ।তুই কাল বিয়ের আসরে থাকবি না।কোনো বিয়ে টিয়ে হবে না কাল আমার আর তোর!
শুদ্ধ ভাইয়ার পায়ের কাছে বসে গেলাম।পা ধরতে গেলেই উনি পিছিয়ে গেলেন।ভ্রুকুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।চোখের জল আটকে না রেখে কাদতে কাদতে বললাম,
-প্লিজ শুদ্ধ ভাইয়া,আমিও চাইনা এই বিয়ে হোক।আমার সামনে স্বপ্নপুরনের সময়।বিয়েতে জড়াতে চাইনা আমি এখন।আপনি মানুষটা কেমন তা জেনে আপনার সাথে তো নয়ই।এইটুকো দয়া করুন।কাকুকে বলুন এই বিয়ে আটকাতে।আব্বুকে মানা করতে পারবো না।উনি অসুস্থ্য।প্লিজ বিয়েটা আটকান।প্লিজ!!!
শুদ্ধ ভাইয়া মলিন দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।বললেন,
-কান্না থামা।
চোখ মুছে উঠে দাড়ালাম।উনি বললেন,
-আমার মতো কাউকে জীবনে জড়াতে হবে না তোকে।কোথাও পালিয়ে যা,নয়তো আজকের মধ্যে ছেলে জুটিয়ে তাকে বিয়ে করে নে।আমি সবরকমের সাহায্য করবো তোকে।
রাগটা আবারো চাড়া দিতে উঠলো মাথায়।এগুলোর কোনোটাই আমার পক্ষে সম্ভব না।এগুলো করলেও আব্বু কষ্ট পাবেন।এই বিয়ে আটকানোর একমাত্র উপায় কাকুর মানা করা।শুদ্ধ ভাইয়া নিজেও বুঝতে পারছেন এটা।তবুও এসব বলছেন উনি!জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললাম,
-এগুলোর কোনোটাই সম্ভব না আমার পক্ষে।কেনো বুঝছেন না আপনি?আপনি কাকুকে বলুন না যাতে…
-পারবো না।
-কেনো?
-তোকে বলবো না।বিয়েটা হবে না কাল।তুই বোবা হয়ে যা,যাতে কবুল না বলতে পারিস।নয়তো আঙুলে ব্যান্ডেজ করা,যাতে রেজিস্ট্রিতে সাইন না করতে পারিস।যা করার কর!কিন্তু কাল বিয়েটা যেনো না হয়!কাল বিয়েটা যেনো না হয়!বুঝেছিস?
-আব্বুর মান সম্মানের বিষয়,নইলে উপায় থাকলে সুইসাইডই…
কথা শেষ করার আগেই শুদ্ধ ভাইয়া গলা চেপে ধরলেন আমার।আমার মুখের উপর মুখ এনে বললেন,
-ডোন্ট ইউ ডেয়ার!আগুন লাগিয়ে দেবো এই শেহনাজ মন্জিলে!শেষ করে দেবো সব!
শ্বাস আটকে আসছিলো আমার।শুদ্ধ ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিলেন।খুক খুক করে কাশি শুরু হয়ে গেছে।উনি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বললেন,
-এইটা শেষ কর।আর বিয়ে ভাঙার জন্য জেট বিমানের চেয়েও দ্রুত মাথা চালা।কাল বিয়ে হবে না মানে হবে না।দ্যাটস্ ফাইনাল!
শেষের দুটো লাইন উনি এতোটাই জোড়ে বলেছেন যে চমকে উঠলাম আমি।কথাগুলো বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন উনি।যীনাত আপু ভেতরে আসার আগেই আবারো দরজা লাগিয়ে হুহু করে কান্না শুরু করে দিলাম।এইতো ভাগ্য!যার সাথে বিয়ে,সে মানুষটা কতোটা খারাপ।নিজচোখে দেখে নিলাম তিনবছর পর।গায়ে হাত তুলেছে সে আমার।সে মানুষটা অবশ্য চায়ও না বিয়েটা হোক।আমার পড়াশোনা?স্বপ্ন?জীবনের কোন পথে এগোচ্ছি আমি?
গাড়ি ব্রেক কষতেই বর্তমানে ফিরলাম।কেউ একজন দরজা খুলে মিষ্টি আওয়াজে বললো,
-এসো ভাবি,বাইরে এসো।
নিজেকে স্বাভবিক করে বেরিয়ে এলাম।অনেকগুলোই মানুষ এ বাসায়।কিছু চেনা মুখ,বেশিরভাগই অচেনা।হয়তো সেজোমার বাবাবাসার লোকজন।সেজোমা হুইলচেয়ার নিয়ে সামনেই।সেজোকাকু কাধ ধরে এগিয়ে আনলো আমাকে।পাশ থেকে এক মহিলা বলে উঠলো,
-কি গো নতুন বউ,সেজোমা উরফ্ শাশুড়িমাকে সালাম করো।
এগিয়ে গিয়ে সেজোমাকে সালাম দিলাম।আরেকজন মহিলা বললো,
-ওমা!পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার দিনকাল কি চলে গেলো নাকি?এ যুগের সম্মান প্রদর্শন বুঝিনা বাপু।
কিছু না বলে চুপ থাকলাম।ওনারা ওনাদের মতো বলাবলিতে ব্যস্ত।সেজোমা বললো,
-একমাত্র আল্লাহতায়ালা ব্যাতিত আর কারো সামনে মাথানত করতে নেই।তোমরা ইসলামের মুলকথা ভুললেও আমার বউমা ভোলে নি।আয় ইনসু,ভিতরে আয়।
ওনারা চুপ হয়ে গেলেন।সেজোকাকু মুচকি হাসলেন শুধু।ওখানে আরো কিছু নিয়মকানুন করা হলো।অবশ্য কিছুই টের পাইনি।শুধু যা বলেছে,চুপচাপ করে গেছি।পাশে থেকে একটা মেয়ে আমাকে ধরে বললো,
-চলো ভাবি,ঘরে চলো।আমি হলাম তোমার ননদীনি।নিজের ননদ তো নেই তোমার।আমি শুদ্ধ ভাইয়ার মামাতো বোন।মাহিয়া।মাহি বলে সবাই।চলো তোমাকে তোমার ঘরে পৌছে দিচ্ছি।
ঘর?আমার ঘর?আদৌও কি ঘর?হ্যাঁ,শুধু ঘরই।ইট পাথরে বানানো একটা ঘর!আর সে ঘরে একটা খারাপ মানুষের বসবাস।আজ থেকে ওখানে থাকতে হবে আমাকে।এজন্য শুধুই ঘর!সবটা ঠিক থাকলে হয়তো ওটা সংসার হতো!সে ঘরে কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য তা ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।আমার দুইজন ফুপাতো ভাই,একটা চাচাতো ভাই,দুটো চাচাতো বোনসহ সেজোমার
বাবাবাসার বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে আমাকে নিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে দাড়ালো।চাচাতো বোন তাপসি দরজায় নক করে বললো,
-শুদ্ধ,দরজা খোল।ইনসু ভেতরে যাবে।ওকে নিয়ে এসেছি আমরা।
কোনো আওয়াজ নেই।এক বড় ভাই আবারো নক করলো দরজায়।বললো,
-দরজা খোল শুদ্ধ!নতুন বউ এভাবে বাইরে কতোক্ষন দাড়িয়ে থাকবে?
আমি আছি আমার দুনিয়ায়।নিচদিক তাকিয়ে সবটা ভাবছিলাম।কি থেকে কি হয়ে গেলো!ওদের কথা আর কানে যায়নি।মাহি গলা উচিয়ে বলে উঠলো,
-ইনসিয়া ভাবির মাথা ঘুরতেছে।কতোটা ধকল গেছে।ফ্রেশ হওয়া জরুরি।
ওর দিকে তাকালাম।এ কথা একবারও বলিনি আমি।ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,
-মাহি,সবাইকে যেতে বল।
সবাই শব্দহীন হেসে চলে গেলো।মাহি একবার আমাকে জড়িয়ে ধরে দৌড় লাগালো।কিছু না বুঝে থম মেরে ওর চলে যাওয়াটা দেখছিলাম।হঠাৎই দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকানোর আগেই হেচকা টানে শুদ্ধ ভাইয়া ভেতরে ঢুকিয়ে দুম করে দরজা লাগিয়ে দিলেন।ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে দেখতেই বুকটা ধক করে উঠলো আমার!
#চলবে…
#তোর_নামের_রোদ্দুর
#সুচনা_পর্ব
লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা