তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ১৯
এত ভোরে সায়রাকে ছাদে দেখে নুরজাহান বেগম বিস্মিত। সন্দিহান দৃষ্টিতে সায়রাকে দেখছে তিনি। দেয়ালের কোণঘেঁষে জড়সড়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। চোখ মুখ ভয়ে চুপসে গেছে তার। নুজাহান বেগমের ভ্রু কুঁচকে এলো। যেই মেয়ে বেলা দশটার আগে বিছানা ছাড়ে না সেই মেয়ে এত সকালে ছাদে! নিশ্চিত কোন কাণ্ড ঘটিয়েছে! নুরজাহান বেগম কঠোর মুখ করে সন্দিহান স্বরে প্রশ্ন করল,
–” এত সকালে ছাদে কি তোর? কারো আওয়াজ পেলাম। তুই একাই নাকি সাথে অন্যকেউ ছিল! ”
থতমত খেয়ে গেল সায়রা। তার জানামতে তার দাদী তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী। মুখ দেখে পেটে খবর বলে দিতে পারেন তিনি। কৃত্রিম হেসে জড় স্বরে উত্তর দিলো সায়রা,
–” ক..কই, কেউ নেই তো। আমি একাই। ঘুম ভেঙেছে তাই ভাবলাম একটু ছাদে হাঁটা হাঁটি করি। ভোরে হাঁটাচলা করলে শরীর সুস্থ থাকে। জানো তো দাদী?”
নুরজাহান বেগমের যেন উত্তরটা পছন্দ হলো না। সন্দেহ রয়েই গেল। গম্ভীর স্বরে আওড়াল,
–” হাঁটা হাঁটি, জ্ঞান দেওয়া শেষ হলে, যাহ্! নিচে যেয়ে চিনি ছাড়া আঁদা চা কর।”
সায়রা বাধ্য মেয়েদের মত মাথা নাড়িয়ে দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। সায়রার যাওয়ার দিকে নুরজাহান বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আজ সায়রার চেহারায় অন্যরকম এক খুশির ঝলক। কিছু তো অবশ্যই ঘটেছে। এসব ভাবনার মাঝে নুরজাহান বেগমের চোখ আটকাল রফিক সাহেবের বাড়ির গেটে দিকে। রফিক সাহেবের বাড়ি আর সায়রাদের বাড়ি পাশাপাশি। এ ছাদ থেকে ওই ছাদের দূরত্ব খুব একটা নয়। অনায়াসে এই ছাদ ডেঙে ওই ছাদে যাওয়া যায়। রফিক সাহেবের বাড়ির গেট দিয়ে আরসালকে বের হতে দেখে নুরজাহান বেগমের সন্দেহ আরো গাঢ় হলো।
চা করে ঘরে ফিরে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল সায়রা। ক্লান্ত শরীর। অশান্ত মন। সারারাত জাগার পরও দু চোখের পাতায় ঘুম নেই তার। বারেবার হাতের আংটি দেখছে। আর লজ্জায় লাল হচ্ছে তার গাল। তখনকার আরসালের বলা কথা গুলো এখনো কানে বাজছে সায়রার। এত মারাত্মক কেন উনি? এই অল্পভাষী লোকটা যে এত গভীর অনুভূতি নিয়ে কথা বলতে জানে তা জানা ছিল না তার। আরসালের স্বীকারোক্তি সায়রার স্রোতহীন শান্ত জীবনটায় অনুভূতির ঝড় তুলে দিয়েছে। প্রতি মুহূর্ত সেই কথা গুলো মনে করে লজ্জায় অনুভূতিতে ভেতরে ভেতরে থরথর কাঁপছে সায়রা। ভেতরের এই কাঁপুনি যদি দেখা যেত তাহলে সবাই ভাবত সায়রা পারকিনসন রোগে আক্রান্ত। ভেবেই হেসে ফেলল সায়রা। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে লাজুক হেসে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে আরসালের অস্থির আওয়াজ ভেসে এলো,
–” দাদী কিছু বুঝে ফেলেনি তো?”
–” উহু, মর্নিং ওয়াকের বাহানায় কাটিয়ে দিয়েছি।”
অপর পাশের অস্থিরতা কমে এলো। শান্ত আওয়াজ ভেসে এলো,
–” আমি আজই মাকে তোদের বাড়ি পাঠাবো”
বিস্ময়ে সায়রার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। তড়িৎ গলায় বলে উঠে,
–” কেন?”
— তোর বাড়ির লোক যা শুরু করেছে! সারাক্ষণ তোর চারদিকে স্পাইয়ের মত ঘুরঘুর করে। এভাবে প্রেম হবেনা। তার চেয়ে বরং বউ করে বাড়ি এনে, চোখের সামনে বসিয়ে তৃপ্তি জুড়ে দেখব তোকে!”
আরসালের অধৈর্য স্বরে সায়রা লাজুক হাসল। হাসি চেপে ধীর স্বরে বলল,
–” আপনার বউ হতে আমার বয়েই গেছে!”
–” তুই হবি তোর ঘাঁড়ও হবে!”
–” এটা কেমন কথা?”
অপর পাশ থেকে উত্তর এলো না। আরসালের ঘন ঘন নিশ্বাসের আওয়াজ ভেসে এলো। সায়রা নীরবতা ভেঙে নিজ থেকে বলল,
–” এখন কাউকে কিছু জানাতে হবে না। দুই পরিবারের সম্পর্ক আগের রূপে ফিরে আসুক তারপর…”
–” তারপর জানাবো? এত দেরী!”
সায়রার কথা কেটে অস্থির কন্ঠে বলে উঠে আরসাল। সায়রা মুখ টিপে আবারো হাসল। মানুষটা এত অধৈর্য কেন? এত অধৈর্য তো আগে ছিল না। প্রেমে পড়েছে বলেই কি এত অধৈর্যতা!
আরো মিনিট দশেক কথা হলো দুজনের। এক পর্যায় আরসাল বলল,
–” গতরাত নির্ঘুম কেটেছে, এখন একটু রেস্ট নে।”
সায়রা দুদিকে মাথা দুলিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,
–” আচ্ছা”
ফোন কাটতেই ঘড়ির দিকে তাকাল সায়রা। দেখল – পাঁচটা চল্লিশ বাজতে চলছে। আজ ভার্সিটিতে পিঠা উৎসব সাড়ে এগারোটায় যেকোনভাবেই হোক ভার্সিটিতে থাকতে হবে তার। আসাযাওয়া বাদ দিয়ে এখনো হাতে চার ঘন্টা সময় আছে। তিন ঘন্টার একটা ঘুম দেওয়া যাবে, তারপর উঠে ভার্সিটির জন্য তৈরি হবে। যেই ভাবা সেই কাজ ফোনে এলার্ম লাগিয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল সায়রা।
গলির থেকে বেরিয়ে সামনে বাসস্টপে দাড়িয়ে আছে সায়রা। আরমিন অনেক আগেই বেরিয়েছে। সিনিয়র হওয়ায় তার কাঁধে সব দায়িত্বের ভার। তৈরি হয়ে বের হতে হতে দেরী হয়ে গেছে সায়রার। মাথা উপর সূর্য। তেজস্বী আলোয় ভাপসা গরম পড়েছে। কালো জামদানির আঁচল ধরে মুখের সামনে পাখার মত নাড়াচ্ছে সায়রা। পর পর দুদিন বন্ধ থাকায় রাস্তাঘাট ব্যস্ত প্রচুর। খালি বাস রিক্সা কোনটাই মিলছে না। সায়রা বারবার এদিকওদিক তাকাচ্ছে। রাস্তার মাঝে শাড়ী পরে সাজসজ্জা করে সঙ সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে একটুও ভালো লাগছেনা তার। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। আজকের দিনেই সব রিক্সা বাসকে লাপাত্তা হতে হলো? তার উপর এই ভাপসা গরম। ঘেমে ধুয়ে একাকার হচ্ছে সে। আচমকা দ্রুতগতিতে সায়রার সামনে একটি গাড়ি এসে থামল। ভয়ে কেঁপে উঠল সায়রা। রেগে তেড়ে সামনে এগোতেই থমকে গেল সে। রাগ মাটিতে পড়ল। গাড়ির মালিক আরসাল। ভ্রু কুঁচকে সামনের এগিয়ে আসল সায়রা। ভারী মুখ করে বলল,
–” এভাবে কেউ গাড়ি চালায়? এখনি গাড়ির চাকার নিচে পড়তাম! খুন করার প্লান করছেন নাকি বলুনতো?”
আরসাল ঠোঁট মেলে চওড়া হাসল। নিমিষ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
–” আপাতত তোর এই লুকে আমি খুন হচ্ছি সায়রা!”
লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো সায়রা। আরসাল আবারো বলল,
–” আমিও ভার্সিটিতে যাচ্ছি। গাড়িতে উঠ। দুজন এক সাথে যাই!”
সায়রা নাকচ করল। এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
–” গলির কেউ দেখলে ঝামেলা হবে। শুধু শুধু কথা রটাবে। তারচেয়ে বরং আপনি যান, আমি রিক্সায় করে আসছি।”
আরসালের গম্ভীর আওয়াজ,
–” আশেপাশে কেউ নেই। আর তাছাড়া কেউ দেখলে বা কথা রটালেই বা কি! মিথ্যা তো নয়।”
–” আমি আপনার মত এত সাহসী না। আমার বাড়ির কেউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে। বিশেষ করে দাদী। দাদী জানলে কথা শুনিয়েই মেরে ফেলবে।”
–” কেলেঙ্কারিকে এত ভয় পাস কেন তুই। যা কেলেঙ্কারি হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমি মরে গেছি তোর ওই চোখে।”
সায়রা ইতস্ততবোধ করল। কুণ্ঠিত হয়ে নজর নামিয়ে মাটির দিকে চেয়ে সায়রা। আরসাল তাড়া দিয়ে বলে উঠল,
–” তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে! মেইন রোডে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো। পেছনে জ্যাম লেগে যাচ্ছে তো।”
সায়রার নাকচ শুনল না আরসাল। বাধ্য হয়ে আরসালের সাথে যেতে রাজি হতে হলো সায়রার। আরসাল গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। সায়রা এদিকওদিক তাকিয়ে দ্রুত পায়ে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলছে তার নিজ গতিতে। সায়রা উঠার পর থেকে বাহিরে তাকিয়ে। এক বারের জন্যও আরসালের দিকে তাকাচ্ছে না সে। আড়চোখে আরসাল সায়রাকে দেখে যাচ্ছে। সায়রার পরনে কালো শাড়ি, হালকা সাজসজ্জা , খোলা চুল। আর কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামে ল্যাপটে থাকা অবাধ্য চুল। সব মিলিয়ে অসামান্য সুন্দরী লাগছে সায়রাকে।যেন গ্রীষ্মের ক্লান্ত দুপুরে এক ছিটে বৃষ্টি! বারবার কোন এক ঘোরে চলে যাচ্ছে সে। কোন এক ভয়ংকর নেশা মাথা চেপে ধরছে। সায়রার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণে প্রমত্তা হচ্ছে বারে বার। নিজেকে শক্ত করতে যেয়েও পারছে না সে। সায়রার কপালে লেগে থাকা ঘাম মুছার জন্য টিস্যু বক্সটা এগিয়ে দিলো আরসাল। কাঁপাকাপাঁ হাতে নিয়ে নিলো সায়রা। নেওয়ার সময় আরসালের হাতে হাত লাগায় কেঁপে উঠল সে। গলা শুকিয়ে কাঠ। আরসালের সাথে একা বন্ধ গাড়িতে ভাবতেই নার্ভাসনেসে নিশ্বাস আটকে আসছে তার। আচমকাই আরসাল সায়রার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে উঁচু করে, গাঢ় এক চুমু এঁকে দিলো, সায়রার ডান হাতের পল্লবে।অনুভূতি , অস্থিরতায় কেঁপে উঠল সায়রা। সারা শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ দৌড়চ্ছে। আশেপাশে কোন কিছুর খেয়াল নেই তার। নিশ্বাসের উঠা নামা দ্রুত বাড়ছে। সায়রা চোখ মুখ খিঁচে লজ্জায় আড়ষ্টতায় মিয়িয়ে গেল। হাত ছাড়ানো চেষ্টা করল। পারল না। আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরল আরসাল। সায়রার দিকে ঝুঁকে আরসালের ফিসফিসিয়ে গভীর আওয়াজ,
–” অনেকদিনের লোভ ছিল এই হাত ছোঁয়ার। আজ ছুঁয়ে দিলাম! ”
চলবে…….