তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ১০

 

বিকালের শেষ প্রহর। ছাদের রেলিং- এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে পাখি সায়রা। দুবোনের হাতে চকলেট। পা ঝুলিয়ে চকলেট খাচ্ছে আর রাস্তা দেখছে। রফিক চাচার বাড়ির সামনে ছোট ভ্যান থেমে। গতকালের ছাদের সেই ছেলেটা বাড়ি বদল করছে। হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো তার। মূলত এই নিয়েই দুবোনের যত আলোচনা। মাসের শুরুতেই বাড়িতে উঠেছে পনের দিন যেতে না যেতেই হুট করে বাড়ি পাল্টাচ্ছে কেন? তার উপর ব্যান্ডেজ লাগানো! বাড়িতে ভূত- প্রেতের উপদ্রব আছে নাকি? এই নিয়ে দুবোনের হাজারো জল্পনা কল্পনা কৌতূহল। সায়রা খোলাচুল এক পাশে এনে রেখেছে। সামনের অবাধ্য ছোট ছোট চুলগুলো দক্ষিণা বাতাসে উড়ছে। অমনি ফোনটা বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করে কানে ধরল সায়রা। ‘হ্যালো’ বলবে তার পূর্বেই অপর পাশ থেকে ধমকের স্বর ভেসে এলো,

— ” ভর সন্ধ্যায় ছাদে কি?”

সায়রা কপাল কুঁচকে নাম্বার দেখল। গতকালকের সেই নাম্বার । আরসাল ফোন করেছে। মাথা তুলে সামনে তাকাতে দেখল, আরসাল ছাদে। এক হাত কানে অন্যহাত পকেটে ঢুকিয়ে স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ব্লাক টি- শার্ট, ব্রাউন থ্রি কটার। মুখে রাগের রক্তিমাভা। সায়রা আমতা আমতা স্বরে বলল,

–” রাস্তা দেখতে এসেছিলাম”

–” কেন এই রাস্তা এর আগে কখনো দেখিসনি? আজ প্রথম দেখছিস? নিজে তো বাঁদর হচ্ছিসই সাথে ছোট বোনটাকেও বানাচ্ছিস! ”

–” আমি ওকে আসতে বলেছি? ও নিজেই তো পিছুপিছু এসেছে।”

সায়রার অসহায় আওয়াজ। আরসাল কাঠিন্য স্বরে বলে উঠল,

–” রাস্তা দেখছিলি নাকি তোর দিওয়ানাকে বিদায় দিচ্ছিলি!”

–” কে দিওয়ানা? ঐ ভাইয়াটা! ওই ভাইয়া কি আপনাকে বলেছে উনি আমার দিওয়ানা?”

–” আমি তো এমনি এমনি বলিনি। বলেছে বলেই বলছি।”

এবার সায়রার রাগ হলো। ইচ্ছা করল ছাদ থেকে ইটা ছুঁড়ে ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। পছন্দ করে তো করে, ভালো কথা। তাই বলে কি এই লোকটাকেই জানাতে হলো? এখন আরসাল ভাই তার জীবন ছারখার করে ফেলবে। এখনো মনে পরে ক্লাস এইটের কথা। একবার আরসাল ভাইয়ের বন্ধু সোহান ভাই সায়রাকে প্রপোজ করেছিল। তাকে আরসাল ভাই যা কেলানোই না কেলিয়েছিল। পরে এ নিয়ে কত ঝামেলাই না হলো। ভাবতেই সায়রার গাঁ শিউরে উঠে।
অপর পাশের ধমকে সায়রার হুশ ফিরে। বিরবির করে বলে,

–” ভাইয়াটার এই অবস্থা কি আপনি করেছেন? কেন করেছেন আরসাল ভাই?”

অপরপাশ থেকে কাঠিন্য আওয়াজ,

–” হ্যাঁ করলে করেছি। কেন? তোর জ্বলছে?”

–” আমার জ্বলবে কেন? আমি তো জাস্ট কারণ জানতে চাইলাম!”

–” আমি তোকে কারণ বলতে বাধ্য নই। আমার পেটাতে ইচ্ছা হয়েছে আমি পিটিয়েছি! ”

সায়রা দমে গেল। সে বেশ ভালো করে জানে আরসালের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। তিনি যুক্তিবিদ্যায় তুখোড়। কিছু তো বলবেই না! উল্টো সায়রাকেই কথার মারপ্যাঁচে ফেলবে।

–” সন্ধ্যা নামছে নিচে যা সায়রা”

সায়রার রাগ হলো। কিন্তু রাগল না। রাগটাকে দমিয়ে ধীর স্বরে বলল,

–” যাচ্ছি”

ফোন কেটে গেল। পাখি পাশ থেকে উৎসুক দৃষ্টিতে একবার আরসালের দিকে তাকাল। তারপর সায়রার দিকে ফিরে উৎসাহী স্বরে জিজ্ঞেস করল,

–” কে ফোন করেছে সায়রাপু? আরসাল ভাই?”

আরসালের নাম শুনতেই সায়রার চেপে থাকা রাগটা পাখির উপর ঝরে পড়ল। চিৎকার স্বরে বলল,

–” জানিনা! তোর এত কিছু জানতে হবে কেন! নিচে চল বেয়াদব মেয়ে ”

সায়রা ধপ করে উঠে দাঁড়ায়। বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। পাখি বোনের কাণ্ডে হা হয়ে আছে। রাগল কেন সায়রাপু? রাগার মত সে কি এমন বলল!

.
রাতে পড়ছিল সায়রা। সামনে সেকেন্ড ইনকোর্স টেস্ট। এমন সময়ই দাদী নুরজাহান বেগম ঘরে এলো। দাদীকে দেখে খানিক অবাক হলো সায়রা। দাদীর সাথে সায়রার সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। কোন প্রয়োজন ছাড়া সচরাচর তিনি এই ঘরে আসেন না। সায়রার সৌজন্য আওয়াজ,

— ” কিছু বলবে দাদী”

দাদী কঠোর স্বরে বলল,

— ” হ্যাঁ! কাল দুপুরে তোর ক্লাস আছে?”

–” নাহ, কাল ক্লাস নেই। শুধু সকালে একটা টিউশন আছে।”

— ” ওহ! কাল কিছু গেস্ট আসবে আরমিনকে দেখতে। তোর টিউশন শেষে বাড়ি ফিরতে হবে না। একদম বিকালে ফিরবি! ”

হতভম্ব হলো সায়রা। বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করল,

–” আপুকে দেখতে আসবে, আমি বাড়িতে থাকলে প্রব্লেম কোথায়!”

নুরজাহান বেগম আক্রোশে বলে উঠেন,

— ” উনারা তোকে দেখে আরমিনকে পছন্দ করবে না। তোর কারণে আগেরবারের মত এই বিয়েটাও ভাঙবে! কে চেইবে সুস্থ মেয়েকে দেখে লুলা মেয়েকে বাড়ির বউ করতে!”

সায়রা প্রতিবাদী সুরে বলল,

–” এভাবে বলছ কেন দাদী? আপু আমার থেকে কোন অংশে কম নয়। যথেষ্ট রূপবতী গুনবতী। বরং আপুর সামনে আমি কিছু না। সামান্য পায়ে সমস্যায়! আপুর রূপ গুন ডাকা পড়বে না।”

নুরজাহান বেগম তেতে যায়। রেগে কঠিন স্বরে বললেন,

–” এইটুকুও কমতি থাকত না। যদি ছোট বেলায় তুই আরমিনকে ধাক্কা দিয়ে সাইকেল থেকে ফেলে না দিতি । তোর কারণে মেয়েটা দুষি। সমাজে এত লাঞ্চনা, তিরস্কার তার!”

নীরবে দীর্ঘশ্বাস লুকালো সায়রা। ছোট করে উত্তর দিলো,

–” ঠিক আছে। টিউশন শেষে নানুবাড়ি চলে যাবো। সন্ধ্যায় ফিরব।”

নুরজাহান বেগম হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। পড়া হলো না সায়রার। বই খাতা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখজোড়া জলে টলটল করছে। যতবার নিজেকে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করে ততবারই অতীত এসে হানা দেয়। অনুতাপ বড্ড বাজে জিনিস একবার পিছু নিলে মৃত্যুর আগ অবধি তা পিছু ছাড়ে না। আজও মনে পড়ে সেই দিন। তখন সায়রার আটবছর বয়স। আর আরমিনের নয়। দুজনের সাইকেলিং- এর শখ ছিল খুব। রোজ বিকালে সাইকেল নিয়ে বের হতো দুবোন। এমনি এক বিকালে গলিতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল। আরমিন সাইকেল চালাচ্ছিল সায়রা তার পাশেই ছিল। আচমকা সামনে থেকে এক প্রাইভেট কার ধেয়ে আসতে দেখে । ঘাবড়ে যায় আরমিন সাথে সায়রাও। ভয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে আরমিন। আরমিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, সায়রা ঘাবড়ে যায়। সাইকেল এক কিনারে আনতে। সাইকেল ধাক্কা দেয় সায়রা। এতে আরমিন সায়রা দুজনই নিচে পরে যায়। সায়রার সামান্য চোট লাগলেও আরমিনের পা ভাঙে! তখন থেকে আরমিন খুঁড়িয়ে হাঁটে। সায়রা তো আরমিনকে বাঁচাতেই এমন করেছিল তবুও কেন এসব হলো। সেদিনের সেই অনুতাপ অপরাধবোধ এখনো গ্রাস করে সায়রাকে। এই জীবনে অনুতাপ থেকে মুক্তি মিলবে কি?

.

গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছে আরসাল। গন্তব্যস্থল বাবা অফিস। যাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। মায়ের অনেক আহাজারি পর যাচ্ছে। গেট থেকে বের হবার সময় গাড়ির কাঁচে টোকা পড়ল। গাড়ির কাঁচ খুলে ভ্রু কুঁচকে বাহিরে তাকাল আরসাল। সামনে মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। পেছনেই মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা আর আরসালের সমবয়সী এক যুবক। সম্ভবত স্ত্রী পুত্র। শিষ্ট স্বরে বলল আরসাল,

–” জি চাচা কিছু বলবেন?”

ভদ্রলোক বললেন,

–” বাবা! মাহির আহমেদের বাড়িটা কোন দিকে?”

আরসালের মাথার টনক নড়ল। দৃষ্টি গাঢ় হলো। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল,

–” আপনারা কারা?”

ভদ্রলোক সৌজন্য হেসে উত্তর দিলেন,

–” আমি উনার স্ত্রীর কলিগ। উনাদের মেয়ের জন্য আমার ছেলের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছি!”

প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো আরসালের। বিনাবাক্যে গাড়ি স্টার্ট করে ফুর করে বেরিয়ে গেল। তার রাগের পরিমাণ এতটাই! ভুলে গেল যে, ঐ বাড়িতে সায়রা ছাড়াও আরো একটা বিয়ে উপযোগী মেয়ে আছে!

চলবে……

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here