তোমাকে

পর্ব 12.1

অনিমা অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নিল I এখনো ওর মাথা ঝিমঝিম করছে I বিকেলের ঘটনাটা মনে হচ্ছে কোন দুঃস্বপ্ন I মুনিরকে বলতে হবে এই বাড়ি ছেড়ে দিতে I ও একটা কমিউনিটির মধ্যে বাস করে I আশেপাশের লোকজন এসব জানতে পারলে নানান কথা হবে I মুনির এখন বিয়ে করতেই পারে I ওর এমন কিছু বয়স হয়নি I তাছাড়া ও সিঙ্গেল I ও চাইলে যে কাউকে বিয়ে করতে পারে I ইউনিভার্সিটি তে অনেক মেয়েই ওর জন্য পাগল, এমনটা শুনেছে অনিমা I এটা সত্যি একটা সময় ওর জন্য তীব্র অনুভূতি ছিল অনিমার মনে, হয়তো এখনো আছে কিন্তু মুনির তো ওকে কখনো ভালোবাসেনি I ও কিছুতেই মুনির এর দয়া নিতে পারবে না I ওকে আজকেই বলতে হবে বাড়ি ছেড়ে দিতে I

অবেলায় দীর্ঘ স্নানের পর অনিমার একটু শীত শীত করতে লাগলো I ঘরোয়া পোশাকের উপর একটা শাল জড়িয়ে নিয়ে ও নিচে নেমে এলো I এক কাপ গরম চা খাওয়া দরকার I

অনিমা নিচে নেমে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো I ডাইনিং টেবিলে মুনির বসে আছে I ওর সামনে দু’কাপ ধূমায়িত চা I

– -এস অনিমা চা খাও

মুনির এমনভাবে ডাকলো যেন এটা ওর ই বাড়ি I অনিমা একজন অতিথি I অনিমা বুঝতে পারছে না মুনির কি করে ভেতরে এল I মেইন দরজা অনিমা বন্ধ করে রেখেছে I তবে কি বেসমেন্ট থেকে উপরে আসার দরজাটা খোলা ? অনিমা একটু জড়োসড়ো হয়ে গেল I ওর পরনে একেবারেই ঘরোয়া পোশাক I ফ্লোরাল লং স্কার্ট তার উপর ফিনফিনে সাদা শার্ট I ভেজা চুলগুলো দুপাশে ছড়ানো I এই পোষাকে ও কখনই কারো সামনে যায়না I অনিমা আচল দিয়ে মাথাটা ভালো করে ঢেকে সালটা গায়ে জড়িয়ে নিল I

-কয়েকটা ব্যাপার ক্লিয়ার হওয়া দরকার I মুনির কথা শুরু করলো

– আমি সামনের সপ্তাহের ফ্লাইট বুকিং দিচ্ছি I আমি চাই আমাদের বিয়েটা বাংলাদেশেই হোক I তুমি তোমার ব্যাংক লোন , অফিসিয়াল ছুটি সব ফাইভ উইক এর জন্য অ্যাপ্রুভ করে নাও I সেঁজুতির আর্ট ক্লাসে বলা হয়ে গেছে I স্কুলে ও কাল বলে দেবে I

অনিমা আকাশ থেকে পড়ল I সেঁজুতি এসব জানে?

-অবশ্যই জানে I ওর সঙ্গে কথা না বলেই আমি তোমাকে বলেছি ভাবছো ? তাছাড়া আমার বাসার সবাই সেজুতিকে সামনাসামনি দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে I সেঁজুতি ও খুব এক্সাইটেড I

অনিমা বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেল I খুব চেষ্টা করে কিছু একটা বলতে যাবে মুনির ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল

-তোমার পাসপোর্ট, তোমার আর সেঁজুতির একটা করে ফটো আইডি আমার লাগবে I সেঁজুতির পাসপোর্ট আমার কাছে আছে I তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে ? বল

অনিমার বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেছে I ও তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল

-আমি কি তোমাকে একবারও বলেছি যে আমি এই বিয়েতে রাজি আছি ?

-না বলোনি তবে বলবে

-এতো কনফিডেন্স? কি ভাবো কি তুমি নিজেকে ?

মনির টের পায় অনিমার রাগ ধীরে ধীরে বাড়ছে I ওর গলা চড়ে যাচ্ছে

-কিছুই ভাবি না I তুমি রাজি হবে কারণ রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না

অনিমা কাটাকাটা গলায় বলল

-তুমি কি প্রমাণ করতে চাও? মনির আহমেদ চৌধুরী একজন পরোপকারী ব্যক্তি ,এটা সবাই জানে নতুন করে প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নেই

-আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না

-তবে কি চাইছো ? অনিমা গলা উঁচিয়ে বলল

-আমি শুধু তোমাদের দুজনকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইছি I ফাইভ উইক পর তোমাদের রিটার্ন টিকেট করা থাকবে I তোমরা ফিরে আসবে I আমি হয়তো এখনই আসতে পারবো না

-তুমি অন্য বাড়ি দেখো মুনির I আমি আর তোমাকে এখানে দেখতে চাই না

মুনির হেসে ফেললো I বললো

-আমরা তো নেক্সট উইক এ চলেই যাচ্ছি I এই সাতদিনের জন্য তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে ? আচ্ছা শোনো পাসপোর্ট, ফটো আইডি ছাড়াও আমার আরো কিছু ডকুমেন্ট লাগবে I আমি তোমাকে জানাচ্ছি I

হঠাৎ করে অনিমার মাথায় রক্ত উঠে যায় I ও উঠে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলে

-তুমি আজ রাতেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে I বুঝেছ ?

মুনির শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো তারপর বললো

-তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাবো না

অনিমা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করে ওঠে

-তোমার এত সাহস হয় কি করে ? তুমি কি ভাবো নিজেকে ? আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? বলতে বলতে অনিমা মনিরের শার্টের কলার খামচে ধরে I

মুনির কিছুই বলল না I নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টাও করল না I শান্ত চোখে অনিমার দিকে তাকিয়ে রইল I তারপর দুই হাতের করতলে ওর মুখটা ধরে ঠোঁটে একটা গভীর চুমু খেলো অনেকক্ষণ ধরে I

অনিমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে I মনে হচ্ছে সময় থমকে গেছে I মুনির ওকে কতক্ষণ ধরে ছিল ও নিজেও জানে না I একসময় ও অনিমাকে ছেড়ে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল

আমি আধা ঘন্টা পরে আসছি ডকুমেন্টগুলো টেবিলের উপর রেখে দিও I

তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল I

পর্ব 12.2

মুনির যখন হলে পৌঁছলো তখন গভীর রাত I ওর সারা শরীর ভেজা, দুই চোখ লাল I রুমে ঢুকে দেখল হাসিব তখনো ঘুমায়নি I

-আরে মামু তুমি কই ছিলা ? প্রোগ্রামের সব কাজ আমার উপর ফালাইয়া তুমি গায়ের I ওইদিকে অনিমা ও নাই I ওর গানের অ্যানাউন্সমেন্টর পরে দেখি সেও লাপাত্তা I

মুনির কোন জবাব দিল না চেয়ারের উপর থেকে টাওয়েল নিয়ে মাথা মুছতে লাগলো I

-এক মিনিট , তোরা দুইজন একলগে ছিলি নাকি ?

-হ্যাঁ

-কি ? তোরা একলগে ছিলি ? কস্ কি ? এইরকম রোমান্টিক ওয়েদারে একলগে কই ছিলা মামা ? সত্যি কইরা কতো চুম্মা টুম্মা খাইছোস নাকি ?

-ওফ হাসিব , কি যাচ্ছেতাই কথা বলিস

-তাইলে তুমি কওনা খুইলা

-অনিমার খুব মাথা ধরে ছিল I আমি ওকে বাসায় পৌঁছে দিই I বৃষ্টি নামল তাই ওদের বাসায় ওয়েট করতে হলো

-এতোক্ষন ওদের বাসায় ছিলি?

-না I বের হয়ে কিছু পাচ্ছিলাম না তাই হেঁটে আসতে হল

-অনিমা তোরে গান শুনাইছে ?

-কি?

-গান শুনাইছে কিনা ?

-হ্যাঁ

-কি গান ?

-রবীন্দ্র সংগীত

-কোনটা ?

-উফ ! এত কথা জানতে চাচ্ছিস কেন ?

-আরে ক না বেটা

‘ -‘এমনও দিনে তারে’

-আরে সাবাস তারপর?

-তারপর কি ?

-তুই কি করলি?

-আমি কি করবো?

-গান শুইনা তুই কি করলি ?

-আমি কি করবো চলে এসেছি

-আরে ধুর ! তুই একটা টিউবলাইট I

-মানে ?

-টিউবলাইট ও না I তুই একটা নষ্ট বাল্ব I এই গান শুইনা কেউ কিছু না বইলা পারে ? হুদাই মাইয়াটারে কষ্ট দিচ্ছস

-আমি ? আমি কষ্ট দিচ্ছি ? অনিমা কে? আমি?

-না তো কি ? তুই বুঝস না মাইয়াটা তোরে চায়

-অনিমা ? আমাকে ?

-হ রে ব্যাটা I ও হইল গানের মানুষ I ও তো তোরে গান দিয়াই প্রপোজ করব নাকি তোর মত 25 পাতার এসাইনমেন্ট লিখব ?

-তুই কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা

-ও I কিছুই বুঝতেছ না ? ঠিক আছে তাহলে আমি তাহের ভাই এর সাথে কথা বইলা নেই যে আপনার লাইন ক্লিয়ার

-এখন এই তাহের ভাই টা আবার কে?

-ফোর্থ ইয়ার এর তাহের ভাই , আমারে ঐদিন জিজ্ঞেস করতেছিল অনিমার কেউ আছে নাকি I না থাকলে একটু সেটিং করে দিতেI আমি বলছি দেখেন বস ওই দিকে চোখ দিয়েন না ওইটা আমার বন্ধুর জিনিস I তা এখন যখন তুই ইন্টারেস্টেড না তাইলে…..

-হাসিব , তোকে আমি খুন করে ফেলবো

-আরে বাহ! তুমি নিজেও কিছু কইবানা অন্য কে ও কিছু করতে দিবা না তাইলে কেমনে হবে?

-কি বলবো ? তুই আমার অবস্থা দেখ I আমার নিজের একটা ঠিকানা নাই I এটলিস্ট একটা অবস্থানে তো আসতে হবে তা না হলে আমি কিভাবে ওর দায়িত্ব নেব?

-আরে! এখনই তোকে ওর দায়িত্ব নিতে কে বলছে ? তুই তোর মনের কথাটা ওরে বল I তুই ওরে চাস না?

-হ্যাঁ চাই, যেকোনো মূল্যে চাই

-এইতো লাইনে আসছো I কবে কবি ওরে?

-যত দ্রুত সম্ভব I হয়তো কালকেই

-গুড I কেমনে কবি কিছু ঠিক করছিস ?

-না I তোর কাছে কোন আইডিয়া থাকলে বল

-আমি কই কি সোজা গিয়া একটা চুমা দিয়া ফালা

-উফ ! হাসিব তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না ?

-আচ্ছা আচ্ছা এর চেয়ে ও একটা ভালো আইডিয়া আছে

-চুপ I অনিমাকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বলবি তো নাক বরাবর ঘুষি খাবি

-আচ্ছা ! এখনই এই অবস্থা I আল্লাহ আমাদের উঠায় নাও I আমাদের আর কোন বেল নাই …

এইভাবে দুই বন্ধুর হাস্যরসে কখন রাত ভোর হয়ে যায় ওরা টেরও পায় না I পরদিন ভোর হতেই মুনির ক্লাসে চলে যায় আর অধীর আগ্রহে অনিমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু অনিমা আসেনা I তারপর দিন না I তারপর দিন ও না I

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here