তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৬

ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। চোখ উঁচিয়ে একবার ফোনের দিকে চোখ বুলাল সায়রা। গোটাগোটা অক্ষরে লিখা ‘ Arsal calling’। খানিক বিরক্ত হলো। উনি আবার পাগলামো শুরু করল? আবারো! এবার ভাঙ্গলে নিজেকে কি করে শক্ত করবে সায়রা? বুকে আটকে রাখা নিশ্বাসটা ফোঁস করে বেরিয়ে এলো। আর মাত্র একটা পরিক্ষা। আগামীকালের পরিক্ষা শেষ হলেই ঝামেলা মুক্ত। মনে মনে সিদ্ধান্ত এঁটেছে সে, এবার পরিক্ষা শেষে বেশ কয়েকদিনের জন্য নানীর বাড়িতে বেড়াতে যাবে। এতে দুটো লাভ, প্রথম মন ভালো থাকবে! দ্বিতীয়ত আরসাল থেকে দূরে থাকা যাবে বেশ কয়েকদিন। এসব ভাবনার মাঝেই চুল গুলো হাত খোপা করে নিলো সায়রা। চেয়ারে দুপা তুলে আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলো। দরজায় কারো কড়া আঘাতে টনক নড়ল সায়রার। বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে, দরজার দিকে মেলল। দাদী এসেছেন। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি টেনে ধীর স্বরে বলল সায়রা,

–” কিছু বলবে দাদী?”

নুরজাহান বেগম ভিতরে এসে সায়রার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসল। চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এঁটে আছেন তিনি। দাদীর এমন গম্ভীর ভাব দেখে বই খাতা গুছিয়ে রাখল। ভীতু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

–” কিছু কি হয়েছে দাদী? আরমিন আপু ঠিক আছে তো?”

নুরজাহা বেগম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,

–” সব ঠিক আছে, তোর সাথে কিছু কথা ছিল!”

–” হ্যাঁ দাদী বলো”

–“আর কয়টা পরিক্ষা আছে?”

–” আগামীকাল শেষ।”

–” তোর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। উনারা দুএকের ভেতর আসতে চাইছে। তোর কি মতামত! ”

দাদীর কথা গুলো গরম শিশার মত সায়রার কানে ঢুকল। মাথায় যেন বাজ পড়ল তার।হতভম্ব, বিস্ময়ে থম মেরে গেছে। নিজেকে সামলে ঝটপট জবাব দিলো সে,

–” বিয়ে? হুট করে বিয়ে কেন? পড়াশোনা শেষ হোক ভালো চাকরী পাই তারপর না হয় বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে!”

দাদীর দাম্ভিক উত্তর,

–” বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যায়। আর রইল চাকরীর কথা! এমন তো নয় যে তোকে চাকরী করে বরকে খাওয়াতে হবে। এখন বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”

মাথা নুয়ে মাটিতে পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল ঘষছে সায়রা। গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন সে। দাদী এখন কি বলে আটকাবে সে? নুরজাহান বেগম আগের মত গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,

–” তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?”

সায়রা ঘাবড়াল, ভড়কাল। পিটপিট দৃষ্টি মেলে একবার দাদীর দিকে চাইল। নুরজাহান বেগমের দৃষ্টি পূর্বের মতই কঠোর, শক্ত। সায়রাকে নিশ্চুপ দেখে, নুরজাহান বেগম ধমকে বললেন,

–” আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি সায়রা! তোর কাউকে পছন্দ? ”

বেশ কিছুক্ষণ নীরব কাটল। সায়রা কিছু ভেবে চেয়ারে পোক্ত ভাবে বসে, গলা ঝেড়ে নীরবতা কাটিয়ে বলে,

–” আমি আরসাল ভাইকে ভালোবাসি দাদী। উনিও আমাকে ভালোবাসেন।”

নুরজাহান বেগমের বিস্ময় আকাশ চুম্বী। চোখে মুখে ক্রুদ্ধতার আভা স্পষ্ট। নুরজাহান বেগম কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন তার পূর্বেই বলে উঠে সায়রা,

–” কিন্তু! কিন্তু আমি চাইনা এই সম্পর্কটা সামনে আগাক।ভবিষ্যৎ এ কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক। আমার আর আরমিন আপু মাঝে কোন দ্বন্দ্ব হোক! এই সম্পর্ক এখানেই ইতি টানা উত্তম! যদি তোমার আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, তুমি বিয়ের সম্বন্ধের ব্যাপারটা সামনে আগাতে পারো। আমার কোন আপত্তি নাই। শুধু একটু সময় প্রয়োজন!”

দাদীর চুপচাপ ক্ষীণ দৃষ্টিতে বেশকিছুক্ষণ সায়রাকে দেখলেন। মনে মনে কিছু একটা ভেবে আলতো হাসলেন। যেন উনার অনুমান ঠিক ঠিক মিলেছে! কপালের দুশ্চিন্তার বলিরেখা গুলো মিলিয়ে গেল। সন্তুষ্ট মেজাজে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন তিনি। দাদীর শান্ত স্বভাবে বেশ অবাক হলো সায়রা। এত বড় এক ঘটনা জানার পরও দাদী এত শান্ত? ব্যাপারটা বেশ ঘাপলা লাগল তার।

.
রিক্সার জন্য রাস্তার পাড় দিয়ে হাঁটছে সায়রা। এই রোডটা একদম ফাঁকা, জনশূন্য, নিরিবিলি। শেষের পরিক্ষা হওয়ায় ডিপার্টমেন্টের সবাই ছোট করে গেটটুগেদারের আয়োজন করেছে। সায়রা যাবেনা যাবেনা বলেও, বান্ধবীদের পিড়াপীড়িতে যেতে হচ্ছে তাকে। সবাই অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। শুধু সায়রাই পিছনে পড়েছে। কাঁচা রাস্তা ছেড়ে পাকা রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই, আচমকা ছোঁ করে এক গাড়ি এসে থামল। গাড়িটা চিন্তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না সায়রা। আরসালের গাড়ি। গাড়ির মালিকের রক্তিম দৃষ্টি লক্ষ করে আঁতকে উঠল সায়রা। পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকল আরসাল। শুনল না সায়রা। না দেখার মত করে, দ্রুত পা চালাল। এতে আরসাল আরো বেশি ক্ষেপে গেল। গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে সায়রার পাশে এসে দাঁড়াল সে। হাত চেপে নিজের দিক ফিরিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

–” ডাকছি আমি! কথা কানে যাচ্ছে না তোর?”

সায়রা থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা সে। নীরবে শুধু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আরসাল জোর গলায় আবারো ধমক দিয়ে বলল,

–” এভাবে বাইম মাছের মত মোড়ামুড়ি করছিস কেন? সোজাসুজি দাঁড়া! আমার ফোন ধরছিলি না কেন? সমস্যা কি তোর! শুনলাম বিয়ে করতে রাজি হয়েছিস।”

সায়রা থামল। পিটপিট করে আরসালের দিকে দৃষ্টি মেলল। আরসাল স্থির দৃষ্টিতে ঠাই তাকিয়ে। দৃষ্টি সরিয়ে বলল সায়রা,

–” আমার আপনাকে পছন্দ না। আপনি তা বুঝেন না কেন? আর তাছাড়া বিয়ের বয়স হয়েছে আমার। বিয়ে করব, বরের সাথে ঘুরবো, বাচ্চা হবে, বাচ্চা নিয়ে খেলব! তাতে আপনার সমস্যাটা কোথায়?”

আরসাল নিস্তব্ধ চেয়ে বেশ শান্ত স্বরে আওড়াল,

–” এটাই কি তোর শেষ কথা?”

উত্তর দিলো না সায়রা। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।আরসাল কয়েক বার ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ফেলে, আগের মত শান্ত স্বরে বলল,

–” আপসে না পেলে ছিনিয়ে নিবো তোকে। এর পর যা যা হবে সবকিছুর জন্য তুই দায়ীই।”

কিছু বুঝবার আগে আরসাল সায়রার হাত বেঁধে, মুখে কস্টিপ লাগিয়ে দিলো। সবকিছু যেন পূর্ব পরিকল্পিত। স্তম্ভিত রইল সায়রা। কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু স্পষ্ট বেরিয়ে এলো না কিছু। সায়রাকে কাঁধে তুলে ফ্রন্ট সিটে সিটবেল্ট চাপিয়ে বসিয়ে দিলো। ছাড়া পাবার জন্য জোরাজুরি করল সায়রা। পারল না। চোখ জোড়া থেকে ক্লান্তিহীন অশ্রু ঝরছে। নিজেকে ছাড়ানো আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু বিফল! আরসালের সামনে সায়রা সকল প্রচেষ্টা বিফল।

 

.
রাত নয়টা। মাথায় লাল ভারী ওড়না। হাতে লাল চুড়ি। খোলা কেশ। গায়ে ভীষণ সাদামাটা থ্রিপিস। এমন সাদামাটা বিয়ের কনে কাজী সাহেব এই প্রথম দেখছেন। খানিক পূর্বেই আরসাল সায়রার বিয়ে হয়েছে। কাজী সাহেব কনের মুখ দেখেই বুঝেছে বিয়েতে কনের মত নেই। জোরপূর্বক, হুমকি ধমকি্তে হচ্ছে। কাজী সাহেব প্রথমে বিরোধ করতে চাইলে, মোটা অংকের সম্মানি দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয় আরসাল! কাজী সাহেব এতে মহা খুশি। আনন্দে সালাম করতে করতে বিদায় নিয়েছেন। এখন ঘরটা পুরোপুরি খালি। আরসালের বন্ধুবান্ধব বাকি সবাই বাহিরে চলে গেলে। ঘরে শুধু আরসাল আর সায়রা। মৃদ্যু আলো জ্বলছে ঘরটায়। সায়রা কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। চোখ জোড়া ফুলে রক্তিম হয়ে আছে। টপটপ অশ্রুকণা গাল বেয়ে ঝরছে। সামনের চেয়ারটায় বসে আছে আরসাল। দৃষ্টি বেশ শান্ত স্থির । নিশ্চুপ সায়রার কাণ্ড দেখছে। সায়রার ফোনটা আরেকবার বেজে উঠতেই মাটিতে সজোরে আছাড় মারল আরসাল। বিকট শব্দ হয়ে কয়েক খণ্ডে ছড়িয়ে পড়ল। ঘাবড়ে গেল সায়রা। অটোমেটিক কান্না বন্ধ হয়ে গেল। আরসাল সামনের দিকে চেয়ার টানল। ভয়ে পিছন সরে গেল সায়রা। থরথর কাঁপছে সে। এই চেনা মানুষটাকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে তার। এই দৃষ্টিতে আজ ভয়ংকর জেদ চেপেছে। যেই জেদ সবকিছু তছনছ করতে সক্ষম! চোখের জল মুছে দিয়ে সায়রার মুখোমুখি বসল আরসাল, দৃষ্টি মিলিয়ে!
গম্ভীর কন্ঠে বলল,

–” এভাবে কাঁদছিস কেন? যা হবার হয়ে গেছে। এখন আইনি ভাবে তুই আমার বউ সায়রা। তোর উপর শুধু আমার অধিকার!”

সায়রা হতভম্ব। শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। আরসাল সায়রার হাত টেনে নিজের কাছে আনল। বুকের সাথে বেশ গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে কানের কাছে নাক ঘষতে ঘষতে ফিসফিস আওয়াজ করে বলল,

–” এখন না আছে অনিশ্চয়তা, না আছে হারানোর ভয়। এখন তুই শুধু আমার! শুধুই আমার!”

চলবে……..

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here