তুমি_আমারই_রবে
বোনাস_পর্ব
#Nishat_Jahan_Raat

“আমি আপনাকে দেখে নেবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

ভয়ে এক প্রকার আমি সিঁধিয়ে গেছি। ছেলেটা যেভাবে আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো মনে হচ্ছে নেক্সট টাইম আমাকে সামনে পেলেই আস্ত চাবিয়ে খাবে। এতো রাগী আর বদমেজাজি ছেলে জীবনে আমি দ্বিতীয় বার দেখলাম! এই ছেলেটা হিমুর চেয়ে কম না। মনে হচ্ছে হিমুর চেয়ে দুকদম বেশি হবে। মুখে এক আঙ্গুল পুড়ে আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে লামিয়াকে বললাম,,,

“এখন কি হবে রে লামু? ছেলেটার ভুলভাল কথায় যদি আঙ্কেল, আন্টি আমাদের ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেন?”

লামিয়া আমার মাথায় গাড্ডা মেরে বলল,,,

“কি দরকার ছিলো ছেলেটাকে এতো ঘাটানোর? এর ফল কি হলো দেখলি তো? এখন আমাদের ফ্ল্যাট ছাড়া ও করবে। এতো কম দামে আমরা ভালো আর নিরাপদ ফ্ল্যাট কোথাও পাবো?”

“সাবধানে কথা বল লামু। আমি ছেলেটাকে ঘাটাই নি। ছেলেটা যদি প্রথমেই উনার পরিচয় দিতেন তাহলে কথা এতোদূর বাড়ত না। উনি প্রথমেই এসে পরিচয় না দিয়ে ফ্ল্যাটের চাবি চেয়ে নিলেন। আর আমি ও উনার পরিচয় না জেনে ফ্ল্যাটের চাবিটা উনার হাতে তুলে দিবো?”

নীলা দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল,,,

“আচ্ছা তোরা থাম তো। ঐ বদরাগী ছেলের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে লাভ নেই। আমার মনে হয় না, আঙ্কেল আন্টি পুরো ঘটনা না জেনে আমাদের ফ্ল্যাট থেকে বের দিবে।”

এর মাঝেই হুট করে ছেলেটা আবার আমাদের সামনে এসে হাজির হলো। ফ্ল্যাটের চাবিটা উনি ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে একনাগাড়ে ঘুড়াচ্ছেন আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ভয়ে আমি কাঁপতে কাঁপতে লামিয়া আর নীলার মাঝখানে ঢুকে পড়লাম। ছেলেটা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের সবার দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে এখনই ছেলেটা আমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিবেন। লামিয়া আমতা আমতা করে ছেলেটাকে কিছু বলতে নিলেই ছেলেটা হঠাৎ হু হা করে হেসে দিলেন। আমি, লামিয়া আর নীলা বেকুব হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। ছেলেটা হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“ওহ্ মাই গড। হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যাথা হয়ে গেলো। আপনারা মেয়েরা কত্তো ভীতু। একটু কি না কি বলেছি ভয়ে আপনারা সিঁধিয়ে গেছেন। আরে আমি আপনাদের সাথে মজা করছিলাম। আপনাদের ভয় দেখানোর কোনো উদ্দেশ্যই ছিলো না আমার। আর দরজাটা আমি ইচ্ছে করে ভাঙ্গি নি। ভাবতে পারি নি এক লাথে দরজাটা এভাবে ভেঙ্গে পড়বে।”

আমি, লামিয়া আর নীলা স্বস্তির শ্বাস ফেলে একে অপরের দিকে তাকালাম। তিনজনই মলিন হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। লামিয়া আমতা আমতা করে ছেলেটাকে বলল,,,

“আসলে আমরা বুঝতে পারি নি। একা তিনজন মেয়ে এই বাড়িতে থাকি তো। তাই অল্পতেই ভয় পেয়ে যাই। তাছাড়া এই বাড়িটা আমাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ। আপনি যখন এ বাড়ি থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন তখনই আমাদের ভয়টা আরো বেড়ে গেলো।”

আমি আর নীলা লামিয়ার কথায় মাথা নাড়ালাম। ছেলেটা খুব স্বাভাবিক কন্ঠে আমাদের বললেন,,,

“ভয় নেই। আপনারা যতোদিন চান এই বাড়িতে থাকতে পারবেন। কেউ আপনাদের এই বাড়ি থেকে তাড়াবে না।”

আমি বুকে হাত দিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“উফফফ বাঁচালেন আমাদের।”

উনি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“শুনুন। আপনাকে বলছি। প্রতিবাদ করতে শিখুন। যখন দেখবেন কেউ আপনাকে অকারণে মুখের উপর যা তা বলছে, ভয় দেখাচ্ছে আর এসব কারণে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন তখনি তার বিরুদ্ধে আপনি রুখে দাঁড়াবেন। এতো সহজে অপরাধীদের ছেড়ে দিবেন না। এতে হারটা আপনারই হবে। লোকজন আপনাকেই ভীতু ভাববে। তখন আরো বেশি করে তারা আপনাকে ভয় দেখাবে, ইচ্ছে করে কষ্টের পাহাড় আপনার উপর চাঁপিয়ে দিবে।”

আমি চরম আশ্চর্য হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ছেলেটা এতো ভালো জ্ঞান দিতে পারে আমি ভাবতে পারি নি। আমি আসলেই প্রতিবাদ করতে শিখি নি। যদি শিখতাম তাহলে হয়তো আমি এখন সংসার জীবনেই থাকতাম। নিজের অধিকার বুঝে নিতাম। হিমু ইচ্ছে করে আমার উপর কষ্টের পাহাড় চাঁপিয়ে দিতে পারতেন না। আমাকে শহর ছাড়া, পরিবার ছাড়া করতে পারতেন না। ছেলেটা হঠাৎ আমার চোখের সামনে তুড়ি মেরে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“স্যরি ম্যাম। অকারণে আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য। শুধু তাই নয় সকালের কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য।”

আমি মলিন হেসে বললাম,,,

“ইট’স ওকে। একটু আগে কি হয়েছে এতক্ষনে আমি সব ভুলে গেছি৷ আর আমার তরফ থেকে ও আমি দুঃখিত। না বুঝেই আপনাকে অনেক ছোট বড় কথা বলে ফেলেছি। আপনাকে চিনলে হয়তো এতো বড় ভুলটা হতো না। যাই হোক, আমাকে মাফ করবেন।”

“আপনি কেনো ক্ষমা চাইছেন? দোষ তো আমার। আমি যদি প্রথমেই আপনাকে আমার পরিচয় দিয়ে দিতাম তাহলে নিশ্চয়ই এতো কিছু হতো না। অযথা কারো কাছে মাথা নিচু করবেন না। যখন জানবেন ফল্ট টা আপনার না, অন্য কারোর।”

এতটুকু সময়েই ছেলেটাকে খুব আপন লাগছে আমার। খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। উনার কথার একেকটা ভাঁজে কোথাও না কোথাও আমার হেরে অতীতটা প্রদর্শিত হচ্ছে। আমাকে অনেককিছু শিক্ষা দিচ্ছে। ছেলেটা আসলেই খুব ভালো মনের মানুষ, আর খুব মিশুক প্রকৃতির ও। উনার বুঝানোর শক্তি খুব প্রখর। আন্টি উনার ছেলেকে যতোটা বদরাগী হিসেবে বর্ণনা দিয়েছেন ছেলেটা অতোটা বদরাগী নয়। উল্টো ছেলেটা স্বচ্ছ, শান্ত আর সরল মনের মানুষ। গলাটা ঝেড়ে আমি উনাকে বললাম,,

“অনেক তো বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হলো। প্লিজ এবার ভিতরে আসুন।”

“না না। আমাকে এক্ষনি ফ্ল্যাটে যেতে হবে। ফ্রেশ হতে হবে। খুব টায়ার্ড।”

“আঙ্কেল, আন্টি আসে নি?”

“না। উনারা কুমিল্লায় আছেন। একজন রিলেটিভসয়ের বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে।”

কুমিল্লা নামটা শুনে আমার বুকটা ধক করে উঠল। পরিবার, সংসার দুটোর কথাই মনে পড়ে গেলো। বিশেষ করে মা, বাবা আর ছোট বোনটার কথা। চোখে জল নিয়ে আমি সবার সামনে থেকে সরে এসে এক দৌঁড়ে রুমে চলে এলাম। এরপর ওখানে আর কি কি হলো জানি না।

বেডের এক কোনায় বসে আমি চোখের জল ছাড়ছি। দুই বছর পর আজ খুব ঘটা করে কাঁদছি। কান্না যেনো আমার কিছুতেই থামছে না। ফেলে আসা অতীকটাকে দারুনভাবে মিস করছি। হিমুকে মিস না করলে ও মা, বাবা, বোন আর শ্বশুড়, শ্বাশুড়ীকে খুব মিস করছি। জানি না উনারা আমায় একইভাবে মিস করছেন কিনা বা আমার জন্য এভাবে চোখের জল ফেলছেন কিনা। তবে একবার মা, বাবার কন্ঠটা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার। কিন্তু সাহসের অভাবে তাদের সাথে কথা বলা হচ্ছে না। আমি মন থেকে চাই না আমার অতীত আমাকে খুঁজুক। আমার মা, বাবা ও আমাকে কখনো খুঁজে পাক। এমন পাষাণ আর অলক্ষী মেয়ের উনাদের দরকার নেই। ছোট বোন লোপাকে নিয়েই উনারা খুশি থাকুক।

কিছুক্ষন পর লামিয়া আর নীলা এসে আমার দুপাশে বসল। দুজনই আমাকে টাইট করে ঝাপটে ধরল। লামিয়া শান্ত স্বরে আমাকে বলল,,,

“হয়েছ তো রূপা। আর কতো কাঁদবি? এবার একটু থাম না। পরিবারের কথা যেহেতু এতোই মনে পড়ে তাহলে উনাদের সাথে একটু কথা বলে নে না ফোনে।”

আমি হেচকি তুলে কেঁদে বললাম,,,

“মা-বাবা কখনো আমার সাথে কথা বলবেন না লামু। উনাদের অনেক অভিমান জমে আছে আমার উপর৷ এই অভিমানের মেঘ সরাতে হলে আমাকে কুমিল্লায় ফিরতে হবে। আমাকে সামনে পেলেই উনারা সব ভুলে যাবেন। কিন্তু আমি যে আর ঐ শহরটাতে ফিরে যেতে চাই না। ঐ শহরটা বড্ড পাষাণ।”

নীলা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,

“ফিরতে হবে না তোকে ঐ শহরে। তুই আমাদের কাছেই থাকবি৷ শুধু একটাই অনুরোধ৷ প্লিজ এভাবে কাঁদিস না। তোকে এই অবস্থায় দেখতে আমাদের ভালো লাগে না।”

ওদের দুজনকে ছেড়ে আমি চোখের জল গুলো মুছে নাক টেনে টেনে বললাম,,

“ঠিকাছে আমি আর কাঁদব না। সবসময় তোদের সাথে হাসি খুশি থাকব।”

লামিয়া মৃদ্যু হেসে আমার ডানটা চেঁপে ধরে বলল,,,

“রেডি হয়ে নে। আজ আমরা সারাদিন ঘুড়ব। বাইরে খাওয়া দাওয়া করব। একেবারে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরব।”

নীলা ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বলল,,,

“সমস্ত খরচ নিশ্চয়ই তুই দিবি?”

“হ্যাঁ আমিই দিবো। কারণ, বার্থডে তো আমার।”

আমি খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে লামিয়াকে বললাম,,,

“আচ্ছা অসব পড়ে হবে। আগে বল ছেলেটা কি চলে গেছে?”

“হুমম। উনো যাওয়ার পরই তো আমরা তোর কাছে এলাম।”

“দরজাটা যে ভেঙ্গে গেলো এখন কি হবে? আমরা বের হবো কিভাবে? তাও আবার বাড়ির মেইন দরজা। আমাদের এবসেন্সে যদি চুরি, ডাকাতি হয়?”

“ইসসস তা তো ভেবে দেখি নি। কি হবে এবার বল তো? ছেলেটা হয়তো এতক্ষনে উনার ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। উনাদের ফ্ল্যাটে তেমন যাই নি আমরা৷ তাছাড়া আঙ্কেল, আন্টি ও বাড়িতে নেই। হুট করে উনাদের ফ্ল্যাটে গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। হয়তো ছেলেটা অস্বস্তিতে ও পড়ে যাবে।”

“এক কাজ করি। বাড়ির গার্ড থেকে ছেলেটার নাম্বার নিয়ে ছেলেটাকে ফোন করে বলি কিছু একটা করতে। আজকের মধ্যেই দরজাটা ঠিক করতে হবে৷ এতো ইনসিকিউরিটির মধ্যে আমরা রাতে ঘুমুবো কিভাবে?”

নীলা বসা থেকে উঠে বলল,,,

“দাঁড়া৷ আমি বাড়ির গার্ড থেকে ছেলেটার ফোন নাম্বার নিয়ে আসছি।।”

এর মাঝেই সদর দরজার কাছে ছেলেটার গলার আওয়াজ শোনা গেলো। ছেলেটা চেঁচাচ্ছেন আর বলছেন,,,

“হ্যাঁলো। শুনছেন আপনারা?”

আমি, লামিয়া আর নীলা তাড়াহুড়ো করে সদর দরজার কাছে এলাম৷ ছেলেটা আমাদের দেখে মলিন হেসে বললেন,,,

“আপনাদের দরজাটা এক্ষনি ঠিক করে দেওয়া হবে৷ মিস্ত্রী একটু পরেই চলে আসবে।”

আমি মৃদ্যু হেসে উনাকে বললাম,,,

“আমরা এক্ষনি গার্ড থেকে আপনার ফোন নাম্বার নিয়ে আপনাকে কল করতাম। দেখুন কল করার আগেই আপনি চলে এলেন।”

ছেলেটা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,,,

“হয়তো কোথাও মনের টান আছে।”

আমি অস্থির দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকালাম। ছেলেটা একগালে হেসে বললেন,,,

“বাই দ্যা ওয়ে আমি মেহুল। আর আপনি?”

“রূপা।”

“হিমুর রূপা?”

#চলবে💖

(লেখিকার উপর ভরসা রেখে গল্পটা শেষ পর্যন্ত পড়ুন। অনুরোধ রইল।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here