তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ১৪

অসুস্থতার কথা শুনে সায়রাকে দেখতে এসেছে রিদ্ধি সায়ন। গতকালই হানিমুন থেকে বাড়ি ফিরেছে তারা। বেশ কয়েকদিন সমুদ্র পাহাড় ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত দুজন। গতকাল নিজ ঠিকানায় ফিরেছে। সায়রাকে মোটামুটি সুস্থ দেখে রিদ্ধি বায়না ধরেছে আজ সন্ধ্যায় তারা ঘুরতে বের হবে। রাতের খাবার সেরে সেখান থেকে রিদ্ধিদের বাসায় যাবে। প্রথমে সায়রা রাজি হলেও আরসালের যাওয়ার কথা শুনে সে নাকচ করল। রিদ্ধি তা দেখে বিরক্ত হলো সামান্য ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,

–” এত ঢং করছিস কেন সায়রা? কত করে বলছি গেলে কি হয় তোর?”

বিরক্তিতে মুখ থেকে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো সায়রার। কপাল কুঁচকে বলল,

–” ওহ আপু! তুমি বুঝছ না ব্যাপারটা।”

–” কেন যাবি না তুই? কি সমস্যা বল আমাকে?”

সায়রা বিরক্তির চোখে কয়েক পলক রিদ্ধির দিকে তাকিয়ে থাকল। কি বলবে রিদ্ধিদিকে যে তোমার বন্ধু সাথে যাচ্ছে, তাই যাবো নাহ? এটা শুনলেই কি রিদ্ধিদি ক্ষান্ত হবে? উহু, একদম না! ক্ষান্ত তো হবেই না বরং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সায়রাকে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করবে!
সায়রা অসহায়ত্ব সুরে বলে উঠে,

–” আমি না গেলে হয়না রিদ্ধিদি? পাখি পিয়াস আরমিন আপুতো যাচ্ছেই!”

রিদ্ধি মুখ ফিরিয়ে অভিমানী সুর টেনে বলল,

–” হ্যাঁ ,হ্যাঁ কেন যাবি তুই? আমার বিয়ে হয়ে গেছে এখন তো আমি পর হয়ে গেছি। তাই না?”

রিদ্ধির অভিমান ভারী মুখখানা দেখে সায়রার মায়া হলো। পেছন থেকে রিদ্ধিকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বলল,

–” আচ্ছা আর অভিমান করতে হবে না। আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি! কেমন? ”

রিদ্ধির ঠোঁটে ইয়া বড় এক হাসি ফুটে উঠল। খুশিতে গদগদ করে বলল,

–” সত্যি তুই যাবি সায়রা?”

–” হ্যাঁ সত্যি যাবো! এবার খুশি তো?”
— ” অনেক খুশি!’

.
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজতেই তৈরি সবাই। নিচে বাড়ির সামনে গাড়িতে সায়ন আরসাল অপেক্ষা করছে। তুর্জয় হসপিটাল থেকে সরাসরি রেস্টুরেন্টে চলে যাবে। পাখি পিয়াস আগে আগেই নিচে নেমে গেছে। আরমিন সায়রা রিদ্ধি নিচে নামবে, এমন সময়ই দরজার সামনে নুরজাহান বেগমের মুখোমুখি হলো তারা। নুরজাহান বেগমকে দেখে সকলের মুখ থমথম হয়ে যায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দেখছেন তিনি। আরমিনকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন নুরজাহান বেগম,

–” এই ভর সন্ধ্যায় এত সাজগোজ করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

আরমিন চুপ। উত্তরে সায়রা আমতা আমতা করে বলল,

–” রিদ্ধিদির বিয়েতে আমি ছিলাম না। তাই সায়ন ভাইয়া আমাদের সবাইকে ট্রিট দিচ্ছে। বেশি রাত করব না, ঘন্টা তিনেকের মধ্যে ফিরে আসবো! আমার যাই দাদী?”

উমেদ কণ্ঠে বলল সায়রা। নুরজাহান বেগম পা থেকে মাথা পর্যন্ত কঠোর চোখে দেখে নিলো সায়রাকে। ধমকে উঠলেন আরমিনকে,

–” কার থেকে জিজ্ঞেস করে বের হচ্ছিস তুই?”

আরমিন নত স্বরে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল,

–” মামীমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নানুমা। মামীমা যেতে বলেছেন।”

–” তোর মামীমা যেতে বলেছে বলেই তোকে যেতে হবে? কি ভাবছিস তুই কেন যেতে চাইছিস আমি তা জানিনা?”

আরমিন ঘাবড়ে গেল। চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। ভয়ার্ত স্বরে আমতাআমতা করছে সে। তা দেখে সায়রা বিনয়ী কন্ঠে বলল,

–” তুমি আপুকে কিছু বলো না দাদী। আমরাই আপুকে জোর করেছি। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়না। একটু বাহিরে বের হলে ভালোলাগবে! আমরা যাই? ”

রিদ্ধিও সায়রার সুরে তাল মিলাল,

–” তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আমি নিজে আরমিন পাখি পিয়াসকে বাড়ি পৌঁছে দিবো! ”

নুরজাহান বেগম যেন শুনেও শুনল না। আরমিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–” এক্ষুনি ঘরে যেয়ে কাপড় পাল্টা। কোথাও যাবিনা তুই!”

সায়রা অফুটন্ত স্বরে আওড়াল,

–” প্লিজ দাদী!”

নুরজাহান বেগম আগের তুলনায় দ্বিগুণ রাগী স্বরে বললেন,

–” সাথে নিতে চাইছিস কেন? লোকজনের সামনে তামাশা বানাতে? তুই খুব সুন্দরী আর ও অসুন্দর প্রতিবন্ধী তা দেখাতে? ও লুলা ওর কোথাও যাওয়ার অধিকার নাই।”

সায়রার দাদীর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা হলো। সেই সাথে রাগও। কারো চিন্তাভাবনা এত নিম্ন কি করে হতে পারে? সায়রার উপর চাপা রাগ জেদ আরমিনের উপর দেখাচ্ছে? মাঝেমাঝে মনে হয় উনি আরমিনের আপন নানী তো?
সায়রা টু শব্দ পর্যন্ত করল না। রাগ চেপে টলটল চোখে কয়েক পলক দাদীকে দেখল। তারপর হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পিছুপিছু রিদ্ধিও।

গাড়িতে ধপ করে উঠে বসল সায়রা। কার গাড়িতে, পাশে কে রাগের মাথায় কোন কিছুই তার খেয়াল হলো না। রাগে অনুতাপে তার চোখ টলটল করছে। আরসাল পাশ ঘুরে স্টিয়ারিং- এ এক হাত ঠেকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সায়রাকে দেখছে। পরনে সায়রার রোজী রেড ফুল হাতার কামিজ। পাতলা জর্জেট ওরনাটা গলার কাছাকাছি থেকে শুরু করে সারা গা নিভৃত ভাবে জড়িয়ে। হাত দুটো ওরনার ভাজে মোড়ানো। ঢেউ খেলা চুল গুলো কোমর অবধি জড়ানো। মুখে তেমন কোন প্রসাধনী নেই। হাল্কা লিপস্টিক। আর চোখে গাঢ় কাজল। ফর্সা মুখশ্রীতে রক্তিমাভা ছেয়ে।বড় বড় আঁখি দ্বয় জলে টলটল করছে। মুখে রুষ্টতা অভিমান স্পষ্ট! কি হয়েছে তার?
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল আরসালের। সায়রাকে শান্ত স্বরে কয়েকবার ডাকল। শুনল না, সায়রা। গভীর কোন ঘোরে মগ্ন সে। দিশাহারা হয়ে আরসাল চট করে সায়রার হাত টেনে নিজের কাছে আনল। হুশ ফিরল সায়রার। মাথা তুলে আরসালের দিকে তাকাল সে। আরসালকে দেখা মাত্র আতকে উঠল সে। হাত ছাড়াতে চেষ্টা করল। আরসাল ছাড়ল না। দ্বিগুণ শক্ত করে হাত চেপে ধরল। দুজনের দৃষ্টি মিলল। আরসাল অশান্ত স্বর,

–” কি হয়েছে তোর? মন খারাপ কেন? কেউ কিছু বলেছে?”

আরসালের কথায় সায়রা নরম হলো। দুর্বল চোখে আরসালের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। আচমকা আরসালকে জড়িয়ে ধরল সায়রা। চোখে বেঁধে রাখা কান্নার বাঁধ অঝোরে গাল বেয়ে নামল। হুহু করে কেঁদে উঠল সায়রা। অনেক সময় এমন হয়, নিজেদের খারাপ লাগা কান্নাটাকে লাখ চেষ্টা করে আটকে রাখি। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেদের শক্ত করে রাখি। যখনি কেউ সহানুভূতির হাত বাড়ায় অমনি চেপে থাকা কষ্ট মান অভিমান গুলো ভেঙে গুড়িয়ে পড়ে। সেই মানুষটার বুকে মাথা রেখেই যেন অশান্ত মন শান্ত হয়। হোক না সে আপন কিংবা পর!
আরসাল স্থব্দ, বিস্মিত কিংকত্র্তব্যবিমূঢ়! কাঁদছে কেন সায়রা? বুকে হাঁতুড়ি চলছে তার। সায়রা কান্নায় তার নিশ্বাস বুজে আসছে। এখনি বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে। আরসালের ঘোর কাটল সায়রার ফোঁপানো কান্নায়। আরসালের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সায়রা। সায়রার কান্না ভারী তপ্ত নিশ্বাসে আরসালের বুক চৌচির! আলতো হাতে সায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আরসাল। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

–” কি হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন! ”

কোন উত্তর এলো না। সায়রা আগেরই মত কেঁদে যাচ্ছে। আরসাল আগের মত আদুরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে,

–” আরে বাবা! না বললে বুঝব কি করে হয়েছে কি?”

বেশ কিছুক্ষণ নীরব কাটল। খানিক পর আরসালের বুক থেকে আড়ষ্ট মিহি আওয়াজ ভেসে এলো,

–” আমি কি খুব খারাপ আরসাল ভাই? সবাই আমাকে এত বেশি ঘৃণা করে কেন?”

আরসাল চুপ। সায়রার মন খারাপের কারণ যাই হোক। এই অভিযোগ যে আরসালকেও ঘিরে তা আরসাল বেশ বুঝছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আরসাল বলল,

–” জীবনের কিছুকিছু ইন্সিডেন্ট হয় যখন আমরা ঠিক ভুলের পার্থক্য করতে পারিনা। চোখের সামনে যা দেখি তাকেই ঠিক মনে করি। অপর পিঠের সত্যতা পরিস্থিতি সরলতা যাচাই করিনা। নিজেদের রাগ জেদে এতটাই অন্ধ হয়ে যাই যে ঠিক- ভুল, সত্যি- মিথ্যে, ন্যায়- অন্যায় সব ভুলে যাই। নিজেদের রাগের বহিঃপ্রকাশ করতে, সামনের মানুষটাকে কষ্ট দিতে কঠোর শব্দের প্রয়োগ করি। তাই বলে এই না যে সামনের মানুষটা সত্যিই খারাপ। বা কথা গুলো মন থেকে বলছে! ”

সায়রার কান্না ততক্ষণে থেমেছে। আরসাল নিজের বুক থেকে সায়রার মুখ তুলল। চোখের জল মুছে। সায়রার দু গালে নিজের দু হাত রাখল। কন্ঠে এক সমুদ্র আবেগ নিয়ে ফিসফিস স্বরে বলল,

–” তুই মোটেও খারাপ না সায়রা। ভীষণ ভালো। তোর এই চোখের সরলতায় এতটাই শক্তি আছে যে, যেকোনো অশুভ ব্যক্তি এই চোখে তাকালে শতভাগ শুদ্ধ হতে বাধ্য!”

আরসালের কথায় সায়রা কোন এক অচিন ঘোরে চলে গেল। এই দিনদুনিয়ার কোন হুশ নেই তার। সামনের মানুষটার কথার মুগ্ধতায় জড়িয়ে গেছে সে। এই মানুষটাকে কঠোর হৃদয়ের মানুষ বলেই জানত সায়রা। আজ এই মানুষটার চোখে এত আবেগ এত অনুভূতি কেন? কেন এত আবেগ অনুভূতির সংমিশ্রণ!
আরসাল আবারো বলে উঠল,

–” কে কি বলল, না বলল, তা নিয়ে একদম ভাববি না সায়রা। তোকে সবাই ভালোবাসে বাবা, মা, ছোট বাবা, ছোট মা , পাখি পিয়াস সবাই। তুই…

–” আর আপনি?”

আরসালের কথা কেটে আনমনে বলে উঠল সায়রা। সে নিজেও জানে না আনমনে কত গভীর প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। আরসাল কয়েক মুহূর্ত সায়রার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল। সায়রার এই গভীর দৃষ্টিতে অস্বস্তি লাগছে তার। ঘামছে সে। নিশ্বাসের উঠানামা বাড়ছে। কিছু বলতে চেয়েও নিজেকে সংযত করে নিলো আরসাল। সায়রা থেকে সামান্য দূরে সরে চুপচাপ গাড়ি স্টার্ড দিলো।

 

চলবে……..

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here