তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৮

থমথমে রাতের আঁধার কাটিয়ে সোনালি ভোরের আলো এসে ছুঁইল ভুবন। ঘুম ভাঙ্গল সায়রার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঘুমে চোখজোড়া লেগে আসছে বারংবার! মাথা চেপে ধরল সে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, মাথা এখনো চিনচিনে ব্যথা করছে। আশেপাশে চোখ বুলাতেই দেখল- খালি বিছানা। বালিশের উপর সায়রার ওড়না রাখা। দ্রুত হাতে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নামার জন্য পা বাড়াল। মাটিতে পা ছোঁয়াতেই চাপা আর্তনাদ করে উঠল। গতরাতের চোট এখনো অনেকটাই কাঁচা। শুখাতে সময় লাগবে। এভাবে হুটহাট চলাচলে চোট গাঢ় হয়ে ইনফেকশন হতে পারে! তাই আলতো করে পা নামাল। আরসাল রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে শাওয়ারের আওয়াজ আসছে। তবে কি উনি ফ্রেশ হচ্ছে? বোধহয়!
অন্ধকার ঘরটায় আবছা আলো। জানালায় ময়ুরপঙ্খীবর্ণ ভারী পর্দার আবরণ। ঘরটা বেগনিলাল বর্ণে রাঙানো। ঘরের একপাশে দেয়াল খোঁদাই করা ছোট লাইব্রেরী, সেখানে নামীদামী দেশবিদেশের বিভিন্ন লেখকের বই। মাঝেই সেগুন কাঠের মেরুন মখমলে মোড়ানো সোনালি রাজকীয় গদি। গদির ঠিক উপরে ছোট সাইজের ঝাড়বাতি, যার টিমটিম আলোয় উজ্জ্বল থাকে চারিদিক! এই জায়গাটা ভীষণ পছন্দের সায়রার। আরসালের অবর্তমানে ঘন্টার পর এই জায়গায় কাটিয়েছে সে। এই ঘরটায় হাজার বার এসেছে কিন্তু আজকের অনুভূতি অন্যসব বারের চেয়ে একদমই ভিন্ন! আজ অনুভূতিটা তিক্তার মাঝে মধুর। ধীর পায়ে জানালার দিকে পা বাড়াল সায়রা। এক ঝটকায় ভারী পর্দা গুলো গুছিয়ে নিলো। সকালে কমল আলো মুখ ছুঁয়ে দিলো সায়রার। আলোর তেজ সহ্য করতে না পেরে বুজে নিলো আঁখিদ্বয়। ভ্রু দ্বয় কুঁচকে এলো। পেছন থেকে একজোড়া হাত কোমর চেপে ধরল সায়রার। আচমকা শীতল পরশে কেঁপে উঠল সে। ঘাড় ফেরাতে গিয়ে পারল না সে। পেছনের মানুষটার উন্মুক্ত বুকে আটকাল। গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা বলে দিচ্ছে, এটাই তার চিরচেনা অতিপরিচীত মানুষটা! আরসাল! যার সাথে গতরাতে তিন কবুল পড়ে বিয়ে হয়েছে সায়রার।
অকস্মাৎ কোমর চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরসাল। সায়রার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে আলতো করে কানে ঠোঁট ছোঁয়াল। আরসালের ভেজা চুলের চুপসে পড়া বিন্দু বিন্দু পানি ঘাড়ে পড়ছে সায়রার। শিহরণে কেঁপে উঠল সে। আবেশে চোখ বুজে নিলো!

–” গুড মর্নিং বউ!”

পেছন থেকে আবেগ মাখা গাঢ় কন্ঠ আরসালের। প্রত্যুত্তর করল না সায়রা। অপেক্ষা করল না আরসাল। ধাঁ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো সায়রাকে। সায়রার চোখ তখনো বন্ধ। আঁখি পল্লব ভেজা। সায়রাকে কোলে তুলে পাশের ডিভাইনটায় বসল। সায়রা ছাড়া পাবার জন্য মোচড়ামুচড়ি করলে শক্ত করে কোমর চেপে ধরল আরসাল!
আলতো হাতে গাল ছুঁয়ে দিয়ে, মুখ টেনে নিজের কাছে আনল। ম্লান স্পর্শে গাল ছুঁইছে বারংবার! চিন্তিত মুখ করে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে,

–” কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? পায়ে কি ব্যথা করছে? প্রচুর! ”

দুদিকে মাথা নাড়াল সায়রা। যার অর্থ ‘না , ব্যথা করছে না!’। কপালে চিন্তার রেখা গুছল আরসালের। সায়রার অগোছালো চুল গুলো কানের পেছনে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

–” তাহলে ফ্যাচফ্যাচ কাঁদছিস কেন? ”

সায়রা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। নাক টানতে টানতে বলল,

–” আমাকে কেন বিয়ে করলেন? খুব কি প্রয়োজন ছিল?”

চমকাল আরসাল। হতভম্ব দৃষ্টিতে কয়েক পলক সায়রার দিকে তাকিয়ে থাকল। এত অবুঝ কেন মেয়েটা! এত অবুঝ হওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল! একটু বুঝদার স্বার্থপর হলে কি ক্ষতি হতো?
আরসাল আগের মত গম্ভীর আওয়াজ করে বলল,

–” হ্যাঁ, প্রয়োজন ছিল। অত্যন্ত প্রয়োজন! নিশ্বাস নেওয়াটা যেমন প্রয়োজন তেমনি তোকে আমার জীবনে প্রয়োজন! নিজেকে তুই কি মনে করিস? উদারতার দেবী! উদার মনে বোনের জন্য আমাকে ছাড়ছিলি?”

–” আপনি আমাকে ভালোবাসেন এটা যেমন সত্য, আপুর প্রতি আমার ভালোবাসাটাও ঠিক ততটাই সত্য! আজ আরমিন আপুর আরো সুন্দর জীবন হতে পারতো। শুধু আমার করা একটা ভুলের জন্য আজ আরমিন আপু সবার দৃষ্টিতে দোষী! এই অনুতাপ আমি কি করে গুছাব!”

–” তোদের দুবোনের ভালোবাসা- বাসিতে আমার স্থানটা কোথায় সায়রা? তোদের ভালোবাসা! তোদের অনুতাপ- অনুশোচনা! এসবের মাঝে আমার ভালোবাসা দমে গেল? আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নাই?”

চুপ রইল সায়রা। আরসাল উত্তরের অপেক্ষা করল। মিলল না! বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল আরসাল,

–” আমি জানি তুই আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসিস! তুই না বললেও তোর ঐ সরল চোখ তা বলে। তোকে জোর করে আদায় করার ইচ্ছা ছিল না আমার। রাজরানি সাজিয়ে আমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসাতে চেয়েছি! কিন্তু…
আমার তোকে হারানোর ভয় ছিল সায়রা। ছোট থেকে দেখে দেখে বড় করলাম আমি! শেষমেশ আমার চোখের সামনে দিয়ে অন্যকেউ নিয়ে যাবে? এত সহজ! এখন সব ভাবাভাবি বাদ। এখন থেকে তুই শুধু আমাকে ভাববি। শুধুই আমাকে!”

ততক্ষণে মাথা নুয়ে নিয়েছে সায়রা। আরসাল বিছানায় সায়রাকে বসিয়ে দিলো। বড় কাবার্ডের ভেতর থেকে দুইটা ব্যাগ বের করে সায়রার হাতে ধরিয়ে দিলো। বলল,

–” এখানে শাড়ি কামিজ দুইটাই আছে বাকি গুলা কাবার্ডে , যেটা ভালো লাগে পর!”

–” কখন কিনলেন এসব?”

–” তোর প্রথম পরিক্ষার পরের দিন”

হতভম্ব চেয়ে থাকল সায়রা। তার মানে সেদিনের সাবধান বানী এমনি এমনি ছিল না! সব কিছু প্রি- প্লান করা ছিল। কাল জাস্ট বোমার মত ফাটিয়েছে। একেই বুঝি, ঠান্ডা মাথার খুনি বলে!
আরসাল ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। সায়রা ব্যাগ থেকে কামিজ বের করে সামনে ধরল। দেখে মনে হচ্ছে একদম ঠিকঠাক সাইজ । এত পার্ফেক্ট সাইজ উনি জানল কি করে! কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় সায়রা!
আরসাল আয়নায় সায়রার বিস্মিত মুখ দেখে বাঁকা হেসে বলল,
–” ডোন্ট ওয়ারী পার্ফেক্ট সাইজ।”

বলেই চোখ টিপল আরসাল। হাত থেকে সাথে সাথে কামিজ বিছানায় পড়ল। লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলো সায়রা। মুখের উপর এই ভাবে কেউ লজ্জা দেয়? লোকটার লজ্জাশরম কম বলে কি , সায়রাও কম নাকি! বিরবির করে বলল সায়রা,

–” আপনি অসভ্য! চরম নিলজ্জ!”

আরসাল সায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,

–” একটু বের হচ্ছি! তাড়াতাড়ি ফিরব। তোর যা যা প্রয়োজন কাবার্ডের প্রথম তাক- এ আছে। সাবধান! বেশি হাঁটা চলা করতে হবে না। বেশি খারাপ লাগলে ফোন করবি আমাকে”

সায়রা বাচ্চাদের মত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
সায়রার ফোন গতকাল আবারো ভেঙেছে আরসাল। তাই পকেট থেকে একটা ফোন বের করে সায়রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–” পাসওয়ার্ড তোর বার্থডেট!”

.

গাছে পানি দিচ্ছিল মুনতাহা বেগম। নাস্তা শেষে এটা উনার নিত্যদিনের কাজ। খুরিয়ে খুরিয়ে মুনতাহা বেগমের পেছনে দাঁড়াল সায়রা। অপরাধি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মনে মনে কথা গুছাচ্ছে। কোথা থেকে শুরু করবে, কি বলে শুরু করবে। আচ্ছা, বড় মাও কি তার উপর রেগে!
পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে। ঘাড় ফিরে তাকাল মুনতাহা। সায়রাকে দেখে প্রফুল্ল কন্ঠে বললেন,

–” চোট নিয়ে ছাদে আসতে গেলি কেন? দেখি দেখি পায়ের কি অবস্থা এখন।”

বলেই পা দেখতে লাগলেন। আফসোস কন্ঠে বললেন,

–” ইশ কতটা কেটেছে। এত নড়াচড়া করতে কে বলেছে তোকে! আবারো রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। তুই বড় হলি না সায়রা! বাচ্চামো এখনো রয়েই গেল!
চল, নিচে চল ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।”

শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল সায়রা,

–” এত কিছু হয়ে গেল! তোমার আমার উপর রাগ হয় না বড়মা?”

মুনতাহা বেগম মিহি হাসলেন। বললেন,

–” রাগ হবে কেন? আমি জানি যা হয়েছে এতে তোর কোন দোষ নেই। আমার রগচটা ছেলেরই দোষ। সেই তোকে জোর করে বিয়ে করেছে তা নিসন্দেহে বলতে পারি। এতে অবশ্য আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি সবসময় চেয়েছি তুই আমার আরসালের বউ হ। একমাত্র তুই- ই যার সামনে আমার এই রগচটা ছেলেটা দুর্বল। আমার ছেলেটা অল্পভাষী, রগচটা ঠিকঠাক অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনা। কিন্তু সে তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সায়রা। কোনদিন আমার ছেলেটার মনে কষ্ট দিস না। এটা তোর কাছে এক মায়ের আবদার!”

সায়রা মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিলো। এই মানুষটা এত বুঝে কেন সায়রাকে!

চলবে……..

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here