তোমাকে
পর্ব 22.1
-একদিন আগেই না বিয়ে করলেন ? একদিনকই এই অবস্থা করে ফেললেন ?
মুনিরের কান গরম হয়ে গেল I মাথা ঝনঝন করতে লাগলো I এই জন্য এই ভদ্রলোককে ও ডাকতে চায়নি I কিন্তু নিরুপায় হয়েই ডাকতে হয়েছে I
অনিমা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর মুনির কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল I মাথা কাজ করছিল না I এখন ও কি করবে ? ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু একা সেটা সম্ভব নয় I কামালকে ও নাজমা দের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে একটা মাইক্রো ভাড়া করে I কামাল ওদের অনেক পুরনো আর বিশ্বস্ত ড্রাইভার I এখন গাড়িটা রাখা আছে কিন্তু এই অবস্থায় ও অনিমা কে নিয়ে ড্রাইভ করে যেতে পারবেনা I আবহাওয়ার যে অবস্থা অ্যাম্বুলেন্স আসতেও অনেকটা সময় লেগে যাবে I তখনই ওর মনে পড়ল পাশের কোয়াটারে মালেক স্যার থাকেন I উনার ছোট ভাই ডাক্তার ,বেড়াতে এসেছে I মুনিরদের 2 ব্যাচ সিনিয়র I কিন্তু এই ভদ্রলোককে মুনিরের একেবারেই পছন্দ না I ভদ্রলোক অতিমাত্রায় রসিক I লাগামহীন রসিকতা করেন I তারপর ও উপায়ান্তর না দেখে ও মালেক স্যার কে ফোন দিল I মালেক স্যার সব শোনার সাথে সাথেই ছোট ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন দারোয়ানকে দিয়ে I
ভেতরে ঢুকেই খালেক ভাই জিজ্ঞেস করলেন
– কি বিষয় ? বিবাহ উত্তর জটিলতা নাকি ? হা হা হা
মুনির মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল I এই জিনিস এখন অনেকক্ষণ সহ্য করতে হবে I ও বলল
– খালেক ভাই একটু দেখেন না I অনেক জ্বর I একটু আগেই মাপলাম 104
খালেক ভিতর ঢুকলো I অনিমার গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা I ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে I খালেক বললো
– আরে ,এইভাবে ঢেকে রাখলে রোগী দেখবো কিভাবে ? তবে বলতেই হবে ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর I
খালেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলল
– কিছু দিয়েছেন ?
– হ্যাঁ একটু আগে জ্ঞান ফিরেছিল তখন প্যারাসিটামল সিরাপ দিয়েছি
– আর কিছু ?
– জলপট্টি দিয়েছি
– তাহলে তো সব করেই ফেলেছেন I আমাকে আর কি দরকার ?
– ভয়ের কিছু নেই তো খালেক ভাই ?
– না , অনেকের জ্বরের প্যাটার্ন টা এরকম হয় I ঠিক হয়ে যাবেI কিন্তু হঠাৎ এরকম হল কেন ? কি এমন করলেন ?
– আসলে বৃষ্টিতে ভিজেছিল অনেকক্ষণ I
– ও , তা গান টান গেয়েছেন নাকি দুজন মিলে বৃষ্টিতে ? তারপর যা হয় আর কি সিনেমায় I
খালেক ভাই চোখ টিপ দিলেন I মুনির জবাব দিলে না I
– শোনেন কোন টিপস লাগলে বইলেন I আমরা আছি কি করতে ? নতুন বিয়ে করেছেন একটু এনজয় করবেন না I হা হা হা
– চলেন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি
খালেক ভাই আরো কিছুক্ষণ অশ্লীল ধরনের রসিকতা করে বিদায় নিলেন I শেষের দিকে মনিরের ইচ্ছা করছিল ভদ্রলোককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে I কিন্তু এমন বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন তাই হাসিমুখে সব হজম করতে হল I
অনিমা যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে I ওর শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে তবে মাথাটা এখনো একটু ভার ভার I অনিমা ফ্রেশ হয়ে একটা আরামদায়ক সুতির জামা পরলো I তারপর বের হলে রান্নাঘরের দিকে গেল I মুনির তখন রান্নাঘরে অনিমার জন্য খাবার তৈরি করছিল I অনিমা ওকে দেখে আর ওদিকে গেল না I গ্লাসে পানি ঢেলে চেয়ার টেনে বসে পরলো I কাল রাতে মুনির কে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে ওর কারনেI অনিমা কখনোই চায়না ওর জন্য কাউকে ঝামেলায় পড়তে হোক I বিশেষত কালকে ও মনিরের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তারপর I এখানে এসে অবধি মুনির ওদের অনেক টেককেয়ার করেছে I ওর মনিরের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত I কিন্তু মুনির তো ওকে চলে যেতে বলেছে তাহলে আর ক্ষমা চাওয়ার কি হল I চলেই যাবে ও I কাল ই ফ্লাইট বুকিং দেবে I যত দ্রুত সম্ভব চলে যাবে I কার উপগ্রহ হয়ে থাকতে চায়না অনিমা I
মুনির বাটি ভর্তি সুপ অনিমার সামনে রেখে বলল
– সবটা খাবে
তারপর চেয়ার টেনে বসে পত্রিকা খুলল I অনিমা লক্ষ্য করলো মুনির খুব গম্ভীর হয়ে আছে I পেপারের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু ঠিক পড়ছেনা I অনিমা কিছু বলল না I সুপের বাটিতে চামচ ঘুরাতে লাগলো I
– তুমি কি আমাকে ভয় পাও অনিমা ?
– ভয় ? তোমাকে? অনিমা বিস্মিত হলে বলল
– তুমি ভয় পেয়ো না I তুমি না চাইলে আমি তোমার কাছে আসবোনা I আমি কথা দিচ্ছি I
অনিমা কিছু বলল না I যেমন চোখ নামিয়ে বসেছিল তেমনি বসে রইল I কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে বলল
– তুমি কাল কাঁদছিলে মুনির ?
– হু
– কেন ?
– তোমার কষ্ট হচ্ছিল I আমি কিছু করতে পারছিলাম না তাই
মুনির লক্ষ্য করলো অনিমার দুই চোখ বেয়ে বড় বড় ফোটায় জল গড়িয়ে পড়ছে I মুনির কিছু বলতে গেলে অনিমা হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল I তারপর বলল
– ছোটবেলা থেকে আমার এরকম ভাবে জ্বর আসে I অনেক টেম্পারেচার উঠে যেত I কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠতো I মিঠু খালা জলপট্টি দিতে দিতে একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো I গভীর রাতে আমার খুব শীত করত I গায়ে কাটা দিত I তারপরে একটু হেসে বলল , আমার জন্য কেউ কখনো কাদেনি I
অনিমার কথাগুলো মনিরের বুকের মধ্যে তীব্রভাবে আঘাত করলো I ও বলল
– এই যে আমি কাঁদলাম I আমি কি তোমার কেউ না অনিমা ?
অনিমার ঠোট কেঁপে গেল, নাকের পাতা ফুলে উঠলো I অনেক কষ্টে কোনমতে ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করল I
মুনির উঠে এসে অনিবার সামনে দাঁড়ালো তারপর কিছুক্ষণ আগে করা প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে অনিমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল
– তুমি কেন এত কষ্ট পাচ্ছো ?
অনিমা দুই হাত দিয়ে মুনির কে আঁকড়ে ধরল I তারপর কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল
– তুমি কি সত্যিই চাও আমি চলে যাই ?
– না , কখনো না I তুমি চাইলেও আমি তোমাকে যেতে দেবোনা I
– কেন ?
– আমি এত কষ্ট করে তোমাকে পেয়েছি I এত সহজে হারাতে পারবো না I আমি তোমাকে অনেক অনেক বেশি………
মুনির কথা শেষ করতে পারল না I তার আগেই ওর ফোন বেজে উঠলো I অনিমা উন্মুখ হয়ে তাকিয়েছিল মনিরের জবাবের অপেক্ষায় I কিন্তু সেটা আর শোনা হলো না I
মুনির ফোন নিয়ে উঠে গেল I হাতের ইশারায় অনিমা কে সুপ খেতে বলল I অনিমা লক্ষ্য করলো মুনির কে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে
– কোন সমস্যা হয়েছে মুনির ?
– হ্যাঁ I ডিপার্টমেন্টে কিছু বহিরাগত ছেলে এসে ঝামেলা করছে I আমাকে একটু যেতে হবে I
– তোমার তো এমনিতেই যাওয়ার কথা ছিল I
– না আমি ছুটি নিয়েছিলাম তোমার শরীর খারাপ বলে
– ও
মুনির চেয়ার টেনে অনিমার কাছে এসে বসল তারপর বলল
– শোনো আমি হাসিনাকে ফোন করে দিচ্ছি ও তাড়াতাড়ি চলে আসবে I তুমি কোন কিছু করবে না I রেস্ট নেবে I কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবে I ঠিক আছে Iবুঝেছ ?
– হ্যাঁ বুঝেছি
– জ্বর আছে ?
– মনে হয় না I
মুনির অনিমার কপালে হাত রাখল I হালকা গরম তবে জ্বর বলা যায় না I মুনির বলল
– একদম পানি ধরবে না I আর গোসল তো করবেই না I
অনিমা হেসে ফেললI বলল
– জি স্যার
মুনির ও হাসল I হঠাৎ করেই দুজনের মধ্যকার মেঘ টা সরে গেল I
পর্ব 22.2
অনিমা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল I ফোনটা এলো চারটার একটু আগেই I মুনির এতটাই এক্সাইটেড ছিল যে অনিমা ভাঙা কণ্ঠস্বর ও লক্ষ্য করল না I
– হ্যালো অনিমা একটা গুড নিউজ আছে
অনিমার বুক কেঁপে উঠলো I তারমানে নীলা হ্যাঁ বলে দিয়েছে ?
– অনিমা শুনতে পাচ্ছ ? আমি বলছিলাম যে ……….
-আমি জানি
মুনির একটু অবাক হল I অনিমা কি করে জানল? পরমুহুর্তেই মনে হোলো কেউ নিশ্চয়ই ফোন করে বলেছে ওকে I
– তুমি জানো ?
– হ্যাঁ I কংগ্রাচুলেশনস I
-অনিমা তুমি না থাকলে এটা কখনোই সম্ভব ছিল না I
– আমি ?
– হ্যাঁ তুমি I তুমি নিজেও জাননা তুমি কি করছ I
অনিমার মনে হল মুনির তাহলে এই কথাটাই ওকে এতদিন ধরে বলতে চাইছিল I ওকে দিয়ে নীলাকে বলতে চাইছিল I কিন্তু তার আগেই সব ঠিক হয়ে গেল I অথচ ও কি ভাবে রেখেছিল I সবাই ঠিকই বলে ও একটা বোকা মেয়ে I অনিমা বলল
-মুনির এতে আমার কোন কন্ট্রিবিউশন নেই I
– হ্যাঁ আছে I তুমি জানোনা I আমি তোমাকে সব বলতে চাই I তুমি একবার আমার সাথে দেখা করো I আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই I
মুনির এখন ওর সঙ্গে ভদ্রতা করতে চাইছে I উপকারের প্রতিদান দিতে চাইছে I কোন উপহার দিতে চাইছে I ওফ I এইসব ও দেখতে হবে ওকে I
– এসবের কোন দরকার নেই I
অনিমার গলা বুজে এলো I প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে I ইচ্ছা করছে ছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে I মুনিরের হঠাৎ একটু খটকা লাগলো I অনিমা এইভাবে কথা বলছ কেন ? কোন সমস্যা হয়েছে কি ? মুনির বলল
– অনিমা তুমি আজকে আমাকে কি বলতে চেয়েছিলে ?
অনিমা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না I বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল I
-অনিমা আমার কথা শোনো I কি হয়েছে আমাকে বল I
মুনির বুঝল অনিমা কাঁদছে I ও আবার ও বলল
– অনিমা প্লিজ আমার কথাটা একটু শোন I আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি I এ কথাটা বলার জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষা করছি I আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ I আমি আর কিছু চাইনা তোমার কাছে I তুমি আমাকে বল কি হয়েছে I
অনিমা চোখ মুছে ফোনটা আবার ধরল I বলল
– মুনির …..
-হ্যাঁ বল
– আমি
– কি হয়েছে বল আমাকে
– আমি ফোনটা রাখছি
– অনিমা শোনো I আমি তোমাকে একটা অ্যাড্রেস টেক্সট করছি I কালকে আমি ওখানে সবাইকে ট্রিট দিচ্ছি I তুমি এস কালকে ওখানে I তোমার সঙ্গে কথা বলার খুব দরকার I
অনিমার আবারও কান্না পাচ্ছে I এখন তাহলে ওরা দুজন এটা সেলিব্রেট করবে I আর অনিমাকে সেখানে গিয়ে …I অনিমা আর ভাবতে পারছে না I এখন কি হবে ? মুনির নীলাকে নিয়ে রিক্সা করে বৃষ্টিতে ভিজবে , জ্বর হলে ওকে ভাত খাইয়ে দেবে ? অনিমা এটা কিছুতেই দেখতে পারবেনা I ওকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে হবে I এত দূরে যেখানে ওর মনিরের কথা মনে ও পড়বে না I
-তুমি ভালো থেকো মুনির I অনেক অনেক ভালো I
অনিমা ফোনটা কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে রাখল I মনিরের বুকটা ধ্বক করে উঠলো I ও ওই ভাবে বলল কেন ? তাহলে কি ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে ?
চলবে……..
লেখনীতে
অনিমা হাসান