তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ৮

 

দখিনের খোলা জানালার পর্দা গুলো উড়ছে। মেঘলা আকাশ। চারিদিক কালো মেঘেদের অন্ধকারে ছেয়ে। কোথাও ঝুম বৃষ্টি নামবে কি? হয়তো! বিছানায় আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছে আরসাল। দৃষ্টি হাতে থাকা আংটিতে সীমাবদ্ধ। গভীর কোন চিন্তায় সে ডুবে। সকাল থেকে মন বড্ড অশান্ত! নিজেকে কেমন যেন এলোমেলো ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। সবকিছু তো আগেরই মত আছে! তবে এই হাহাকার কেন, কেন এই শূন্যতা? সে তো এমনটাই চেয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত সম্পর্কের শেকড় থেকে মুক্তি। তবে এই অস্বস্তি, বুক জ্বালা পোড়া কেন!

.
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। দিনের আলো একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে বাড়ির লাল নীল মরিচ বাতি গুলো পিটপিট করে জ্বলছে । জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। নজর সদর দরজার দিকে। বরযাত্রা রিদ্ধিকে নিয়ে ফিরছে।অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে তাকিয়ে আছে সায়রা। আজকের এই বিশেষ দিনে বোনটার পাশে থাকা হলো না তার। সকালে সেই ঘটনার পর, অস্বস্তি লজ্জাবোধে ঘর থেকে বের হয়নি সে। শরীর খারাপের বাহানা করে রুমেই থেকে গেছে। যাওয়ার আগে রিদ্ধি সায়রার সাথে দেখা করতে এসেছিল। জড়িয়ে ধরে দুবোন খুব কেঁদেছে। ধীরেধীরে গাড়ি সদর দরজা পেরিয়ে, চোখের আড়ালে ছুটে চলল। সায়রা ঠাই সে দিকে তাকিয়ে।চোখ ফিরাতেই আচমকা বাম হাতের অনামিকা আঙুলে নজর আটকায় তার। থমকে যায় সে। বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত শূন্যতায় নাড়া দিয়ে উঠে। আংটির ছাপ এখনো রয়ে গেছে। ভীষণ খালিখালি অনুভব হচ্ছে। অভ্যাস ভীষণ বাজে জিনিস! একবার পিছু নিলে সারাজীবন আঠার মত লেগে থাকে। হয়তো আংটিটা সায়রার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই তো এই শূন্যতা!

–” বিয়ে ভাঙা নিয়ে কি তোর বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই সায়রা! কষ্ট হচ্ছে না তোর?”

আরমিনের কথায় সায়রার হুশ ফিরে। পিছন ফিরে জোর পূর্বক হাসি হাসি মুখ করে বলে,

–” কষ্ট হবে কেন! বরং খুশি হচ্ছে।আজ এতো বছর পর অনুতাপ থেকে মুক্তি পেলাম।”

আরমিনের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। ক্ষীণ দৃষ্টিতে সায়রার দিকে তাকিয়ে। হতভম্ব স্বরে বলল,

— ” আর আরসাল ভাই? উনার কথা একবার ভাবলি না? উনি কি চায় জানতে চাইলি না!”

আরসালের নাম শুনতেই সায়রার প্রচণ্ড অভিমান হলো। গলায় কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে। বারবার উপচে আসতে চাইছে। কন্ঠে একরাশ অভিমান ঢেলে উদাসী স্বরে,

–” ভেবেছি তো! উনার কথা ভেবেই সব করেছি। আরসাল ভাই আমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে আপু! তিনি স্পষ্ট জানিয়েছে আমার সাথে কথা বলা তো দূর, আমার চেহারাও দেখতে চাননা তিনি। সেখানে সারাজীবন এক ছাদের নিচে থাকা অসম্ভব! এতো ঘৃণার ভেতর সংসার গড়া যায়না আপু। বিয়ে হলেও বিচ্ছেদ নিশ্চিত। তাই পূর্বেই দুজনের আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো। অন্তত কারো জীবন তো আর নষ্ট হবে না।তা ছাড়া সবার নিজেস্ব পছন্দ আছে। হয়তো আরসাল ভাইয়েরও আছে! বিনাদোষে এই অনুভূতিহীন সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার কোন মানে হয়না আপু।”

–” এই চারবছরে তুই একবারের জন্যও কি আরসাল ভাইকে ভালোবাসিসনি? ”

সায়রা তাচ্ছিল্য হাসে। দূর আঁধার ঢাকা আকাশে চোখ মেলে তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

–” ভালোবাসা জিনিসটা আপেক্ষিক! যা সবার প্রতি জন্মায় না। না ভালোবাসার উপর জোর খাটানো যায়। আমরা দুজন দুজনার জন্য না। তাই- ই হয়তো ভালোবাসাটাও জন্মায়নি!”

.
সেই ঘটনার পর আরো দুদিন কাটল। এই দুইদিন আরসাল নিজের ঘর থেকে একবারের জন্য বের হয়নি। সারাদিন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। মুনতাহা টাইম টু টাইম তিনবেলা খাবার নিয়ে যায়। মায়ের জোরাজোরিতে কখনো খায় , কখনো আবার ফিরিয়ে দেয় আরসাল। ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখে ভীষণ চিন্তিত তিনি। কি চায় আরসাল? কেন এই রাগ জেদ! ছেলেমেয়েরা যত বড় হয় বাবামায়েদের তাদে্রকে বুঝার ক্ষমতা ধীরেধীরে কমে যেতে থাকে! তাদের মন বুঝতে ততটাই অক্ষম হয়ে পরে। মুনতাহার ভীষণ আফসোস হচ্ছে, কেন যে ছেলেটা বড় হয়ে এমন হয়ে গেল! ছোটই তো ভালো ছিল মায়ের কাছে ছোট বড় সব কথা শেয়ার করতো! মনের সব সংশয় দূর করত।
বিকালের দিকে তুর্জয় বাড়িতে আসে। আরসালের খোঁজ করতেই মুনতাহা তার সকল অভিযোগের ঝুলি খুলে বসে। ছেলের এই অনিয়ত, ঘরবন্ধি থাকায় ভীষণ চিন্তিত তিনি। তিনি ছেলেকে স্বাভাবিক দেখতে চায়। আর কতদিন এই অনিয়ম চলবে? কি চায় সে? স্পষ্টভাবে কেন বলছে না!
ফুপুর কথা শুনে তুর্জয় আরসালের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। দরজায় নক করতেই দরজা খুলে যায়। আরসাল রুমে নেই। বারান্দায় হয়তো!

বিকালের শেষভাগ। পরিষ্কার আকাশ। তুলার মত মেঘরাশি গুলো ছাড়া ছাড়া হয়ে উড়ছে। রক্তিম কমলাবর্ন সূর্যটা পশ্চিমা আকাশে হেলে পড়ছে। বেতের চেয়ারটায় বসে সামনের কাচের টেবিলের উপর পা তুলে কফি খাচ্ছে আরসাল। দৃষ্টি সায়রার বারান্দার বন্ধ দরজায় নিরূদ্ধ। এত চমৎকার মনমুগ্ধকর বিকেল। তবুও আরসালের চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি। তুর্জয় ধপ করে আরসালের সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল। বলল,

–” কংগ্রাচুলেশন! অবশেষে অনিচ্ছাকৃত সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেলি। ট্রিট কবে দিচ্ছিস বেটা?”

এমনিতেই তুর্জয়ের উপর সুপ্ত এক রাগ কাজ করছে আরসালের। সায়রা আশেপাশে তুর্জয় ঘুরঘুর না করলে তার এত রাগ হতো না। না সায়রার সাথে সেদিন বাজে ব্যবহার করত। তুর্জয়ের কথায় আরসালের চেহারার বিরক্তি ভাবটা স্পষ্ট হলো। তুর্জয় লক্ষ করল কিন্তু তোয়াক্কা করল না। বলল,

–” অবশ্য, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। সায়রা দেখতে আহামরি তেমন কিছুনা। ঐ গায়ের রঙ ফর্সাই যা। মেয়েদের সৌন্দর্য চোখ আর হাসিতে। যার কোনটাই সায়রার নাই, ইউ ডিজার্ভ বেটার।”

আরসাল হুংকার দিয়ে উঠে। নির্বেদ দৃষ্টিতে তুর্জয়ের দিকে চেয়ে ঝাঁঝাল স্বরে বলল,

— ” সায়রা যথেষ্ট সুন্দরী, মোহ মায়ায় ঘেরা বাস্তব পুতুল। ওর টানাটানা চোখে অদ্ভুত এক সরলতা আছে। যেই সরলতায় হাজার বছর অনায়াসে ডুবে থাকা যায়। আর হাসি! ঐ মুক্তা ঝরা হাসিতে নেশাকারী কিছু তো আছে, যা দেখার পর চোখ ফেরানো দুষ্কর হয়ে যায়। তাছাড়া কে আমার জন্য বেটার, কে না। তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না তুর্জয়। আমার ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা আছে!”

এতোটুকু বলে আরসাল থামল। রাগে ফোঁসফোঁস করছে। আরসালের বাচ্চাদের মত এমন কাণ্ডে তুর্জয় কিটকিটে হেসে ফেলে। নিজের মনের অনুভূতি গুলো বলছে তাও রাগে গরগর করে।কন্ঠে সামান্যতম আবেগ নেই। এত চড়া মেজাজ কারো কি করে হয়? যে ছেলে নিজের মনের অনুভূতির সাথে অপরিচীত, বদ মেজাজি! এমন ছেলের সাথে কোন মেয়ে বিয়ে ভাঙবে না তো কি করবে?
তুর্জয় হাসি থামিয়ে উৎফুল্ল স্বরে বলল,

–” কংগ্রাচুলেশন ব্রো! ইউ আর ইন লাভ। তুই তোর না মানা এক্স ফিওনসেকে ভালোবেসে ফেলেছিস। তাও প্রচণ্ড! বুঝলি আরসাল, সায়রা তোর গলায় কাটার মত বেজে গেছে এখন না ফেলতে পারছিস, না গিলতে পারছিস!”

প্রত্যুত্তরে আরসাল রেগে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পারল না। থমকে রইল। কয়েক পলক তুর্জয়ের দিয়ে চেয়ে তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে সিগারেট জ্বালাল। গম্ভীর হয়ে ভাবল, তুর্জয় ভুল কিছু তো বলেনি। সত্যিই তো, সায়রা তার গলায় কাটার মত বিঁধে আছে। না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে। তার উপর সায়রাকে নিয়ে এই এলোমেলো ভাবনা। সায়রাকে সে কেন এত ভাবছে? কেন এই অস্থিরতা, শূন্যতা! সত্যি কি সায়রাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে!
আচ্ছা, আমরা মানব জাতি এমন কেন? হারানোর পরেই কেন তার মর্ম বুঝি।

চলবে……

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here