তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ৩৫

গতরাতের ভারী বর্ষনের পর, আজ চকচকে আকাশ। প্রভাতের আলো ভুবনের কোণা কোণা ছুঁয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলল আরসাল। নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করল। কিছুটা চমকাল সে। তবে কি গতরাতে এখানেই চোখ লেগে গেছে! ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় বসল। চারিদিকে একবার সন্ধানী চোখ বুলাল। সায়রা নেই! সায়রা কোথায়? নিচে, কিচেনে! ভাবল আরসাল। কাবার্ড খুলতেই দেখল সবকিছু আগের মতই সুন্দর গোছানো। এই দেড়বছরে কিছুই পাল্টায়নি।সবটা যত্ন করে রেখেছে সায়রা। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আরসাল ফিরবে। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটল আরসালের। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে পৌঁছাল আরসাল। আহনাফ সাহেব, মুনতাহা বেগম আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। ছেলের সাথে সময় কাটাবে বলে আজ অফিসে যাননি। আরসাল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সায়রার তল্লাসী করছে। আশেপাশে কোথাও দেখছে না তাকে, মাকে কি একবার জিজ্ঞাস করবে? বেশ কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তায় কাটিয়ে মুনতাহা বেগমকে প্রশ্ন করল আরসাল,

–” মা সায়রা কোথায়?”

মুনতাহার স্বাভাবিক উত্তর,

–” বোনের বিয়ে, বাবার বাড়িতে গেছে!”

আরসাল তেতে উঠল। রাগী আওয়াজ করে বলল,

–” এতদিন পর আমি বাড়ি ফিরেছি আর ও আমাকে ফেলে বোনের বিয়ে খেতে বাবার চলে গেল? ওর বাবার বাড়ি কি শ’ মাইল দূরে! সাতদিন আগে যেতে হবে তাকে!”

আহনাফ সাহেব খাবার ছেড়ে চোখ উঠিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলেটা শুধরাল না আর, সেই আগের মত লাগামহীনই রয়ে গেল। মুনতাহা বেগমের আগের মত স্বাভাবিক উত্তর,

–” বোনের বিয়েতে বাবার বাড়িতে যাচ্ছে সায়রা, আমি বাঁধা দেব! লোকে বলবে আমি পুত্রবধূর উপর অত্যাচার করি। বাবার বাড়ি যেতে দেই না!”

মায়ের বক্তব্যে আরসালের রাগ বাড়ল। প্রচণ্ড রাগ হলো। শেষমেশ মাও তার সাথে পাল্টি নিচ্ছে, নিশ্চয় আরসালকে জ্বালাতে দুজনের প্লান এসব। রাগী আওয়াজে বলল আরসাল,

–” এখন পুত্রবধূ বলা হচ্ছে! এতদিন তো ঠিক মেয়ে মেয়ে বলে জান দিতে, এখন সবাই মিলে আমার সাথে প্রতিশোধ নিচ্ছ! বদলা নিচ্ছ তাই না?”

মুনতাহা বেগম কিছু বলল না মিটমিট হাসল শুধু। সকালের নাস্তা আর করা হলো না আরসালের। ক্ষিপ্ত মেজাজে খালি পেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

দুপুর দেড়টা। দরজা খুলে আরসালকে দেখে বিন্দুমাত্র চমকাল না সিন্থিয়া বেগম ।আরসাল আসবে তা যেন আগে থেকেই জানতেন তিনি। বেশ সৌজন্য ভাবে স্বাগতম জানালেন আরসালকে। বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসেছে, খালি হাতে তো আসা যায় না! কাঁচা শাকসবজি থেকে শুরু করে, ভাজাভুজি, ফলমূল, রকমারি মিষ্টান্ন কোন কিছু আনতে বাদ রাখেনি আরসাল।
এতকিছু ঘটে গেছে, দেড়বছর কেটে গেছে। আরসাল কিঞ্চিত লজ্জাবোধ করল। সোফায় বসে আশেপাশে চোখ বুলাল। চোখ শুধু সায়রাকেই খুঁজছে। সকাল থেকে একবারের জন্য দেখেনি। কোথায় মেয়েটা? এত জ্বালাচ্ছে কেন তাকে!

বাহিরের হৈ চৈ আওয়াজে ঘুমঘুম চোখে টলতে টলতে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সায়রা। এখান থেকে বসার ঘর স্পষ্ট একদম। সোফার রুমে আরসাল সিন্থিয়াকে বসে থাকতে দেখে, ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। হকচকিয়ে উঠল। চোখের ঘুম কোথাও উড়ে গেল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে গম্ভীর কোন আলোচনা চলছে। এখান থেকে স্পষ্ট কিছু শুনা যাচ্ছেনা। রুমে চলে গেল সায়রা। খট করে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগে বড়বড় শ্বাস ফেলছে আর নখ কামড়াচ্ছে। খানিক বাদে দরজার কড়া নড়ল, বাহির থেকে সিন্থিয়া বেগমের উঁচানো আওয়াজ ভেসে এলো,

–” সায়রা ! আরসাল এসেছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছে, খাওয়া দাওয়া করবি!”

ঘুমের অভিনয় করে, ভাঙ্গা আওয়াজে বলল সায়রা,

–” পরে করবো মা, এখন ঘুম পাচ্ছে আমার! ”

–” সেই সকাল থেকে ঘুমাচ্ছিস আর কত ঘুমাবি তুই? কতক্ষণ হলো ছেলেটা অপেক্ষা করছে!”

সায়রার মুখ থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। গলা উঁচিয়ে ফোঁস করে উত্তর দিলো,

–” উনাকে খেয়ে চলে যেতে বলো, আমার ঘুম হয়নি আমি আরো ঘুমাব!”

বাহির থেকে সিন্থিয়া বেগমের ঝাঁজাল বিরবির আওয়াজ এলো। তোয়াক্কা করল না সায়রা। ফিসফিস করে বলল,

–” এই দেড় বছর অনেক জ্বালিয়েছেন, অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি। এবার কষ্ট পাওয়ার পালা আপনার আরসাল। একচুলও ছাড় দেবনা আপনাকে, হুহ!”

বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল সায়রা। বিকেল সাড়ে চারটা। সূর্যের তাপ তখন নরম হয়ে এসেছে। আকাশে রক্তিম আলোর খেলা। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল সায়রা। প্রিয় বান্ধবী তাইবাকে ফোন করল। আজ বাহিরে খাবে সারা সন্ধ্যা শপিং করে কাটাবে। বেশ সুন্দর করে সেজে তৈরি হয়ে নিলো সায়রা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো। খারাপ না, বেশ ভালোই লাগছে। জুতা জোড়া হাতে তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার বাহিরে তাকাল। কেউ নেই। ড্রইং ফাঁকা। আরসাল চলে গেছে? আলতো পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে। পিয়াসের রুম থেকে শব্দ আসছে। তবে কি উনি পিয়াসের ঘরে? ভাবল সায়রা। কয়েক কদম সামনে যেতেই আরসালকে দেখল সায়রা। পিঠ দেখা যাচ্ছে উনার। বেশ সচেতন পায়ে বাড়ি থেকে নেমে গেল সায়রা। রিক্সায় চড়ে মাকে ফোন করে জানাল, তাইবার সাথে শপিং- এ যাচ্ছে, ফিরতে রাত হবে। রাতের খাবার বাহির থেকেই খেয়ে আসবে! সিন্থিয়া বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কাটল। সুইচ অফ করে ফোনটা ব্যাগে রেখে দিলো।
স্বপ্নের শহর ঢাকা। দিনের আলো থেকে রাতে কৃত্রিম মিটমিট আলোর ঢাকা বুঝি বেশ সুন্দর। এই কৃত্রিম, অপ্রাকৃত জিনিস গুলোতেও যেন মানুষের মত মোহমায়ায় মাখানো। থানা রোডের চারতালা বিল্ডিং- এ এক নামীদামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে সায়রা তাইবা। সায়রার দৃষ্টি সচ্ছ কাচের বাহিরে ব্যস্ত রাস্তায়। ভীষণ সাধারণ দৃশ্যকে এমন গভীর দৃষ্টিতে দেখছে, যেন বিশেষ কিছু! তাইবা বেশ ঠাহর চোখে সায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট থেকে দুজন একসাথে। স্কুল কলেজ একত্রেই ছিল, ভার্সিটিতে একত্রেই আছে। সেই সাপেক্ষে সায়রার রগরগ সম্পর্কে অবগত তাইবা। সায়রাকে এমন আনমনা দেখে প্রশ্ন করল তাইবা,

–” শুনলাম আরসাল ভাই ফিরে এসেছে।”

সায়রার আনমনা উত্তর,

–” হুম”

–” এতদিন যার জন্য এত অপেক্ষা, এত তপস্যা। এখন যখন সেই মানুষটা তোর কাছে ফিরে এসেছে, তাকে এভাবে এড়িয়ে চলছিস কেন? ”

–” কে বলল, এড়িয়ে চলছি? আমি তো পালাচ্ছি!”

–” পালাচ্ছিস! কেন পালাচ্ছিস তুই?”

–” আমার ভয় হয়, প্রচণ্ড ভয় নিজেকে। উনার মুখোমুখি হলে আমার ভিতরের চেপে থাকা রাগ জেদ বড় কোন ঝড়ের রূপ নিয়ে সব তছনছ করে না দেয়!”

তাইবা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল,

–” তুই আরসাল ভাইকে ঘৃণা করিস?”

–” আমার দ্বারা তা অসম্ভব!”

–” এখনো ভালোবাসিস?”

–” প্রচণ্ড, প্রচণ্ড ভালোবাসি! ”

–” তাহলে মেনে নিচ্ছিস না কেন উনাকে?”

–” কি করবো, পারছি না যে ক্ষমা করতে। দেড় বছর অনেক ভুগেছি, অনেক সহ্য করেছি। এখন না পারছি উনার কাছে থাকতে, না পারছি দূরে থাকতে! তাই তো পালাচ্ছি শুধু!”

সায়রার কথায় তাইবা হাসল। মেয়েটা প্রচন্ড জেদি। ভাঙবে তবুও মচকাবে না!

রাত নয়টা। বাস স্ট্যান্ডে রিকশা থেকে নেমে গেল তাইবা। স্ট্যান্ডের পাশেই তার বাড়ি। তাইবাকে বিদায় দিয়ে সেই রিকশায় চলে গেল সায়রা। জ্যামে পড়ে বেশ দেরী হয়ে গেছে। নিশ্চয় মা চেঁচাবে! ভাবল সায়রা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া বইছে। রাতে ঝুম বৃষ্টি নামবে নিশ্চয়! দোকানীরা হুড়মুড় করে দোকান গুছাচ্ছে, বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। রাস্তার ধুলাবালির সাথে নোংরা পলিথিন ব্যাগও বাতাসে উড়ছে। ওড়না দিয়ে মুখ চেপে নিলো সায়রা। বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত নেমে পড়ল সে। আচমকা লোডশেডিং হয়। চারিদিক অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল সায়রা। বিরবির করে বলল,

— ” অসহ্য! এখনি কি লোডশেডিং হওয়ার ছিল!”

ফোনের টচ জ্বালিয়ে। যেই গেটে পা রাখবে অমনি কেউ পেছন থেকে হাত চেপে ধরে। ভয়ে শরীরের রক্ত হিম সায়রার। টচ নিয়ে পিছন ফিরে আরসালকে দেখে ছোট নিশ্বাস ফেলল। খেয়াল করে দেখল- চোখমুখ ভয়ংকর রকম লাল আরসালের। বেশ শান্ত আওয়াজ তার,

–” বাড়ি চল সায়রা”

ধীর আওয়াজে বলল সায়রা,

–” আমি যাবো না, হাত ছাড়ুন !”

বোঝানোর আওয়াজে বলল আরসাল,

–” তুই বাড়ি চল, তোর সব শাস্তি মাথা পেতে মেনে নিবো আমি।”

–” কাউকে কোন শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। হাত ছাড়ুন!”

বলেই হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো সায়রা। সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে হেচকা টান পড়ল। আরসালের বুকে যেয়ে পড়ল সায়রা। সায়রাকে নিজের সাথে শক্তভাবে জড়িয়ে নিলো আরসাল। ফিসফিস করে বলল,

–” আমি তোকে ছাড়া ভালো নেই। একদম ভালো নেই। সারাটা দিন আমার কেমন কেটেছে তোর কোন আইডিয়া আছে? পাগল হচ্ছি আমি সায়রা। জাস্ট পাগল হচ্ছি। আমি তোর অপরাধি! শাস্তি দিবি তো? তোর সব শাস্তি মাথা পেতে নিবো আমি। শুধু তুই বাড়ি ফিরে চল!”

–” মাত্র অর্ধেক দিনে আপনার এই হাল আরসাল? আমি যে দেড়বছর ছটফট করেছি ! … যাকগে, এই রাতে আপনার সাথে কথা বাড়াতে চাইনা। ছাড়ুন আমাকে। অসহ্য লাগছে আমার!”

আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে নিজেকে আরসালের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে নিলো। বড়বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সায়রা। আরসাল পেছনে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সায়রাকে চলে যেতে দেখে পেছন থেকে চিৎকার করে বলল,

–” চলে যাচ্ছিস তো! বেশ! যেই অবধি তুই বাড়ি না ফিরবি আমিও বাড়ি ফিরবো না। আমি এখানেই রাস্তায় তোর অপেক্ষা করব!”

সায়রা পিছন ফিরে ছোট ছোট চোখ করে আরসালের দিকে তাকাল একবার। তারপর পায়ের গতি বাড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

চলবে……

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here