তোমাকে

পর্ব 4.2

দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস সবে শুরু হয়েছে I সবার মধ্যে একটা ঢিলেঢালা ভাব I কারোরই তেমন মনযোগ নেই ক্লাসে I সবাই চাইছে রেজাল্ট হওয়ার আগেই পিকনিকে যেতে I ফার্স্ট ইয়ারে গাজিপুর পিকনিক হয়েছিল I এবার সবাই একটু দূরে কোথাও যেতে চাইছে I হাসিব অবশ্য একটু বেশি দূর ভেবে ফেলেছে I আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যান স্যারের কাছে গিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার আবেদন করে ফেলেছে I স্যার হ্যাঁ না কিছুই বলেননি I ফান্ডিং এর অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেছেনI হাসিব ফিরে এসে বলল

দোস্ত স্যার তো পিছলায়া গেল

মনির নিজেও যেতে চাইছে না ও বলল

বাদ দে না এতদুর যাওয়ার দরকার কি?

আরে , সারা জীবন কি খেলি লেখাপড়া করমু নাকি ? পরীক্ষা দিছি একটু বেড়ামু না ?

আশেপাশে কোথাও দেখ , এত দূরে কেন? তোকে আগেই বলে রাখছি কক্সবাজার হলে কিন্তু আমি যাচ্ছি না I

কেন?

আমার স্টুডেন্ট এর পরীক্ষা I তিন দিনের জন্য যেতে পারবো না

এটা কি কও মামু? তুমি না গেলে চলব কেমনে?

মনির আসলে এড়িয়ে যেতে চাইছে কক্সবাজার যেতে হলে মিনিমাম দুই হাজার টাকা দিতে হবে এখন এত টাকা নষ্ট করার কোন মানে হয় না I সেকেন্ড ইয়ারের অনেকগুলো বই কিনতে হবে I

শুনো মামু তোমার ফেল্টু স্টুডেন্ট রে দুইদিন না পড়াইলে কিছু হইবো না

ফেল্টু বলেই মিস করা যাবে না I আর তুই আমাকে মামু বলা বন্ধ করবি?

আরে চেতস্ কেন্? তবে মামু কই , তোর বউরে ঠিকই ভাবি কমু I ওই দেখ আমগো ভাবি আইতাছে

মনির তাকিয়ে দেখল অনিমা আর নীলা হেঁটে আসছে I মনির অসম্ভব বিরক্ত হলো I সেই প্রথম দিন থেকে নীলা ওকে দেখতে পারেনা I দেখলেই রেগে যায় I তারপরেও সবাই এই রাগের মধ্যে অনুরাগ এর সন্ধান বের করল I ক্লাসে টিচার প্রশ্ন করলে কে আগে উত্তর দেবে নিলা না মনির সেটা দেখার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে থাকে I মনের সঠিক উত্তর দিলে নিলা রেগে যায় I বিরক্ত হয়ে মনির ক্লাসে রেসপন্স করা বন্ধ করে দিল I এর কয়েকদিন পর স্যার ক্লাসে ওপেন কোশ্চেন করলেনI মনির ইচ্ছা করেই চুপ করে রইলো I স্যার বললেন

নিলা তুমি ট্রাই করো
নীলা জবাব দিতে পারলো নাI

মনির WHAT ABOUT YOU?

বাধ্য হয়ে মনির কে উত্তর দিতে হল I এটা নিয়েও সবাই গল্প তৈরি করল I সবার ধারণা নীলাকে জিতিয়ে দিতে মনির ইচ্ছা করে চুপ করে থাকে I নীলার প্রতি ওর এতটাই টান I মনিরের দম বন্ধ হয়ে আসে I কিছু বলাও যায় না I বলতে গেলে কথায় কথা বাড়ে I

আসল বোমাটা ফাটলো টুরে যাওয়ার 2 দিন আগে I এক সপ্তাহ পরে রেজাল্ট আউট হবার কথা ছিল কিন্তু এক সপ্তাহ আগে হয়ে গেল I যথারীতি নীলা প্রথম হয়েছে I কিন্তু কি করে যেন মনির সেকেন্ড হয়ে গেল I সেটাও খুব অল্প মার্কসের ডিফারেন্স এ I মনির এর চেয়ে ও বেশি খুশি বোধ হয় হল হাসিব I দৌড়ে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল I

আরে মামুI আমার গুরু, তুমি এই রেজাল্ট করবা আমি জানতাম I কিন্তু নীলা এইরকম মুখ ভার কইরা আছে কেন , ফাস্ট পাওয়ার পরেও?

ফার্স্ট হওয়ার আনন্দের চেয়ে মনে হয় আমার সেকেন্ড হওয়ার দুঃখ বেশি ওর

আরে কি কস I তুই সেকেন্ড হইছোস ওর তো খুশি হওয়ার কথা

না I আমার মত একজন ওর ক্লোজ কম্পিটিটর এটাও নিতে পারছে না

ওI আমার কিন্তু মনে হয় মাইয়াটা তরে লাইক করে

আরে ধুর

কেন , তোর কুচ কুচ হয়না

এসব ফালতু বিষয় নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার I কাজের কথা শোন তুই চেয়ারম্যান স্যার কে কি বলেছিস ?

আমি আবার কি কইলাম

মিথ্যা কথা বলিস না হাসিরI স্যার সেদিন আমাকে ডেকে টুর এর ট্রান্সপোর্টেশন এর দায়িত্ব নিতে বলেছেন I তুই স্যার কে কিছু বলেছিস তাই না?

হাসির দাঁত বের করে হাসল

আমি খালি কইছি মনির ঢাকার বাইরের ও এই সব ভালো জানে I তো ভুল বলছি নাকি?

তুই আমাকে ট্যুরে নেয়ার জন্য এই ফন্দি করেছিস তাই না

আরে মামু একটু না করলে তুমি যাইতা? এখন আমাদের ভাবিরে রাজি করাইতে হবে I সে না গেলে কালচারাল প্রোগ্রাম এর কি হবে ?

কার কথা বলছিস?

আরে মামু আমাগো ভাবির কথা বলতাছিI তুমি গিয়া একটু কওনা তাইলে ঠিকই যাইবো

কি ভাবি ভাবি শুরু করেছিস I

তো কি মামি কমু? যা না , গিয়া একটু ক না ওরে

যা ভাগ এখান থেকেI আমি এসব কিছু করতে পারবোনাI কালচারাল সেক্টর তোর I তুই যেভাবে পারিস ম্যানেজ করI

মুখে এ কথা বললেও মনিরের একটু চিন্তা হলো আসলেই কি অনিমা যাচ্ছে না I মনির তাকিয়ে দেখল দূরে অনিমা নীলা সহ আরো কয়েকজন জটলা বেঁধে গল্প করছেI মনির দলটার দিকে এগিয়ে গেল I মনিরকে আসতে দেখে আশেপাশের মেয়েরা হাসাহাসি শুরু করে দিলI মনির পাত্তা দিল নাI এগিয়ে এসে বলল

কংগ্রাচুলেশনস নীরা

থ্যাংকস

নীলা আর কিছু বলল না I মনিরকে পাল্টা অভিনন্দন ও জানালো না I মনির অবশ্য এরকম কিছু আশা ও করেনি I ও অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল

অনিমা তোমার সঙ্গে কথা ছিল একটু আসবে

অনিমা সহ বাকিরা সবাই বেশ অবাক হলI অনিমা কিছু বলল না মনিরের সঙ্গে হাঁটতে লাগলো

তুমি কি এই ট্যুরে যাচ্ছ না অনিমা?

যাচ্ছি তো I কে বলল যাচ্ছি না? আমি তো শুনলাম তুমি যাচ্ছনা I

মনির বুঝলো হাসিব কাজটা ইচ্ছা করেই করেছে I ফাজিল ছেলে একটা

না আমিও যাচ্ছি I আমাকে ভলান্টিয়ার হিসেবে যেতে হচ্ছেI আসলে হাসিব খুব টেনশনে আছে কালচারাল প্রোগ্রাম নিয়েI

মনির অনিমাকে হাসিবের কাছে নিয়ে গেল তারপর বলল

এইযে কালচারাল প্রোগ্রাম এর চিফ কে নিয়ে এসেছিI যা মিটিং করার কর I আর তোকে তো আমি পরে দেখে নিচ্ছি I গেলাম আমি I

নীলার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে I এই ছেলেটা নিজেকে কি ভাবে? সারাক্ষণ ভাবলেশহীন মুখ করে ঘুরে বেড়ায় I ওর সামনে আসলে আরো নির্লিপ্ত ভাব দেখায় I অনিমার সঙ্গে তো ঠিকই হেসে হেসে গল্প করে I এমন নয় যে নিলা মনিরকে ভালোবাসে কিন্তু ছেলেদের চোখে মুগ্ধতা দেখে ও অভ্যস্তI কেউ তাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে এটাও নিতে পারছে নাI তাছাড়া ছেলেটাকে প্রথমে যত ক্যালাস মনে হয়েছিল অতটা ও নয় I নীলা চায় মনির ওর কাছে এসে নতজানু হোক কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে নাI যদিও সবাই বলছে অনিমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বটা নীলার কাছে পর্যন্ত আসার জন্যই I অনিমা কে জিজ্ঞেস করতে হবে কি এত গল্প করে ওরা I ওর ব্যাপারে কিছু জানতে চায় কিনাI

ট্যুরে যাওয়া নিয়ে অনিমা খুবই এক্সাইটেড ছিল কিন্তু যাওয়ার দিন ই ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল I আজ বৃহস্পতিবার , আজকেই রওনা হবার কথাI সকালে দুইটা ক্লাস করে সবাই বাড়ি ফিরে যাবে এরপর বিকেল পাঁচটায় আবার ডিপার্টমেন্টে আসতে হবে I ঠিক ছয়টায় রওনা হবার কথাI

ক্লাসে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে সুমি জানতে চাইল

কিরে? মনির তোর সাথে এত কি কথা বলে ?

তেমন কিছু না

নীলার ব্যাপারে জানতে চায়?

কখনো কিছু জানতে চাইনিI কেন?

বুঝিস না, নিজে তো আর সরাসরি কিছু বলতে পারেনা তাই তোর সঙ্গে ভাব জমাচ্ছে I

মানে?

মানে নীলা পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে একটা তো সিরি লাগবেই তাই না? চল ক্লাসে যাইI

তুই যা আমি আসছি

অনিমার মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল I ওর ধারণা ছিল মনির ওর বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী I তাহলে কি সবটাই ভুল? শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে মনির ওর সাথে বন্ধুত্ব করেছে? এ পৃথিবীতে কি তাহলে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব বলতে কিছু নেইI অনিমার হঠাৎ নিজেকে খুব একা, খুব নিঃসঙ্গ মনে হলI

মনির মিজান স্যার কে ট্যুরের কিছু লাস্ট মোমেন্ট আপডেট দিয়ে তাড়াহুড়া করে ক্লাসে যাচ্ছিলI দূর থেকে দেখলে অনিমা মন খারাপ করে লাইব্রেরীর সামনে বসে আছেI মনির মনে মনে হাসলোI এই মেয়েটা কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না I কিরকম মুখ ফুলিয়ে মন খারাপ করে বসে আছেI মনির গিয়ে ওর মুখোমুখি বসলো I

কি হয়েছে?

কিছু না I অনিমা চোখ তুলে তাকালো নাI ওর চোখ ভর্তি জল

ক্লাস করবে না?

অনিমা মাথা নাড়লো তারপর উঠে উল্টো দিকে হাঁটা দিলI

অনিমা শোনো

অনিমা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলোI তারপর বলল

তুমি ক্লাসে যাও মনির I শুরু শুরু এখানে সময় নষ্ট করো নাI

অনিমা দাঁড়াওI আমার একটা হেল্প দরকার

কি? নীলার ব্যাপারে কিছু জানতে চাও? এসংক্রান্ত কোন হেল্প?

মনিরের কপালে ভাঁজ পড়লI তবে এবারও পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলোI

চলো কোথাও বসি

কেন?

বললাম না আমার একটা হেল্প লাগবেI সেটাই বলতে চাই

বসতে হবে না , এখানেই বল

ওকে I আমার স্টুডেন্ট এর জন্য একটা গিফট কিনতে হবে I তুমি একটু হেল্প করবে কিনতে ? আমি বুঝতে পারছি না কি কেনা উচিত I

এই হেল্প দরকার তোমার আমার কাছ থেকে?

হ্যাঁ কেন? তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার কাছ থেকে নীলার ইনফরমেশন চাই ? এজন্য তোমার সাথে কথা বলি?

অনিমা কিছু বলল না , মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইল

শোনো , আমি তোমার সাথে কথা বলি কারণ তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে I নীলার ব্যাপারে কিছু জানতে হলে আমি ওকেই জিজ্ঞেস করবো তোমাকে না I এখন কি তুমি একটু আমাকে জিনিসটা কিনতে হেল্প করবে?

অনিমা জবাব দিল নাI ওর মাথায় শুধু একটা কথাই বাজতে লাগল

‘ তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে’
মনির কি তাহলে সত্যিই ওকে পছন্দ করে ?

চলবে…

লেখনীতে : অনিমা হাসান …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here