তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ১৩
ব্যস্ত শহর। থানা রোড পাড় হয়ে, চত্বরের কাছাকাছি হাসপাতালটার সামনে রিকশা থামল। চারিদিকে কোলাহল পরিবেশ। সায়রা মায়ের হাত ধরে রিকশা থেকে নামল। শরীর ভীষণ দুর্বল। গতকাল রাত থেকে ছেড়ে ছেড়ে জ্বর। গলির মোরের ডিসপেনসারি থেকে ঔষধ নেওয়া হয়েছে, সেই ঔষধে কাজ হচ্ছে না। জ্বর কমার কোন নাম নেই। উল্টো গা কাঁপিয়ে ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসছে। ডক্টর দেখিয়ে মাকে বাহিরে দাঁড়াতে বলে তুর্জয়ের কেবিনে চলে গেল সায়রা। তুর্জয় কেবিনেই ছিল। আজ সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত তার ডিউটি। মিনিট দশেক পর বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হবে সে। এমন সময়ই দরজায় নক পড়ল। সামনে সায়রাকে দেখে খানিক চমকায় সে। এক গাল হেসে বিস্মিত স্বরে বলে,
–” আরেহ! সায়রা যে। এই সময় এখানে কি করে?”
সায়রা দুর্বল হেসে। সামনে এগিয়ে বলে,
–” ডক্টরের কাছে এসেছিলাম। গতরাত থেকে সর্দি জ্বর। কিছুতেই কমছে না।”
–” ডক্টর কি বলল! সিরিয়াস কিছু?”
–” না তুর্জয় ভাই তেমন কিছুনা। সিজনাল জ্বর। কিছু ঔষধ দিয়েছে। বলল সেরে যাবে।”
–” ওহ!”
সায়রা বিস্তৃত হাসল। তুর্জয় রুষ্ট মুখ করে বলল,
–” আমি তোমার উপর ভীষণ রেগে সায়রা! তুমি দিনদিন মীরজাফর হয়ে যাচ্ছ। এতবড় এক কাণ্ড ঘটল আর তুমি আমাকে জানালে না? লুকালে! ”
সায়রার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। ভাবুক কন্ঠে বলে উঠল,
–” কি লুকালাম তুর্জয় ভাই?”
তুর্জয়ের গম্ভীর উত্তর,
–” কাল ছেলেপক্ষ আরমিনকে দেখতে এলো তুমি আমাকে জানালে না কেন?”
সায়রা কিছু একটা ভেবে বলল,
–” আপনি কি আরমিন আপুকে নিয়ে সিরিয়াস?”
তুর্জয় ফিচেল হেসে উত্তর দিলো,
–” শতভাগ সিরিয়াস। তোমার কি মনে হয় আমি এমনি এমনি তোমার বোনের পিছন টাইমপাস করছি? আমার প্রথম আর শেষ ভালবাসা কেবল আরমিন।”
সায়রার মন খারাপ হলো। সে এতদিন ভেবেছিল তুর্জয় ভাই হয়তো মজা করছে। তাইতো তেমন গভীরে যায়নি। বাড়িতে আরমিনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে তুর্জয়কে জানায়নি। কাল যদি সত্যি সত্যি বিয়েটা ঠিক হয়ে যেত তখন? তখন কি করত সে? দুর্বল স্বরে বলল সায়রা,
–” আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো মজা করছেন। আপুকে নিয়ে তেমন সিরিয়াস না। তাইতো কিছু জানাইনি।”
তুর্জয় উত্তর দিলো না। সায়রা আবারো জিজ্ঞেস করল,
–” আপুকে এত ভালোবাসেন। বলছেন না কেন তাকে?”
তুর্জয় দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল,
–” বলবো । তার আগে কিছু কাজ আছে তা গুছিয়ে নেই। তারপর নিজের মনের কথা আরমিনের সামনে তুলে ধরব। আরমিন যেই সিদ্ধান্ত নিবে তা মাথা পেতে মেনে নিবো।”
সায়রা সহমত হলো। মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
–” আপনার সব সিদ্ধান্তে পাশে আছি তুর্জয় ভাই। আশাকরি আরমিন আপুর সিদ্ধান্ত আপনার ভালোবাসার পক্ষেই হবে।”
তুর্জয় মুচকি হাসল। দুজন টুকটাক কথা বলছিল। সায়রা বের হতে নিলে তুর্জয় বলল,
–” এখন কি সোজা বাড়ি যাবে? চলো আমি তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আসি।”
সায়রা কিছু বলবে এমন সময়ই আচমকা দরজা খুলল। দরজার দিকে তাকিয়ে দুজন দেখল- আরসাল দাঁড়িয়ে। মুখশ্রী রাগে রক্তিম। সায়রা ঘাবড়ে গেলেও তুর্জয় বেশ স্বাভাবিক। রাগে ফোঁস উঠল আরসাল,
–” তোর ডক্টর তো দুতলায়! তুই এখানে তিন তলায় কি করছিস?”
সায়রা আমতাআমতা করে বলল,
–” তুর্জয় ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল একটু! ”
আরসাল রাগে দ্রুত পা চালিয়ে সায়রার সামনে এলো। সায়রার হাত টেনে নিজের কাছে আনল। কপালে হাত ছুঁয়ে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
–” গায়ে এখনো জ্বর আছে। ছোটমা বাহিরে অপেক্ষা করছে। বাড়ি যা , বাড়ি গিয়ে রেস্ট নে।”
–” কিন্তু….”
–” কোন কিন্তু না। এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি না করে সোজাসুজি বাড়ি যা।”
সায়রা মন খারাপ হলো। ভেবেছিল ফেরার পথে সামনের মোরের থেকে ফুচকা খেয়ে নিবে কিন্তু এখন তা আর সম্ভব না। তাই মন খারাপ করে তুর্জয়কে বলল,
–” আপনি কি এখন বাড়ি ফিরবেন তুর্জয় ভাই?”
তুর্জয় কিছু বলবে তার পূর্বেই আরসাল খ্যাঁক করে উঠল। রেগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল,
–” তুর্জয় তোর সাথে যাবে কেন? ওর কি আর কোন কাজ নেই? আমার তুর্জয়ের সাথে কথা আছে, তুই ছোট মায়ের সাথে বাড়ি যা।”
আরসালের পজেসিভনেস দেখে তুর্জয় ঠোঁট চেপে হাসল। জেলাসি স্পষ্ট আরসালের মুখে ভেসে। আরসাল মানুক, না মানুক সে সায়রাকে ভালোবাসে। আরসালের সায়রার সাথে বলা প্রত্যেক কথা ,কাজ ,রাগ ,জেদ সবকিছু প্রকাশিত অপ্রকাশিত সব ভাবে বলে যে সে সায়রাকে ভালোবাসে। দূর থেকে যেই কেউ বলবে আরসাল সায়রাকে প্রচন্ড ভালোবাসে!
সায়রা আরসালের দিকে পিটপিট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এই মানুষটা গণিতের কঠিন সূত্রের মত দেখতে সহজ সুলভ কিন্তু ব্যাখ্যা করতে গেলে ভীষণ কঠিন, সায়রা ভাবল। মনে মনে বিরবির করল,” সকালে তো ঠিক ছিল এখন আবার কি হলো! সকালে এক সন্ধ্যায় আরেক! হু।”
আরসালের জোর ধমকে সায়রার হুশ ফিরল।
–” কি হলো! এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এক্ষুণি বাড়ী যা।”
সায়রা দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। সায়রা বেরিয়ে যেতেই আরসাল তুর্জয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
–” সমস্যা কি তোর? সায়রার সাথে এত কিসের কথা? ওর সাথে তোর কিসের সম্পর্ক?”
তুর্জয়ের বেশ স্বাভাবিক উত্তর,
–” কোন গভীর সম্পর্ক থাকলেই যে কথা হবে নয়তো হবে না এমন কোথাও লিখা আছে? যেমন তোর আর সায়রার সম্পর্কটাই দেখ, গত চারবছর তোদের কত গভীর সম্পর্ক ছিল সায়রা তোর ফেয়ান্সি ছিল এই চারবছর তোদের একবারের জন্যও কথা হয়েছে? হয়নি তো।”
আরসালের রাগে মেজাজ খারাপ হচ্ছে আগের বারের চেয়ে দ্বিগুন ক্ষিপ্ত হয়ে ধমকে বলল,
–” এখানে আমার সায়রার সম্পর্কের কথা আসছে কোথা থেকে?”
তুর্জয় মুচকি হাসল। বলল,
–” তোর এত রাগ হচ্ছে কেন? কারণ তুই এখনো মানতে পারছিস না সায়রা আর তোর নেই। ভেঙ্গে গেছে সম্পর্কটা। কেউ না কেউ তার জীবনে আসবে।”
আরসাল চিৎকার করে তুর্জয়ের কলার চেপে ধরল। ভয়ংকর রেগে গেছে সে। ভারী স্বরে আওড়াল,
–” সায়রা থেকে দূরে থাক! ওকে নিয়ে কোন প্রতিযোগিতা না! ও একান্তই আমার!”
তুর্জয় ফিচেল হেসে শার্টের কলার ছাড়িয়ে নিলো । দূরে সরে গেল।
–” ভয় নেই আরসাল ,আ’ম নট ইন্টারেস্টেড! আমি অন্যকাউকে শুদ্ধতার সাথে ভালোবাসি। কিন্তু কেউ না কেউ তো অবশ্যই সায়রার জীবনে আসবে। তখন কি করবি? তাকেও এভাবে শাসাবি? নাকি মারধর করবি? নিজের আরাধ্য জিনিস নিজের কাছে যত্নের সাথে রেখে দে। হারিয়ে চিরকাল আফসোস করে কি লাভ?”
আরসাল চুপ থাকল। কোন উত্তর না দিয়ে হনহন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
.
সায়রা বিছানায় গা এলিয়ে বসে ছিল। কিছু খেতে ভালো লাগছে না। মুখে ভীষণ অরুচি। জ্বরে তেতো মুখ কিছু দিতেই বেরিয়ে আসতে চায়। ভেবেছিল মায়ের সাথে বাহিরে বেরিয়েছে তৃপ্তি করে ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু তা আর হলো কই? তার উপর এত গুলা ঔষধ! এমনিতেই ছোট থেকে ঔষধ তার ভীষণ অপছন্দ। ঘ্রাণ শুকলেই গা গুলিয়ে আসে। এমন সময় ছোট ভাই পিয়াস ছুটে এলো। হাতে তা বড়সড় এক ব্যাগ! ভ্রু কুঁচকে এলো সায়রার। সন্দিহানে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
–” এই ব্যাগে কি?”
পিয়াস উত্তর দিলো না। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করল। সায়রা সন্দিহান বিস্মিত হয়ে তা দেখছে। পিয়াস হাপাচ্ছে। তা দেখে দেখে সায়রা আবার জিজ্ঞেস করল,
–” কিরে, বললি না এই ব্যাগে কি? আর তুই বা কেন হাপাচ্ছিস ?”
পিয়াস ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বিছানায় বসল। যেন রাজ্যের সব কাজ সে একা হাতে সেরে এসেছে। সায়রা তখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। পিয়াস বলল,
–” জানিস, তোর জন্য কত কষ্ট করেছি? মায়ের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি!”
সায়রা বিস্মিত স্বরে আওড়াল,
— ” আমার জন্য? আমার জন্য আবার কি কষ্ট করলি!”
পিয়াস ব্যাগটা সায়রার দিকে এগিয়ে দিলো। ক্লান্ত স্বরে বলল,
–” আরসাল ভাই এই গুলা তোর জন্য পাঠিয়েছে! বলেছে- কারো কাছে যেন না বলি। সোজা তোর হাতে পৌঁছে দেই! ”
আরসাল ভাই আবার কি পাঠাল। কিছু পাঠানোর কথা তো নয়। সায়রা দ্রুত হাতে ব্যাগ খুলল। প্রথমেই দেখল একবক্স চকলেট পেস্ট্রি। সায়রা অবাক হলো। বাকি জিনিস আনপ্যাক করতেই দেখল- ভিতরে ফুসকা বক্স, এক বক্স বড় ক্যাটবেরী চকলেট এবং নামকরা দোকানের বিরিয়ানিও আছে। সব সায়রার পছন্দের জিনিস।
কিছুক্ষণ থম মেরে রইল সায়রা। এসব কেন পাঠিয়েছে আরসাল ভাই? বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে রইল সায়রা। বিস্ময় কাটিয়ে সায়রা পিয়াসকে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
–” উনি এসব দিয়েছে বলেই তোর আনতে হবে?
–” আমার কি দোষ? আমি আনতে চেয়েছি? আরসাল ভাই জোর করে দিয়েছে। আর বলেছে আমাকে নতুন গেম কিনে দিবে।”
সায়রা বিরক্তির সুরে বলল,
–” আর তা শুনে তুই নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলি? ”
সায়রা তখনো রাগি দৃষ্টিতে পিয়াসের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবে। ঘোর কাটল ফোনের টোনে। মেসেজ এসেছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরসাল পাঠিয়েছে।
” জ্বর হলেই তোর মন ফুসকা জন্য আকুম বাকুম করে তা জানি। আর ঔষধের সাথে তো তোর আবার পুরানা শত্রুতা। ভণিতা না করে চুপচাপ খাওয়া দাওয়া করে ঔষধ খেয়ে নে! বুঝেছিস? ”
সায়রা চট করে আরসালকে ফোন করল। দুবার রিং বাজতেই ফোন তুলল আরসাল। আরসালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সায়রা দুশ্চিন্তার সুরে গটগট করে বলতে শুরু করল,
–” আপনি কি পাগল হয়েছেন আরসাল ভাই? এসব কেন পাঠিয়েছেন? কেউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আপনাকে এসব পাঠাতে কে বলেছে? আমি পিয়াসকে নিচে পাঠাচ্ছি এগুলা নিয়ে যান!”
অপর পাশ থেকে রাম ধমক পড়ল। ক্ষিপ্ত আওয়াজ ভেসে এলো,
–” এখন কি আমি তোর ইচ্ছায় শ্বাস ফেলব? আমি কি করব না করব তোকে বলে করতে হবে। আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি পাঠিয়েছি। চুপচাপ খেয়ে নে। একদম চালাকি করার চেষ্টা করবি না সায়রা । পিয়াস তোর সামনেই আছে।আমাকে আপডেট জানাবে। আমার কথা না শুনলে, এর পর যে কেলেঙ্কারি হবে তা সামাল দিতে তোর…”
সায়রা চট করে ফোন কাটল। ভয়ে শ্বাস উঠানামা করছে তার। আরসাল ভাইকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে সত্যি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। যা সামাল দিতে সায়রার জীবন কাটবে।
চলবে……..
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।