তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_২৩
#nishat_jahan_raat (ছদ্মনাম)

অবাকের পর অবাক হচ্ছি আমি। আমার অগোচড়ে কতো কিছুই না ঘটে গেলো। যা আমার ধারণা শক্তির বাইরে ছিলো। এর মাঝেই মনে হলো আমার আম্মু পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডাকছেন। আশ্চর্য হয়ে আমি পিছনের দিকে তাকাতেই দেখলাম, আম্মু, আব্বু আর লোপা চোখে জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

বসা থেকে উঠে কাঁদতে কাঁদতে আমি দৌঁড়ে আম্মু, আব্বু আর লোপার মুখোমুখি হলাম। আম্মু আমাকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,,

“তোর মনে কি একটু ও দয়া, মায়া নেই রূপা? দীর্ঘ আড়াই বছর কিভাবে পারলি আমাদের ছাড়া থাকতে? আমাদের কথা একটু ও মনে পড়ে নি? একবার কি মনে হয় নি কল দিয়ে জিগ্যেস করি আমার পরিবারের মানুষরা কেমন আছে, ভালো আছে কিনা? সুস্থভাবে বেঁচে আছে কিনা?”

“তোমরা আমাকে মাফ করে দাও আম্মু প্লিজ। জেদে, অভিমানে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পিছু ফিরে তাকানোটাই তখন সবচে বেশি অপমানের আর ঘৃণার মনে হচ্ছিলো। তার মানে এই না যে আমি তোমাদের মনে করি নি। তোমাদের কথা ভাবি নি। বরং প্রতিটা দিনের শুরু থেকে রাতের শেষ অব্দি আমি তোমাদের মনে করেছি, জমিয়ে রাখা স্মৃতি গুলো মনে রেখে রাতের পর রাত কেঁদেছি। তোমাদের ভালো থাকা, সুস্থতা নিয়ে আল্লাহ্ র কাছে দো’আ চেয়েছি। জানি না উপর ওয়ালা আমাদের দো’আ কবুল করেছেন কিনা। তবে আমি মনে প্রাণে চেয়েছি তোমরা ভালো থাকো। সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করো।”

আমাকে ঝাপটে ধরে আব্বু, আম্মু, লোপা সবাই খুব কাঁদছিলো। আব্বু আমার মাথায় আলতো করে চুমো খেয়ে বলল,,,

“এই আড়াই বছর আমাদের অনেক কাঁদিয়েছিস মা। শুধু আমাদের ই না, তোর শ্বশুড়, শ্বাশুড়ি, হিমু সবাইকে কাঁদিয়েছিস, কষ্ট দিয়েছিস। যা হয়েছে সব ভুলে যা মা। আমাদের সাথে বাড়ি ফিরে চল। নতুন করে আবার সব শুরু কর। এবার যা হবে ভালো হবে। সবার কল্যাণে হবে। অভিমানকে আর প্রশয় দিস না মা। হিমুকে অন্তত আর একটা বার সুযোগ দিয়ে দেখ। আশা করছি এবার হিমু নিজের চরিএকে সংশোধন করতে পেরেছে। অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে একজন খাঁটি মানুষ হতে পেরেছে। চরিএকে দাগমুক্ত করতে পেরেছে। তোরা দুজন দুজনের ভাগ্যে ছিলিস বলেই উপর ওয়ালা হিমুকে আবার তোর কাছে ফিরিয়ে এনেছে। না হয় ঐদিনই বাস দুর্ঘটনায় হিমু শেষ হয়ে যেতো। পুরো নিঃশ্বেস হয়ে যেতো। শুধু তোর ভাগ্যের জোরে হিমু বেঁচে গেছে। আবারো স্বামীর অধিকার নিয়ে তোর কাছে ফিরে আসতে পেরেছে। তাই বলছি হিমুকে ক্ষমা করে দে। আর একটা সুযোগ দে।”

আমি হেচকি তুলে কেঁদে আব্বুকে বললাম,,

“আমি উনাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি আব্বু। সার্জারীর কারণ না জেনেই আমি উনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি৷ কেনো জানো? কারণ আমি বুঝতে পেরেছি কোনো করুণ পরিস্থিতি ছাড়া উনি উনার প্রিয় মুখটা বদলান নি। আরে উনি তো আমার স্বামী আব্বু। আমার ইহকাল আমার পরকাল সব। যার জন্য আমি নাকে নাকফুল পড়ি, হাতে চুড়ি পড়ি। সব উনার মঙ্গলের জন্যই তো পড়ি। উনার উপর যতোই অভিমান থাকুক না কেনো সব কিছুর উর্দ্ধে উনি আমার স্বামী। যখন স্বামী নিজের ভুল বুঝে তার স্ত্রীর কাছে ফিরে আসে তা ও আবার এই করুন অবস্থা নিয়ে তখন আমার অন্তত মনে হয় না পৃথিবীর কোনো স্ত্রী তার স্বামীর উপর অভিমান পোষে রাখতে পারবে। অন্তত মায়াবোধ থেকে হলে ও সে তার স্বামীকে ক্ষমা করে দিবে। দীর্ঘ সাত মাস আমি উনার সাথে সংসার করেছি। নিজের স্বামী হিসেবে মেনেছি। দীর্ঘ আড়াই বছর পরে ও আমি উনাকে স্বামী হিসেবেই মানছি। ঐ খারাপ লোকটাকেই আমি স্বামী হিসেবে মানি আব্বু। উনার শারীরিক ব্যাথার তুলনায় আমার মনের ব্যাথাটা খুব বেশি গাঢ় নয়। উল্টে উনার শারীরিক ব্যাথাটা আমার মনের ব্যাথাটাকে দ্বিগুন গাঢ় করে তুলছে। বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত লোকটা আমাকে একটু ও শান্তি দেয় নি৷ কোনো না কোনা ভাবে ঠিক জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে এসেছে। তবু ও বলছি আমি উনাকে ভালোবাসি আব্বু। খুব বেশি ভালোবাসি।”

আব্বু হালকা হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,,

“বেশ! বাঁচালি আমাদের। আমরা তো ভেবেছিলাম, আমাদের এই অভিমানী মেয়ের অভিমান এতো সহজে ভাঙ্গবে না। খুব কাঠ, খড় পোঁড়াতে হবে।”

এর মাঝেই হিমু হন্ত দন্ত হয়ে আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে উনার বুকের মাঝে মিশিয়ে খুব রেগে বললেন,,,

“এতো কিছু বললে শুধু এটাই বললে না তোমার এই খারাপ স্বামীটা ও তোমাকে অনেক ভালোবাসে? পাগলের মতো ভালোবাসে। তুমি ছেড়ে আসার অনেক আগে থেকেই সে তোমাকে ভালোবাসে। শুধু প্রকাশ করার সময়টা পায় নি।”

আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি আর চেঁচিয়ে বলছি,,

“আপনার সাথে আমি এখন কোনো কথা বলতে চাইছি না হিমু। আপনাকে তো আমি পরে বুঝে নিবো। এখন দয়া করে আমাকে ছাড়ুন।”

ছাঁদে উপস্থিত বাকি সবাই লজ্জায় মুখ ঢেকে ছাঁদ থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন। হিমুর এমন হুটহাট টানা হেছড়ায় সবাই খুব লজ্জায় পড়ে গেছেন। তাই হয়তো আমাদের মাঝে থাকতে চাইছেন না। উনি আমাকে না ছেড়ে উল্টে আরো টাইট করে ঝাপটে ধরে বললেন,,

“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি রূপা৷ আগামী ১০০ বছর ও ছাড়ব না। বাই এ্যনি চান্স যদি তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও তাহলে ঠ্যাং খোঁড়া করে আমার কাছেই রেখে দিবো। পা ভাঙ্গা বৌ কে নিয়েই সংসার করব। আমাদের ভালোবাসা ইতিহাস হয়ে থাকবে বুঝলে?”

“হিমু আপনি কিন্তু একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন। আপনার এই অসভ্যতার জন্যই সবাই লজ্জায় ছাঁদ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।”

হিমু বাঁকা হেসে বললেন,,,

“আসলে উনারা বুঝে গেছেন এখন আমাদের প্রাইভেট টাইম। শুধু আমার রূপা ই বুঝল না।”

আমি তড়িঘড়ি করে কিছু বলার আগেই লোপা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,,,

“আসলে আমি তোমাদের পাশেই আছি। দুজন খুব অন্তরঙ্গতায় আছো তো তাই হয়তো আমাকে খেয়াল করো নি। যদি একটু সংযত হতে তাহলে আমি কিছু কথা বলে চলে যেতাম।”

হিমু খানিক লজ্জা পেয়ে তাড়াহুড়ো করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পেতেই আমি যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। লোপার দিকে তাকাতেই দেখলাম লোপা মাথা নিঁচু করে খুব কাতর স্বরে আমার হাত ধরে বলল,,

“আপু জিজুকে ক্ষমা করে দে প্লিজ। পারলে আমাকে ও ক্ষমা করে দিস। আসলে এই সবকিছুর জন্য আমিই শতভাগ দায়ী। আমার নির্বুদ্ধিতার জন্যই আজ তোদের মাঝে এতো কিছু হয়ে গেলো,এতো দূরত্ব চলে এলো, মাঝখানে এতোটা বছর পাড় হয়ে গেলো, কতো ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হলো। তোর বার্থডে সারপ্রাইজ নিয়ে এতোটা না ভাবলে হয়তো তোরা আজ একসাথেই থাকতি আপু। খুব জমিয়ে সংসার করতি। জিজুর ও নিজের চেহারা হারাতে হতো না। এ সবকিছুর জন্য আমি খুব অনুতপ্ত রে আপু। প্লিজ ফরগিভ মি।”

আমি খুব শক্ত কন্ঠে হিমু এবং লোপার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

“তোদের দুটোকে আমি এই জীবনে ও ক্ষমা করব না। দুটোই ক্রিমিনাল। জোড়া বেঁধে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিস।”

আমি এবার লোপার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“তুই না হয় ছোট। ছেলে মানুষী করেছিস। তা বলে কি তোর জিজু ও তোর সাথে তাল মিলাবে? আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করবেন না?”

এর মাঝেই হিমু খুব ক্ষেপে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“এই তুমি না একটু আগে বললে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ? এখন আবার মত পাল্টিয়ে নিলে? সমস্ত দোষ আমাকেই দিচ্ছ?”

ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলটা আমি উনার মুখের কাছে তাক করে বললাম,,

“ওটা লোক দেখানো ছিলো বুঝলেন? ভিতরে ভিতরে আমি আপনাকে এখনো ক্ষমা করতে পারি নি। তাছাড়া সমস্ত দোষ তো আপনারই। আপনার নির্বুদ্ধিতার জন্যই আমাকে ঐ রাতে বাড়ি ছেড়ে আসতে হয়েছিলো।”

উনি আমার আঙ্গুলটা হালকা করে ধরে এক ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,,,

“হিমুর রূপা তো দেখছি হিমুর চেয়ে ও বড় শেয়ানা। যেমন কুকুর তার তেমনি মুগুর। প্রবাদটা আমাদের ক্ষেএে খুব যায়! আমি আমার নির্বুদ্ধিতার জন্য খুব অনুতপ্ত রূপা। শুধু তাই নয় এই অনুতপ্ততাই মূলত আমার চরিএকে দাগমুক্ত করেছে। একজন আর্দশ স্বামী হিসেবে তোমার পাশে থাকতে চাইছে।”

এর মাঝেই হিমুর ফোন বেজে উঠল। হিমু আমার আঙ্গুলটা ছেড়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে খুব গম্ভীরভাবে কলটা পিক করে বললেন,,

“হুম। কোথায় আছো?”

ঐপাশ থেকে কে কি বলল জানি না। মিনিট দু, এক বাদে উনি আবার বললেন,,,

“সোজা বাড়ির ছাঁদে চলে এসো।”

কলটা কেটে দিলেন উনি। আমি খুব কৌতুহলী হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

“কে? কাকে ছাঁদে আসতে বললেন?”

“আছে একজন!”

“কে সে?”

“আসছে। দেখলেই বুঝতে পারবে।”

হিমু ছাঁদের দরজার কাছে অধীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লোপা আমার কাঁধে মাথা রেখে আমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করেই চলছর৷ আমার মনযোগ আপাতত ছাঁদের দরজার দিকে। হিমু কাকে ছাঁদে আসতে বললেন তাই আমার চিন্তার বিষয়। দুই, তিন মিনিট বাদে ছাঁদের দরজায় আমি “আকাশকে” দেখতে পেলাম। সাথে ঐ দিনের মেয়েটা। মেয়েটার কোলে ফুটফুটে একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ও আছে। মেয়েটার বয়স এক থেকে দেড় বছরের হবে। আমি হতবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশকে আমি এই মুহূর্তে একদম এক্সপেক্ট করি নি। ধীর পায়ে হেঁটে আমি আকাশের কাছে এগিয়ে গেলাম। অমনি হিমু আমার হাতটা ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“তো আকাশ বলো, কেনো রূপাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? ফার্স্ট টু লাস্ট এভরিথিং।”

আকাশ অনুতপ্ত ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

“রূপা। আমাকে মাফ করে দিও প্লিজ। আমি ঐ দিন কথা দিয়ে ও কথা রাখতে পারি নি। ঐ দিন রেজিস্ট্রি অফিসে আসার পথে জানতে পারি সাবিলার আম্মু হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। সাবিলা, মানে আমার ওয়াইফ। সাবিলা আমার আপন ফুফাতো বোন হয়। ওরা চট্টগ্রামেই থাকে। ফুফা অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। ফুফু ও হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন। সাবিলার কোনো ভাই, বোন ও ছিলো না। পুরো একা হয়ে গিয়েছিলো সাবিলা। ফুফুর মৃত্যুর দিনই ঠিক হয় সাবিলার সাথে আমার বিয়ে হবে। ফুফুর কুলখানির দিনে। পরিবারের কথা ভেবে সাবিলার কথা ভেবে আমি বাধ্য হয়ে বিয়েটা করি। বিয়ের পর পরই চট্টগ্রামে সাবিলার বাড়িতে চলে আসি। তোমার সাথে যোগাযোগ করার কোনো মুখ ছিলো না আমার রূপা। তাই বিশেষ করে কুমিল্লা ছেড়ে পুরো পরিবারকে নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসা।”

আমার থেকে চোখ সরিয়ে আকাশ ওর ওয়াইফের কাঁধে হাত রেখে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,,,

“রূপা। এ হলো আমার মেয়ে। “টুম্পা।”

আমি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

“তিন মাস আগে তো তোমাদের কোলে এই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখি নি আকাশ। তুমি আর সাবিলা দুজন হুড খোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভিজছিলে!”

“বাবুকে রেখেই আমরা ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম। সাবিলার হাঁটুতে ব্যাথা ছিলো। তাই মূলত ডক্টরের কাছে যাওয়া। তাছাড়া ঐ দিন খুব ঝড়, বৃষ্টি হচ্ছিলো তাই টুম্পাকে সাথে নিয়ে যাই নি।”

আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে আকাশকে বললাম,,

“অন্তত একটা বার তো তোমার ক্রাইসিসের কথাটা আমাকে জানাতে পারতে আকাশ। আমাকে এভাবে দুটো বছর এতোটা কষ্টের মাঝে না রাখলে ও পারতে। আমি কি এতোটাই খারাপ ছিলাম? তোমার ক্রাইসিসের কথা জেনে ও তোমাকেই দোষারোপ করতাম? অন্তত তুমি আমার ভাগ্যে ছিলে না সেটা ভেবেই নিজেকে শান্তনা দিতাম। আর তোমাকে ও হয়তো ক্ষমা করে দিতাম।”

আকাশ আর সাবিলা মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকাতেই আমার চোখে জল চলে এলো। ধীর পায়ে হেঁটে আমি হাত বাড়িয়ে সাবিলার কাছে এগিয়ে এসে সাবিলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

“টুম্পাকে একটু আমার কোলে দিবে সাবিলা?”

সাবিলা চোখে জল নিয়ে হেসে হেসে টুম্পাকে আমার হাতে দিয়ে বলল,,,

“হুম। অবশ্যই নিবে। তুমি তো টুম্পার খালামনি রূপা।”

টুম্পাকে কোলে দিয়ে সাবিলা কাতর স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

“আকাশকে ক্ষমা করে দিও রূপা৷ পারলে আমাকে ও ক্ষমা করে দিও। আসলে আমার জন্য আকাশ তোমাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। শুধু মাএ আমার দুর্ভাগ্যের জন্যই আজ তোমাদের আলাদা হতে হলো। দুটো ভালোবাসার মানুষকে দু দিকে যেতে হলো। নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবেই আমি নিরুপায় হয়ে আকাশকে বিয়ে করেছিলাম। যদি ও জানতাম আকাশ তোমাকে খুব ভালোবাসতো। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, বিয়ের দীর্ঘ দুই বছর পর আকাশ আমার প্রতি দুর্বল হয়। এর আগে টানা দু বছর আকাশ সারাক্ষণ রূপা রূপা করত। খুব কষ্ট হতো তখন। মেয়েটা হওয়ার পর আকাশ একটু বেশি করেই আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। মনে প্রাণে আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়।”

আমি শুধু চোখ তুলে সাবিলা আর আকাশের দিকে তাকালাম। কিছু বললাম না। আমার পাশ থেকে হিমু সাবিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

“আকাশ আর রূপার মাঝে আপনি এসেছেন বলেই আজ আমি রূপাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি সাবিলা। এক্ষেএে আমি আপনার কাছে খুব ঋণি।”

হিমু এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন আকাশ। তুমি ঐ দিন রূপাকে ছেড়ে না গেলে হয়তো রূপার সাথে আমার বিয়েটা হতো না। এতো ভালো মনের একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেতাম না। মন থেকে বলছি, আমি তোমাদের দুজনের কাছেই খুব ঋণি।”

আমার মনযোগ এখন টুম্পার দিকে। আশেপাশে তাকানোর সময় নেই। টুম্পা টোল পড়া গালে এক গাল হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমি ওর কতো দিনের চেনা! প্রায় অনেকবার সে আমাকে দেখেছে। টুম্পার অমায়িক হাসি দেখে অজান্তেই আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। আকাশের প্রতি জমে থাকা রাগটা মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেলো। আমি হেসে হেসে টুম্পার টোল পড়া গালে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছি আর বলছি,,

“তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ আমি আকাশকে ক্ষমা করে দিলাম লিটল প্রিন্সেস। ইউ আর সো কিউট এন্ড সুইট সোনা। উম্মাহ্।”

হালকা হেসে আমি সাবিলার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“সাবিলা। তুমি না খুব ভাগ্যবতী। এতো কিউট আর লক্ষী একটা মেয়ে তোমার গর্ভে জন্ম নিয়েছে। যার মুখের দিকে তাকালে অনায়াসে সব কষ্ট, ভুল বুঝাবুঝি নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। তাই হয়তো বাচ্চা রা এতো নিষ্পাপ আর পবিএ হয়।”

আকাশ হঠাৎ খুব হেসে বলল,,

“আমি জানতাম রূপা। সব সত্যি জানার পর তুমি ঠিক আমাকে ক্ষমা করে দিবে। তোমাকে তো আমি খুব ভালো করে চিনি বলো? শুধু মুখ লজ্জার কারনে তোমার সাথে দেখা করা বা যোগাযোগ করার সাহস টা হয়ে উঠে নি।”

আমি মলিন হেসে আকাশের দিকে তাকালাম। হিমু আমার কাঁধে হাত রেখে আমার মাথায় মাথা ঠেকিয়ে খুব শান্ত স্বরে বললেন,,,

“আমি খুব লাকি রূপা। তোমার মতো ভালো মনের একজন জীবন সঙ্গিনী পেয়ে৷ ক্ষমা করার মতো মহৎ গুনটা তোমার মধ্যে খুব প্রখর রূপা। যা হয়তো সচরাচর সবার মধ্যে থাকে না।”

চোখ তুলে আমি হিমুর দিকে তাকালাম। হিমু মায়া ভরা চোখে টুম্পার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

“আপনি এতো খুশি হচ্ছেন কেনো হিমু? আমি কিন্তু এখনো আপনাকে মন থেকে ক্ষমা করি নি।”

হিমু ফিসফিসিয়ে আমার কানে কানে বললেন,,

“আমি জানি রূপা। তুমি আমাকে মন থেকেই ক্ষমা করে দিয়েছ। শুধু একটু রাগ জমে আছে। এই রাগটা ও আস্তে আস্তে কমে যাবে। হিমু রূপাকে খুব বেশিদিন রাগ করে থাকতে দিবে না। সঠিক সময়ে ঠিক মানিয়ে নিবে। দেখো না সামনে আরো কি কি হয়। হিমু ঠিক রূপার মন জয় করে নিবে।”

আমি উনার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বললাম,,

“আমি জানি হিমু। আপনি খুব সহজে আমার মন জয় করে নিবেন। এই ক্ষমতাটা আপনার মাঝে আছে। বিশ্বাস করুন হিমু। আকাশের বিবাহিত, সুখি জীবন দেখে আমার একটু ও কষ্ট হচ্ছে না। কারণ, আমি এখন একা নই। আমার হিমু আমার পাশে আছে। আমার ছাঁয়া হবে, আমার সুখ, দুঃখের ভাগিদার হয়ে, আজীবন পথ চলার সাথি হয়ে! আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি হিমু। খুব ভালোবাসি।”

এর মাঝেই টুম্পা হঠাৎ কেঁদে উঠল। তাড়াহুড়ো করে আমি টুম্পাকে সাবিলার কোলে তুলে দিলাম। আর সাবিলার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“এতো রাতে টুম্পাকে নিয়ে এখানে আসাটা তোমাদের ঠিক হয় নি সাবিলা। বাচ্চা মেয়ে রাতের আঁধারে মন্দ বাতাস লাগতেই পারে। তোমাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো।”

সাবিলা খুব পেরেশান হয়ে বলল,,

“হিমু ভাইয়া বলল এক্ষনি আর্জেন্ট আসতে হবে। তাই আমরা বাবু সহ তাড়াহুড়ো করে চলে এলাম।”

হিমুর দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকালাম আমি। হিমু পিছনের চুল গুলো টেনে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে কিছুই বুঝেন না। নাক টিপলে দুধ বের হবে। আকাশ আর সাবিলা আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে টুম্পা সোনাকে কোলে নিয়ে চলে গেলো। টুম্পাকে ছাড়তে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। বাচ্চা মেয়ে, এতটুকু সময়ে খুব মায়ায় পড়ে গেছি। তার উপর এতো গলুমলু আর কিউট একটা বাচ্চা৷ টুম্পা পুরো সাবিলার মতো হয়েছে। সাবিলার ও হাসি দিলে গালে টোল পড়ে৷ খুব অমায়িক লাগে।

এসব ভেবে আমি মন খারাপ করে ছাঁদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। লোপা আমাকে ক্রস করে ছাঁদ থেকে নামছে আর হাসতে হাসতে পেছন থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,

“আপু মন খারাপ করিস না। তোর ও টুম্পার মতো একটা ফুটফুটে বাচ্চা হবে। আমার জিজু কিন্তু প্রস্তুত হয়ে আছেন। তোর ইশারা পেলেই উঠে পড়ে লাগবেন।”

হিমু ও লোপার দুষ্টু কথায় সায় দিয়ে আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে লোপাকে উদ্দেশ্য করে চিল্লিয়ে বললেন,,,

“থ্যাংকস লোপা। আমার মনের কথাটা এতো কম শব্দে তোমার বোনকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি কিন্তু সত্যিই প্রস্তুত হয়ে আছি।”

আমি প্রচন্ড রেগে উনাকে খুব জোরে ঝাঁড়ি দিয়ে বললাম,,

“এখনো বৌ এর মন ই জয় করতে পারলেন না আবার বাবা হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত ভাবছেন? ছিঃ হিমু, সেইম অন ইউ।”

“উফফ এতো হাইপার হচ্ছ কেনো? রূপার মন জয় করা তো হিমুর মাএ কয়েকদিনের ব্যাপার।”

“শুনেন। এসব বাজে বকবক ছেড়ে আগে বলুন আকাশে আপনি কিভাবে খুঁজে পেলেন?”

উনি বেশ ভাব নিয়ে বললেন,,

“সিম্পল৷ রূপাকে যেভাবে খুঁজে পেয়েছি সেভাবে!”

“ছবি ছাড়া আকাশের খোঁজ করলেন কিভাবে?”

“লোপা দিয়েছে। মেবি ফেইসবুক একাউন্ট থেকে।”

আমি কিছু বললাম না। হনহনিয়ে ছাঁদ থেকে প্রস্থান নিলাম। হিমু পেছন থেকে জোরে চেঁচিয়ে বললেন,,

“কুমিল্লা যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে যাও রূপা। কিছুদিন বাদেই তো এই হিমুর সাথে তোমার এগেইন মেরেজ।”

“যাবো না আমি, আপনার মতো খারাপ লোকের সাথে কোথাও। আর বিয়ে করা তো দূরে থাক। আমি লামিয়া আর নীলার কাছেই থেকে যাবো।”

#চলবে,,,,

(আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। গল্পের সমাপ্তি ঘনিয়ে এসেছে। হয়তো এিশ পর্বের মাঝেই শেষ হয়ে যাবে। অনেকেই ইনবক্সে বলছেন গল্পটা আমার লিখা #মেঘে_ঢাকা_চাঁদের মতো স্যাড এন্ডিং হবে কি না! তাদের বলছি, গল্পটা হ্যাপি এন্ডিং হবে। গল্পের নামের সাথে স্যাড এন্ডিং একদমই যায় না। সো ডোন্ট ওরি। ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন। ভালোবাসা নিবেন সবাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here