#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি পর্ব : ৫
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব : ৫
______

ইউশ্যানের হাসিখুশি দিন চলছে। পরিবারের সাথে সময় কাটানো, তাদের নিয়ে ট্যুরে যাওয়া, প্রিয়তম স্বামীর সান্নিধ্যে ব্যাকুলতা প্রকাশে র‍্যাংকন পর্যন্ত আশ্চর্যান্বিত পর্যায়ে! এই তো কিছুদিন পূর্বেও মেয়েটা তার সান্নিধ্যে কেমন নিস্পৃহতা, অনীহা দেখাত অথচ আজকাল আগ বাড়িয়ে সবকিছু তদারকি করছে, মেয়ের সাথে সময় কাটানো শেষে নিজেদের কক্ষে এসে সুগন্ধি দিয়ে তার নৈকট্য লাভের আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রত হয়ে রয়েছে। বিষয়গুলো লক্ষ করে র‍্যাংকন জিজ্ঞেস করেই ফেলল ভেতরে জমে থাকা প্রশ্ন,

“আজকাল দেখি বড়োই উচ্ছ্বাসিত দেখাচ্ছে তোমায়?”

র‍্যাংকনকে কোট খুলতে সাহায্য করতে থাকা ইউশ্যানের হাত খানিক সময়ের জন্য স্থগিত হয়ে পড়ল। পেছনের কর্মকাণ্ডগুলো একলহমায় চোখের সামনে দ্রুততার সহিত ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ভেসে উঠল। পরক্ষণেই উৎসুকভাব নিয়ে আয়নার মধ্য দিয়ে র‍্যাংকনের তাকিয়ে থাকা দেখে হেসে বিষয়টাকে সহজাত দেখালো।

“কেন উচ্ছ্বাসিত আমায় ভালো লাগছে না বুঝি? তাহলে কি মনমরা হয়ে থাকতে বলছো?”

বলেই খানিক মন খারাপের ভান করল। তা দেখে র‍্যাংকন এগিয়ে গিয়ে দু’হাতের আঁজলায় ভরে নিলো ইউশ্যানের মুখটাকে।

“আরে আমি কি সেটা বলেছি নাকি? বিগত দিনগুলোর ইউশ্যান আর বর্তমান ইউশ্যানের মধ্যে বিস্তর তফাৎ আমাকে অবাক করছে! এটুকুর জন্যেই জিজ্ঞেস করা। তাই বলে রাগ করবে?”

টানটান অত্যাধিক ফর্সা চামড়ার মাঝে একটু গোলাপি আভা জড়ানো ইউশ্যানের নত হওয়া মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে র‍্যাংকনের আজো মনে পড়ে গত হওয়া প্রেমে মত্ত হওয়া সময়কার দিনগুলোকে। কতোই না আবেগপ্রবণ ভরা যৌবন ছিল দু’জনার! ছিলো ক্লাস ব্যাঙ্ক করে পাগলামো ঘেরা লং ড্রাইভ, মাতলামোতে ভরা লেট নাইট ক্ল্যাবের ড্যান্স ফ্লোরে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির নৃত্য চালিয়ে গড়াগড়ি খাওয়া। ভেবেই হাসি পেল তার, স্মিত হাসি ঠোঁটের কোণে খেলেও গেল সাথে সাথে। তা দেখে ইউশ্যান নিজের গালে থাকা র‍্যাংকনের হাত সরিয়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে সরে যেতে যেতে বলল,

“আমি রাগ করলাম অথচ সে হাসছে তা দেখে।”

“আহা! আবারও রাগ!”

বলেই চলে যাওয়া ইউশ্যানের সরু কোমর র‍্যাংকন নিজের বলিষ্ঠ হাতে আবদ্ধ করে বিছানায় ফেলল। চড়াও হলো ইউশ্যানের উপর। কপট রাগের ভানে তীক্ষ্ণ চোখে ভস্ম করার প্রচেষ্টা চালালো ইউশ্যান। অথচ নির্বিকার র‍্যাংকন প্রেমিকাস্বরূপ স্ত্রীর রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত হাতে ন্যস্ত হলো। সবকিছুর মাঝে পুরোনো বিষয়গুলো চাপা পড়ে যেতে দেখে র‍্যাংকনের আড়ালে আলগোছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ইউশ্যান।
______

সমুদ্র নীলাভ পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে দু’জনা। সেই নীলাভ পানির মাঝেই উল্লাসিত হয়ে উচ্ছাসতা নিয়ে একে-অপরকে ভিজিয়ে দেওয়ার দুষ্টুমিতে মত্ত তারা। তারা আর কেউ নয় ইউশ্যান ও র‍্যাংকন। সুইমিংস্যুটে ইউশ্যানের ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে খুঁজে বেড়াতে র‍্যাংকনের ব্যস্ত হাতখানা দুষ্টুমিতে মত্ত হতে নিলেই ইউশ্যান পানির ঝাপটা দিয়ে দূরে সরে গিয়ে খিলখিলিয়ে হেঁসে ওঠে। হাসিতে মত্তা ইউশ্যান হঠাৎই খেয়াল করল কোথাও কেউ নেই, বিরান জলধর। সেখানে নিজ প্রিয়তম স্বামীর পর্যন্ত অস্তিত্ব নেই। কোথায় গেল তার স্বামী? তাদের সুখের মাঝে আনন্দের মাঝে কার কুৎসিত নজর পড়ল? প্রিয় মানুষটা কি হারিয়ে গেল নাকি কারো হাত আছে হারিয়ে যাওয়াতে? একসময় ইউশ্যান চিৎকার করে করে পানির মাঝেই হাতড়ে খুঁজে ফিরে র‍্যাংকনকে।

“র‍্যাংকন!”

“র‍্যাংকন!”

“র‍্যাংকন।”

‘নাহ, স্বপ্ন ছিল তাহলে!’ স্বগোতক্তি করে ইউশ্যানের ঘুম ভাঙল। পাশ ফিরে তার স্বামীকে স্বীয় বিছানায় পেয়ে বুকের মধ্যে চেপে থাকা ভয়টা দূরীভূত হলো। তবুও মনের কোণে খচখচানিটা রয়ে গেল। কোনো কারণবিহীন এমন অদ্ভুত স্বপ্ন কেন এলো এই ভাবনায়।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে ভয়ানক সেই স্বপ্নটা ম্লান হয়ে গেল ক্ষণেক্ষণে। কারণ খুশির আমেজ সেখানে ছেয়ে গেল অফ ডে হওয়ায়। ম্যাশা, র‍্যাংকন ও ইউশ্যান সকলেই আজ বাড়িতে উপস্থিত। সেজন্য র‍্যাংকন ও ইউশ্যান দিনটি উদযাপন করবে প্রফুল্লতার সহিত এমন ভাবনায় সকালের নাস্তা তৈরিতে কিচেনে পদার্পণ করে। দুজনের নাস্তা তৈরির বদৌলতে কিচেনের অবস্থা নাস্তানাবুদ উলটো। ময়দা দিয়ে মাখামাখি অবস্থা দু’জনে সাথে কিচেনও। একে-অপরের এমতবস্থা অবলোকন করে হেসে ফেলল।

যেহেতু অফ ডে তাই এই সুযোগে আজকে গ্রোসারি আইটেম কিনতে শপে যাওয়ার কথা ভাবল ইউশ্যান। বিকেলে র‍্যাংকনকে অবগত করে বাইরে বের হবে এমন সময় ম্যাশা তার মায়ের সাথে যেতে আগ্রহ দেখায় বিধায় ইউশ্যান হেসে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যায় শপের উদ্দেশ্যে। শপে হেঁটে হেঁটে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী নিচ্ছে ইউশ্যান। হাসি-হাসি মুখ করে মাঝেমধ্যে মেয়েকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে হাতের জিনিস দেখিয়ে। ম্যাশাও মায়ের সাথে কথা বলে তাল মিলিয়ে হাঁটছে। হঠাৎই তার চোখ যায় বাচ্চাদের খেলনার জিনিসপত্রের জোনে। এদিকে ইউশ্যানের বেশখানিক পর খেয়াল আসে মেয়ে যে তার সাথে নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে লক্ষ করে অথচ মেয়েকে দেখতে পায় না। খানিক সময়ে মেয়েটা কোথায় গেল? দৌড়ে আশেপাশের স্থানগুলোতে খোঁজে করে ইউশ্যান শব্দ করে মেয়ের নাম ধরে ডেকে ওঠে,

“ম্যাশ! বেবি!”

“ম্যাশা! কোথায় তুমি ডিয়ার?”

কান্নায় ভেঙে পড়ল ইউশ্যান। হৃদয়ের অভ্যন্তর হতে ভয়েরা নৃত্য করে জপলো, মেয়ের কোনো ক্ষতি হলো না তো? শপের মালিকের কানে ঘটনাটা পৌঁছা মাত্রই তিনি সিসিটিভি ফুটেজ দেখার জন্য ইউশ্যানকে বলেন। অন্তত শপ থেকে কিছু হয়েছে কি না জানার জন্য।

বিস্মিত হয়ে বিস্ময়াবহ দৃশ্য অবলোকন করছে বিমূর্তধারী ইউশ্যান। সিসিটিভির ফুটেজে স্পষ্ট এভিগ্রিলকে দেখা যাচ্ছে। যেখানে ইউশ্যান ও ম্যাশা ছিল এবং একই সময়ে এভিগ্রিলের অবস্থান সেখানে; যারপরনাই ভয় ও আতঙ্ক গ্রাস করল ইউশ্যানকে। এভিগ্রিল তাহলে তার উপর এভাবে প্রতিশোধ নিলো! তার মেয়েকে কিডন্যাপ করে!
______

পরীক্ষার রেজাল্টের মার্কসীট টিচার্স রুমের লকারে থাকে, যা কেবল টিচার’দের ব্যতীত অন্যকারো অনুমতি নেই ধরার। সেই লকারের চাবি পর্যন্ত সেখানেই থাকে ঝুলানো অবস্থাতে। কিন্তু ইউশ্যানকে বিষয়টার অসৎ ব্যবহার করতে হয়েছিল, কারো বন্দি হতে মুক্তি লাভের আশায়। এবং লকার থেকে অন্য ছাত্রের মার্কসীট চুরি করে এভিগ্রিলের ব্যাগে রাখতে হয়েছিল সকলের অগোচরেই। বিষয়টা এত দ্রুতই ঘটে যায় যারফলে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখার সময় পান না আর না এমন সাংঘাতিক ঘটনার মাঝেও নিশ্চুপ হয়ে মাথা নত করে থাকা এভিগ্রিলকে কিছু জিজ্ঞেস করার। কারণ দৃশ্যত চোখে এভিগ্রিলের নত মস্তক ও চুপটি থাকা দেখে ভেবে নেন সে-ই দোষী, নাহলে তো তার চ্যাঁচামেচি করার কথা। তাই কোনো ভাবনা না ভেবেই পুলিশ ডাকেন। অবশ্য ছাড়াও পেয়ে যায় সে দুু’দিন পরই, যখন তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। তবে সে আর ভার্সিটি যায়নি। তাই বলে ফিরে এলো ইউশ্যানকে এভাবে হেনস্তা করে প্রতিশোধ নিতে! মুখে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে ইউশ্যান। এক ভুলে কত ভুলের সৃষ্টি হলো! আদৌও ভুল নাহ, পাপ হবে। প্রায়শ্চিত্ত বারেবারে কেন তার ছোট্ট মেয়েটাকে দিতে হয়? এখন কোথায় পাবে মেয়েকে? র‍্যাংকনকে’ই বা কী জবাব দেবে সে? হঠাৎই মনে পড়ল, ভোরের স্বপ্নের কথা। স্বপ্নে তাহলে কারো হারিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল! আর সেটা এটাই হওয়ার সংকেত! সকালের হাসিখুশি সময়ের কথা মনে পড়ল ইউশ্যানের আর এখন সন্ধ্যার সময়টাতে দিনের উজ্জ্বলতা আলোর রাশি ম্লান হয়ে এলো কান্নার করুণ আর্তনাদের সুরে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here