- তোমাকে
পর্ব 20.1
অনিমার যখন ঘুম ভাঙলো তখন সবে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে I জানালার ফাক গলে ভোরের নরম আলো ঘরের ভেতর এসে পড়ছে I চারিদিকে আবছা অন্ধকার I অনিমা চোখ খুলে মনে করার চেষ্টা করল ও কোথায় I সহসা কিছু মনে করতে পারলো না I অচেনা ঘর ,অচেনা জানালার পর্দা সব মিলিয়ে কেমন নতুন অনুভূতি I অনিমা মনে করতে পারল না ও এখানে কি করে এসেছে I যতদূর মনে পড়ছে ও বারান্দায় বসে ছিল I মুনির ওকে বিয়ের ছবি দেখাচ্ছিলো I তবে কি ওই ওকে এখানে নিয়ে এসেছে ? এসব কি হচ্ছে ওর সাথে ? অনিমা ভয়ে ভয়ে পাশ ফিরে তাকালো I হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে মুনির I মনে হচ্ছে কেবলই ঘুমিয়েছে I ওকি সত্যিই ঘুমাতে পারে না? কি অদ্ভুত I কেন ? হঠাৎ করে ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে বহু বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল অনিমার I একবার ওকে দেখার জন্য ভোরবেলা ক্যাম্পাসে ছুটে যেত অনিমা I কি সব পাগলামিতে ভরা ছিল সেসব দিনগুলো I একদিন ওকে না দেখলে মনে হতো দম বন্ধ হয়ে আসছে I কি তীব্রভাবে চেয়েছিল ও মুনিরকে অথচ মুনির ওকে কোনদিনও ভালোবাসেনি I অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাট থেকে নেমে গেল I
অনিমার শাশুড়ি মা ওকে একটা লাল পাড় হলুদ শাড়ি দিয়েছেন I বলেছেন আজ সকালে এটা পড়তে , কয়েকজন দেখা করতে আসবে I অনিমা স্নান সেরে ,শাড়ি বদলে ঘর থেকে বের হল I রেহানা বেগম তখন পরোটার জন্য আটা মাখছিলেন I অনিমা কে দেখে হাসলেন I অনিমা কাছে গিয়ে বলল
– আমি কিছু করব ?
– না, সব তো করাই আছে I আমি শুধু পরোটা গুলা বেলবো , নাজমা ভেজে দেবে I তুমি একটু বাচ্চাদের দেখে এসো , কি যে মজা করে ঘুমাচ্ছে I
অনিমা ঘরে ঢুকে হতবাক হয়ে গেল I চারজন খাটে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে I ইফতি আর তনু , সেজুতিকে দুদিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে I ইস্তি জায়গা না পেয়ে ওর পা জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে পরে আছে I অনিমার চোখে জল এসে গেল I ওর মেয়েটার ভাগ্যে এত ভালোবাসা ছিল I ও নিজে কখনো ওকে এসব দিতে পারত না I
– দেখলে ভাবি এক দিনেই কেমন ভাব হয়ে গেছে এদের
অনিমা চোখ মুছে হাসলো
-তোমার মেয়েটা ভারী মিষ্টি I চলো খাবে I ভাইয়ার একটা মিটিং আছে I এখনই বের হবে I
– মুনিরের মিটিং আছে ? বলেনি তো কিছু
– আমাকে এইমাত্র বললো I তোমাকে খুঁজছিল
– আচ্ছা আমি দেখছি
ঘরে ঢুকে অনিমা হেসে ফেলল I মুনির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই এর সাথে যুদ্ধ করছে I
– তুমি টাই বাধতে পারোনা ?
– টাই বাধা আমার কাছে পৃথিবীর কঠিনতম কাজ
– দাও আমি করে দিচ্ছি
মুনির খুব অবাক হয়ে গেল I অনিমা খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে , এত কাছে যে ওর শরীরের উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে I আচ্ছা , অনিমা এভাবে কাকে টাই বেঁধে দিত ?
– তুমি টাই বাধা কার কাছে শিখেছ অনিমা ?
– বাবার কাছে I আমি সবসময় বাবাকে টাই বাধে দিতাম I তবে এভাবে কখনো বাধিনি I সবসময় নিজের গলায় পড়ে বেঁধে দিতাম I তাই এখন একটু সময় লাগছে I
মুনির মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল I তারপর বলল
– থ্যাঙ্ক ইউ অনিমা
– এই সামান্য একটা টাই এর জন্য ?
– না
– তাহলে ?
– ফর এভরিথিং
অনিমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল I কাটা কাটা গলায় বলল
– SHOULD I SAY THANKS TOO ? OR I SHOULD SAY I’M GRATEFUL TO YOU .
মুনিরের হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল I এই মেয়েটা কে ও এত বেশি ভালোবাসে অথচ ও কি সারা জীবন ওকে ভুল বুঝেই যাবে ? মুনির আর কিছু বলল না , ফাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল I
মুনির যখন ফিরল তখন প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে I অনিমা ওর জামা কাপড় গুলো আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিল I সুটকেস এর ভেতর থেকে শঙ্খ আর অনিমার বইটা বের হলো I মুনিরের স্মৃতি বলতে ওর কাছে এই দুটো জিনিসই আছে I এ দুটো ও কখনো নিজের থেকে আলাদা করে না I অনিমা ভেবেছিল মুনিরের সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না I তাই এদুটো সঙ্গে নিয়ে এসেছিল I অনিমা শঙ্খটা যত্ন করে ভেতর রেখে বইটা খুলে দেখছিল I তখনই মুনির ঘরে ঢুকলো I অনিমার হাতে বইটা দেখে চমকে গেল I এটা ও এখানেও নিয়ে এসেছে ? এত স্পেশাল এটা ওর কাছে ? অনিমা প্রথম পাতায় গানের লাইনগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিল I কি প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতো ও মুনিরকে অথচ সেটা ওকে কোনদিন বলতেই পারল না I
– এই বইটা তোমাকে কে দিয়েছে অনিমা ?
অনিমা চমকে উঠল I মুনির কি তবে এই বইটা দেখেছে ? হয়তো ওর বইয়ের আলমারিতে দেখেছো কোনদিন I
– কে দিয়েছে ? মুনির আবারো জানতে চাইলো
– কেউ দেয়নি I এটা আমার বই I আমি কিনেছিলাম I
– আর ওই লেখাটা ?
অনিমা বেশ অবাক হল I মুনির লেখাটা ও পড়েছে ? আশ্চর্য তো
– ওটা আমারই লেখা
– তোমার ? তোমার লেখা ?
– হ্যাঁ I তুমি বোধহয় আমার বাংলা হ্যান্ড রাইটিং দেখনি তাই চিনতে পারোনি I
মুনির হতভম্ব হয়ে গেল I তার মানে কি অনিমা এটা অন্য কাউকে দিতে চেয়েছিল I আরো কি কেউ ছিল ওর জীবনে ? কি সব নাম যেন বলতো হাসির , তাদের মধ্যে কেউ ? মুনির আর ভাবতে পারছে না I দম বন্ধ হয়ে আসছে I সবকিছু ছাপিয়ে যে চিন্তাটা মাথায় আসছে সেটা আরো ভয়ঙ্কর I ইচ্ছা করছে বইটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে I মুনির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল I
-ভাবি আসবো ?
– হ্যাঁ নাজমা এসো
– ভাইয়ার জন্য এই শরবতটা এনেছিলাম
– কোথায় ও ?
– মনে হয় উঠানে
-আচ্ছা আমি দিয়ে আসছি
উঠানে এসে অনিমার মনটা ভাল হয়ে গেল I এত সুন্দর একটা উঠান I গাছ লাগালে খুব সুন্দর লাগতো I মুনির বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল I অনিমা ওর হাতে গ্লাসটা দিয়ে বলল
– তোমাদের এত সুন্দর উঠান I গাছ লাগাওনা কেন ?
– তুমি লাগিও I
– এখানে একটা বাগান বিলাস হলে খুব সুন্দর হতো আর ওই পাশে একটা শিউলি I আচ্ছা , ডিপার্টমেন্টে একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল না ? তোমার মনে হচ্ছে একবার তুমি ………
অনিমা চুপ করে গেল I কথা শেষ করল না I
মুনির একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে I সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস রুম থেকে ওই গাছটা দেখা যায়I মুনির যখনই সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস নেয় ওই গাছটা দেখে আর অনিমাকে মনে করে I কি ভীষণ খুশি হয়েছিল ও সেদিন I ওর সব কিছু মনে আছে ? তাহলে ও কেন নিজেকে এত দূরে সরিয়ে রাখে ?
তোমাকে
পর্ব 20.2
ওরা যখন টিএসসি পৌঁছলো তখনো টিএসসি জমে উঠেনি I একটা আবৃত্তি দল গোল হয়ে বারান্দার কোনায় বসে আছে I বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু ছেলে মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে I মুনির আর অনিমা সামনের করিডোরের কাছে বসলো ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে I অনিমা কিছু বলছে না I মাথা নিচু করে বসে আছে I কাধের ব্যাগটা নামিয়ে পাশে রেখেছে I কোলের উপর এখনো ও বইটা রাখা I মুনির আড়চোখে একবার অনিমাকে দেখল I এই মেয়েটার ব্যাপার-স্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না I তিন দিন ধরে উধাও হয়ে ছিল I এই তিন দিনে মুনির এক ফোঁটা ঘুমাতে পারেনি এক মুহুর্ত স্বস্তি পায়নি I শুধু মনে হয়েছে অনিমা ঠিক আছে কি না I গতকাল একটা ক্লাস টেস্ট ছিল, ভেবেছিলো তখন হয়তো অনিমা আসবে I বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছিলো এই হয়তো অনিমা ঢুকবে I লেখায় এতোটুকু ও মনোযোগ দিতে পারছিল না I শেষে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেছে I স্যার খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
– মুনির তোমার লেখা শেষ হয়ে গেল ?
– স্যার আমার প্রিপারেশন ভালো নেই
একথা বলে মুনির আর দাঁড়ায়নি I সারাদিন উদভ্রান্তের মত ঘুরেছে I ক্লাসের কয়েকটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেও অনিমার ফোন নাম্বার পায়নি I একবার মনে হল নিলার কাছ থেকে নেয়া যায় কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে হল না থাক I হাসিব থাকলে অবশ্য কোন সমস্যা হতো না I কিন্তু ও ঢাকার বাইরে গেছে I ওর কাজিনের বিয়ে I অনিমার বাসা অবশ্য ও চেনে I কিন্তু বাসায় যাওয়াটা বোধ হয় ভালো দেখাবে না I মুনিরের নিজের ও কিছু বলার আছে অনিমাকে I আর দুদিন পর রেজাল্ট দেবে I মুনির ভেবেছিল ঐদিন ওকে শাড়িটা আর চিঠিটা দেবে I কিন্তু অনিমা কি বলতে চায় সেটা আগে শোনা দরকার I
অনিমা মাথা নিচু করে বসে আছে I মুনিরের কেন জানিনা মনে হল মেয়েটার খুব মন খারাপ I কিছু একটা নিয়ে ও খুব অস্থিরতার মধ্যে আছে I মুনির নরম গলায় বলল
– অনিমা তুমি কিছু বলবে বলছিলে
অনিমা ওর গভীর কালো চোখ দুটো তুলে তাকালো I মুনিরের মনে হলো এই চোখের দিকে তাকিয়ে একটা জীবন অনায়াসে পার করে দেয়া যায় I মুনির ঘোরলাগা কন্ঠে বলল
– বল , আমি শুনছি
– আমি, আমি আসলে……
– মুনির ভাই
-সজল তুই ?
– সুমন ভাই ফোন দিসে I বলছে আর্জেন্ট
মুনির একটু বিরক্ত হল I সুমনের সাথে আজ সকালেই কথা হয়েছে I এরমধ্যে এমনকি আর্জেন্ট ইসু থাকতে পারে ? মুনির ফোন দিয়ে উঠে গেল I
– আপা স্লামালিকুম
– ওয়ালাইকুম আসসালাম I কি ব্যাপার সজল ক্লাস করছ না ?
– না আপা I সকালের ক্লাসটা ক্যান্সেল হইছে
– ও আচ্ছা
অনিমা আর কথা বাড়ালো না I দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মুনিরকে লক্ষ করতে লাগলো I মনে হয় কোন সমস্যা হয়েছে I মুনির ভুরু কুঁচকে কথা বলছে I দুমিনিটের মধ্যেই মুনির কথা বলা শেষ করে ফোনটা সজলকে ফিরিয়ে দিল I সজল সালাম দিয়ে চলে গেল I
-কোন সমস্যা মুনির? অনিমা জানতে চাইল
– হ্যাঁ I চেয়ারম্যান স্যার আমাকে দেখা করতে বলেছেন I এখনই I
– ও I তাহলে তো তোমার যাওয়া উচিত I অনিমা বিষন্ন কন্ঠে বলল
– চলো তাহলে ডিপার্টমেন্টে যাই I যেতে যেতে কথা বলি
– না তুমি যাও I আমি বাসায় চলে যাব I আমার আর ক্লাস করতে ইচ্ছা করছে না I
-চলো তোমাকে রিক্সায় তুলে দেই
– না ঠিক আছে I আমি চলে যাব I অনিমা উঠে দাঁড়ালো তারপর পেছন ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করলো
– অনিমা দাঁড়াও
মুনির দৌড়ে গিয়ে ওকে আটকালো
– তোমার বইটা
– ও আচ্ছা I থ্যাংকস
– আমারও তোমাকে কিছু বলার ছিল I আমি কি তোমাকে ফোন করতে পারি ? যদি তোমার ফোন নাম্বারটা দিতে I
অনিমা ফোন নাম্বার দিল I
– আমি চারটার সময় ফোন করবো
– আচ্ছা I আমি অপেক্ষা করবো
– চলো তোমাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে আমি যাই
– আচ্ছা চলো
মুনির অনিমার হাত ধরলো I ওর মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে I অনিমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছা করছে না I অনিমা কিছু বলতে চেয়েছিল I ওকে খুবই বিষন্ন দেখাচ্ছে I অনিমা একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছে I ওর মনে হল ওদের আশপাশে কেউ নেই I সমস্ত চরাচর শূন্য I এই পৃথিবীতে একমাত্র ওরাই দুজন মানব মানবী I অনিমা মনে মনে বলল, মুনির আমার হাতটা কোনদিনও ছেড়ে দিওনা I
চলবে….
লেখনীতে
অনিমা হাসান
কোভিড আক্রান্ত হয়ে পড়ে ছিলাম বেশ ক’দিন I অনেকেই লেখা না পেয়ে হতাশ হয়েছেন I সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থী I আমার নিজস্ব পেইজ থাকলে আপডেট দিতে পারতাম I কি আর করা I আর তিনটা পর্ব আছে I তাড়াতাড়ি দিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ I