তোমাকে
পর্ব 24.1
– ভাবি তুমি কাঁদছো কেন ? এখন তো সব ঠিক হয়ে গেছে I তাই না ?
-তুমি বুঝবে না I ও কেন আমার সঙ্গে এমন করল I আমি তো ………. I অনিমার গলা বুজে এলো I ঠিক আছে নাজমা I আমি রাখছি I
– ভাবি একটা কথা বলব ?
– হু
– এখনো কিন্তু দেরি হয়ে যায় নি I
অনিমা জবাব দিল না I অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করছে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না I তবু ও জিজ্ঞেস করল
– আচ্ছা নাজমা, তুমি নীলাকে চেনো ?
– হ্যাঁ চিনি তো
– তুমি কি জানো মুনির ওকে…
অনিমা কথা শেষ করতে পারল না I টের পেল ফোন ভাইব্রেট করছে I তাকিয়ে দেখল হাসিবের কল এসেছে I অনিমা নাজমা থেকে বিদায় নিয়ে কলটা রিসিভ করল
-হ্যালো কে বলছেন ? আমি এই নাম্বার থেকে একটা মিসকল পেয়েছি
– হাসিব আমি অনিমা
– আরে অনিমা, কেমন আছো তুমি ? আমার নাম্বার কোথায় পেলে ? নিশ্চয়ই তোমার ডার্লিং দিয়েছে ?
– তুমি একদম আগের মতই আছো
– মোটেই না I আমি তোমাদের উপর ভীষণ রেগে আছি I তোমরা এইটা একটা কাজ করলা ? আমাকে ছাড়াই বিয়ে করে ফেললা
– আসলে আমাদের সোমবারে আসার কথা ছিল I তাই পরের ফ্রাইডেতে ডেট ফিক্সট হয়েছিল I কিন্তু
আমরা বৃহস্পতিবার রাতেই চলে আসি I আর তাই…….
– তাই তোমার ডার্লিং আর থাকতে পারলো না তাইতো ?
– না না সেরকম কিছুই না I
-তোমরা দুজন না হয়ে যদি অন্য কেউ হত না তাহলে আমি ….I যাক, সে কই ? তোমাকে দিয়ে ফোন করালো যে
– ডিপার্টমেন্টে গেছে I কি যেন ঝামেলা হয়েছে ওখানে
– আচ্ছা শোনো I ও তো আর পার্টি দেবেনা I আমি আজকে তোমাদের দুজনের অনারে পার্টি দিছি I সাতটার সময় তোমরা দুজন চলে এসো আমার বাসায় I
– এসবের কি দরকার
– আরে তোমাদের ফেমাস লাভ স্টোরি সাকসেসফুল হইল সেলিব্রেশন হবে না ?
অনিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
– আমাদের কোনো লাভ স্টোরি নেই I এই বিয়েটা কন্সেকন্টলি হয়ে গেছে
– এসব কি বলছ তুমি ?
– ঠিকই তো বলছি I আমাদের মধ্যে তো কখনো কিছু ছিল না I অন্তত আমার কখনও মনে হয়নি যে মনির আমাকে ভালবাসে I
– তুমি তো ভালোবেসেছিলে I এটাতো ঠিক I
– একদিকের ভালোবাসা কি যায় আসে বলো ?
-ও তোমাকে শেষ পর্যন্ত বলতেই পারে নি তাই না ?
– কি বলবে ? কিছু থাকলে তো বলবে ? আর যখন আমি বলেছি তখন চোরের মত পালিয়ে গেছে
– আরে ধুর I তুমি যে বলছো এইটা তো সে বুঝতেই পারেনি I আমি কত করে বললাম I দেরি করিস না কিন্তু না i সে নিজেকে তোমার দায়িত্ব নেয়ার জন্য তৈরি করছিল
– আমার দায়িত্ব ? ও তো নীলাকে ভালোবাসতো
– এইসব ফাউল ইনফর্মেশন কই পাও ?
– মানে ?
– নীলা কখনো স্ক্রিনে ছিলোই না
-তুমি জানো না হাসিব I মনির আমাকে নিজে বলেছে
– কি বলেছে ? যে ও নীলা কে ভালোবাসে ?
– না সেটা বলেনি
– তাহলে ?
– বলেছে গুড নিউজ আছে
– আর তুমি ধরে নিলে ? শোনো অনিমা তোমাদের মধ্যে কি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল আমি জানিনা I তোমাকে শুধু একটা ইনফর্মেশন দিব I তুমি কি জানো যে তোমার বিয়ের পর ও তিন দিন হসপিটালে ছিল I 12 ঘন্টা ওর জ্ঞান ছিল না I
অনিমার কথা আটকে গেল I এক হাতে মুখ চাপা দিয়ে ও ডুকরে কেঁদে উঠলো
-অনিমা তুমি ঠিক আছো ?
– না I আমি এত বড় ভুল কি করে করলাম
– ভুল শুধরে নেওয়ার সময় এখনো আছে
অনিমা চোখ মুছে বলল
-তুমি আমাকে একটা হেল্প করবে ?
– অবশ্যই
– আমি তোমাকে ফোন করছি
অনিমা ফোন রেখে ঘরে ফিরে এলো তারপর নীল খামটা খুলে ভেতর থেকে চিঠিটা বের করল I
অনিমা
তুমি নিশ্চয় অবাক হচ্ছো, তোমার সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা হয় তারপরও কেন চিঠি লিখছি I আসলে তোমাকে অনেকবার বলতে চেষ্টা করেছি ,পারিনি I আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি I এই পৃথিবীতে সব কিছুর চাইতে বেশি, আমার নিজের চাইতেও বেশি I
আমি জানি তুমি আমার ঐদিনের আচরণে কষ্ট পেয়েছো I তোমার কাছে এই সত্যিটা স্বীকার না করলেই নয় I সেদিন আমার কোনো জরুরি কাজ ছিল না I তোমার কাছ থেকে আমি পালিয়ে এসেছিলাম ভয় এ I সেদিন যখন তুমি গান শেষ করে আমার সামনে এসে দাড়ালে আমার খুব ইচ্ছা করছিলো তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে I সাহস হয়নি I মনে হয়েছিল আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙতে পারবো না I এমনটা করলে তুমি আমাকে ঘৃণা করবে I যেটা সহ্য করার শক্তি আমার নেই তাই পালিয়ে আসতে হল I
অনিমা যদি তুমিও আমাকে ভালোবাসো তাহলে কম্পিটিশনের দিন এই শাড়িটা পড়ো I না হলে এটা আমাদের বন্ধুত্বের উপহার হিসেবে তোমার কাছে রেখে দিও I আমি তোমাকে কোন অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না I আমি সবসময়ই চাই তুমি অনেক অনেক ভালো থাকো I
মুনির
অনিমা অনেকক্ষণ চিঠিটা ওর বুকের মধ্যে চেপে ধরে কাঁদলো I তারপর চোখ মুছে চিঠি আর শাড়িটা ওর আলমারিতে তুলে রেখে মুনির কে ফোন দিল I মুনির ফোনটা ধরল না I অনিমা খুব অবাক হল I এমনটা তো হওয়ার কথা নয় I ওর কোনো বিপদ হয়নি তো ?
পর্ব 24.2
-হ্যালো মনির তুই কি একটু CMH এ আসতে পারবি ? মামার অবস্থা ভালো না রে I এখনই ব্লাড দরকার I তোর তো O পজেটিভ I একটু চলে আয় না দোস্ত I
বলতে বলতে হাসিব কেদে ফেলল I মুনির তখন অনিমাদের বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে I মুনির কে ওর রেজাল্ট উপলক্ষে সব বন্ধুরা মিলে একটা মোবাইল উপহার দিয়েছে I ফোনটা পেয়ে মনির প্রথমে অনিমা কে ফোন করেছে I কিন্তু কাল থেকে অনিমার ফোন বন্ধ I হাসিবকে টেক্সট করেছে I মুনির হাসিবকে না করতে পারলো না রিক্সা ঘুরিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা দিলো I
হাসিবের মামার অবস্থা আসলেই বেশ খারাপ I ওর বাবাও দেশে নেই I ওর মা খুব ভেঙে পড়েছে I হাসিব নিজেও প্রচুর কান্নাকাটি করছে I মুনির পৌঁছানোর পর দেখল একজন ডোনার পাওয়া গেছে I ওকে স্ট্যান্ডবাই রাখা হলো I হাসিবের অবস্থা দেখে মুনির ওকে ফেলে যেতে পারলনা , রাতে হসপিটালে থেকে গেল I পরদিন দুপুরে ব্লাড দিয়ে হলে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল I এরমধ্যে মুনির অন্তত এক হাজার বার অনিমা কে ফোন করেছে কিন্তু আগের মতই অনিমা ফোন বন্ধ I মুনির ঠিক করল ও অনিমার সঙ্গে দেখা করবে I ওকে জানতেই হবে অনিমা ওকে কি বলতে চেয়েছিল I
সন্ধ্যার দিকে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো I বিভিন্ন জায়গায় বৈদ্যুতিক সংযোগ নষ্ট হয়ে সারা শহর অন্ধকারে ডুবে গেল I মুনির এর আর বের হওয়া হলো না I পরদিন শুক্রবার I ও ঠিক করল সকাল সকাল চলে যাবে I
মুনির যখন অনিমাদের বাসায় পৌঁছলো তখন দুপুর হয়ে গেছে I গেটের কাছে ভির দেখে মুনির বেশ অবাক হল I মুনির রেজিস্ট্রি খাতায় নাম লিখতে যাবে তখন দারোয়ান জিজ্ঞেস করল
– আপনি কি বিয়েবাড়িতে যাবেন ?
– কোন বিয়েরবাড়ি ? মুনির অবাক হয়ে জানতে চাইল I
– হাসান সাহেবের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আজকে
– কার ? মনিরের মনে হল ও ভুল শুনছে
– অনিমা আপার বিয়ে আজকে I ওই তো বর চলে আসছে I আপনি একটু সাইড হয়ে দাঁড়ান
মুনির হতভম্ব হয়ে গেল I হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমেছে I মুনির দেখল অনেকগুলো গাড়ি এসে থেমেছে গেটের কাছে I একটা গাড়ি থেকে অসম্ভব সুদর্শন একজন যুবক বেরিয়ে এল I মনে হচ্ছে এই বর I সবাই ছাতা দিয়ে থাকে ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে I
মুনির আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল I বৃষ্টির মধ্যেই পথে নেমে এলো I হঠাৎ করেই ওর বুকের বাঁদিকে প্রচন্ড ব্যথা করতে লাগলো I মুনির ওই অবস্থাতেই হাঁটতে শুরু করল ধীর পায়ে I ওর শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে অনিমা কে না দেখে ও একটা দিন থাকতে পারেনা তাহলে বাকি জীবনটা ও কি করে থাকবে I
অনেক বছর পর আজ মুনির কাঁদলো I বৃষ্টির জলের সঙ্গে ওর চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল I ব্যস্ত দুপুরে, রাস্তায় তখন দারুন ভিড় I ঝড় বৃষ্টি আর ট্র্যাফিক জ্যাম এর শব্দ মুনির এর কান অবধি পৌঁছলো না I ওর কানে তখন অনিমার একটা গান বাজছে কেবল I
মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে
বিদায় সন্ধ্যাবেলা
আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এ পারে
তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা
সেই সে বিদায় ক্ষণে
শপথ করিলে বন্ধু আমার
রাখিবে আমারে মনে
ফিরিয়া আসিবে খেলিবে আবার
সেই পুরাতন খেলা
মনে পড়ে…
মুনির হলে পৌঁছল গভীর রাতে I ঘরের ভেতর হাসিব পায়চারি করছিল I অনিমার খবরটা ও পেয়েছে ওর বাবার কাছ থেকে I ব্যাবসায়িক সূত্রে হাসান সাহেবের সাথে তার পরিচয় আছে I হাসির অনেকবার মুনির কে ফোন করেছে I ও ধরেনি I মুনির যখন রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো হাসিব ওকে দেখে ভয় পেয়ে গেল I মুনির হাসিবের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ ভাবে হাসল তারপর সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরল I
চলবে
লেখনীতে
অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here